পাতে পরিমিতি I উ ই ন্টা র ডা য়ে ট
কুয়াশার চাদর ছড়ানো শীতের ঋতুতে প্রকৃতি উজাড় করে দেয় দারুণ কিছু মৌসুমি ফল ও শাকসবজি। কিন্তু সব খাবারই কি স্বাস্থ্যের জন্য ভালো?
শীতের সকালে বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করে না। মনে হয় সারা দিন যদি শুয়ে থাকা যেত! আলস্যে বালিশে জড়িয়ে থাকা ঘুম যেন ছাড়তে চায় না। কিন্তু কাজ ফেলে শুয়ে থাকাও সম্ভব নয়। তার ওপর যদি থাকে ক্লান্তিভাব, তাহলে কাজেও মন বসে না আর। তাই এই শীতে চাই বাড়তি সতর্কতা। কেননা গরমকালে যে খাবারগুলো খাওয়া হয়, সেগুলো শীতে খেলে ভালো ফল মিলবে না। ‘উইন্টার ডায়েট’ একটি ভিন্ন বিষয়।
আমাদের দেশে শীতের সময় খাবারের বৈচিত্র্য বেশি দেখা যায়। কেননা এ ঋতুতে যেসব সবজি মেলে, সারা বছরেও সেসবের বেশির ভাগ থাকে না। তাই শীতকালে খাদ্যতালিকায় সবজি রাখা ভালো। শীতের সবজিগুলো পুষ্টিতে ভরপুর। তাতে ভিটামিন এ, আয়রন, ভিটামিন সি ও ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়। এসব সবজি দিয়ে করতে পারেন লো অয়েলের ফ্রাইড রাইস, সবজি খিচুড়ি, পোহা, সবজির চপ, সবজি কাটলেট, বিভিন্ন কারি ইত্যাদি। এ ঋতুতে গাঢ় সবুজ, লালশাকসহ বিভিন্ন শাক পাওয়া যায়। শীতে পালংশাক হতে পারে বেস্ট চয়েস। এতে রয়েছে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, আয়রনসহ ভিটামিন এ এবং ফোলেট। তবে যাদের কিডনিতে সমস্যা রয়েছে, তাদের পালংশাক এড়িয়ে চলা ভালো। কেননা এই শাকে রয়েছে প্রচুর পটাশিয়াম। এ ছাড়া রক্তে ইউরিক অ্যাসিড বেশি কিংবা বাতের সমস্যা থাকলে পালংশাক খাওয়া বন্ধ রাখা ভালো।
উইন্টার ডায়েটে থাকতে হবে পর্যাপ্ত প্রোটিন। রাখা যেতে পারে গরম ভাতের সঙ্গে মাছ ও ফুলকপির পাতলা ঝোল, চিকেন দিয়ে লাল টমেটো ও মটরশুঁটির কারি, চিকেন বা ফিশ চপ ইত্যাদি। অনেক সময় শীতে কোনো খাবার তৈরি করতে ইচ্ছা করে না। তাই অনেকেই চিপস, চানাচুর, কুকি, চকলেট ইত্যাদি খেতে শুরু করেন। সে ক্ষেত্রে এগুলোর পরিবর্তে খাওয়া যেতে পারে কয়েক প্রকার বাদাম, সিডসসহ মিক্সড নাট, ড্রাই ফ্রুট, খেজুর ইত্যাদি। এগুলো হেলদি ও এনার্জেটিক।
শীতে ঠান্ডা অনুভূতির কারণে অনেকেই পানি পান করেন কম। ফলে ডিহাইড্রেশনের আশঙ্কা বাড়ে; পাশাপাশি শরীরে ক্লান্তিভাব ও ঝিমুনি থাকে। এ সমস্যার সমাধানে খাদ্যতালিকায় রাখা যেতে পারে বিভিন্ন প্রকার স্যুপ। যেমন: চিকেন স্যুপ, বেবি কর্ন স্যুপ, ভেজিটেবল স্যুপ, ক্লিয়ার সি ফুড স্যুপ ইত্যাদি। এ ছাড়া রাখা যেতে পারে গরম দুধ বা দুধের তৈরি খাবার। যেমন: দুধে ভেজানো গরম-গরম পিঠা। এটি এনার্জি জুগিয়ে ক্লান্তিভাব কমাবে।
শীতকালে অনেকের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায়। কেউ কেউ শীত সহ্যই করতে পারেন না। ঠান্ডা কাশি ও গলাব্যথা শুরু হয় কারও কারও। আর যাদের এগুলোর পাশাপাশি অ্যাজমা বা হাঁপানির সমস্যা আছে, তাদের কথা তো বলাই বাহুল্য। অনেকের আবার এই সময় অ্যালার্জির সমস্যা দেখা দেয়। এসব রোগবালাই থেকে সুরক্ষিত থাকতে অবশ্যই ইমিউন বুস্ট করে—তালিকায় এমন খাবার রাখলে ভালো। এতে শরীরের ছোট ছোট সমস্যা বড় রূপ নেবে না। আমাদের দেশে অনেকেই ঠান্ডা কাশিকে অবহেলা করেন; বিশেষত বাচ্চা বা বয়স্কদের ক্ষেত্রে। অনেক পরিবারেই ঠান্ডাজনিত রোগে বাড়ির ছোট বাচ্চা, বয়স্ক ব্যক্তিদের ওষুধ এমনকি নিজে নিজেই সেবন শুরু করে, যা পরবর্তীকালে বড় সমস্যা তৈরি করতে পারে। পরিবারের কারও কোনো সমস্যা হলে অবহেলা করা ঠিক নয়। কেননা শীতে বিভিন্ন ধরনের ফ্লু থাকতে পারে, যা সাধারণ ওষুধে সারে না। তা থেকে নিউমোনিয়ার রূপ নিতে পারে, সে ক্ষেত্রে অবশ্যই ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। তবে সবার আগে বাড়িতে যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। কারণ, বয়স্ক ব্যক্তি বা শিশুরা নিজের যত্ন নিজে নিতে পারে না। তাই অবশ্যই একটু গরম কাপড় পরানো; পায়ে মোজা, মাথায় টুপি, গলায় মাফলার জড়ানো ভালো। ঠান্ডা যদি লেগেই যায়, সে ক্ষেত্রে মেনে চলা যেতে পারে কিছু হোম রেমেডি। যেমন: ২ চামচ শর্ষের তেল বাটিতে নিয়ে তাতে তিনটি রসুনের কোয়া যোগ করে ১ থেকে ২ মিনিট চুলায় হিট দিয়ে নিতে হবে। কিছুটা ঠান্ডা কিংবা তাপমাত্রা স্বাভাবিক হলে বুকে, পিঠে, পায়ের তলায় অল্প করে ঘষে দিলে শিশু বেশ আরাম বোধ করবে। যাদের ঠান্ডা কাশির সমস্যা আগে থেকেই আছে কিংবা হঠাৎ আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে পথ্যই একমাত্র সমাধান। সে ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত খাবারগুলো ডায়েটে যোগ করা যেতে পারে:
তুলসীপাতা: প্রতিদিন সকালে কয়েকটি তুলসীপাতা নিয়ে সেগুলোর রস করে এক থেকে দুই চা-চামচ গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রয়োজনে সঙ্গে মধু যোগ করে নিলে খুশখুশে কাশি, এমনকি দীর্ঘদিনের কাশি থাকলে উপশম হবে।
মধু: খালি পেটে সকালে লেবু ও মধুমিশ্রিত পানি একটি সুপার কম্বিনেশন। এক গ্লাস হানি-লেমন ওয়াটার গ্রহণে ইমিউনিটি পাওয়ার বাড়বে। ঠান্ডা-কাশির ঝামেলাও দূর হবে।
আদা: এটি ইমিউনিটি বুস্টার ফুড। একে সবচেয়ে পাওয়ারফুল মেডিসিনাল ইনগ্রেডিয়েন্ট হিসেবে ধরা হয়। সে ক্ষেত্রে প্রতিদিন খাদ্যতালিকায় আদা মিশ্রিত চা, মসলা চা, গ্রিন টি বা ব্ল্যাক কফি রাখা যেতে পারে। ঠান্ডা-কাশিতে আদা-চা বা মসলা চা খেলে এই শীতে বেশি উপকার মিলবে।
জলপাই: শীতে পাওয়া যায় সিজনাল কিছু ফ্রুট। এই যেমন, জলপাই। প্রতিদিন দু-একটি জলপাই খাদ্যতালিকায় রাখা যেতে পারে, যা ভিটামিন সি-এর চাহিদা পূরণের পাশাপাশি শরীরের ইমিউনিটি বাড়াবে। হাইপারটেনশন রোগীদের ক্ষেত্রেও জলপাই খুব ভালো চয়েস। জলপাই উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে।
হলুদ: ঠান্ডা কাশির সমস্যা বেঁধে গেলে প্রতিদিন ১ কাপ লো ফ্যাট মিল্কে একটু হলুদ যোগ করে সেবনে কাশির কষ্ট দূর হতে পারে। এ ছাড়া হলুদ মিশ্রিত দুধ ইনসমনিয়া দূর করে। ফলে রাতে ঘুম ভালো হয়।
পুদিনাপাতা: অনেকেই শীতকালে ভাজা মুড়ি খেতে পছন্দ করেন। এতে কিছুটা রসুনকুচি, পুদিনাপাতা যোগ করে নিন। এটি খেতে যেমন সুস্বাদু, তেমনি খুশখুশে কাশির যন্ত্রণা থেকে মুক্তি মিলবে।
আমাদের দেশে খুব স্বল্প সময়ের জন্যই আসে শীত। এই ঋতুকে উপভোগ করার জন্য হেলদি থাকা চাই। তাই ‘উইন্টার ডায়েট মডিফিকেশন’ করা জরুরি।
নিশাত শারমিন নিশি
চিফ ডায়েটিশিয়ান ও হেড অব ডায়াবেটিস ডিপার্টমেন্ট
পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
ছবি: ইন্টারনেট