পাতে পরিমিতি I নারী স্বাস্থ্য ও পুষ্টি
নারীজীবনে বাড়তি কিছু শারীরিক ও মানসিক সমস্যা থাকে। যেমন ঋতুস্রাব ও গর্ভাবস্থা। তাই ডায়েটও কিছুটা আলাদা। মেনে চললে থাকে সুস্থ জীবনের সম্ভাবনা। পরামর্শ দিচ্ছেন নিশাত শারমিন নিশি
নেপোলিয়নের জগদ্বিখ্যাত উক্তি: ‘আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।’ একজন সুস্থ মা-ই পারেন সুস্থ সন্তান জন্ম দিতে। নারীরা শিশুকাল থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত পার করেন অনেকগুলো ধাপ। প্রতিটি ধাপে থাকতে হয় পর্যাপ্ত পুষ্টি উপাদান। একেক ধাপে একেক রকম পুষ্টিচাহিদা থাকে, যা কমবেশি হলে দেখা দেয় অপুষ্টি। নারী যখন বয়ঃসন্ধিতে পা রাখেন, তখনই তার শরীরে নানা পরিবর্তন আসে। শারীরিক ও মানসিক অবস্থার বদল হওয়ায় সময়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তখন শুরু হয় পিরিয়ড। ঋতুস্রাব চলাকালীন অনেক মেয়ের ক্ষেত্রেই দেখা দেয় বিভিন্ন জটিলতা। এ সময় প্রচুর ব্লিডিং, ক্রাম্পিং, হাত-পা ও জয়েন্ট পেইনসহ বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে খাদ্যতালিকায় রাখা চাই পুষ্টিকর খাদ্য উপাদান। অতিরিক্ত ব্লিডিং হলে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। সে ক্ষেত্রে ডায়েটে রাখা যেতে পারে আনার [বেদানা] ও গাঢ় সবুজ শাক; যেমন কচুশাক, পালংশাক ইত্যাদি। এ সময় যাদের প্রচণ্ড মুড সুইং হয়, মানসিক অবস্থা ভালো রাখতে ডায়েটে যুক্ত করতে পারেন ছোট কলা, বাদাম, ডার্ক চকোলেট। পিরিয়ড চলাকালে ডায়েটে গরম দুধও থাকুক। তাতে অল্প হলুদ মিশিয়ে পান করলে তলপেটের ব্যথা কমে আসে। তা ছাড়া খাদ্যতালিকায় রাখা যেতে পারে মাছ, চিকেন স্যুপ, বিভিন্ন ধরনের ফল এবং প্লেন ওয়াটার। এ সময় কুসুম গরম পানি ও তরল খাবার গ্রহণ করলে অনেকটা আরাম মেলে।
বয়ঃসন্ধি পার হয়ে নারী যখন প্রাপ্তবয়স্ক হন, তার জীবনে দেখা দেয় আরও পরিবর্তন। বিয়ের পিঁড়িতে বসার সময় চলে আসে সামনে। কেউ কেউ লেখাপড়া শেষ করতে পারেন। তখন আসে চাকরির চাপ। প্রাপ্তবয়স্ক হতে হতেই অনেকে আবার ওজন নিয়ে সমস্যায় ভোগেন। আমরা যে খাবার খাই, তা কতটুকু ওজন বাড়াবে বা কমাবে, সেটি নির্ভর করে নিজ নিজ লাইফস্টাইলের ওপর। অনেকেই পরিশ্রমের চেয়ে বেশি খান, আবার কেউ প্রয়োজনীয় পরিমাণে খান না। এতে দেখা যায় ইমব্যালেন্স। কর্মজীবী নারী যারা ডেস্ক জব করেন, তাদের ওজন স্বাভাবিক রাখতে ডায়েটের কিছু পরামর্শ রইল:
অফিসে সকালে ডিউটি থাকায় অনেকেই ব্রেকফাস্ট মিস করেন। ফলে শুরুতেই শরীর ইমব্যালেন্সড হয়ে যায়। তাই ব্রেকফাস্ট স্কিপ না করে সহজে খাওয়া যায় এমন খাবার সিলেক্ট করতে পারেন। যেমন ওটস, দুধ ও ফলের মিশ্রণে তৈরি সহজ ব্রেকফাস্ট। এ ছাড়া খেতে পারেন ব্রেড টোস্ট, সয়ামিল্ক ও ডিম। এগুলোতে মেলে পর্যাপ্ত কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ক্যালসিয়ামসহ বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান।
অনেক অফিসে লাঞ্চ প্রোভাইড করা হয়। কারও কারও অভিযোগ, অফিসের লাঞ্চে ওজন বেড়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কিনোয়া স্যালাড, হাতে বানানো রুটি দিয়ে তৈরি শর্মা, স্টিম ফিশ উইথ অ্যাভোকাডো স্যালাড, লো অয়েলের পাস্তা ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে কারও ওজন কম থাকলে খাবারের পরিমাণ একেবারে না বাড়িয়ে একটু পর পর অল্প অল্প খাবার গ্রহণ করা ভালো।
নারীজীবনের আরেকটি কঠিন স্টেপ হলো মেনোপজ। সাধারণত ৪৫ থেকে ৫৫ বছরকে মেনোপজের সময় ধরা হয়। এটি পিরিয়ড বন্ধের সময়। এ স্টেজে ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন হরমোন নিঃসরণ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে হট ফ্লাশ, মুড চেঞ্জ, অ্যাংজাইটি, স্লিপ ডিস্টার্বেন্সসহ স্মৃতিশক্তি লোপের প্রবণতা দেখা দেয়। মেনোপজের সময় এসব সমস্যা স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নিতে হবে। কিছু খাদ্য উপাদান খাদ্যতালিকায় সংযুক্ত করার মাধ্যমে এসব সমস্যা থেকে অনেকটা দূরে থাকা সম্ভব। উদাহরণ দেওয়া যাক—
হোল গ্রেইন: খাওয়া যেতে পারে লাল আটার রুটি ও লাল চালের ভাত। তাতে মিলবে রিভোফ্লাবিনসহ অন্যান্য বি ভিটামিন, আয়রন, কপার ও ম্যাগনেশিয়াম। এ ছাড়া রয়েছে প্রচুর ফাইবার। মেনোপজের সময় যাদের কনস্টিপেশন দেখা দেয়, তাদের ক্ষেত্রে হোল গ্রেইন খুবই উপকারী। স্নায়ুর রোগ নিরাময়সহ হাত-পা ঝিমানোর সমস্যা দূর করতেও এটি ভালো ভূমিকা রাখে।
ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড: মাছ, বাদাম ইত্যাদিতে থাকে প্রচুর ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড। খাদ্যতালিকায় রাখা যেতে পারে মাছের ঝোল দিয়ে গরম-গরম লাল চালের ভাত, যা মেনোপজ চলাকালে উপাদেয়। মেনোপজের সময় যাদের বালকি ইউটেরাসসহ লো এবডোমিনাল ফ্যাট বেড়ে যায়, তাদের ক্ষেত্রে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড খুবই কাজের।
ভিটামিন ডি: বাংলাদেশে, বিশেষ করে শহরের নারীদের প্রায়শই ভিটামিন ডি কম হতে দেখা যায়। মেনোপজের সময় শরীরে এই ভিটামিন কম থাকাটা অবশ্য স্বাভাবিক। এটি কম থাকলে অস্টিওপোরোসিস, হাড়ের দুর্বলতাসহ শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই ভিটামিন ডি যুক্ত খাবার খাওয়া প্রয়োজন। তাই প্রতিদিন খাদ্যতালিকায় রাখা যেতে পারে ডিম ও মাশরুম।
তবে শুধু খাদ্য গ্রহণ করলেই চলবে না, মানতে হবে কিছু রেসট্রিকশনও। মেনোপজের সমস্যাগুলো প্রতিরোধের জন্য খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে হবে কিছু খাবার। যেমন অতিরিক্ত মসলা, ঝাল ও চর্বি। এ ছাড়া যাদের অ্যালকোহল গ্রহণের বদ-অভ্যাস রয়েছে, তা অবশ্যই বাদ দিতে হবে।
সময় গড়িয়ে যখন বার্ধক্য হাতছানি দেয়, তখন শরীর যেন নেতিয়ে পড়ে। দেখা দেয় বিভিন্ন অসুখ-বিসুখ। এ সময় ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপসহ ঘিরে ধরে নানান রোগ। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীর ও মন—দুটোরই যত্ন প্রয়োজন। কেননা মন ভালো না থাকলে শরীরও ভালো রাখা যায় না। আবার শরীর ভালো না থাকলে মনও খারাপ থাকে। তাই উভয়েরই সঠিক যত্ন চাই। সে ক্ষেত্রে বার্ধক্যজনিত অপুষ্টি যেন না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখুন। বয়স বাড়লে মা-বাবার প্রতি সন্তানদের বেশি যত্নবান হওয়া উচিত। কেননা বাড়তি যত্ন তাদের আরও সুস্থ ও সবল রাখতে পারে। অনেকেরই এ সময় দাঁত পড়ে যায় কিংবা মাড়ি নরম হয়ে যায়। তাই খাবারগুলো সেভাবেই সিলেক্ট করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নরম ও সহজপাচ্য খাদ্য তাদের জন্য বেশ উপযুক্ত। কিছু পরামর্শ রইল:
সকালের নাশতায় কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও ভিটামিন সমৃদ্ধ একটি ব্যালেন্সড খাবার রাখা ভালো। তাই খাদ্যতালিকায় দুধ-সুজি বা দুধ-সাগু রাখতে পারেন। সঙ্গে রাখা যেতে পারে ফ্রুট জুস বা গোটা একটি ফল। তবে ডায়াবেটিস থাকলে মিষ্টি বা মিষ্টিজাতীয় খাবার গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা জরুরি।
উচ্চ রক্তচাপের ভয়ে অনেকেই বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দেন ডিম। ওষুধ গ্রহণের পর রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকলে খাদ্যতালিকায় একটি ডিম রাখা যেতেই পারে। তবে প্রেশার বেশি থাকলে বাড়তি লবণ, ডিমের কুসুমসহ চিংড়ি, খাসি ও গরুর মাংস খাওয়া বন্ধ রাখা দরকার।
যত্নে থাকুন নারী। হোন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী।
লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
ছবি: ইন্টারনেট