যাপনচিত্র I শখের বশে
বিপ্লব সাহা। প্রখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার। ফ্যাশন ব্র্যান্ড বিশ্বরঙ-এর প্রতিষ্ঠাতা। কেমন তার একান্ত জীবন?
একই সঙ্গে সৃজনশীল ও ঝুঁকিপূর্ণ পেশা ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে পথচলা শুরুর সময় সম্পর্কে জানতে চাইলে বিপ্লব সাহা বললেন, ‘হয়তো অদ্ভুত শোনাবে, কিন্তু আমাকে তেমন স্ট্রাগল করতে হয়নি; বরং সব সময় সৃষ্টিকর্তার সহায় পেয়েছি। ১৯৯১-৯২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে পড়তে শুরু করি। ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ শুরু করি ১৯৯৪ সালে। অনেকটা শখের বশেই। এখন যেমন এ ক্ষেত্রে অনেকে আসেন ব্যবসায়িক মনোভাবে তাড়িত হয়ে, আমার বেলায় তেমনটা ঘটেনি। ছাত্রজীবনের আগে থেকেই ইভেন্টের কাজ করতাম। হোম ইন্টেরিয়র থেকে শুরু করে সবকিছু তখন চারুকলার ছেলেমেয়েরাই করত। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর আমার ব্যস্ততা বেড়ে যায়। আমি ছিলাম নারায়ণগঞ্জের ছেলে। ঢাকায় এসে কাজ করতে হতো। সে সময় মোবাইল ফোন না থাকায় অনেকে আমাকে খুঁজে পেতেন না। দরকার ছিল আমাকে খুঁজে পাওয়ার জন্য একটি ঠিকানার। আমার ধারণা, সে সময় মোবাইল ফোন থাকলে আমি হয়তো এতটা সৃষ্টিশীলতা আঁকড়ে থাকতে পারতাম না, আর আমার এ প্রতিষ্ঠানের জন্মই হতো না।’
‘যাহোক, সে সময় খেয়াল করলাম, সারা বছর ইভেন্টের কাজ থাকে না। ফলে সেই দোকানে বিভিন্ন পণ্য, গিফট আইটেম, হাতে তৈরি কার্ড—এসব বিক্রি করতে শুরু করলাম। দুই থেকে চার বছরের মধ্যে খেয়াল করলাম, আমার এসব কাজ, ডিজাইন মানুষ পছন্দ করছে। নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় রাইফেলস ক্লাবের বিপরীতে সান্ত¡না মার্কেটে একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন রুমে আমার শোরুমের যাত্রা শুরু। এর আশপাশে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের আড্ডা বসত। নানা কারণে মার্কেটে আসা অনেকে মনের অজান্তেই আমার শোরুমে ঢুঁ মারতেন। তারাই পরবর্তীকালে হয়ে উঠেছিলেন শোরুমের কাস্টমার। ১৯৯৬ সালের ঈদ আমার প্রতিষ্ঠান কিংবা স্বয়ং আমার জন্য বাঁকবদলের সময়। ঈদকে কেন্দ্র করে সে বছর আমি পাঞ্জাবি, শাড়ি, হ্যান্ড পেইন্ট ইত্যাদি পণ্য তুলেছিলাম। ক্রেতারা সেসব লুফে নিয়েছিলেন। এ ছাড়া বন্ধুরা ঘরে বসে কাজ করা বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর হাতে তৈরি পণ্য আমার দোকানে দিয়ে যেতেন। আমি সেগুলো বিক্রি করে লভ্যাংশ রেখে তাদের টাকা পরিশোধ করতাম। উদ্দেশ্য ছিল, নারায়ণগঞ্জবাসীর জীবনমান ও রুচিবোধে পরিবর্তন আনা।’
দেশখ্যাত এই ফ্যাশন ডিজাইনারের প্রতিদিন সকাল শুরু হয় একইভাবে। ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে পানি পান করেন। এরপর ধর্মীয় ও ভক্তিমূলক গান শোনেন। নিজের প্রতিদিনের সূচি আগে থেকেই ডায়েরিতে লিখে রাখেন। সকালে তাতে চোখ বুলিয়ে ঠিক করেন সারা দিনের কর্মপরিকল্পনা। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রামে প্রয়োজনীয় যোগাযোগ সেরে নেন। পেজ মেইনটেইন করেন বলে বিভিন্ন আপডেট দেওয়ার বিষয় থাকে। এসব করতেই সকাল ৯টা বেজে যায়। সকালে নাশতা করার নির্দিষ্ট সময় নেই তার। অফিস থাকলে কখনো বাসায় খাবার টেবিলে বসেন; কখনো আবার গাড়িতে বসে সারেন দিনের প্রথম আহার। কখনো অলস দিন কাটালে একবারে ব্রাঞ্চ সারেন। তবে সকালে সাধারণত নাট, টমেটো, শসা, রুটি, সবজি—এসব থাকে পাতে। স্বাস্থ্য বিবেচনায় অতিরিক্ত তেলজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলেন। ব্যাকপেইনে আক্রান্ত বলে বিশেষ কিছু ব্যায়াম করতে হয় তাকে। শীতকালে হাঁটেন সময় পেলেই; তবে খুব একটা নিয়মিত নয়। বাসায় থাকলে মধ্যাহ্নভোজ সারেন দুইটা-আড়াইটার মধ্যে। যেকোনো স্বাস্থ্যকর খাবারই সই।
বিপ্লব সাহা স্মৃতি হাতড়ে বেড়ানো মানুষ—তা তার বাসার হোম ইন্টেরিয়র দেখলেই বোঝা যায়। ফার্নিচার পরিকল্পিতভাবে করা নয়; বরং নিজের সবচেয়ে পছন্দের ব্যক্তিত্ব বাবা-মায়ের রেখে যাওয়া স্মৃতিস্মারক; ক্ষেত্রবিশেষে সমসাময়িক আদলে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। বাসার সোফাও তার বাবার আমলের। নিজের বাসাকে ফার্নিচারের দোকান বানানোর পক্ষপাতী তিনি নন! দেয়ালকে অনেক কিছু দিয়ে ঢেকে দিতে চান না। বাসা তার কাছে আরামের জায়গা; অতিরিক্ত জিনিস দিয়ে না ভরিয়ে, খালি জায়গা রাখতে ভালোবাসেন।
ছোটবেলা থেকে ফ্যাশন বা স্টাইলের ক্ষেত্রে আরামকেই প্রাধান্য দিয়েছেন তিনি। নিজেকে তথাকথিত স্টাইলিস্ট ভাবেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ফরমাল প্যান্টের সঙ্গে শার্ট পরতেন। মানুষের জন্য কাজ করতে ভালোবাসেন ফ্যাশন ও স্টাইল নিয়ে; তাই নিজেকে নিয়ে ভাবার খুব একটা সুযোগ মেলে না তার। পাঞ্জাবি পরার ও সংগ্রহ করার নেশা আছে। কাপড়ের ক্ষেত্রে পছন্দের রং সাদা, নীল ও কালো। এড়িয়ে চলেন গ্রে কালার। পছন্দের অ্যাকসেসরিজ ঘড়ি এবং আংটি। পারফিউম ব্যবহার পছন্দ করেন; তবে বেশির ভাগ সময় তা উপহার হিসেবেই পান।
বলে রাখি, প্রখ্যাত এই ফ্যাশন ডিজাইনার আগে কিন্তু একজন পেইন্টার। ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন। ইউরোপে একবার ১ মাস ২৫ দিন অবস্থানকালে পেইন্টিংয়ের প্রতি আগ্রহের জন্য টিকিট কেটে গিয়েছেন বিশ্বখ্যাত বিভিন্ন মিউজিয়ামে। তিনি বলেন, ‘আমার পড়ার বিষয় বলে পেইন্টিংয়ের ডিটেইলিং জানি। সামনে থেকে দেখেছি লিওনার্দো দা ভিঞ্চির মোনালিসা। একই চিত্রশিল্পীর দ্য লাস্ট সাপার আমার সবচেয়ে পছন্দের পেইন্টিং। এ তালিকায় আরও আছে বিভিন্ন মাস্টার পেইন্টারের সৃষ্টিকর্ম। ব্রাইট কালার পছন্দ করি বলে ভ্যান গঘ, ভিঞ্চি আমার বিশেষ পছন্দের। দেশে পছন্দ জয়নুল আবেদিন, রফিকুন নবী, কাইয়ুম চৌধুরী, শিশির ভট্টাচার্য্যরে কাজ। তবে আমি এখন যেসব কাপড়ের ডিজাইন করি, তা পেইন্টার বিপ্লব সাহা থেকেই করি।’
ঘুরে আসা পছন্দের জায়গা কানাডার ক্যালগারি শহর, চীন; তবে সবচেয়ে প্রিয় কাতার। সে দেশে কাটানো ৭-৮টি দিন তার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় সময়। সেখানকার মানুষের জীবনযাপন, নিয়মানুবর্তিতা, স্থাপত্য, সমুদ্রসৈকত, ছবি, মনুষ্যত্ব, দেশপ্রেমের পাশাপাশি দেশটির প্রতি অভিবাসীদের ভালোবাসা তাকে মুগ্ধ করেছে।
আড্ডাবাজি সম্পর্কে বিপ্লব সাহার ভাষ্য, ‘কাজ আমার বন্ধু। কাজ সম্পৃক্ত মানুষের সঙ্গেই আমার বন্ধুত্ব। কাজ শেষে ফিরে আসি বাসায়। পরিবার আমার কাছে সবকিছু।’ স্ত্রী, ছেলে, মেয়েকেই সবচেয়ে কাছের বন্ধু মনে করেন। বিশেষ উৎসবে ভাই-বোনসহ পরিবারের সবাই মিলে আড্ডা দিতে ভালোবাসেন। বললেন, ‘চারুকলা জীবনে বন্ধুদের বাসায় গিয়ে আড্ডা দিতাম। এখন চারুকলার সামনে দিয়ে গেলে আবেগতাড়িত, স্মৃতিকাতর হই। সেখানে দেখি বন্ধুবান্ধব আড্ডা দিচ্ছেন। এমন জীবন আমার ছিল না। প্রতিদিন দেখা করে কফি শপে আড্ডা দেওয়ার মতো বন্ধু আমার খুব একটা নেই।’
আরও বলেন, ‘অবসর সময়ে সবচেয়ে পছন্দ করি গান শুনতে। গান আমার সঙ্গে ছায়ার মতো থাকে। একসময় সিনেমা দেখা হলেও এখন তেমন সময় হয় না। পছন্দের সংগীতশিল্পী সাগর সেন, হৈমন্তী শুকলা, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, লতা মঙ্গেশকর, মান্না দে, রুনা লায়লা প্রমুখ। আমার বাসায় ক্যাসেট প্লেয়ার ছিল না; তাই যাদের তা ছিল, তাদের সঙ্গে গড়ে উঠত বন্ধুত্ব। নারায়ণগঞ্জে থাকাকালে উর্মি ইলেকট্রনিকস, গীতি মালঞ্চ, গীতাঞ্জলী—এসব ক্যাসেটের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে অনেক গান শুনেছি এবং মুখস্থ করেছি। ইচ্ছে ছিল ভবিষ্যতে ক্যাসেটের দোকান দেওয়ার; তবে সেই বাস্তবতা এখন আর নেই।’
একসময় রান্না করতে পছন্দ করলেও এখন ব্যস্ততার জন্য সময় হয়ে ওঠে না তার। রাতে ১২টার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েন। মাঝেমধ্যে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আড্ডা ও আলাপচারিতায় একটু দেরি হয়। জীবনদর্শনে সততা ও মনুষ্যত্ব তার কাছে সবচেয়ে বড়। এ দুটির উপস্থিতি থাকলে জীবন অনেক সহজ ও সুন্দর হয়ে যায় বলে বিশ্বাস করেন।
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: সাজ্জাদ হোসেন