দৃশ্যভাষ্য I নারকীয় নান্দনিকতা
খাড়া পাহাড়ের গা ঘেঁষে বিন্দু বিন্দু মানুষ। কর্মব্যস্ত। ওঠানামারত। যেন আদিম কোনো গুহাচিত্র! অথচ এটি আধুনিক মানবসভ্যতার এক দুর্বিষহ জীবন-ছবি
এ হলো ব্রাজিলের মুক্তাঙ্গন স্বর্ণখনির কর্মপরিবেশকে বৃহৎ মাত্রায় ক্যামেরাবন্দী করা সদ্য প্রয়াত ব্রাজিলিয়ান প্রসিদ্ধ আলোকচিত্রী সেবাসচিয়ো সলগাদোর (১৯৪৪-২০২৫) দুর্দান্ত আলোকচিত্রগুলোর একটি। একে এই ফটো সিরিজের প্রতিনিধিত্বকারী ছবিও বলা চলে। মাটির বিশাল খাদ ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে কাজ করে যাওয়া কয়েক হাজার মানুষের কুঁকড়ে যাওয়া ও পলকা শরীরের এক মিনিয়েচার যেন। ছবিতে ধরা পড়া বেশির ভাগ খনিশ্রমিকই খাড়া পাহাড় বেয়ে ওই খাদের ভেতর-বাহির করছেন। তারা হাতে ধরে রেখেছেন হাতিয়ার; অথবা সরু মই ও খাড়া ঢাল বেয়ে উঠছেন-নামছেন। এই সিরিজের বেশ কিছু শটে ফ্রেমের মধ্যে দিগন্তকে অন্তর্ভুক্ত না কথার পথ বেছে নিয়েছিলেন সলগাদো; ফলে এই শ্রমিকদের বিপজ্জনক অভিযাত্রাটির সমাপ্তি কোথায় গিয়ে ঘটে, সেটির দেখা পাওয়া দর্শকের পক্ষে সম্ভব হয় না।
ব্রাজিলের মিনাস গেরাইস রাজ্যে জন্মগ্রহণকারী এই আলোকচিত্রী দেশটির পারা রাজ্যের গ্রাম সেহা পেলাদায় (আক্ষরিক অর্থে, উন্মুক্ত পর্বতমালা) এ সিরিজের ছবি তোলার জন্য ৩৫ দিন ওই শ্রমিকদের সঙ্গে জীবন কাটিয়েছিলেন। বলে রাখা ভালো, মিনাস গেরাইস দীর্ঘদিন ধরে খনিজ সম্পদ এবং খনি কার্যক্রমের জন্য পরিচিত, যা ব্রাজিলের অর্ধেকের বেশি খনিজ উৎপাদন সরবরাহ করে। ১৬৯৮ সালে সেখানে সোনা ও ১৭২৯ সালে হীরার খনি আবিষ্কৃত হয়। ফলে খনি, খনিশ্রমিক ও খনি শ্রম সম্পর্কে শৈশব থেকে প্রত্যক্ষ ধারণা ছিল সলগাদোর। অন্যদিকে সেহা পেলাদার অবস্থান আমাজন নদীমুখ থেকে ৪৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে; সেখানে ছিল একটি বৃহত্তর স্বর্ণখনি। একেবারেই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে, খালি হাতে, প্রায় এক লাখ শ্রমিক কাজ করেছেন। পরবর্তীকালে নানা বিতর্ক ও প্রতিকূলতার কারণে খনিটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়।
১৯৮৬ সালে তোলা, ‘সেহা পেলাদা গোল্ড মাইন, স্টেট অব পারা, ব্রাজিল’ (সংক্ষেপে, ‘সেহা পেলাদা’) শিরোনামের সিরিজটির বেশ কিছু আলোকচিত্র ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকায় ১৯৮৭ সালে যখন প্রকাশ পায়, তাতে বিশ শতকের শেষ ভাগের স্বর্ণ-আহরণজনিত উন্মাদনা এবং এর ফলে খনিশ্রমিকদের মানবেতর জীবনচিত্র সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনার জন্ম ঘটে। এমন উদ্ঘাটনে একধরনের দায়বোধ অনুভব করে সলগাদো তার আলোকচিত্র-অভিযাত্রা আরও প্রায় চার দশক চালিয়ে গেছেন; ক্যামেরাবন্দী করেছেন কুয়েতের জ্বলন্ত তেলের কূপ, রুয়ান্ডার গণহত্যা এবং আমাজন রেইনফরেস্ট নিধনের বাস্তব চিত্র। হতদরিদ্র ও অধিকারবঞ্চিত মানুষদের দুর্দশাকে দৃশ্যগতভাবে মনোমুগ্ধকর আলোকচিত্রে পরিণত করার জাদু দেখানোয় কোনো কোনো আলোকচিত্র সমালোচক তাকে একজন ‘দুর্দশার নান্দনিকতার কারিগর’ হিসেবে অভিহিত করেন।
ব্রাজিলের স্বর্ণখনির এই ছবিগুলো যখন একটি ফাইন আর্ট কনটেক্সটে প্রদর্শিত হয়, তখন এগুলোর আকার এত বড় করে তোলা হয়, তাতে ডকুমেন্টেশনের কর্মযজ্ঞে মহাপ্রলয়ের হুমকি ছড়ানো চিত্রকল্পের নান্দনিকতা ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য নিজের ৮০তম জন্মদিন ঘিরে ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সলগাদো বলেছেন, ‘আমি তৃতীয় বিশ্বের মানুষ। যেখানে জন্মেছি, সেই ব্রাজিল ছিল একটি উন্নয়নশীল দেশ। এই ছবিগুলো আমি তুলেছি নিজের অবস্থান, নিজের দুনিয়া, নিজের আবির্ভাবস্থলের দৃষ্টিকোণ থেকে।…সমালোচকেরা আমাকে যে তকমাই দিক না কেন, তাতে আমি বিমোহিত নই; বরং এসব চিত্র আমার মনে অপরাধবোধের জন্ম দেয়।’
তার এমন অনুভূতিকে খুঁটিয়ে দেখতে এই আলোকচিত্রের দৃশ্যপট সম্পর্কে আরেকটু বিশদ ধারণা লাভ করা শ্রেয়। সেহা পেলাদায় স্বর্ণখনি আবিষ্কারের গল্পটি রোমাঞ্চকর। ‘রেয়ার হিস্ট্রিক্যাল ফটোস’ ওয়েবসাইট সূত্রে জানা যায়, ১৯৭৯ সালে স্থানীয় এক নদীতে সাঁতার কাটার সময় স্থানীয় এক শিশু নদীতীরে একটি ৬ গ্রাম ওজনের স্বর্ণের দলা পায়। এ খবর সহসাই চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে আর স্বর্ণ আহরণের ধুম পড়ে যায়। গেল শতকের আশির দশকের সেই শুরুর দিকে সেহা পেলাদা অঞ্চলে এক লক্ষাধিক স্বর্ণ অনুসন্ধানীর ব্যস্ততা বেড়ে যায়। আর তা ওই দৃশ্যপটকে শুধু দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ওপেন-এয়ার স্বর্ণখনিই নয়; বরং সবচেয়ে সহিংস অঞ্চলেও পরিণত করে।
শুরুর দিকে ওই প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছানোর উপায় ছিল উড়োজাহাজে চড়া, নয়তো হাঁটা। নিকটবর্তী শহর থেকে একটি নোংরা পথের শেষ মাথায় পৌঁছতে গাড়িচালকদের হরদমই মোটা অঙ্কের টাকা দিতে বাধ্য হতেন খনিশ্রমিকেরা; সেখান থেকে বাকি পথ, প্রায় ১৫ কিলোমিটার হেঁটে পৌঁছতে হতো খনিতে। সেখানে সহসাই বড় বড় স্বর্ণের দলা আবিষ্কৃত হতে শুরু করে; সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়টির ওজন ৬ দশমিক ৮ কিলোগ্রাম, আশির দশকে যার বাজারমূল্য ছিল ১ লাখ ৮ হাজার ডলার (অন্তর্জালসূত্রে জানা যায়, যা বর্তমান বাজারমূল্যে প্রায় ৪ লাখ ২১ হাজার ৩৩৭ ডলার বা ৫ কোটি ১৫ লাখ ২৮ হাজার টাকা)। গোল্ড রাশের সময় যখন তুঙ্গে, খনিটি তখন আতঙ্কজনক পরিস্থিতি ও সহিংসতার জন্য কুখ্যাত হয়ে ওঠে; ওই অঞ্চলে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে খুন ও পতিতাবৃত্তি।
দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে প্রতিষ্ঠিত অলাভজনক সংস্থা ‘পাবলিক ডেলিভারি’র তথ্যসূত্রে জানা যায়, বিপজ্জনক লোকেশনের ‘সেহা পেলাদা’ সিরিজের এই সাদাকালো ছবিগুলো সলগাদো তুলেছিলেন একটু দূরবর্তী এবং একটি উন্নত সুবিধাজনক অবস্থান থেকে। যে লোকেশন ও অ্যাঙ্গেলে এগুলো তোলা হয়েছে, সে কারণে বিষয়বস্তু অর্থাৎ খনিশ্রমিকদের স্রেফ একেকটি বিন্দুর মতো দেখায়। সেহা পেলাদা ছিল সেই সময়কার ব্রাজিলের সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ খনি। সিরিজটিতে সলগাদোর তোলা ওই খনির মোট ২৮টি আলোকচিত্র জায়গা পেয়েছে। খনির ঘটনাবলির সত্যিকারের চিত্র ক্যামেরাবন্দী করার জন্য শ্রমিকদের সঙ্গে একান্তভাবে মিলেমিশে জীবন কাটানোর সময়, প্রতিটি ৩০ থেকে ৬০ কিলোগ্রাম ওজনের ভারী বস্তা বয়ে ওই বিপজ্জনক খাড়া পাহাড় বেয়ে শ্রমিকদের অন্তত ৬০ বার আসা-যাওয়া করতে দেখেছেন তিনি। সবচেয়ে বাজে ব্যাপার হলো, অসুখ, সহিংসতা ও বিপদের ছড়াছড়ির মাঝেই চালিয়ে যাওয়া প্রতিটি ট্রিপের জন্য একেকজন শ্রমিক মাত্র ৬০ সেন্ট (বা বর্তমান হিসেবে প্রায় ৭৩ টাকা) সম্মানী পেতেন।
ছবি তুলতে গিয়ে খনিটি প্রথমবার দেখার স্মৃতিচারণায় সলগাদো বলেছেন, ‘দেখামাত্রই আমার শরীরের সব লোম দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। পিরামিড, মানবসভ্যতার ইতিহাস ভাঁজ খুলে দিয়েছিল। সময়ের গোধূলিলগ্নে ভ্রমণ করেছিলাম আমি।’ ১৯৯২ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেন, ‘সৌভাগ্যের বার্তাবাহী বাতাসের তাড়া খেয়ে সেহা পেলাদার স্বর্ণখনিতে এসেছিলেন লোকগুলো। কাউকে জোর করে আনা হয়নি; তবু একবার পৌঁছানোমাত্রই সবাই পরিণত হয়েছিলেন স্বর্ণ-স্বপ্নের ক্রীতদাসে। নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার যুদ্ধে হয়ে পড়েছিলেন অবতীর্ণ। একবার এর ভেতরে ঢুকে যাওয়ার পর এই চক্র থেকে বেরোনো অসম্ভব হয়ে পড়েছিল তাদের পক্ষে। যখনই শ্রমিকদের কোনো একটি উপদল স্বর্ণের সন্ধান পেত, যারা কাদা-মাটির ওই স্তূপ বয়ে আনতেন, সেই বস্তা থেকে স্বর্ণ পাওয়ার আইনত অধিকার তাদের থাকত। ওই বস্তার ভেতর তারা হয়তো সৌভাগ্য ও স্বাধীনতা খুঁজে পেতেন। ফলে খনির কিনারা বেয়ে, মাটির দলা আর স্বর্ণলাভের আশায় ভরা বিশাল বোঝা নিয়ে বেরিয়ে আসা ছিল তাদের জীবনের এক বিকারগ্রস্ত পরম্পরা। বাইরের কেউ যখন সেখানে প্রথমবার যেতেন, তার চোখে ধরা পড়ত কাদা ও স্বপ্নের ভাস্কর্য হয়ে থাকা ৫০ হাজার মানুষের এক মানবপশুর অসামান্য ও যন্ত্রণাদায়ক চিত্রকল্প। কানে ভেসে আসত শুধুই বিড়বিড় ও নির্বাক চিৎকার; কোনো যন্ত্র নয়, বরং মানবহস্তে চালিত শাবলের ঘর্ষণশব্দ। এ ছিল স্বর্ণের নিজস্ব আওয়াজ, যা স্বর্ণ সংগ্রহকারীদের আত্মার ভেতর প্রতিধ্বনিত হতো।’
ওই খনিতে তোলা ছবিগুলো বস্তুত সলগাদোর একটি বিশাল সিরিজের অংশ, যেটির শিরোনাম ‘ওয়ার্কারস: অ্যান আর্কিওলজি অব দ্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল এইজ ১৯৮৬-৯২’, যেখানে তার তোলা দুনিয়ার আরও ২৬টি প্রান্তের ৪২টি ধরনের কর্মক্ষেত্রের ৩ হাজার ১৩১টি ছবি স্থান পেয়েছে। সিরিজটির ছবিগুলো আলাদা প্রিন্ট করার পাশাপাশি, একই শিরোনামে ১৯৯৭ সালে একটি বইয়েও সংকলিত করেছিলেন তিনি। আর তা দুনিয়ার বিবিধ সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তুলে ইতিবাচক পরিবর্তনের আশাবাদ জারি রেখেছে। বলে রাখা ভালো, সেহা পেলাদা স্বর্ণখনির অস্তিত্ব ছিল ১৯৮০ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত। এটি এখন আর সক্রিয় নয়। পানিতে ভরে গিয়ে একটি অত্যন্ত দূষিত হ্রদে পরিণত হয়েছে।
লাইফস্টাইল ডেস্ক
