skip to Main Content

দেহযতন I অ্যাক্রোবেটিক এক্সারসাইজ

এখনো ফিটনেস জগতে তুলনামূলকভাবে নতুন ধারণা। তবে গ্রহণযোগ্যতা তথা চর্চা বাড়ছে

অ্যাক্রোবেটিক ওয়ার্কআউটের সবচেয়ে জনপ্রিয় রূপগুলোর একটি হলো অ্যাক্রোইয়োগা, যা অ্যাক্রোবেটিকস ও ইয়োগার এক দারুণ সমন্বয়। এটি ২০০৩ সালে ক্যালভিন ক্লেইন কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার জেনি সাওয়ার ক্লেইন ও লেখক জেসন নেমার প্রতিষ্ঠা করেন। এর পর থেকে এই ওয়ার্কআউট বিস্ময়করভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং আমেরিকান লেখক, পরিচালক, অভিনেত্রী ও প্রযোজক লেনা ডানহ্যাম, মার্কিন অভিনেত্রী অ্যাশলে জাড, ব্রাজিলিয়ান ফ্যাশন মডেল গিসেল বুন্ডচেনসহ বহু তারকা ও সাধারণ মানুষ আনন্দের সঙ্গে এতে অংশ নেন।
এসব শুনে অনেকে কৌতূহলী হয়ে ট্রাই করতে আগ্রহী হতেই পারেন। এই দেহচর্চার শারীরিক উপকারিতার তালিকা বেশ দীর্ঘ; তবে চর্চা শুরুর আগে কিছু বিষয়ে যথাযোগ্য জ্ঞান থাকা চাই।
মার্কিন বহুমুখী উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারী, ফিটনেস কোচ, বক্তা ও মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অ্যালেক্স ডোনোলো বলেন, ‘অ্যাক্রোইয়োগা গোটা শরীরেই প্রভাব ফেলে। এর চর্চা দুজন মিলে করতে হয়। সঙ্গীর শরীরকে হাওয়ায় তুলে ধরে রাখতে হয় বলে এতে বাইসেপ কার্লের চেয়ে অনেক বেশি পেশিশক্তি ও সমন্বয় প্রয়োজন। এর প্রতিটি কৌশল নিজ নিজ উপায়ে পুরো শরীরকে ব্যায়ামে নিয়োজিত করে; ফলে এতে একক পেশি ব্যবহারের চল নেই।’
ডোনালো আরও জানান, এই দেহচর্চায় পা, বাহু, কোর থেকে শুরু করে শরীরের প্রায় সবকিছুকে নিয়োজিত এবং একসঙ্গে কাজ করানো চাই। এসব কাজ ঘটাতে দেহের সকল মাংসপেশির সমন্বিতভাবে কাজ করা জরুরি। অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বলেন, ‘আমি এর চর্চা করতে গিয়ে দেখেছি, একজন ব্যক্তির পক্ষে প্ল্যাঙ্ক অবস্থায় থাকা সত্যিই কঠিন। এতে কোর, কাঁধ ও বাহু শুধু সক্রিয়ই থাকে না; এর বাইরে সব পেশি আপনাআপনি অতিরিক্ত গতিতে কাজ শুরু করে দেয়—যেন আমি নিচে থাকা সঙ্গীর ওপর পড়ে না যাই।’
সঙ্গীর শরীরের ওপর পড়ার কথা ভেবে অনেকে ইতস্তত বা দুশ্চিন্তা করলেও সঠিকভাবে এই দেহচর্চা করা গেলে এমন দুর্ঘটনা ঘটার ঝুঁকি কম। নিউইয়র্ক সিটির সার্কাস ওয়্যারহাউসে পেশাদার সার্কাস আর্টিস্টদের জন্য পরিচালিত প্রোগ্রামের পরিচালক সুজি উইনসন বলেন, ‘অ্যাক্রোইয়োগা চর্চার সময় বেশির ভাগ মানুষ মাটিতে পা ফেলতে ভয় পান; তবে মনে রাখা চাই, প্রশিক্ষকেরা কিন্তু ভীষণ অভিজ্ঞ ও বিনয়ী। প্রশিক্ষণরতদের ধাপে ধাপে উৎসাহ দিয়ে তারা এগিয়ে নিয়ে যান। তাই ভয় নেই! মেঝের ওপর একটা ক্র্যাশ ম্যাটও থাকে!’
‘অনুশীলনের প্রথম দিকে পড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। সেটি মেনে নিলেই বরং এই ব্যায়ামের সঙ্গেও বন্ধুত্ব করা সহজ হয়ে ওঠে,’ বলেন ডোনোলো। তার মতে, এটি প্রোপ্রিওসেপশন বা দেহের সচেতনতা বৃদ্ধিতেও সাহায্য করে। তিনি বলেন, ‘কীভাবে এই পেশিগুলোকে একত্রে সমন্বয় করে কাঙ্ক্ষিত প্রভাব ফেলা যায়, এই ভাবনা থেকেই প্রোপ্রিওসেপশনে দক্ষতা বাড়ে।’
সম্পর্ক উন্নয়ন ও সুরক্ষায়
মার্কিন লেখক ও লাইফস্টাইল উদ্যোক্তা লুইস হাউসের মতে, সঙ্গীর সঙ্গে একত্রে চর্চা করা হয় বলে অ্যাক্রোবেটিক স্টান্ট মানুষের মধ্যকার সম্পর্ক আরও নিবিড় করে তোলে। তিনি বলেন, ‘অ্যাক্রোইয়োগা আদতে কাপল থেরাপির চেয়ে অনেক ভালো। এই দেহচর্চার জটিল অংশগুলো যদি সাফল্যের সঙ্গে সামলাতে পারেন, তাহলে ব্যক্তিগত সম্পর্কের জটিল অংশগুলোতেও আপনার পক্ষে সফলভাবে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।’ তার মানে এই চর্চা শুধু শরীর নয়, মনের ওপরও ফেলে ইতিবাচক প্রভাব। হাউস ও তার ফিজিক্যাল থেরাপিস্ট প্রেমিকা জেন এস্কুইয়ার জানিয়েছেন, এই ওয়ার্কআউট তাদের মধ্যে বিশ্বাসপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে।
বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফল স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে, ‘পার্টনারভিত্তিক ওয়ার্কআউট’ রোমান্টিক সম্পর্ককে উন্নত করতে সহায়ক। আমেরিকান ম্যাগাজিন সাইকোলজি টুডের মতে, যখন আপনার নিজের ও নিজ সঙ্গীর মধ্যে পারস্পরিক শারীরিক গতিবিধি প্রতিফলিত হয়, আপনারা ‘আনকনশাস নন-ভারবাল মিমিক্রি’ তৈরি করেন। এই অবচেতন মিমিক্রি সঙ্গীদের একে অপরকে মানসিকভাবে অনুভব করতে সহায়ক। যারা এতে অংশ নেন, তারা নিজ নিজ সঙ্গীর সঙ্গে দৃঢ় বন্ধন গড়ে তুলতে সক্ষম।
মনে প্রশান্তি
আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি
শুধু অ্যাক্রোইয়োগা নয়, যেকোনো অ্যাক্রোবেটিক ওয়ার্কআউট অনুশীলনের মাধ্যমে নানাভাবে আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা উন্নত হতে পারে। প্রথমত এ ধরনের দেহচর্চায় নিয়মিত অনুশীলন ও অধ্যবসায় প্রয়োজন। যারা প্রশিক্ষণ চালিয়ে যান, তারা নিজেদের অর্জনে গর্ব ও সন্তুষ্টি অনুভব শুরু করেন। এই অনুভূতি জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলতে পারে এবং সামগ্রিকভাবে আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তোলে। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য অ্যাক্রোবেটিক ক্লাসগুলো সচরাচর আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা বাড়ানোর দিকে লক্ষ রাখে। এই ক্লাসগুলোতে নতুন দক্ষতা আয়ত্তের জন্য উৎসাহিত করা এবং নিজেকে চ্যালেঞ্জ জানানোর সুযোগ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষকের নির্দেশনায় নিরাপদে নতুন কৌশল শেখার মাধ্যমে তারা নিজেদের দক্ষতায় আত্মবিশ্বাসী বোধ করতে থাকেন।
মানসিক চাপ ও উৎকণ্ঠা হ্রাস
প্রবীণদের জন্য এ ধরনের ব্যায়াম মানসিক চাপ ও উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করে। এই ব্যায়ামে এন্ডোরফিন নির্গত হয়, যে হরমোন স্বাভাবিকভাবে মেজাজের উন্নতি ঘটায়। এই এন্ডোরফিনগুলো চাপ ও উদ্বেগ কমাতে এবং সামগ্রিক মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
দেহে স্বস্তি
পেশির ভর ও শক্তি বৃদ্ধি
এর মাধ্যমে স্ট্রেন্থ ট্রেনিং পেশির ভর ও শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। কারণ, ওজন উত্তোলন বা প্রতিরোধমূলক ব্যায়াম করলে (যেমন রেসিস্ট্যান্স এক্সারসাইজ) পেশির লোয়ারে চাপ সৃষ্টি হয়। তারপরে দেহ এসব চাপ পুনরুদ্ধার করে পেশির আকার ও শক্তি বাড়ায়। ফলে পেশির ভর ও শক্তি বাড়ে দারুণভাবে।
হাড়ের ঘনত্ব বৃদ্ধি ও ঝুঁকি হ্রাস
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের হাড় দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে উঠতে পারে। এর ফলে হাড় ভাঙার (ফ্র্যাকচার) এবং অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি বাড়ে। অ্যাক্রোবেটিক এক্সারসাইজের অন্তর্গত স্ট্রেন্থ ট্রেনিং হাড়ে চাপ প্রয়োগ করে হাড়ের ঘনত্ব উন্নত করতে সহায়ক। এটি শরীরকে আরও বেশি হাড়ের টিস্যু তৈরিতে উদ্দীপ্ত করে। এর ফলে হাড় ভাঙার এবং অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি কমে যায়।
বিপাক ক্ষমতার উন্নতি
অ্যাক্রোবেটিক ওয়ার্কআউট আপনার মেটাবলিজম বা বিপাক শক্তি বাড়াতে পারে। এর মাধ্যমে শরীরে ক্যালরি বার্নের হার বাড়ে। যখন আপনি আরও মাসল মাস তৈরি করেন, তখন শরীরে সেই পেশি বজায় রাখার জন্য বেশি শক্তির প্রয়োজন পড়ে। ফলে বিশ্রামের চেয়ে আপনি বেশি ক্যালরি বার্নে উদ্বুদ্ধ হন, যা আপনাকে ওজন কমাতে এবং সুস্বাস্থ্য ধরে রাখতে সহায়তা করে।
দীর্ঘমেয়াদি রোগের ঝুঁকি হ্রাস
এ ধরনের দেহচর্চার মাধ্যমে টাইপ ২ ডায়াবেটিস, হার্টের রোগ ও উচ্চ রক্তচাপের মতো দীর্ঘমেয়াদি রোগের ঝুঁকি কমানো সম্ভব। কেননা, এর অন্তর্গত স্ট্রেন্থ ট্রেনিং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ, রক্তচাপ কমানো ও কোলেস্টেরলের মাত্রা উন্নত করার ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।
ভারসাম্য ও সমন্বয় রক্ষা
কোর ও দেহের নিচের অংশের পেশি শক্তিশালী করার মাধ্যমে ভারসাম্য ও সমন্বয় উন্নত করতে ভূমিকা রাখে স্ট্রেন্থ ট্রেনিং। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ভারসাম্য ও সমন্বয় কমে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। অ্যাক্রোবেটিক ওয়ার্কআউট জয়েন্টের গতি পরিসর বাড়িয়ে নমনীয়তা উন্নত করতে কাজে দেয়। ইনজুরির ঝুঁকি কমাতে এবং শরীরের সামগ্রিক গতিশীলতা বাড়াতে এই দেহচর্চা কার্যকরী।
অ্যাক্রোবেটিক ওয়ার্কআউট চর্চা মূলত ধৈর্য, নিয়মিত অনুশীলন এবং নিরাপত্তামূলক সচেতনতার বিষয়। ফলে এর চর্চায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের দেখা মেলে। শুরুতে সহজ মুভ দিয়ে শক্তি, নমনীয়তা ও ভারসাম্য উন্নত করা শ্রেয়। পরে ধীরে ধীরে ফ্লিপ বা অ্যাক্রো ড্যান্সে মনোনিবেশ করা যেতে পারে। তবে চর্চা যেভাবেই হোক, গ্রহণ করা চাই কোনো ফিটনেস বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে।

 ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top