ছুটিরঘণ্টা I আজারবাইজানে ম্যালাকাইট ঝাঁপি
ছবির মতো মনোরম প্রকৃতি। কবিতার মতো স্নিগ্ধ অবয়বের বাসিন্দা। পূর্ব ইউরোপীয় দেশ আজারবাইজানের রাশিয়া সীমান্তঘেঁষা গ্রাম খিনালিক ঘুরে এসে লিখেছেন ফাতিমা জাহান
দুপুর হতে চলল; অথচ রোদের তেজ নেই। উল্টো হিমশীতল বাতাস বইছে। খিনালিক গ্রামের একদম প্রান্তের পাহাড়ে দাঁড়িয়ে আমি। পাশে গ্রামের তিন বাসিন্দা। তারা শুধু গ্রামবাসীই নন; এই অঞ্চলের আদিবাসীও। অবশ্য পোশাকে আদিবাসীর চিহ্নমাত্র নেই। সবাই শার্ট, প্যান্ট আর জ্যাকেট পরে আছেন। তারাই আগে এসেছেন এখানে; আমিই বরং তাদের সঙ্গে এসে জুটেছি। তিনজনের মধ্যে একজন সামান্য ইংরেজি জানেন। তিনি অল্প দূরে সবুজ পাহাড়ের ঢালে কয়েকটি একতলা ভবন দেখিয়ে বললেন, ‘ওই যে দেখো রাশিয়ার সীমান্ত। আর অনুচ্চ ভবনগুলো সে দেশের সেনাছাউনি।’
আমি অবাক হয়ে তার কথা শুনি। রাশিয়া এত কাছে! যেন পা বাড়ালেই সে দেশের মাটি স্পর্শ করা, হাত বাড়ালেই মখমলের মতো ঘাসের ওপর ফোটা ফুল ছুঁয়ে দেখা যায় এবং মাথা উঁচু করে সামনে তাকালেই ম্যালাকাইটের ঝাঁপির সন্ধান পাওয়া যাবে। রাশিয়া আমার কাছে এক স্বপ্নের দেশ। সে দেশের শিল্প-সাহিত্য, সমাজব্যবস্থা, রাজনীতির কথা শুধু বইয়ে পড়েছি। আজারবাইজানে এসে যে রাশিয়ার সীমান্তে পৌঁছে যাব, ভাবিনি। রাশিয়াকে বরফের দেশ জানলেও দূরের সারি সারি পাহাড়ের সীমাহীন সৌন্দর্যের বর্ণনা কোনো পুস্তকে পড়িনি। আজারবাইজানের খিনালিক গ্রামের মানুষজনও রুশ ভাষা জানেন। এখন অবধি খুব কম মানুষকে গ্রামের পথে দেখেছি। যাদের দেখা পেয়েছি; তারা গায়ের রং, চুল, চোখের রং মিলিয়ে হুবহু রাশিয়ানদের মতো দেখতে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার আগে সবাই তো একই প্রজাতন্ত্রের বাসিন্দা ছিলেন। আর এখান থেকে আমি যদি গড়িয়ে পড়ি, তাহলে অবশ্যই রাশিয়ায় গিয়ে পৌঁছাব বিনা ভিসা এবং বিনা কসরতে। যখনই দেখেছি এত কাছে, আমার মাথায় রাশিয়ার ভূত চেপে বসেছে।
আমি আরও অনেক গল্প শুনতে চাই রাশিয়ার। জিজ্ঞেস করতে চাই দেশ ভাগ হওয়ার আগে কেমন ছিল এ গ্রাম। তখন নিশ্চয়ই সীমান্ত ছিল না। মানুষের অবাধ চলাচল ছিল। কিন্তু খুব বেশি ইংরেজি না জানার কারণে এরা কেউ কিছু বলতে পারলেন না।
আজারবাইজানের রাজধানী বাকু থেকে আমি একটা গ্রুপ ট্যুরে এসেছি। গ্রুপে ইউরোপীয়, এশিয়ান মিলিয়ে ১২ জন। আমি গাড়ি, গ্রুপের সঙ্গীসাথি, গাইড—সবাইকে ছাড়িয়ে গ্রামের অন্য প্রান্তে চলে এসেছি। অবশ্য খিনালিকে পৌঁছানোর পরই গাইড আমাদের ছেড়ে দিয়ে বলেছেন গ্রাম চষে, মানে ঘুরে বেড়াতে। আমি, শ্রীলঙ্কান মেয়ে মারিয়া আর সৌদি আরবের দুটি ছেলে কিছুক্ষণ একসঙ্গে ঘুরে সবে আলাদা হয়ে গিয়েছি।
আমার সামনে ঢেউখেলানো সবুজ পাহাড়। পাহাড়ের ওপাশে মেঘ। কোথাও চমৎকার গাঢ় নীল আকাশ। আকাশের ভাঁজে ভাঁজে আবার সেই মখমলের সবুজ চাদর বিছানো সারি সারি পাহাড়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তো পৃথিবীর কত দেশকেই মুগ্ধ করে রাখে; মতো কিন্তু খিনালিক গ্রামের এমন নির্জন সৌন্দর্য আর কোথাও নেই।
এই গ্রামের বাসিন্দাদের শিকড় এসেছে ককেশিয়ান আলবেনিয়ান জনগোষ্ঠী থেকে। যিশুর জন্মের দুই-তিন শ বছর আগে এরা এখানে এসে বসবাস শুরু করেন। আজারবাইজানের সর্বোচ্চ শিখরে অবস্থিত এই গ্রাম। যেন সবচেয়ে উঁচুতে দাঁড়িয়ে নিজের দুই পাশে আজারবাইজান আর রাশিয়াকে সামলে রেখেছে। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখান থেকে গ্রামের একমাত্র স্কুল ও হাসপাতাল দেখা যাচ্ছে। সেখান থেকে সামান্য এগোলেই রাশিয়ার সীমান্ত।
খিনালিককে প্রাচীন গ্রাম হিসেবে ইউনেসকো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। গ্রামের বাসিন্দারা এই জনপদের আদিবাসী জনগোষ্ঠী বলেই এমন স্বীকৃতি। এই গ্রামের মানুষজন এখনো দুই হাজার বছর আগের ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে ঠিকই; তবে জ্বালানি হিসেবে এখনো শুকনো গোবর ও কাঠ ব্যবহার করা হয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কাছের শহর থেকে আসে। এই উঁচু পাহাড়ি এলাকায় বাজার বসে সপ্তাহে এক দিন। গ্রামবাসী পশুপালন করে জীবিকা নির্বাহ করেন। শীতকালে বরফ পড়ে সমস্ত পথঘাট বন্ধ হয়ে গেলে বাধ্য হয়ে গৃহবন্দির জীবন কাটান। সেই দিনগুলোতে সময় কাটাতে উল দিয়ে নানা হস্তশিল্পের কাজ করেন। সপ্তাহে তিন দিন বাস আসে বাকু থেকে। এরা অবশ্য গ্রাম ছেড়ে কোথাও যান না। এদের যাবার প্রয়োজনও পড়ে না। কী শান্তির জীবন এদের!
পথে কোনো মানুষ নেই। সরু পথ পাহাড় বেয়ে নেমে গেছে নিচে। আমি এর মাঝে অবাক হয়ে ম্যালাকাইটের ঝাঁপি থেকে বের হওয়া ছিটকে ছিটকে পড়া ঐশ্বর্য দেখছি। পাহাড়ের ঢালে গৃহপালিত মুরগি, ছাগল চরে বেড়াচ্ছে। পাথরে তৈরি একেকটা বাড়ি বেশ দূরে দূরে। সাধারণ গ্রামের দৃশ্য হলেও অসাধারণ করে দিয়েছে পেছনের পাহাড়। একটু আগে ঝলমলে পরিষ্কার নীল আকাশ দেখেছি; এখন গোমড়া মুখে আধেক আলো বিলিয়ে তাকিয়ে আছে। এসব দেখতে দেখতে পাহাড়ের ঢালের ফুলের গালিচার সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেল। এরা কারও জন্যই ফোটেনি; তবু অসহনীয় সুন্দর হয়ে পাহাড়কে রঙিন করে দিয়েছে। অনেক দূরে একটি ঘর। আর সামনে রাশি রাশি ফুল। এমন এক ফুলের রাজ্যে সকালবেলা দুয়ার খুলে শিশিরভেজা ঘাসে খালি পায়ে কি কেউ হাঁটে এখানে? অলস দুপুরে মিঠে রোদে কি কেউ পা মেলে ঘাসের ওপর বসে বই পড়ে কিংবা বাতাসের বয়ে যাওয়া শনশন আবেশে মোহগ্রস্ত হয়? কে জানে, হয়তো হয়! তবে এখন আশপাশে কেউ নেই।
বাকু থেকে খিনালিক আসার পথের বেশির ভাগই ছিল সবুজ গ্রাম বা বড়সড় জঙ্গল। সেসব পার হয়ে খিনালিকের যত কাছে আসছিলাম, প্রকৃতির রূপ দেখে পলক ফেলতে ততই ভুলে যাচ্ছিলাম। মিনিবাসের সামনের সিটে বসেছিলেন গাইড টিম। বয়স ২৫-২৬। এমন আমুদে গাইড আর দেখিনি! চমৎকার সব গান গাড়িতে বাজাচ্ছেন আর বন্ধুর মতো গল্প জুড়েছেন সবার সঙ্গে। গল্প করতে করতে বলে ফেললেন, ওর নাকি মিউজিক কম্পোজার হওয়ার খুব ইচ্ছা। গাড়িতে নিজের কম্পোজ করা কয়েকটা মিউজিক বাজালেন। আমরা শুনে বিমোহিত! এত গুণ এই ছেলেটার! সৌদি আরবের ছেলে দুটি এতক্ষণ একেবারেই কথা বলছিলেন না। টিমের পাল্লায় পড়ে ওরাও জানালেন, ওদেরও মিউজিকের প্রতি আগ্রহ অগাধ। টিমের জোরাজুরিতে ওদের কম্পোজ করা মিউজিকও গাড়িতে বাজানো হলো। চমৎকার ইংলিশ কনটেম্পরারি মিউজিক কম্পোজ করেছেন তারা। কে বলে সৌদি আরবের ছেলেমেয়েরা শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞানে পিছিয়ে আছে! আমি যত দেশে সৌদি তরুণদের দেখা পেয়েছি, সব জায়গায় এদের ভীষণ আধুনিক, বন্ধুভাবাপন্ন আর শিক্ষিত হিসেবেই পেয়েছি।
এদিকে বাইরে পাহাড় আমাকে হাতছানি দিচ্ছে। আমি টিমকে বলে গাড়ি থামালাম। সবাই হুড়মুড় করে নেমে গেল গাড়ি থেকে। সামনে অনিন্দ্যসুন্দর পাহাড়ের সারি পান্নার মতো ঝকমকিয়ে উঠছে। তখনো অনেক দূরে খিনালিক গ্রাম। সেখানে ছোট ছোট হীরক বিন্দুর মতো ঘরগুলো জ্বলজ্বল করছে। আর পাহাড়ের পা খানিকটা ভিজিয়ে দিয়েছে সরু একফালি এঁকেবেঁকে যাওয়া শুভ্র নদী। স্বপ্নও বোধ হয় এত সুন্দর হয় না!
আমরা স্কুলের বাচ্চাদের মতোই হয়ে গেলাম। সামনের দৃশ্য দেখে কেউ গাড়িতে বসতে চাচ্ছে না। টিম জোর করে সবাইকে আবারও মিনিবাসে উঠিয়ে, নিয়ে চললেন খিনালিক গ্রামের দিকে। সবুজের উপুড় করে দেওয়া ঐশ্বর্য দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছে গেলাম খিনালিকে। আমাদের গাড়ি থামল গ্রামের একমাত্র দোকানের সামনে। আমরা যে রকম সামনের দিকে খোলা দোকান দেখে অভ্যস্ত, সে রকম দোকান আজারবাইজানে দেখা যায় না। সবই সুপারশপের মতো, ভবনের ভেতরে। এ দেশে ঠান্ডার কথা ভেবে এমন ব্যবস্থা। খিনালিকের দোকানের সামনে লেখা—মার্কেট। অবশ্য এ গ্রামের মানুষ কেশমিতস ভাষায় কথা বলেন। এটি খিনালিকের নিজস্ব ভাষা। এ ভাষা নিয়ে তেমন গবেষণা হয়নি। নিজেদের গ্রামকে এরা বলেন কেশ; আর গ্রামের অধিবাসীদের কেতিদ। এ রকম কয়েকজন কেতিদের সঙ্গে দোকানের মুখে দেখা হয়ে গেল। বেশির ভাগই শিশু। এদের মুখে সারল্য মিশে আছে।
টিম আমাদের সময় বেঁধে দিলেন। দুই ঘণ্টার মধ্যে গ্রাম দেখে আবার এখানেই ফিরে আসতে হবে। আমি আর মারিয়া তাই ছুটলাম। পাহাড়ি পথ, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে খানিক দূরে দেখি গ্রামের কবরস্থান। প্রতিটি কবর আলাদা করে সোনালি পাথর দিয়ে বাঁধানো; আর কবরের মাথায় এপিটাফ। কবরে শায়িত ব্যক্তির ছবিও আছে এপিটাফের ওপর। দূর থেকে যতখানি দেখা যায়, তা-ই দেখলাম। এরপর গ্রামের আরেক প্রান্তে চলে এলাম। সেখানে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম আর আমি কয়েকজন কেতিদের সঙ্গে মেতে উঠলাম গালগল্পে। এদের মুখেও শিশুর মতো সারল্য। সেখান থেকে চললাম স্কুলের দিকে। সূর্য এখন মধ্য গগনে; তবে বাদলে ঢাকা, তাই বেলা কত হলো বোঝার উপায় নেই। ঘড়িতে বাজে একটা। স্কুলের সামনে বা ভেতরে কেউ নেই। দোতলা সারি সারি স্কুল কক্ষ, দেয়ালে সারি সারি জানালা। ক্রিম কালারের দেয়াল আর লাল চারচালা ছাদ। নিশ্চুপ পুরির মতো স্কুলের বাগানে কিছুক্ষণ ঘুরে হাসপাতালের দিকে চললাম। হাসপাতালও দেখতে হুবহু স্কুলের মতো। মনে এক সুপ্ত ইচ্ছা, আরেকটু এগোই না কেন, রাশিয়ার সীমান্তে পৌঁছানো যাবে!
পাহাড়ের ওপর থেকে যত কাছে দেখাক না কেন, সীমান্ত আসলে কয়েক কিলোমিটার দূরে। আমি তাই গ্রামের বাড়িঘর দেখার জন্য আবারও পাহাড় বেয়ে মূল গ্রামের দিকে চলে এলাম। সবুজের মাঝে, হাত বাড়িয়ে নানা রঙের ফুল ছুঁয়ে দিয়ে আসতে আসতে মনে হলো, এই গ্রামকে ইউনেসকো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্ভুক্ত করা সার্থক। আমার ভ্রমণ সার্থক এখানে এসে।
গ্রামের এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি এতটাই দূরে, মনে হলো এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে অবস্থিত। বাড়িগুলোর দেয়াল পাথরখণ্ড দিয়ে তৈরি। ছাদ পাকা হলেও বাড়ির মাথায় টিনের চৌকোনা চাল বসানো, যাতে বরফ গড়িয়ে পড়তে পারে। বাড়ির যা আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে, তা হলো, দেয়ালজুড়ে জানালা। অসামান্য সুন্দর সেই জানালার আকার। মাঝখানে কাঠের ফ্রেম দিয়ে বাঁধানো। আমি যখন বাড়ি আর জানালায় বিভোর, তখন বাড়ির পেছন থেকে একটি পরি এলো একগুচ্ছ বুনোফুল হাতে। এসেই আমার হাতে ফুলগুলো দিয়ে রুশ ভাষায় কী যেন বলল। আমরা কেউ কারও ভাষা জানি না; তবু এই হিমশীতল দুপুরে তার আন্তরিকতা আর উষ্ণতার ভাষা বুঝতে আমার একটুও অসুবিধে হলো না। মেয়েটির বয়স ১০-১১; লাল সোয়েটার আর গোলাপি টুপিতে ওকে লাল পরির মতোই লাগছিল। মনে হয়েছিল, এখুনি ডানা মেলে উড়ে যাবে।
ওদের বাড়ির আধখোলা দরজায় আধাআধিভাবে আরেকটা পরি দাঁড়িয়ে আছে, যাকে আমি দেখতে পাচ্ছি না। সে লজ্জা পাচ্ছে। আমি ওদের পেরিয়ে আরেকটু ওপরের দিকে এলাম। এখান থেকে আবারও দিগন্তবিস্তৃত ঢেউখেলানো পাহাড় আর চোখ শীতল করা সবুজের আবেশ দেখে নেওয়া যায়। এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাহাড়ি ফুলের শোভা দেখি আর ভাবি, এত সুনসান গ্রামও হয় কীভাবে!
পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সরু পথ ধরে নামতে নামতে এক জায়গায় এসে থামলাম। এখানে এখন তিনজন পরি আকাশ থেকে নেমে এসেছে! এদের বয়স ৯-১০ বছর। নিজেদের মাঝে কলকল করেই যাচ্ছে। আপেলের মতো লাল লাল গাল আর আরও মিষ্টি হাসিতে পাহাড়ের আনন্দ বাড়িয়ে চলেছে। কী খুঁজতে এসে কী খুঁজে পেয়েছি, সে আমিই জানি। কে জানত এই দুর্গম, নির্জন, শান্তিময় গ্রামে কিছুক্ষণ পরপর আকাশ থেকে পরি নেমে আসবে! কে জানত, এমন অসম্ভব সুন্দর মখমলে ঢাকা সবুজ পাহাড় চুপি চুপি আমাকে রুশ দেশের রূপকথার জগতে নিয়ে যাবে!
আমি পাহাড় পেরিয়ে চললাম আমার দলের সঙ্গীসাথিদের কাছে। আমার আগে সবাই এসে হাজির। টিম চিৎকার করে বললেন, ‘ওহ্ খোদা, তোমায় পাওয়া গেছে! আমরা তো ভেবেছি তুমি পাহাড়ের মাঝে হারিয়ে গেছ।’ বললাম, ‘আসলে ওদিকটায় গড়িয়ে প্রায় চলেই যাচ্ছিলাম। হারিয়ে গেলে মনে একটুও খেদ থাকত না। কারণ, আর যাবই-বা কোথায়। গিয়ে পড়ব তো রাশিয়ায়।’ টিম জানেন, এ রকম আধপাগল লোক দলে একজন তো থাকবেই। তাই আমাকে পাত্তা না দিয়ে দল নিয়ে চললেন গ্রামের একটি বাড়ি দেখাতে।
আমরা পাহাড় বেয়ে বেয়ে ওপরে উঠে একটা বাড়ির সামনে দাঁড়ালাম। দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন স্থূলদেহী, নীল চোখ আর সোনালি চুলের রাশিয়ান এক ভদ্রলোক। তিনিই বাড়ির মালিক। নাম আখমেদোভ। পেশায় পশুপালক। প্রয়োজনের অতিরিক্ত পশু আছে তার। আমাদের নিয়ে বৈঠকখানায় বসালেন। ট্র্যাডিশনাল খিনালিক বৈঠকখানায় কোনো সোফা বা চেয়ার থাকে না। মোটা মোটা তোশকের ওপর চাদর বিছিয়ে নানা আকারের বালিশ সাজিয়ে রাখা হয়। এর ওপর বিছানো থাকে কম্বল। এখানে, এই কম্বলের নিচে বসেই খোশগল্প চলে। আমরা বসতে না বসতেই বাড়ির আরেক মালিক ট্রে ভরে চা নিয়ে এলেন। তিনি আখমেদোভের স্ত্রী। রাশিয়ানদের মতো লম্বা ঝুল দেওয়া জামা পরে, মাথায় ছোট একটা স্কার্ফ বেঁধে, হাসিমুখে চা পরিবেশন করলেন।
রাশিয়ার সীমান্তে আদিবাসী গ্রাম; তাই আমি ভেবেছি, এরা হয়তোবা খ্রিস্টান বা স্বাধীন ভাবনায় বিশ্বাসী। আমাকে অবাক করে দিয়ে টিম বললেন, ‘এ গ্রামের সবাই মুসলমান।’ মানে খিনালিকে পা দেওয়ার পর যত মানুষ দেখেছি সবাই মুসলমান। অথচ তাদের পোশাক দেখে বা কথাবার্তায় তা বোঝা যায়নি।
একরাশ বিস্ময় নিয়ে আখমেদোভের বাড়ি থেকে বের হলাম। এবার টিম আমাদের নিয়ে যাবেন গ্রামের মসজিদে। আমি মসজিদটি পার হয়ে এসেছিলাম; কিন্তু বহিরাঙ্গ দেখে কিছুতেই মনে হয়নি এটি মসজিদ। সাধারণ একটা বাড়ির মতো দেখতে। এখন নামাজের সময় নয়, তাই মসজিদের ভেতরটা ফাঁকা। ভেতরে লম্বা লম্বা কার্পেট বিছানো। এক পাশে স্তূপাকারে ছোট ছোট জায়নামাজ আকারের গদি রাখা। এখানে সারা বছর ঠান্ডা থাকে। ঠান্ডা মেঝেতে যেন কষ্ট না হয়, সে কারণে গদি বিছিয়ে নামাজ পড়েন মুসল্লিগণ। এ গ্রামের কারও বাড়িতে রুম হিটার বা সেন্ট্রাল হিটিং সিস্টেম নেই। অতিরিক্ত ঠান্ডার সময়ে নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী কয়লা জ্বালিয়ে ঘর গরম রাখেন। ভারতের যেসব গ্রামে বরফ পড়ে, সেখানেও এ রকম প্রাচীন পদ্ধতি অবলম্বন করে ঘর গরম রাখা হয়।
মসজিদ দেখে আমরা ফিরে চললাম বাকুর দিকে। পথের দৃশ্য আরও মনোহর। কোথাও ঢেউখেলানো সবুজ পাহাড় আর তার পায়ের কাছে বিস্তীর্ণ সমতলভূমি। সমতলে গুটিকয়েক ঘর। ঘরকে ছায়া দিচ্ছে কিছু বার্চ গাছ। জানালা থেকে সরে সরে যাওয়া সবুজ দৃশ্যের মাঝে হঠাৎ মনে হয়, এটি গাড়ির জানালার ফ্রেম নয়, যেন বসার ঘরে টাঙানো ছবির ফ্রেম হয়ে গেছে। প্রকৃতি এত নিখুঁতভাবে ধরা দিয়েছে, বাস্তবের এই দৃশ্যকে কল্পনা বলে মনে হয়। সরে সরে যাচ্ছে; তবু মনে হয় ধরে রাখি।
ছবি: লেখক
