রম্যরস I স্যান্ডেল -সুমন্ত আসলাম
‘আসছে দেশে শুভ দিন, স্যান্ডেল মার্কায় ভোট দিন।’
সকাল থেকে একনাগাড়ে মাইক বেজে চলছে এলাকায়। রিকশায় একজন বসে আছেন, তার হাতে টেপরেকর্ডার, সেখান থেকে কথাগুলো বের হচ্ছে মাইকের গলা দিয়ে।
মার্কা তো অনেক শুনেছি, কিন্তু স্যান্ডেল মার্কা কখনো শুনিনি। কৌতূহল হচ্ছে বেশ। কিন্তু স্যান্ডেল মার্কায় কে দাঁড়িয়েছেন, তার নাম বলা হচ্ছে না মাইকে। একনাগাড়ে বলে যাচ্ছে—‘আসছে দেশে শুভ দিন, স্যান্ডেল মার্কায় ভোট দিন।’
বাসায় ফিরলাম সন্ধ্যায়। শরীরে অফিসজনিত ক্লান্তি। বউকে বললাম, ‘চা দাও।’
‘চা-পাতা নাই বাসায়।’ বউ নির্ভার গলায় উত্তর দিল।’
‘বাসায় চা-পাতা নেই, গেছে কোথায়?’
পাশে বসল বউ। মাথার চুলে একঝলক হাত বুলিয়ে বলল, ‘রাতে যার সঙ্গে মাঝে মাঝে ফোনে কথা বলো, তার বাসায়।’
২
নুডলস বানিয়ে আনল বউ। বেশ পছন্দের খাবার আমার। এক চামচ মুখে দিলাম। দ্বিতীয় চামচ মুখে দিতেই সুতোর মতো লম্বা কী একটা টান পড়ল জিব-দাঁত-গলায়। আলতো করে হাত দিয়ে টেনে বের করলাম গলা থেকে—একটা চুল! বাসায় লম্বা চুলের তেমন কেউ নেই; মেয়ের মাথার চুল ছোট। সুতরাং বউয়ের চুল। দু আঙুলে চেপে ধরে পাশে রাখলাম। পানি আনতে গেছে বউ। ফিরে আসতেই বললাম, ‘আজকের নুডলসটা অন্য রকম হয়েছে।’ পাশে রাখা চুলটা হাতে দিলাম তার, ‘চুল আরেকটা বেশি দিলে আরও বেশি মজা হতো!’
ব্যাপারটা পাত্তাই দিল না বউ। কিচেনে চলে গেল আবার। ফিরে এসে কফির মগটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘মাথার লম্বা চুলে মুখ গুঁজে মানুষ মজা পায়, কিটকিট করে কামড়ায়ও মাঝে মাঝে, জগৎ ভুলে যায় সেই সময়টাতে; তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু মাত্র একটা চুল কোথাও পেলেই অন্যায়, জগতের সব দোষ!’
কফিতে চুমুক দিলাম, ‘কফিটাও মজা হয়েছে।’ হাত ধরে পাশে বসাই বউকে, ‘খাবারে তাদেরই চুল পাওয়া যায়, যারা খুব মনোযোগ দিয়ে রাঁধে, আন্তরিকতা নিয়ে আয়োজন করে; যেমন সফল হয় তারাই, যারা পরিশ্রম করতে করতে ভিজে যায় ঘামে।’
খুশি হলো বউ।
আবারও বুঝে গেলাম—মানুষকে খুশি করা খুব কঠিন কিছু না।
৩
রাত দশটার দিকে চমকে উঠলাম—‘মতলব ভাইয়ের সালাম নিন, স্যান্ডেল মার্কায় ভোট দিন।’ মতলব ভাই! মানে আমাদের এলাকার বড় ভাই। খুব সাধারণ একজন মানুষ। অনেকটা সরল। তিনি ভোটে দাঁড়াবেন, তা-ও আবার স্যান্ডেল মার্কায়। স্যান্ডেল মার্কা কি আসলেই আছে?
সেই ছোটকাল থেকে দেখে আসছি মতলব ভাইকে, পায়ে সারাক্ষণ স্যান্ডেল, জুতা দেখিনি কখনো। ব্যস্ততার ভঙ্গিতে হেঁটে বেড়ান এখানে-ওখানে, মোড়ের চায়ের দোকানে চা খান। আমাদের গ্রামে এক বিজ্ঞাপন নির্মাতা এসেছিলেন একবার, একটা বিজ্ঞাপনের শুটিং করতে। মতলব ভাইকে দেখে কেন জানি পছন্দ করে ফেলেন তিনি। কথা বলতে বলতে বলে ফেলেন, ‘বিজ্ঞাপন করবেন? স্যান্ডেলের বিজ্ঞাপন? আমার কাছে একটা অফার আছে। আপনি স্যান্ডেল পরে হাঁটবেন, হঠাৎ হোঁচট খাবেন, পড়ে যাবেন; কিন্তু আপনার পায়ের স্যান্ডেল জোড়া আকাশের দিকে উঠে যাবে।’
‘আমি মাটিতে পড়ে যাব, আর আমার পায়ের স্যান্ডেল জোড়া যাবে আকাশের দিকে!’
‘জি। দৃশ্য ফ্রিজ। স্ক্রিনে লেখা উঠবে—“আপনি পড়ে যাবেন, কিন্তু স্যান্ডেল পড়বে না; উড়ে যাবে সাফল্যের আকাশে”।’
‘মানুষ পড়ে থাকবে মাটিতে, স্যান্ডেল সাফল্যের আকাশে উড়ে কী করবে?’
‘কী করবে?’ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বিজ্ঞাপন নির্মাতা নিজেই প্রশ্ন করে বসেন।
‘তারপর কোনো বিজ্ঞাপন নির্মাতার মাথায় গিয়ে পড়বে!’
৪
কিছুটা সকালেই বেজে উঠল কলবেলটা। অফিস ছুটি আজ। একটু বেশি ঘুমোতে চেয়েছিলাম; হলো না। এরই মধ্যে দুবার কলবেল বেজেছে। দরজা খুলে দিলাম। মতলব ভাই দাঁড়িয়ে দরজায়।
‘তুমি সাংবাদিক মানুষ, আমার একটা কাজ করে দিতে হবে যে ভাই।’
ভেতরে বসালাম মতলব ভাইকে। বউ চা-নাশতা দিল। খেতে খেতে বললাম, ‘কী কাজ করতে হবে, মতলব ভাই?’
‘এরই মধ্যে জেনে বা শুনে ফেলেছ বোধ হয়—আমি ভোটে দাঁড়িয়েছি।’
‘জি, মাইকে শুনেছি।’
‘আমার মার্কাটাও শুনেছ তাহলে—স্যান্ডেল মার্কা।’
‘জি। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না—স্যান্ডেল মার্কা কেন? এই মার্কা কি আদৌ ব্যালট পেপারে থাকবে?’
‘তুমি দুটি প্রশ্ন করেছ আমাকে। আমি প্রথম প্রশ্নটার উত্তর দিচ্ছি তোমাকে।’ কিছুটা শব্দ করে চায়ে একটা চুমুক দিলেন মতলব ভাই। আমার দিকে চোখ স্থির করে তাকালেন, ‘সম্ভাবনা কম, তবু ধরো আমি সত্যি সত্যি স্যান্ডেল মার্কা পেলাম। আমার মিছিল-মিটিংয়ে তো তেমন লোকজন হবে না। আমি কমপক্ষে এক শ জোড়া স্যান্ডেল কিনব। প্রত্যেকের হাতে একটা স্যান্ডেল দেব, টাকাপয়সা দিয়ে মিছিল-মিটিং করাব। তারপর গোপনে আরও একটা দলকে টাকাপয়সা দিয়ে ঠিক করব, একটা চুক্তি করব, তাদের হাতেও স্যান্ডেল থাকবে। একসময় দুই দলের মাঝে কৌশলে মারামারি বাধিয়ে দেব।’
‘মারামারি বাধিয়ে দেবেন! কেন?’ চায়ে চুমুক দিতে গিয়েই থেমে যাই আমি।
‘তুমি একবার ভেবে দেখো, কল্পনা করো—দুই দল মারামারি করছে, কিন্তু তাদের হাতে কোনো লাঠি নেই, ধাতব অস্ত্র নেই, বোমা-ককটেল নেই, আছে স্যান্ডেল। সেই স্যান্ডেল দিয়ে তারা একে অপরকে গালে মারছে, পিঠে মারছে, চোয়ালে মারছে, সারা শরীর ক্ষত-বিক্ষত করছে।’
‘এতে আপনার লাভ?’
‘আনন্দ, স্রেফ আনন্দ।’
‘কী রকম?’
‘এই দেশে নির্বাচন এলে প্রথম আমার পেটাতে ইচ্ছে করে তোমার-আমার মতো সাধারণ মানুষকে। তারা নির্বাচন নিয়ে লাফায়, ভোট ভোট করতে করতে রাতের ঘুম হারাম করে, মিটিং-মিছিলে গরম করে ফেলে চারপাশ। কিন্তু তারপর? গত পঞ্চাশ বছরে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, সাধারণ মানুষের কতটুকু পরিবর্তন দেখেছ জীবনযাত্রার, কীভাবে কোথায় উন্নতি হয়েছে তাদের? কিন্তু যারা নির্বাচিত হয়, তারা পাল্টে যায়, নিজেকে বদলে ফেলে স্বমহিমায়; ভুলে যায় যাদের ভোটে সে নির্বাচিত হয়েছে, তাদের। পাঁচ বছর পর তারা আবার আসে আমাদের ঘরের দরজায়, আমরাও ভুলে যাই সব। অথচ আমাদের হাতে তখন স্যান্ডেল তোলা উচিত, কিন্তু তুলি না। সেই না তোলার অপরাধে আমি মার্কার নাম করে সবার হাতে স্যান্ডেল তুলে দিতে চাই। তারা সুবিধাভোগী ক্ষমতাবানদের কিছু বলার, কিছু করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলার দোষে নিজেরাই যেন নিজেদের গালে স্যান্ডেল মারে!’
কিছুক্ষণ কথা বলি না আমি। চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে মতলব ভাইয়ের। চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ যে কত বলদ, তারা নিজেদের স্যান্ডেল ক্ষয় করে ভোট দিতে যায়, অসৎ কিছু মানুষকে ক্ষমতায় পাঠিয়ে আনন্দ পায়।’
‘আমরা সাধারণ মানুষেরা বলদ!’
‘অবশ্যই। কৌতুকের ছলে একটা ঘটনা বলি তোমাকে। এক লোক নির্বাচনের প্রচারে ভাষণ দিচ্ছিলেন। হঠাৎ ভাষণ থামিয়ে সামনে তাকান। মঞ্চের সামনের সবার দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলেন, “এবার বলুন, আপনারা আমার কাছে কী চান?” কেউ কিছু বলে না; বলার সাহস পায় না। নির্বাচনের ওই লোক তখন বলেন, “আমি এই এলাকায় অনেকগুলো সেতু বানিয়ে দেব আপনাদের।” কিছুটা দ্বিধা নিয়ে এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে যান; বলেন, “আপনি এত সেতু বানাবেন, আমাদের এলাকায় তো কোনো খাল নেই!” বাটপার ওই ভোট প্রার্থী উত্তর দেন, “খাল নাই তো কী হয়েছে, আগে খাল কেটে নেব।” সবাই হাসতে থাকেন, হাততালি দিতে থাকেন; সঙ্গে সঙ্গে ওই বৃদ্ধ মানুষটাও।’ মতলব ভাইও হাসতে থাকেন, ‘এই হচ্ছি আমরা সাধারণ জনগণ!’
খালি কাপটা হাতে নিলেন মতলব ভাই।
‘আরও এক কাপ চা দেব, মতলব ভাই?’
‘না। তোমাকে বরং একটা কৌতুক বলি। কুড়িগ্রামে সেই সময়ে বেশ শীত পড়েছে। সময়টা নির্বাচনেরও। বয়স্ক এক লোক ভোটে দাঁড়ালেন। এক সাংবাদিক একটা ইন্টারভিউ নিলেন তার—
সাংবাদিক: যদি আপনার কয়েক শ বিঘা জমি থাকত, তাহলে আপনি কী করতেন?
বৃদ্ধ: গরিব মানুষদের মাঝে বিলিয়ে দিতাম, যাতে চাষবাস করে খেতে পারে তারা।
সাংবাদিক: যদি আপনার কয়েক কোটি টাকা থাকত, তাহলে কী করতেন?
বৃদ্ধ: অনেকগুলো স্কুল-কলেজ বানাতাম, যেখানে সবাই ফ্রিতে লেখাপড়া করত।
সাংবাদিক: যদি আপনার বিশাল একটা বিল্ডিং থাকত, তাহলে?
বৃদ্ধ: ঘরহারা রাস্তার মানুষদের থাকতে দিতাম সেখানে।
বৃদ্ধের কথা শুনে খুব আনন্দ পাচ্ছিলেন ওই সাংবাদিক। নড়েচড়ে বসলেন তিনি। বৃদ্ধের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘যদি আপনার এক জোড়া নতুন স্যান্ডেল থাকত?’
কোনো কথা বললেন না বৃদ্ধ এবার। কেমন নিশ্চুপ তিনি। সাংবাদিক আবার প্রশ্ন করলেন তাকে। আগের মতোই চুপ বৃদ্ধ। সাংবাদিক কিছুটা চড়া গলায় আগের প্রশ্নটা করলেন বৃদ্ধকে। এবারও বৃদ্ধ নীরব থাকায় সাংবাদিক বললেন, ‘জমি থাকলে বিলিয়ে দিতেন, টাকা থাকলে স্কুল-কলেজ বানাতেন, বিল্ডিং থাকলে সবাইকে থাকতে দিতেন। কিন্তু স্যান্ডেল থাকলে কী করতেন, তা বলছেন না কেন?’
বৃদ্ধ সোজা হয়ে বসলেন। তারপর কিছুটা নিচু গলায় বললেন, ‘এতক্ষণ যেসব জিনিসের কথা বলেছেন, সেগুলো তো আমার নেই, কখনো হবেও না। কিন্তু স্যান্ডেল যে আমার সত্যি সত্যি আছে। তবে এক জোড়া না, এক পাটি। ইনশা আল্লাহ, নির্বাচনে জিতলে দ্রুত আরেক পাটি কিনে ফেলব।’ মতলব ভাই আগের মতোই হাসতে হাসতে বললেন, ‘কী বুঝলে? মানুষ ক্ষমতা পেতে চায় প্রথমে নিজের জন্য কিছু করতে, শেষ দিন পর্যন্ত সে নিজের জন্যই সব করে। উঠি।’
উঠে দাঁড়ালেন মতলব ভাই, ‘যা বলতে এসেছিলাম, তা আর এখন বলতে ইচ্ছে করছে না।’
‘বাসায় যাবেন এখন?’
‘না, জুতার দোকানে যাব। ভোটেও দাঁড়াব না আমি; মিছিল-মিটিংয়ের জন্য অত জুতাও কেনা সম্ভব না। মাত্র এক জোড়া প্লাস্টিকের কিংবা শক্ত রাবারের জুতা কিনব। সামনে নির্বাচন, বাসার দরজায় অনেকে আসবে। দেখি, কোনো কাজে আসে কি না!’
ইলাস্ট্রেশন: দিদারুল দিপু
