skip to Main Content

মনোজাল I আয়নাতে ঐ মুখ দেখবে যখন

প্রেশার টু লুক পারফেক্ট—একে এখন আর হালকা করে নেওয়ার উপায় নেই। মানসিক আর স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে যে!

পরিসংখ্যান বলছে, যতই দিন যাচ্ছে, নারীরা ক্রমশ কৃত্রিম সৌন্দর্যের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছেন। যার মাত্রা রীতিমতো ভীতিকর; বিশেষ করে তাদের স্বাস্থ্যের জন্য। প্রশ্ন হচ্ছে, কারণ কী। আসলে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাহ্যিক সৌন্দর্য দিয়ে নারীকে বিচার করা হয়। এই প্রবণতা নতুন কিছু নয়। যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। সমাজে পুরুষদের তুলনায় নারীরা সব সময় তাদের চেহারা নিয়ে অনেক বেশি সচেতন ও সংবেদনশীল। বাহ্যিক অবয়ব অনুসারে তাদের কঠোরভাবে বিচার করা হয় এবং সৌন্দর্যের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে চেহারা সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে নানা রকম সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়। আর সেই থেকে নারীর মানসিক অস্থিরতা বেড়ে যাওয়া, নিজেকে নিয়ে দুঃখবোধ তৈরি হওয়া, সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে না চাওয়া, সম্পর্ক এড়ানো এবং ক্রমাগত অন্যের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করাসহ সৃষ্টি হয় নানা রকম মানসিক সমস্যা। মনোবিশেষজ্ঞদের মতে, যেসব নারী বিশ্বাস করেন, তাদের চেহারার কারণে অন্যরা তাদের সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করেন না, তারা একসময় বিষণ্নতায় ভুগতে থাকেন। দুর্ভাগ্যবশত, চেহারা নিয়ে এই উদ্বেগ কেবল শিক্ষিত বা শহুরে সমাজেই সীমাবদ্ধ নয়। সৌন্দর্যের মানদণ্ডের ওপর এই বিচারের বিশ্বায়িত প্রভাব গ্রামীণ পরিবেশেও এখন বিস্তৃত ও প্রতিষ্ঠিত। আকর্ষণীয়তার ধারণা এবং নারীকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করার সামাজিক মাপকাঠি সব সমাজেই তার ভাবমূর্তি বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখে।
ঠিক এ কারণেই জনপ্রিয় হচ্ছে প্লাস্টিক বা কসমেটিক সার্জারি। হবে নাই-বা কেন? নারী যেখানে তার গায়ের রং, শারীরিক কাঠামো নিয়ে ক্রমাগত সমালোচিত হচ্ছেন, সেখানে তিনি যদি নিজেকে ইচ্ছেমতো সুন্দর করে তোলার চাবি হাতে পান, তাহলে সেটি ব্যবহার না করার কোনো কারণ তো নেই। কী করা সম্ভব হয় না এর মাধ্যমে! লাইপোসাকশন, টামি টাকস, বাট লিফট, ফ্যাট রিমুভাল, স্কিন টাইটেনিং, বোটক্স, ফিলার, জ-লাইন স্কাল্পটিং, ব্রাও লিফট, ব্রেস্ট অগমেন্টেশন প্লাম্পড লিপ ইত্যাদি। বাংলায় বললে এককথায় মেদ ঝরানো থেকে শুরু করে নিজের চেহারার আমূল পরিবর্তন করা পর্যন্ত সবকিছু। গবেষকদের জরিপ মোতাবেক, সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে যেখানে মুখমণ্ডল আর দেহাবয়ব এখন সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হয়ে উঠেছে, সেখানে অবস্থাপন্ন নারীরা বিশ্বাস করেন, এই পদ্ধতিগুলো বেছে নেওয়ার অর্থ বিলাসবহুল সুস্থতা বেছে নেওয়া। ক্রমেই এ নিয়ে সচেতনতা বাড়ছে, নারীরা বন্দী হচ্ছেন কসমেটিক সৌন্দর্যের বেড়াজালে। কারণ, যেখানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্লাস্টিক সার্জারি ও অন্যান্য কৃত্রিম সৌন্দর্য পদ্ধতিগুলোকে দীর্ঘমেয়াদি কৌশল হিসেবে ক্রমাগত উপস্থাপন করে যাচ্ছে, তখন সৌন্দর্যসচেতন নারীমাত্রই একে লুফে নিচ্ছেন বিকল্প হিসেবে। বিবেচনা করতে বাধ্য হচ্ছেন।
বোস্টন ইউনিভার্সিটির স্কুল অব মেডিসিন বিশেষজ্ঞদের ২০২৪ সালের এক গবেষণা অনুসারে, ফটো-এডিটিং অ্যাপ এবং সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারও একজন নারীর কসমেটিক সার্জারি করার ইচ্ছার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। কসমেটিক সার্জারির আগের ও পরের ছবিগুলো দেখে একজন নারী মনে করতে বাধ্য হন, তিনি প্রাকৃতিকভাবে দেখতে স্বাভাবিক নন কিংবা চেহারা ত্রুটিযুক্ত। একটু ঠিকঠাক করে নিলেই অসাধারণ হয়ে উঠবেন। এই ফলাফল আর নিজেকে আরও আকর্ষণীয়ভাবে দেখার তৃষ্ণাই তাকে ছুরির নিচে যেতে কিংবা ইনজেকশন গ্রহণে প্ররোচিত করে।
লৈঙ্গিক বয়সের কারণেও নারীরা পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি চাপের সম্মুখীন হয়ে থাকেন। বার্ধক্য নিয়ে দীর্ঘস্থায়ী উদ্বেগ, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারুণ্যে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা এবং আবেশী সৌন্দর্যের সংগ্রাম তাদের এসব দিকে ক্রমশ প্ররোচিত করে। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট হলি শিফের মতে, নিজেকে একটি নির্দিষ্টভাবে দেখার সামাজিক চাপ নারীদের ক্রিয়াকলাপকে উল্লেখযোগ্যভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, তরুণ সৌন্দর্যের আদর্শের মেনে চলার নেশা কখনো কখনো তাদের অস্ত্রোপচারের কথা বিবেচনায় বাধ্য করে; যা রীতিমতো বড় একটি সমস্যায় পরিণত এখন।
সমস্যা থাকলে সমাধানও আছে! প্রশ্ন হচ্ছে, সেটি কী? এসব কসমেটিক সার্জারি বা মেডিকেশন শরীরে নানাভাবে প্রভাব ফেলতে পারে। চেহারা বিকৃত হওয়া থেকে শুরু করে মারাত্মক অসুস্থতা; এমনকি অকাল মৃত্যুও অস্বাভাবিক নয়। তরুণ থাকার জন্য ক্রমশ জনপ্রিয় হওয়া মেডিকেশনের ঝুঁকি সম্পর্কে সমাজ বিশেষজ্ঞরা তাই খুব গুরুত্ব নিয়ে ভাবছেন। তারা চেষ্টা করছেন কীভাবে নারীকে এই ঝুঁকির হাত থেকে বাঁচানো যায়। সে জন্য নানা ধরনের গবেষণা চলছে; দেওয়া হচ্ছে অনেক রকম পরামর্শ। সমাধানগুলো জানা থাকলে ক্ষতি নেই কিন্তু।
 স্বতন্ত্রতাকে আলিঙ্গন করতে হবে। সমাজের সৌন্দর্যের আদর্শের সঙ্গে তাল মেলানোর চাপ থেকে নিজেকে বিরত রাখা চাই। টেলিভিশন বা মোবাইল স্ক্রিনে যা উপস্থাপিত হয় তাই একমাত্র সৌন্দর্য নয়, সেটি বোঝার মতো বুদ্ধি নিশ্চয় মাথায় আছে।
 সোশ্যাল মিডিয়া ডিটক্স ভালো কাজ করে এ ক্ষেত্রে। অর্থাৎ এটি থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকা যায় আরকি। তা ছাড়া ফেক, মডিফাইড ও ফিল্টার করা ছবি থেকেও নিজেকে মুক্ত রাখা চাই। নিজের ব্যক্তিত্বে নিজেকে সুন্দর দেখার চেষ্টা করতে হবে। অন্যরা কে কী বলল, সেটা সব সময় মাথায় রাখা জরুরি নয়।
 ম্যাগাজিন বা সোশ্যাল মিডিয়ায় সৌন্দর্য সম্পর্কে কোনো ব্যক্তির মতামত শেষ কিছু নয়, যা মেনে চলতে হবে। সৌন্দর্যের সামাজিক ধারণা পরিবর্তিত হতে থাকে; কিন্তু তার সঙ্গে তাল না মেলালেও চলবে। যখন এগুলো কেবল একটি ট্রেন্ড ছাড়া আর কিছুই নয়, তখন তা অনুসরণ করার কোনো মানে হয় না।
 যদি এই উদ্বেগ দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করে, থেরাপির সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। এতে করে অনুভূতিগুলোর জন্য দায়ী নেতিবাচক সব চিন্তাভাবনা শনাক্ত ও পরিবর্তন করতে সহায়তা মিলবে।
 সেলফ কেয়ার বা নিজ যত্ন নেওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে, যা নিজের সম্পর্কে ভালো বোধ করায়। দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তনগুলো করার দিকে মনোনিবেশ করলে উপকার মিলবে। ব্যায়াম উপভোগ না করলে নাচ, জুম্বা বা অ্যাকোয়া-ইয়োগা করা যায়।
 আত্মসহানুভূতি গড়ে তোলার উপায় হিসেবে নিজের প্রতি মমত্ববোধ জাগিয়ে তোলা জরুরি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের আসল চেহারা গ্রহণের চেষ্টা করা যায়। চেহারা সম্পর্কে কিছু ইতিবাচক কথা লিখে রাখা অথবা মনে মনে বারবার বলা যে, ‘আমি এমনিতেই সুন্দর’। এই আত্মবিশ্বাস নিজের সম্পর্কে ভালো বোধ করাবে।
 ব্যক্তি কাদের সঙ্গে মিশছেন বা আড্ডা দিচ্ছেন, সে ব্যাপারে সাবধান হওয়া জরুরি। এমন মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা চাই, যারা স্বাভাবিক সৌন্দর্যকে মূল্য দেয়। যখন আপনি এমন কারও সঙ্গে যোগাযোগ ও সম্পর্ক গড়বেন, তা আপনার মনকে ইতিবাচক করে তুলতে রাখবে সহায়ক ভূমিকা।
মনে রাখা চাই, যদি নিরাপত্তাহীনতা এতটাই গভীরভাবে মনের ভেতর প্রোথিত হয় যে তা উদ্বেগ বাড়ায়, তাহলে কৃত্রিম সৌন্দর্যবর্ধন কোনো উপকারে না-ও আসতে পারে। সে ক্ষেত্রে নিজেকে প্রশ্ন করা যেতে পারে, সোশ্যাল মিডিয়া, সমাজ আর মানুষ তুলনা ও মতামত দিয়ে দমিয়ে না রাখলে কখনো কসমেটিক সার্জারি এবং এ ধরনের চিকিৎসার পথ বেছে নেওয়ায় আগ্রহী হতেন? উত্তর যদি ‘না’ হয়, তাহলে এই সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়াই মঙ্গল।

 রত্না রহিমা
মডেল: ফাবলিহা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: কৌশিক ইকবাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top