নখদর্পণ I প্রেরণায় রাজকাহন
মিনিমালিজমের রাজত্ব এবার আর টিকছে না। মসনদে ম্যাক্সিমালিজম। সেখানে প্রবল প্রতাপ নিয়ে চলছে মোগল ম্যাজিক
মোগল সাম্রাজ্যের ইতিহাস দারুণ জমকালো। শিল্পসমৃদ্ধ। ফ্যাশনের নানান ভাগে দেখা যায় সে সময়ের আধিপত্য। এবার নেইল আর্টও নাম লিখিয়েছে সেই দলে। সোনালি রাজত্বের সেই সময়কে অনুকরণ করে নয়, অনুপ্রেরণা হিসেবে নেওয়া হচ্ছে। এমন ভাবনার অঙ্কুর আরও এক দশক আগের। দক্ষিণ এশিয়ার শিল্পীরা যখন থেকে নখের ছোট্ট ক্যানভাস নকশায় রাঙানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, তখনই শুরুয়াত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইনস্টাগ্রাম আর পিন্টারেস্টে দেখা যায় সেসব প্রথম দিককার নকশা। মোটিফগুলো ছিল চিত্রকর্ম, রাজকীয় পোশাক আর স্থাপত্য থেকে অনুপ্রাণিত। কখনো ফতেহপুর সিক্রি তো কখনো শালিমার বাগের ছোঁয়া।
ভারতের নেইল আর্টিস্ট রিয়া মেনন নখের সারফেসে মোগলাই নকশা করে দিতে সিদ্ধহস্ত। বিশেষভাবে বিয়ের কনেদের নখ এমন নকশায় রাঙাতে ভালোবাসেন তিনি। কারণ পাওয়া যায় তার অন্তর্জালের বয়ানে, ‘আমি চাই, আমাদের কনেদের সাজে সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের প্রকাশ থাকুক। নিজস্বতা থাকুক তাদের বিশেষ দিনের সাজে।’
মোটিফ ম্যানিয়া
মোগল ইন্সপায়ারড নেইল আর্টের বিশেষ দিক ডিজাইন ডিটেইল। নকশাকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে এঁকে নেওয়া একধরনের চ্যালেঞ্জই বটে। রাজকীয় মোটিফ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে নাটকীয়ভাবে উপস্থাপন করা হয়। মোগলদের সমৃদ্ধ সংস্কৃত থেকে প্রাণিত নকশার মধ্যে কয়েকটি মোটিফের নিয়মিত ব্যবহার দেখা যায়।
ঝরোখা
এটি মূলত বারান্দা। যা দেখা যেত মোগল আমলের হাভেলি বা প্রাসাদে। নেইল আর্টের ঝরোখাতে রানির উপস্থিতি আছে এমন দৃশ্যের নকশা করা হয়। এই মোটিফে প্রকাশ পায় রাজবাড়ির সদস্যদের ব্যক্তিগত জীবনযাপনের ছোঁয়া। আর রানিকে এখানে কনের মতো উপস্থাপন করা হয়।
চারবাগ
পার্সিয়ান শব্দ চারবাগ; অর্থ চতুর্ভুজাকৃতির বাগান। স্বর্গোদ্যানের কনসেপ্ট এখানে মূল দর্শন। চারবাগের মাঝখানে ভাগ ভাগ করে দেওয়া হয়। এই দর্শন এসেছে স্বর্গীয় নদী থেকে। এর বাস্তব ব্যবহার দেখা যায় সম্রাট হুমায়ুনের সমাধি, কাশ্মীরে অবস্থিত শালিমার বাগানে, তাজমহল প্রাঙ্গণে। নেইল আর্টে শিল্পীর তুলিতে প্রস্ফুটিত হয় এই মোটিফ। একটি নখের বদলে দু-তিনটি নখ মিলিয়েও নকশা করা হয়। পদ্ম, জুঁই আর টিউলিপ ফুলও অনেক সময় দেখা যায় তাতে। চারবাগ নকশায় দর্শন হিসেবে কাজ করে সমৃদ্ধি, সুন্দরতা ও সমকালীনতা। সোনালি আর সবুজ রঙের মিশেলে সাধারণত এই নকশা সম্পন্ন হয়। বিয়ের কনের নখ রাঙাতে নকশাটির জনপ্রিয়তা অনেক।
মোগল মুকুট
উপমহাদেশে যখন মোগলদের শাসন, তখন সম্রাট, সম্রাজ্ঞীসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা মাথায় মুকুট পরতেন; যা ছিল সম্মান, শক্তি ও পদমর্যাদার প্রতীক। নেইল আর্টিস্টদের দেখা যায় তাদের নকশায় নানাভাবে এই মুকুট ব্যবহার করতে। বিভিন্ন রকম হয় এই নকশাগুলো। এমন নকশা সাধারণত রিং ফিঙ্গারে বেশি দেখা যায়। গোল্ড ফয়েল, মেটালিক জেল পেইন্ট অথবা থ্রিডি এমবেলিশমেন্টে সম্পন্ন করা হয়। অনেক সময়ে আরও জমকালো করে তোলার উদ্দেশ্যে আর্টিস্টরা ব্যবহার করেন ছোট আকারের রুবি, ময়ূরের পাখাসহ নানা কিছু। উদ্দেশ্য—রাজাধিরাজদের মতো রাজকীয় লুক তৈরি।
মানডালা
সাম্য, আধ্যাত্মিকতা আর পরিশীলিততার প্রতীক হিসেবে মানডালা ব্যবহৃত হয়। এর শিকড় পোঁতা আছে জ্যামিতিতে। মোগলদের সৌন্দর্যদর্শনে এর উপস্থিতি লক্ষণীয়। মানডালা মূলত সংস্কৃত শব্দ। নখে এই মোটিফ থেকে প্রাণিত হয়ে বৃত্ত, ফুল ও জ্যামিতিক প্যাটার্ন তুলে আনেন শিল্পীরা। সাধারণত সাদা, সোনালি, কালো, ন্যুড আর প্যাস্টেল রং বেছে নেওয়া হয়। দুভাবেই ব্যবহার করা যায়। একটি নির্দিষ্ট নখের কেন্দ্রীয় মোটিফ হিসেবে; আবার নখের একদম ওপরের দিকে অর্ধবৃত্তের মতো করেও। এই মূল মোটিফকে সঙ্গত দিতে ওস্তাদ ডটস, পেইজলি আর আঙুর ফলের নকশা। এই মোটিফে প্রশান্ত মন, সম্পূর্ণতা আর কেন্দ্র প্রকাশিত হয়।
জালি
জ্যামিতির জমিন থেকে পাওয়া মোটিফের মধ্যে জালি বহুল ব্যবহৃত। একসময় মোগল রাজবাড়ির নকশায় জালির ব্যবহার ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাজমহলের জানালা, মসজিদের দেয়াল বা অলিন্দে এই নিখুঁত কাটাকাটি দেখা যায়। সেখান থেকে নখ সাজাতে ষড়ভুজ, আকাশের তারা, ফুলের জালির নকশায় দেখা যায় এই মোটিফ। নখে এর সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে স্নিগ্ধ সাদা, সোনালি আর কালোর ব্যবহারই বেশি দেখা যায়। যেকোনো নখেই এই নকশা করে নেওয়া যেতে পারে অনায়াসে। নেইল ফয়েল, জেলের ব্যবহার করে থ্রিডি রূপ দেওয়া হয় অনেক নকশায়। জালি মোটিফের দর্শনে শিল্প, রহস্য আর সৌন্দর্য একসঙ্গে মিশে থাকে। আংটি বদল, কাবিনের মতো আয়োজনে চোখে পড়ে বেশি। এই দুয়ের সঙ্গে বুটি মোটিফ ব্যবহার করার প্রবণতা দেখা যায়। পুরোনো জামদানির নকশায় পাওয়া যায় বুটিদার নকশা। মোগল সাম্রাজ্যে মসলিনের উত্তরাধিকার নিয়ে আসা এই মোটিফের জয়জয়কার ছিল সবখানে। নখ সাজানোর মন্ত্রেও যুক্ত হয়েছে এটি। ব্রাইডের নেইল বেডে জায়গা করে নিচ্ছে।
রঙে রঙিন
নখে মোগল ভাইব পেতে হলে শুধু নকশা এঁকে নিলেই চলবে না; রং নির্বাচনেও থাকা চাই সচেতন। জুয়েল টোন সেই সময়ের রাজশিল্পীদের অতি পছন্দের বিষয় ছিল বলেই ধারণা করা হয়। রংগুলোও তাই অনেকটা সেই কালার প্যালেট থেকে খুঁজে বের করা। পান্না, রুবি, নীলকান্তমণির রং থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে রাঙানো হয় নেইল আর্টের নকশা। এইগুলোই মূল রং হিসেবে বেশি গুরুত্ব পায়। অনেকে বেইসে ব্যবহার করে থাকেন ন্যুড, আইভরি আর গোল্ড ফয়েল। ডিজাইন ডিটেইলিংয়ের জন্য কালো রং এখানে ব্যবহার করা হয়। সাজিয়ে তোলার অনুষঙ্গ হিসেবে মিরর ওয়ার্ক, কুন্দন, মুক্তাও পায় প্রাধান্য।
পাশ্চাত্য থেকে আসা বহু নকশার রাজত্ব দেখা গেছে দীর্ঘ সময়। এখন সেখানে পরিবর্তনের হাওয়া। ফ্যাশনপ্রেমীরা নিজস্বতা খোঁজেন। এআই বিউটি আর কে বিউটি পেরিয়ে নতুন সময়ে পা রেখেছেন ফ্যাশনিস্তারা। তারা বুঝতে শুরু করেন, আত্মপরিচয়ের অলংকরণে অনন্যতার নিশ্চয়তা মেলে। তাই উপমহাদেশের স্বর্ণযুগের ইতিহাসে ভরসা। রাজকাহন থেকে নিয়ে আসা নকশায় বর্তমানে বাজিমাত।
সারাহ্ দীনা
ছবি: সংগ্রহ
