কভারস্টোরি I দ্য স্টাইল শিফট
মিলেনিয়াল ও জেনারেশন জেড—এই দুই প্রজন্মের ফ্যাশন সেন্স, দৃষ্টিভঙ্গি, প্রযুক্তির প্রভাব একে অপরের থেকে আলাদা হলেও তাদের স্টাইল আলোচনায় সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। মিলেনিয়ালাদের কাছে যেখানে মিনিমালিজম ও সংস্কৃতির ছাপ গুরুত্বপূর্ণ, জেনারেশন জেড সেখানে বিদ্রোহ ও আত্মপ্রকাশে বিশ্বাসী। বাংলাদেশি প্রেক্ষাপটে দুই প্রজন্মই ফ্যাশনশিল্পে বড় ক্রেতা-গোষ্ঠীতে পরিণত। নতুন ফ্যাশন উদ্যোগ ও সাব-ব্র্যান্ড তৈরিতে তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। লিখেছেন সারাহ্ দীনা
খটমট গুরুগম্ভীরে এবারের শুরু। সে কেমন? সামাজিক বিজ্ঞান বই আর ফ্যাশন—এই দুইকে বসানো হচ্ছে পাশাপাশি। স্কুলের পাঠ্য বইয়ের অতি চেনা লাইন—মানুষ সামাজিক জীব। সেই ছোট্টটি থেকেই জেনে আসা। বাক্যটি মূলত সমাজবিজ্ঞানী ও দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতবাদ। এই সামাজিক জীবেরা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে মানসিকভাবে। এই পরিবর্তন বিশ্লেষণের জন্য গবেষকেরা প্রজন্মভিত্তিক ভাগ শুরু করেন। প্রজন্ম বা জেনারেশন ধারণাটি গেল শতকের বিশের দশকের। এসব গবেষণাপত্রে পাওয়া তথ্যমতে কাছাকাছি সময়ে জন্ম নেওয়া মানুষদের মানসিকতা ও মূল্যবোধে বেশ মিল থাকে; যা অনেক সময় ঐতিহাসিক ঘটনা, যুদ্ধ, প্রযুক্তির অগ্রগতি ও রাজনীতির মাধ্যমে প্রভাবিত হয়। বর্তমান সময়ের আলোচিত দুই প্রজন্ম এবারের আলোচনায় অতি গুরুত্বপূর্ণ। কারা তারা? মিলেনিয়াল আর জেনারেশন জেড। ব্যাপক বয়ানের আগে তাদের সময়কাল বাতলে নিলে বুঝতে সহজ হতে পারে। প্রথমে আসে মিলেনিয়াল। ১৯৮১ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে যাদের জন্ম, তারা। আর যারা এর পরবর্তী অধ্যায়, তারা জেনারেশন জেড। ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সাল—এই সময়কালে জন্মগ্রহণকারী। মিলেনিয়াল আর জেনারেশন জেড কোনো ঘোষণা ছাড়াই প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের দ্বন্দ্ব, সৌহার্দ্য—সবেতেই আবেগের উচ্ছ্বাস।
ফ্যাশন দুনিয়াতে বহু ট্রেন্ডই ফিরে ফিরে আসে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পুরোপুরি কর্পূরের মতো উবে যায় খুব কম ট্রেন্ড। মিলেনিয়াল আর জেনারেশন জেড—দুই প্রজন্মের ক্ষেত্রেও তাই-ই হয়েছে। মিলেনিয়ালরা যেমন তাদের পূর্বসূরি জেনারেশন এক্সের কাছ থেকে উত্তরাধিকারী হিসেবে নানান কিছু পেয়েছেন, একই রকম ঘটনা জেন-জিদের সঙ্গেও ঘটেছে। দুই দলেরই আছে বেশ কিছু মিল; তবে অমিলও অগুনতি!
অন্য ভুবন
দুই প্রজন্মের মাঝে হাজার রকম পার্থক্য। মিলেনিয়াল আর জেন-জি। যেন দুই ভিন্ন দুনিয়ায় বসবাস তাদের। সেটা অবশ্য সব প্রজন্মেই দেখা গেছে। পরের জেনারেশন নিয়ে সন্তুষ্টির সাক্ষী কোনো কালেই পাওয়া যায়নি; বরং নিয়ম করে শোনা গেছে অভিযোগ। পরের প্রজন্মকে দিয়ে ‘কিসসু হবে’ না, এই সূত্রে বিশ্বাস ছিল, আছে, হয়তো থাকবেও! ফ্যাশনে সময়ের ছায়া বড্ড স্পষ্ট। জীবনযাত্রার মান, জাঁকজমক কেমন ছিল, তা বুঝতে তাই ফ্যাশন অ্যালবামে চোখ রাখেন অনেকে। কারণ, ফ্যাশন মূলত যাপিত জীবনের গল্পটাই বলে।
ক্যালেন্ডারে ২০২৫ সাল। মিলেনিয়ালরা ত্রিশ থেকে চল্লিশোর্ধ্ব। আর জেন-জি? তারাও প্রায় ত্রিশের দৌড়ে। একদম শেষ সময়ে তাড়াহুড়ো করে এই দলে ভিড়েছেন যারা, অর্থাৎ যাদের জন্ম ২০১২ সালে, তারাও এখন টিনেজার। ছোট্টটি নেই আর। ফ্যাশন নিয়ে ভাবনার ঠিক দ্বারপ্রান্তেই তারা। তাই ২০২৫ সাল ফ্যাশন বিশ্বের জন্য বিশেষ এক সময়। দুই প্রজন্মের ভাবনার বহিঃপ্রকাশে দ্রুত লয়ে হচ্ছে পটপরিবর্তন। প্রযুক্তির প্রভাবও এখানে হিসাবের বিষয়। কারণ, এখন অবধি যত প্রজন্ম এসেছে, তাদের মধ্যে মিলেনিয়াল আর জেনারেশন জেড প্রযুক্তিগত দিক থেকে সবচেয়ে বেশি আশীর্বাদপুষ্ট। প্রযুক্তিতে মুনশিয়ানায় সমানে সমান দুই পক্ষই। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফ্যাশন নিয়ে আলোচনার ঝড়ের কারিগরের তালিকায় জেন-জির সংখ্যাই বেশি।
স্টাইল-অ্যাসথেটিক বদল
মিলেনিয়ালদের সময়ে দারুণ জনপ্রিয় অ্যাসথেটিক ছিল ওয়াই টু কে, বোহো, নর্ম কোর, মিনিমালিজম, কটেজ কোর, প্রেপি স্টাইল। নিরীক্ষার দারুণ প্রয়োগ দেখা গেছে সে সময়টাতে। ব্যক্তিস্বাধীনতাও অতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। অন্যের নয়, বরং নিজের পছন্দে পোশাক পরার চল শুরু সে সময়। ডিজিটাল ইনফ্লুয়েন্স ছিল অন্যতম আলোচনার বিষয়। নব্বইয়ের দশকের শেষ থেকে ২০১০, এই প্রজন্ম স্টাইলকে কালচারাল রেফারেন্সের মুড বোর্ড হিসেবে ধরে রেখেছে। শুধু আন্তর্জাতিক ফ্যাশন বিশ্ব নয়, আমাদের দেশের লোকাল মার্কেটেও দেখা গেছে এর প্রভাব। ওয়াই টু কের লো রাইজ জিনস, বেবি টি-শার্ট আর রাইনস্টোনের জুয়েলারির জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। সফট গ্রাঞ্জ কোরের আগমনে টি-শার্টের স্লোগানে প্রতিবাদী হয়ে ওঠার চল এ সময়ের। হিপস্টার ওয়েভে ভিনটেজ আর ইন্ডি মিউজিক থেকে প্রাণিত স্টাইলের চর্চাও ছিল তুমুল। বোহো শিক দাপিয়ে বেড়িয়েছে সগর্বে। কী তার বৈভব! বোহিমিয়ানদের যাপিত জীবন সেখানে কাজ করেছে অনুপ্রেরণা হিসেবে। ফেস্টিভিটি আর স্পিরিচুয়ালিটির সন্ধি ঘটেছে। অ্যান্টি-ফ্যাশন রেভল্যুশন এসেছিল নর্ম কোরের হাত ধরে। সেখানে ড্যাড স্নিকার আর প্লেইন টিতে হয়েছে বাজিমাত। মিনিমালিজম রাজত্ব করেছে দীর্ঘ সময়। এই কোরের নিউট্রাল টোন, ক্লিন লাইন এবং কোয়াইট লাক্সারির দাপট এখনো রয়ে গেছে মিলেনিয়ালদের যাপিত জীবনে। এই প্রজন্মের ফ্যাশনকে এক লাইনে বয়ান করলে বলতে হবে, এরা ব্যক্তিত্ব, আবেগ আর নিজের সকল দ্বন্দ্বকে একই সঙ্গে ধারণ করেছেন।
জেনারেশন জেডদের ফ্যাশনে অ্যাসথেটিক হিসেবে পাওয়া যায় ওল্ড মানি অ্যাসথেটিক, স্ট্রিট স্টাইল মিটস লাক্সারি, পিন্টারেস্ট পারফেক্ট প্রেপি স্টাইল, দ্য ক্যাজুয়াল ইয়েট ক্লাসি ভাইব, ওয়াই টু কে অ্যান্ড নস্টালজিয়া। জেনারেশন জেডের ফ্যাশন অ্যাসথেটিকের মূলে খুঁজে পাওয়া যায় তরলতা। প্রয়োজন অনুযায়ী পাত্রের আকার ধারণের গুণ যেমন তরলের থাকে, তেমনই আছে এই প্রজন্মের ফ্যাশন সেন্সে। পাশাপাশি বিদ্রূপতাকেও যে ফ্যাশনে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, সেই বিষয়ে দেখিয়েছে মুনশিয়ানা। ডিজিটাল রিমিক্স কালচার এখানে এসে ডানা মেলতে পেরেছে আপোসহীনভাবে। সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টিকটক, পৃথিবী আর পরিবেশ নিয়ে দুশ্চিন্তা, রাজনীতি, ডিজিটাল রিমিক্স কালচার। তবে এরই মাঝে তারা বিভিন্ন দশক থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ফ্যাশন নিয়ে নিরীক্ষা করে যাচ্ছেন। জেন্ডার কোডকে দেখাচ্ছেন বুড়ো আঙুল। সামাজিক শৃঙ্খলের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান, বিদ্রোহ ও আত্মযত্ন—সবই তারা ফ্যাশনে প্রকাশের চেষ্টা করেছেন।
জেন-জিদের সময়ে ই-গার্ল/ই-বয় নিয়ে এসেছে লেয়ারিং আইডিয়া। কটেজকোর ও ফেইরিকোরে দেখা মিলছে সফট টোন, প্রকৃতিপ্রাণিত নকশা। ওয়াই টু কে ফিরে এসেছে লো রাইজ জিনস, ব্যাগেট ব্যাগ আর বাটারফ্লাই ক্লিপ নিয়ে। টেকওয়্যার আর জেন্ডারলেস ফ্যাশন এই প্রজন্মের মাধ্যমে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এই দুই বিষয়ের ভাবনা মিলেনিয়ালদের ফ্যাশনে সেভাবে দেখা না গেলেও, পরবর্তী প্রজন্মকে দেখা গেছে সাদর আমন্ত্রণ জানাতে। তবে কোনো একটি নির্দিষ্ট অ্যাসথেটিক নিয়ে মেতে থাকার ইচ্ছা কখনোই জেনারেশন জেডদের মাঝে দেখা যায়নি; বরং তাদের ওয়্যারড্রোব প্ল্যানিংয়ের বড় জায়গাজুড়ে সব সময় আছে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ব্যতিক্রমতা। হাস্যরসাত্মক মিমকে তারা ফ্যাশনে অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। আবার একই সঙ্গে তারা টেকসই তত্ত্বের বিষয়ে এবং প্রকৃতিকে সুস্থ রাখতে সচেতন। তাই ধরিত্রীর ক্ষতি হয় এমন কিছুতে তাদের সায় নেই বলা যেতে পারে। আরও একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। জেনারেশন জেড পোশাকের মাধ্যমে শুধু নিজেদের সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে চায় না; চায় ফ্যাশন স্টেটমেন্ট তৈরি করে বিশেষ হয়ে থাকতে।
মিডিয়া অ্যান্ড ইনফ্লুয়েন্স
মিলেনিয়াল
মিলেনিয়ালদের শৈশব-কৈশোরে টেলিভিশন ও সিনেমা হলের কনটেন্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তারা একই সঙ্গে ইন্টারনেটহীন জীবন এবং প্রযুক্তির রমরমা সময়ের সাক্ষী। তাই তাদের ফ্যাশনে অভিনেতা-অভিনেত্রী, গায়ক-গায়িকাদের বেশ প্রভাব পরিলক্ষিত। যেমন রিয়ানা, কিম কারদাশিয়ান, বিয়ন্সে, লেডি গাগা, জেন্ডায়া, এমা ওয়াটসন, জিজি হাদিদ, ভিক্টোরিয়া বেকহাম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগ বিশ্বকে আরও কাছাকাছি নিয়ে আসে। মুহূর্তের মধ্যে নিজ নিজ মতামত জানিয়ে দেওয়ার শুরুটা সেখানেই। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম আর পিন্টারেস্ট ধীরে ধীরে ফ্যাশনের ডমিনেন্ট সোর্স হয়ে ওঠে। এর ধারাবাহিকতায় ফ্যাশন ব্লগ আর ইউটিউব চ্যানেল। ইনস্টাগ্রাম ইনফ্লুয়েন্সারের জার্নির শুরুয়াতও মিলেনিয়ালদের হাত ধরে। এই প্রজন্মের ফ্যাশন-সচেতনদের জন্য ম্যাগাজিন ছিল পরম আকাঙ্ক্ষিত। কারণ, সেখানে পাওয়া যেত তারকাদের ছবি। ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাতে ওলটাতে ডিভাইসের স্ক্রিনে স্ক্রল করে নিউজ পড়ে নেওয়ার অভ্যাসও তৈরি করতে হয়েছে তাদের। রিয়েলিটি টিভি শোর জনপ্রিয়তা এ সময়ের দর্শকদের মাধ্যমে। সেখানে তারকাদের দীর্ঘ সময় দেখার ফলাফল ফুটে উঠত ফ্যাশনিস্তাদের পোশাকে। ফ্যাশন এভাবেই ধীরে ধীরে বিনোদনের অংশ হয়ে ওঠে। এর বাইরে রেড কার্পেটে তারকাদের উপস্থিতিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। মিডিয়ার হাত ধরে ফাস্ট ফ্যাশনের গতি বেড়েছে। প্রতিবার নতুন পোশাকে ক্যামেরার সামনে হাজির হওয়ার চেষ্টা সেখান থেকেই। জেন-জি ক্রস ওভারের ঠিক আগে আগে টিকটকের সঙ্গে পরিচয় ঘটে মিলেনিয়ালদের। ফ্যাশন হ্যাকস, থ্রিফট শপিং, স্টাইল চ্যালেঞ্জের প্রতি অনুরাগ এখান থেকে শুরু।
জেনারেশন জেড
জেনারেশন জেড মূলত যখন বুদ্ধিবৃত্তিক গ্রোথের দিকে পা বাড়িয়েছে, তখনই তার জগতে ইন্টারনেটের বিস্তরণ ঘটেছে। টিকটকের আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এই প্রজন্ম। তাদের ফ্যাশন সুপার পাওয়ার হিসেবে জায়গা করে নেয় এই সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম। উইসডম কায়া, নাভা রোজ ও বেস্টড্রেসডের মতো ফ্যাশন কনটেন্ট ক্রিয়েটর অ্যাকাউন্টের ফলোয়ার বাড়তে থাকে দ্রুত লয়ে। ভাইরাল হয় গেট রেডি উইদ মি ধরনের স্টাইলিং ভিডিও কনটেন্ট। ইনস্টাগ্রামও তাদের পছন্দের তালিকায় আছে। আনফিল্টারড, ক্যাজুয়াল কনটেন্ট দিতে পছন্দ করে এই প্রজন্ম। ইউটিউব আর ভ্লগস তাদের ফ্যাশন সেন্স উন্নত করতে ভূমিকা রেখেছে। পিন্টারেস্টেও তারা মুড বোর্ড তৈরি করে থাকেন। রিয়েল লাইফ ইনফ্লুয়েন্সারদের প্রতি আছে আকর্ষণ। তবে সত্যতার বাইরে কাল্পনিক কোনো কিছুতে আগ্রহ একেবারেই কম। এই প্রজন্মের হাত ধরে বিপ্লবও সংযুক্ত হয়েছে ফ্যাশনে। বডি পজিটিভিটি, জেন্ডার ফ্লুইডিটির মতো বিষয় ফ্যাশনের মাধ্যমে সবার সামনে একদম ভিন্ন রকমভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন তারা। মিম কালচার নিয়েও মেতেছেন বহুবার। বিদ্রূপাত্মক বহু বিষয়কে তারা ফ্যাশনে অন্তর্ভুক্ত করেছেন, যেগুলোকে বর্ন ফ্রম মিমজ বলা হয়। আবার মব ওয়াইফ অ্যাসথেটিকও এসেছে এভাবে।
মিলেনিয়ালদের মতো জেন-জিরাও সেলেবদের কাছ থেকে প্রাণিত হয়েছেন। জেন্ডায়া এই দুই প্রজন্মের কমন ফ্যাশন ইন্সপিরেশন। তালিকায় আরও আছেন বিলি আইলিশ, কাইলি জেনার, দোজা ক্যাট, অলিভিয়া রড্রিগো, ব্ল্যাক পিংক।
ফ্যাশন ভ্যালু অ্যান্ড শপিং হ্যাবিট
অনলাইন শপিংয়ের প্রথম ক্রেতা ছিল মিলেনিয়াল জেনারেশন। কিন্তু সেটা তারা প্রথম থেকে পেয়েছেন এমন নয়। বরং অ্যাডপ্ট করে নিয়েছেন; অর্থাৎ তাদের শিখতে হয়েছে। আর জেনারেশন জেড জন্ম থেকে মোবাইল-ফার্স্ট শপিংয়ে অভ্যস্ত। তারা মুঠোফোনের পর্দাতেই সবকিছু কিনতে শিখেছেন।
মিলেনিয়ালদের শপিং স্টাইলে ব্রাউজিং আর প্ল্যানিং—দুই-ই কাজ করে। তার পরের প্রজন্ম কেনাকাটার সময়ে আবেগের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। অনেক সময় তারা তেমন কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই কেনাকাটা করেন। আবার মিলেনিয়ালরা অ্যাপ, ওয়েবসাইট ও স্টোরে গিয়ে কেনাকাটা করতে পছন্দ করেন। আর মিলেনিয়ালদের মাঝে দেখা যায় সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শপিং সেরে নেওয়ার আগ্রহ। অর্থাৎ এসব প্ল্যাটফর্ম তারা সার্চ ইঞ্জিন হিসেবেও ব্যবহার করেন। মিলেনিয়ালরা রিভিউ, ব্লগ, ইনফ্লুয়েন্সারদের কনটেন্ট ভরসা করে সিদ্ধান্ত নেন। জেন জিরা টিকটক ট্রেন্ডস, রিলস থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে থাকেন। মূল্যবোধেও পাওয়া যায় পার্থক্য। উচ্চ মানের পণ্যের জন্য খরচে আগ্রহী হন মিলেনিয়ালরা। আর এর পরের প্রজন্ম আনকোরা, নকশা একদম আলাদা ও টেকসই এমন পোশাক বেছে নেয়। ব্র্যান্ড লয়ালিটি মোটেই দেখা যায় না জেনারেশন জেডের মধ্যে। তারা ট্রেন্ড দেখে সিদ্ধান্ত নেন বেশির ভাগ সময়। বায়িং ট্রিগার বর্তমান ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে। মিলেনিয়ালদের মধ্যে ফ্লাশ সেল, ইমেইল প্রমোশন, লয়ালিটি পয়েন্টসের মাধ্যমে কেনাকাটা আগ্রহ তৈরি করে। জেনারেশন জেডের বায়িং ট্রিগারের পেছনে কাজ করে ভাইরাল ট্রেন্ড, ফিয়ার অব মিসিং আউট, অ্যাসথেটিক ও ইনফ্লুয়েন্সার পিক। টেকসই তত্ত্বের দিকে মিলেনিয়ালরা অনেক সময়ে সমঝোতা করলেও এ ক্ষেত্রে জেনারেশন জেড খুব সচেতন। ইকো-কনশাস, এথিক্যাল ব্র্যান্ড—এসবে তাদের বিশ্বাস। জেনারেশন জেডের কেনাকাটার ক্ষেত্রে আরও একটি বিষয় কাজ করে। তারা এআই টুল, ভার্চুয়াল স্টুডিওর প্রতি আগ্রহী। ডিজিটাল ক্লথিং ড্রপ, মেটাভার্স ফ্যাশন শো তাদের কাছে খুব পরিচিত বিষয়; যা মিলেনিয়ালদের জন্য একদম নতুন কনসেপ্ট।
মিলেনিয়াল X জেনারেশন জেড
বেশ কিছু ফ্যাশন আইটেম আছে, যা দুই প্রজন্মই ব্যবহার করে যাচ্ছে। এসব পোশাকের তালিকায় আছে লং সক, লো রাইজ জিনস, টিনটেড সানগ্লাস, হেয়ার বো, ইলেকট্রিক কালার প্যালেট, ক্রকস, গ্রাফিক টি, স্পোর্টস ওয়্যার, মিনি স্কার্ট। নাইনটিজের শেষ ও টোয়েন্টিজের শুরুর দিকে এসব আইটেম ব্যবহার শুরু করেছিলেন মিলেনিয়ালরা। আবার, এত বছর পরে ফিরতি যাত্রা জেনারেশন জেডদের সঙ্গে নিয়ে। যদিও এবারের তরুণদের দাবি, তারাই নাকি সেরা স্টাইলিং সম্পন্ন করতে পেরেছেন। তারাই যুগোপযোগিতায় এগিয়ে। নিজেদের সেই ধারণার সাপোর্টে বেশ কিছু যুক্তিও হাজির করেছেন তারা। তাদের মতে মিলেনিয়ালদের ফ্যাশন সেন্সে বেশ কিছু ভুল রয়েছে। যেগুলোকে তারা ভুল হিসেবে নয়, ফুল হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এর মধ্যে আছে মিলেনিয়ালরা বডি টাইপ বুঝে পোশাক বেছে নেননি, নেন না। আবার, বয়সকেও মাথায় রেখে পোশাক পরিকল্পনা করেন না। তারা চেষ্টা করেন তারুণ্যকে ধরে রাখতে। বেসিককে বাদ দিয়ে অতিরঞ্জনে দেন মনোযোগ। কারণ, বেসিক মূলত বোরিং বলেই বিবেচিত। অলংকার নির্বাচনেও তাদের নাকি দূরদর্শিতার অভাব আছে। তারা নাকি জানেনই না, আরাম আর স্টাইল একই সঙ্গে বসবাস করতে পারে। এই-ই শেষ নয়, আরও আছে। মিলেনিয়ালরা নাকি নিজের জন্য সাজেন না, অন্যের মনমতো নিজেকে সাজান!
প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ
বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৪৪ শতাংশের বয়স ১৩ থেকে ৪০। অর্থাৎ এর মাঝেই আছে মিলেনিয়াল ও জেনারেশন জেড। এই বিপুল সংখ্যার প্রভাব রয়েছে ফ্যাশন বাজারে; যা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। মিলেনিয়ালদের সময়ের রমরমা ফ্যাশন লেবেলের অনেকগুলো চিরদিনের জন্য ঝাঁপ নামিয়েছে। আবার নতুনেরও ঘটেছে উত্থান। মিলেনিয়ালদের হাত ধরে এ দেশের ফ্যাশন বাজারে ডিজাইনার ওয়্যারের চাহিদা শুরু হয়। বিবি রাসেল, চন্দ্র শেখর সাহা, মাহিন খান, আনিলা হক ধারণ করেছিলেন সেই পথের আলোকবর্তিকা। এরপরে দীর্ঘ সময় বাজার ধরে রেখেছে দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলো। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আড়ং, কে ক্র্যাফট, অঞ্জন’স, বাংলার মেলা, রঙ, নিপুণ। রাজধানীর বেইলি রোড, ধানমন্ডি, বনানী, গুলশান ও বসুন্ধরা সিটিকে কেন্দ্র করে কলেবর বাড়তে থাকে এই লোকাল ফ্যাশন মার্কেটের। ২০০১ সালে শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে ব্যবসা শুরু করে নিত্য উপহার; যা অনেকটাই বদলে দেয় ঢাকার মধ্যবিত্ত তরুণের ফ্যাশন। গোল গলা রঙিন গেঞ্জিতে সৃজনশীল নকশা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। একের পর এক শোরুম হতে শুরু করে সেখানে। তরুণদের পছন্দের জায়গায় পরিণত হয়। আবার, করোনাকালে দেখা যায় অনলাইন কেনাকাটায় আগ্রহ। ব্যবসায়ীরাও ক্রেতাদের চাহিদা বুঝে অনলাইনে হাত পাকিয়ে নিয়েছেন। বিভিন্ন রকম ছাড় ক্রেতা আকর্ষণে ভূমিকা রাখছে। বেশ কিছু তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান দেশের বাজারে রিটেইল শপ নিয়ে এসেছে। সেসব পোশাকেও আগ্রহ দেখিয়েছেন মিলেনিয়ালরা। এই বয়সীরা বিয়ের পোশাকের জন্য শপিং মলে না ঘুরে ব্রাইডাল ডিজাইনারদের কাছে যেতে শুরু করেন। পাশাপাশি নিজেদের তাঁতশিল্প বাঁচাতেও তারা ভূমিকা রাখেন। জামদানি শাড়ি বেছে নিয়েছেন অনেক মিলেনিয়াল কনে; যা আদতে বাংলাদেশের বিয়ের বাজারকে উপকৃত করেছে।
সময়ের সঙ্গে ফ্যাশনের পরিবর্তনকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে বাংলাদেশের ফ্যাশন বাজার। যার প্রমাণ পাওয়া যায় প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডগুলোর শুধু তরুণ ক্রেতাদের আকর্ষণ করার উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরি করা সাব-ব্র্যান্ড থেকে। আড়ংয়ের তাগা, কে ক্র্যাফটের ইয়াং-কে, সারার ঢেউ এই ঘরানার উদ্যোগ।
জেনারেশন জেডদের পছন্দ নিয়েও কাজ হচ্ছে। থ্রিফট শপিং এখন করা যাচ্ছে ফ্যাশন উদ্যোগেও। আবার প্রি লাভড প্রোডাক্ট কেনাতেও মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। ইদানীং ভাড়ায়ও মেলে এমন পোশাক। এক দশক থেকে বিভিন্ন স্থানে আয়োজিত মেলা থাকছে আলোচনায়। অনেকে এসব মেলায় হাজির হচ্ছেন আনকোরা ফ্যাশন পণ্যের খোঁজে। ঢাকার ফ্যাশনিস্তাদের মাঝে এসব ফ্যাশন ইভেন্ট বেশ জনপ্রিয়। ফ্যাশন উইকেও আগ্রহ বাড়ছে দিন দিন। ঢাকা মেকারস, আরকা ফ্যাশন উইকসহ আরও বেশ কিছু ইভেন্ট সাড়া তুলতে পেরেছে। যার টার্গেট অডিয়েন্স মূলত জেন-জি। মাল্টি-ব্র্যান্ডেড প্ল্যাটফর্মের চাহিদা বেড়েছে। এই প্রজন্ম যেহেতু স্বাধীনচেতা, তাই তারা একই ছাদের নিচে অনেক ধরনের ব্র্যান্ডের রাজত্বকে বেশ ইতিবাচকভাবে দেখেন।
সমাপ্তিবিন্দু
মিলেনিয়ালদের আত্মপ্রকাশের ফ্যাশন ছিল নিজস্বতার, আর জেনারেশন জেডের স্টাইল প্রতিবাদ ও নিরীক্ষার। একসময় যে ট্রেন্ড ছিল ঐতিহ্য, এখন তা হয়ে উঠছে পুরোনোর মোড়কে নতুন কিছু। প্রযুক্তি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মূল্যবোধের ওপর দাঁড়িয়ে দুই প্রজন্মের ফ্যাশন ধারণা তৈরি করেছে নিজ নিজ ভাষা। বাংলাদেশে এই দুই প্রজন্ম ফ্যাশনের বাজারে এখন অবধি সবচেয়ে প্রভাবশালী। এর কারণ তাদের অভিনব চাহিদা ও ক্রয়ক্ষমতা। তাই ভবিষ্যতের ফ্যাশনে এই দ্বৈরথই সম্ভবত সৃষ্টি করবে নতুন ধারা।
দ্য ওল্ড স্কুল ডিভা
নাজিফা তুষি
আমার জন্ম জেনারেশন জেডের একদম শুরুতে। তাই হয়তো মনে মনে খানিকটা মিলেনিয়াল আমি। পুরোটা কোনোটাই নই। তাই নিজস্বতা আঁকড়ে ধরেই আমার পথচলা। কৈশোরে আমার আলাদা করে কোনো তারকার ফ্যাশনের প্রতি আগ্রহ ছিল না। আমাকে আকৃষ্ট করত সাহস। সাহসী ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হতাম। এরপরের অধ্যায়ে আমি ওল্ড স্কুল। যেমন আমার প্রিয় পোশাক শাড়ি। এর কারণ শাড়িকে স্টাইলিং করা যায় নানাভাবে। এটি একঘেয়ে পোশাক নয় মোটেই। খুব সাধারণ অথবা আবেদনময়—দুই ধরনের লুকই তৈরি করতে পারে এই বারো হাত বুননের পোশাক। কখনো যদি আমাকে স্যুটকেসে শুধু একটা পোশাক নিতে বলা হয়, তখনো শাড়িই থাকবে সেখানে। এটাই আমার সব সময়ের গো-টু ড্রেস। এর বাইরে জিনস আর টি-শার্ট আমাকে আরাম দেয়। কৈশোর পেরিয়ে দুরন্ত বিশের পরে বয়সের ক্যালেন্ডারে ত্রিশ আসুক কিংবা চল্লিশ, আমি থেকে যেতে চাই একই রকম। প্রাণবন্ত। আর তখন আমার ওয়্যারড্রোব প্ল্যানিং যে বদলে যাবে পুরোটা, তা কিন্তু নয়। বরং তখনো শাড়িতেই সুন্দর থাকতে চাই। ফোরটি হতেই পারে আমার নিউ থার্টি! প্রিয় তারকা কৈশোরে ছিল না বলে এখনো নেই, তা নয়। এখন তালিকায় আছে একাধিক নাম। অড্রি হেপবার্ন আর স্কারলেট জোহানসন আছেন একদম ওপরের দিকে। আমি লাক্সের ব্যানারে এসেছিলাম এই ইন্ডাস্ট্রিতে। সেখান থেকে আজ অবধি চলার পথে নিজস্বতাই আমাকে ফ্যাশন সচেতন করে তুলেছে। এমনই থাকতে চাই। আত্মবিশ্বাস আর স্বকীয়তা নিয়ে।
মডেল: নাজিফা তুষি
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: সানায়া কুটর বাই সানায়া চৌধুরী
ছবি: কৌশিক ইকবাল
