skip to Main Content

ছুটিরঘণ্টা I নীলাম্বরী শেফশাওয়েন

মরক্কোর ব্লু সিটি। নীল রঙে সাজানো মহাকাব্যিক এক পৃথিবী। ঘুরে এসে লিখেছেন ফাতিমা জাহান

মনে হলো, যেন আকাশের একটি টুকরো এসে জড়ো হয়েছে মাটিতে। একটাই রং—নীল। যদি আকাশ থেকে নেমে ধরণীর বুকে ঠাঁই নেয়, তাহলে তাকে আকাশের অংশই বলা যাবে। এর চেয়ে মূল্যবান এখন আমার কাছে আর কিছু নয়! দূর থেকে একরাশ সবুজ পাহাড়ের মাঝে এক টুকরো নীল রং দেখিয়ে গাড়িচালক বললেন, ‘ঐ যে দেখো, ব্লু সিটি শেফশাওয়েন।’ আমি ব্লু সিটি দেখি বা না দেখি, দেখতে পাই আমার সামনে বৃষ্টির ধারার মতো আকাশ নেমে এসেছে। দূর থেকে আকাশ এত মোহময়, কাছে গেলে কে জানে কেমন হবে দেখতে!
মরক্কোর শেফশাওয়েন শহরের ভেতর দিয়ে গাড়ি চলছিল আর মনে হচ্ছিল, এই বুঝি একটি বড় নীল তোরণ এবং তার সঙ্গের নীল দরজা খুলে যাবে; খুলে দেবে অসীম নীল আকাশের জগৎ। আকাশে ওড়ার ইচ্ছা মানুষের আদিকাল থেকে। কিন্তু আমি যে আকাশেই থাকতে চাই! আকাশের নীলে বসবাস করার উপায় থাকলে নির্ঘাৎ সে আবাসই বেছে নিতাম।
এখন শেফশাওয়েন ব্লু সিটির সামনে গাড়ি থামিয়ে গাড়িচালক বললেন, ‘ভেতরে গাড়ি যাবে না; তোমাকে হেঁটে ব্লু সিটি দেখতে হবে।’ হেঁটে হেঁটে শহর দেখার চেয়ে আনন্দের আর কিছুই হয় না। আমি সামনের তোরণের দিকে পা বাড়ালাম। শেফশাওয়েনের ব্লু সিটি আসলে পুরোনো শহর, মরক্কোয় যাকে মেদিনা বলে। এ দেশের প্রতিটি শহরেই মেদিনা আছে। তবে এ শহরের মেদিনায় আকাশ নেমে এসেছে; মাটি থেকে নীলকান্তমণি পাথর থরে থরে সেজেছে শহরটির জন্য।
তোরণ পেরিয়ে এগোলে আর এই জগতে থাকার মতো বাতাবরণ রইল না! এ এক অন্য জগৎ; নীলা পাথরের ভুবন ভোলানো দুনিয়া। ডানে, বাঁয়ে নীল রঙের সরু গলি চলে গেছে; সামনের চড়াই—সেও কি কম নীল! কিন্তু আমি যে দ্বিধায় পড়ে গেছি, এই নীলকান্তমণি শহরের কোন গলি দিয়ে সফর শুরু করি! কিছু না ভেবে বাঁয়ের গলিতে ঢুকে পড়লাম। এ এক প্রাচীন মহল্লা যেন। পাশাপাশি একতলা, দোতলা বাড়িগুলো নীল রং করা। গলি শেষ হবে; তবু নীল রঙের কিসসা ফুরোবে না। বাড়িগুলোর কাঠের দরজা-জানালায়ও নীল রং করা। নীল রঙে শহর ছড়িয়ে দেওয়ার আইডিয়া যারই হোক না কেন, তার যে শিল্পের প্রতি শ্রদ্ধা আর কোমল রঙের প্রতি অগাধ আস্থা, তা মানতেই হয়।
ব্লু সিটির মূল গলি একটাই। সে গলির ডানে-বাঁয়ে শাখা-প্রশাখার মতো বয়ে গেছে নানা গলি। আমি আবার মূল গলি ধরে এগোলাম। মূল গলিতে পায়ে চলার পথ। এ পথ দিয়ে গাড়ি চলাচল করার নিয়ম নেই। গাড়ি চলাচল করবে কীভাবে, পাহাড়ি চড়াই-উতরাই পথের কোথাও পেবল ওয়ে বা ছোট ছোট পাথর দিয়ে বাঁধানো পথ, সে পাথরের পথেও নকশা কাটা। কোথাওবা সিঁড়ির ধাপে ধাপে উঠে গেছে পথ। গাড়ি চলাচল করতে পারে না বলে এই ছোট্ট পুরোনো শহরে কার্বন ফুটপ্রিন্ট নেই বললেই চলে।
মূল গলির দুপাশে স্যুভেনির শপ। ভেতরে হয়তো মানুষের আবাস আছে। মরক্কোর যেকোনো মেদিনায় মানুষের আবাসের সঙ্গে গলিমুখো দোকান থাকে। একটি দোকানের সামনে দেখি, সারি সারি কার্পেট ঝোলানো; তার সামনে দাঁড়িয়ে এক মরোক্কান বিক্রেতা। তার পোশাক নীল; এ জগতের সঙ্গে মিলিয়ে নীলের বাণিজ্য করছেন যেন। পথ ধরে চলছেন নানা দেশের ট্যুরিস্ট। এদের মাঝে প্রায় সবাই ইউরোপীয়; কিছু মরোক্কান ট্যুরিস্টও আছেন অবশ্য। সঙ্গে মহল্লার লোকজনের আনাগোনা তো আছেই। এই নীলাম্বর শহরে ট্যুরিস্টদের থাকার জন্য অল্প কিছু হোটেল রয়েছে। আর আছে অগুনতি মরোক্কান রেস্তোরাঁ।
আশপাশে যত স্যুভেনির শপ দেখছি, সব কটিতেই সব শোপিস, স্যুভেনির নীল রঙের। আসলেই আজ আকাশ মাটিতে নেমে এসেছে। নীল রঙের দেয়াল, নীলের একটুও বাড়াবাড়ি নেই। আকাশ কখনোই নীল নিয়ে বাড়াবাড়ি করে না। নীল রংকেও কখনো বাড়াবাড়ি করতে দেখিনি। গাঢ, হালকা—যেভাবেই ছড়িয়ে যাক না কেন, তা সব সময় সৌম্য, স্থির। চোখে একধরনের প্রশান্তি বুলিয়ে দেয়।
নীলাম্বরের মতো এই শহর কবে, কেন নীলকে জড়িয়ে নিয়েছে, তা খুব বেশি জানা নেই কারও। ইতিহাস বলে, ১৪৭১ সালে শেফশাওয়েন নগর প্রতিষ্ঠা করেন মুলে আলী বিন রাশিদ। মূলত দেয়ালে ঘেরা এ শহর একটি দুর্গ। পর্তুগিজদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বংশধর মুলে আলী বিন রাশিদ পাহাড়ে এ দুর্গ নির্মাণ করেন। পরবর্তীকালে উত্তর মরক্কোর ব্যারব্যার জনগোষ্ঠী, আন্দালুসিয়ার মুসলমান এবং পর্তুগিজ ইহুদিরা এ শহরে এসে বসবাস শুরু করেন। স্পেন থেকে যখন মুসলমানদের বিতাড়িত করা হয়, তখন মরক্কোর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য শহরের মতো শেফশাওয়েনে এসে তারা বসতি গড়েন। এখানে পাহাড়ের চূড়ায় একটি স্প্যানিশ মসজিদ আছে।
১৯২০ সালে শেফশাওয়েন চলে যায় স্পেনের দখলে। মাঝখানে ফরাসিরাও এ শহরের দখল নিতে চেয়েছিল। ১৯৫৬ সালে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মরক্কো মুক্ত হলে শেফশাওয়েন থেকে দখল তুলে নেয় স্পেন। তখন থেকে এটি মরক্কোর ঐতিহ্যবাহী শহর হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
এ শহরে প্রায় প্রতি গলিতে মসজিদ আছে। হাঁটতে হাঁটতে সবে ছোট গলিতে ছোট একটি মসজিদ পার হলাম। সাধারণত মরোক্কান মসজিদের সামনের ইওয়ান বা প্রবেশপথজুড়ে থাকা কক্ষ মসজিদের আঙিনার প্রথম ভাগে থাকে। স্থান সংকুলান না হওয়ায় এ মসজিদের ইওয়ান দেখলাম গলিতেই করা হয়েছে। ভালোই হলো, বাইরে থেকে ইওয়ানের ছাদের মুরিশ নকশা দেখতে পেলাম। মরক্কোর নিজস্ব বিশেষ জ্যামিতিক নকশাকে বলা হয় মুরিশ শিল্প। এখন মসজিদ বন্ধ বলে বাইরে থেকে দেখতে হলো; যদিও এ দেশে বাইরে থেকে মসজিদের তেমন কিছুই দেখা যায় না।
আশপাশের নীলাম্বরে মোহিত হতে হতে, আরও খানিকটা এগিয়ে দেখি, এখানকার গোলচত্বরে হাজির হয়ে গেছি। এ জায়গাকে বলে উতা হাম্মাম। একসময় জনগণের গোসলখানা ছিল মাঝখানের নীল রঙে রাঙানো ভবনটি। এখন ভবনের চারদিকের দেয়ালে চারটি নল বসানো। একটি নলের কাছে একজন নারী বালতি ভরছেন নলের পানিতে। উতা হাম্মামের ছাদের দিকে সাদা রঙের মুরিশ নকশা করা। পুরো হাম্মামখানায় নীলের ছড়াছড়ি।
এটি যেহেতু চত্বর, তাই চারপাশের অনেক কিছু দেখা যাচ্ছে। এতক্ষণ গলির ভেতরে ছিলাম। কিছু কিছু গলির কিছু অংশ ছাউনি দেওয়া ছিল বলে শুধু গলি আর তার মনোহারিণী নীলাভ দোকানপাট দেখতে হয়েছে। এখন পুরো নীল আসমান আমার দখলে। এক পাশে শেফশাওয়েন মেদিনা আর একটু দূরে সবুজ পাহাড়ের চূড়ায় রয়েছে স্প্যানিশ মসজিদ। স্থানীয় ভাষায় বলা হয় স্প্যানিওল মস্কি। সেখানে যাওয়ার পথ একটাই—পাহাড় বেয়ে ওপরে যেতে হবে। এমনিতেই শেফশাওয়েন শহর সমুদ্রপৃষ্ঠ থাকে ২ হাজার ফুট উঁচুতে দাঁড়িয়ে, এখন আমাকে আরও উঁচুতে উঠতে হবে।
হাম্মাম থেকে নেমে খানিক এগোলেই সরু একটি জলধারা পেরিয়ে, সিঁড়ি বেয়ে পাহাড়ি নুড়ি বিছানো পথ। পথ শুরু হওয়ার আগে এক পাশে সারি সারি পেইন্টিং ঝুলিয়ে রাখা আছে। সাদা ক্যানভাসে নীল রং কিংবা নীল ক্যানভাসে সাদা রং মিলেমিশে শেফশাওয়েনের নীল সুরে সুর মিলিয়ে ডাকছে পথিককে। বলা হয়ে থাকে, প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে এই শহরের সৌন্দর্যবর্ধনের নিমিত্তে নগরপিতা সব বাড়িঘর নীল রং করতে বলেছিলেন। এর আগেই অবশ্য কিছু বাড়িঘরের নীল রং মহল্লার শোভা বাড়িয়ে দিয়েছিল। আর এভাবেই শেফশাওয়েন হয়ে ওঠে ব্লু সিটি বা ব্লু পার্ল অব মরক্কো। নীল মুক্তা সে তো এক দুর্লভ বস্তু; সহজে মেলে না। অথচ এখানে আমি কত সহজেই নীল মুক্তার সন্ধান পেয়ে গেছি!
স্প্যানিওল মস্কিতে যাওয়ার জন্য প্রায় কুড়ি মিনিট পাহাড় চড়তে হলো আমাকে। এখানে দিনে সূর্যের সঙ্গে ভালোই মোলাকাত হয়; রাতে পড়ে ঠান্ডা। দিনের এই প্রখর তাপ দেখলে বোঝা মুশকিল, রাতের তাপমাত্রা ১৫ থেকে ১৬ ডিগ্রিতে নেমে যায়। যতই ওপরে উঠছি, ততই মনে হচ্ছে এক অন্য জগতে চলে এসেছি। চারদিকে কেউ নেই। বাতাসে গাছের পাতার শব্দ শোনা যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে পাখি ডেকে উঠছে আর সেই মুহূর্তে আমি পাহাড়ের ওপর থেকে খানিক দূরে ছড়ানো-ছিটানো নীল মুক্তা দেখছি। এভাবেই প্রখর রোদে পাহাড় বেয়ে ওপরের দিকে চললাম। আমি নানা দেশে পাহাড়ের চূড়ায় প্যাগোডা, মন্দির বা গির্জা দেখেছি। পাহাড়ের চূড়ায় প্রার্থনালয় নির্মাণের কারণ হলো, প্রার্থনায় যত বেশি শারীরিক কষ্ট হবে, ততই মজবুত হবে সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভক্তি। এই মসজিদে যাওয়ার পথে আমার তা-ই মনে হলো। নামাজের আহ্বানে খরতাপ, ঝড়-বাদল—সবকিছু উপেক্ষা করে খোদার দরবারে হাজির হলে ইমান পাকাপোক্ত হবে নিশ্চয়।
স্প্যানিওল মস্কি প্রায় পৌঁছেই গেছি; নিচে তাকিয়ে দেখি, পাহাড়ের মাঝামাঝিতে সারি সারি কবর। শেফশাওয়েনের বাসিন্দাদের কবর। সাধারণ কবরগুলোর দেয়াল কোনোটা সাদা, কোনোটা নীল রং করা। আড়ম্বরহীন কবরগুলোকে দূর থেকে মোটেই সাধারণ মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে পাহাড়ের গায়ে কে যেন সাদা আর নীল রঙের মুক্তা ছড়িয়ে দিয়েছে।
আরেকটু এগোতেই স্প্যানিওল মস্কির সাদা ভবন চোখে পড়ল। এখান থেকে পায়ে হাঁটার পাকা পথ। ছোট আকারের স্প্যানিশ মসজিদটি দেখতে সাদা রঙের দোচালা ঘরের মতো। ছাদে খয়েরিরঙা ট্যালি বসানো। একদিকে ছোট চারকোনা মিনার। আমার আগে দুজন ইউরোপীয় ট্যুরিস্ট এসে মসজিদের বাইরে বসে আছেন। মরক্কোর মসজিদে মুসলমান ছাড়া অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারে না। আমি মসজিদে ঢোকার লোভ সামলাতে পারলাম না। সবে জোহরের নামাজ শেষে মাত্র দুজন মুসল্লি বেরিয়ে এলেন। একজন ইমাম; অপরজন মসজিদের দেখভালকারী। মরক্কোর সব মসজিদে নারীদের নামাজের স্থান থাকে। আমি স্প্যানিওল মস্কির ভেতরে ঢুকে পড়লাম। এত ছোট মসজিদ আগে দুটার বেশি দেখিনি। নারীদের নামাজের স্থান পর্দা দিয়ে ঘেরা। লাল কার্পেট আর কাঠের ছাদ। নারীদের নামাজের স্থানটি খুবই ছোট। একসঙ্গে পাঁচজনের বেশি নামাজ পড়তে পারবেন না। এই মসজিদে সব মিলিয়ে একসঙ্গে খুব সম্ভবত ২০ জনের নামাজ পড়ার জায়গা হবে।
মসজিদ থেকে বেরিয়ে মন দিলাম বাইরের দিকে। সামনে ব্লু সিটি নীল চাদর বিছিয়ে রেখেছে। তার চারপাশে ঘন হয়ে আছে সবুজ গাছপালা। মরক্কোর সত্যিকারের নীল মুক্তার কিছুই এখনো দেখা হয়নি। তাই আমি পাহাড় বেয়ে নিচের দিকে চললাম পায়ে চলা পথের ছোট শহরের বাকি নীল মুক্তাগুলো খুঁজতে।
পাহাড় থেকে বেজায় তেষ্টা নিয়ে নেমেছি। তবে মরক্কোর খানাপিনার দোকান কখনো আমাকে নিরাশ করেনি। ব্লু সিটিতে ঢোকার মুখেই একটি জুসের দোকান। দোকানের সামনে সারি সারি আনার, কমলা সাজানো। আমি চাইলেই এরা ফলের জুস বানিয়ে দেবেন। দোকানদার ছেলেটি নামাজ পড়ছিলেন। আমিও খোলা দোকানের চেয়ারে বসে আশপাশের দৃশ্য দেখতে থাকি। পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ছোট এক নদী। নদীর নাম রাস এল মা। নদীর পানির কাছে সব দেশি ট্যুরিস্ট ভিড় করেছেন। কেউ কেউ হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে বসে থাকতে দেখে জুসের দোকানদার লজ্জা পেলেন। আমার তো প্রকৃতি আর সৌন্দর্য দেখা ছাড়া কোনো কাজ নেই। তাই তাকে বললাম, তার লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। আনারের জুসের গ্লাস হাতে আমি নদীর কিনারে চলে এলাম। নীল শহরের রঙের খানিকটা ছটা নদীতেও এসে পড়েছে।
নদীর তীর ছেড়ে আমি আবার নীল মুক্তার শহরের অলিগলিতে ঢুকে পড়লাম। একটি গলির ভেতরের ভবনের দেয়ালজুড়ে পেইন্টিং ঝোলানো। খেয়াল করে দেখলাম, ভবনটি আসলে মসজিদ। যে-সে মসজিদ নয়, খোদ জুমা মসজিদ; মানে শহরের প্রধান মসজিদ। আর পেইন্টিংগুলোতে শুধু শেফশাওয়েনের নীল বাড়িঘরের চিত্রই নয়; কিছু মানুষের চিত্রও আছে। মরক্কোর আনাচে-কানাচে আমি যত ঘুরে বেড়াচ্ছি, ততই আশ্চর্য হচ্ছি। মানুষের ছবির সঙ্গে মসজিদের বিরোধ নেই; পোশাকের সঙ্গে মতবাদের নেই বিরোধ। আশ্চর্যজনক ঘটনাই বটে।
জুমা মসজিদটি স্প্যানিওল মস্কির চেয়ে বড়; তবে বিশাল নয়। আজ থেকে সাড়ে ছয় শ বছর আগে জনসংখ্যার কথা চিন্তা করেই এসব বাড়িঘর বা মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। অবশ্য এর পরে যে খুব একটা জনসংখ্যা বেড়েছে, তা নয়; এ শহরে বাসিন্দার চেয়ে ট্যুরিস্ট বেশি। অবশ্য ট্যুরিস্টবিহীন শহর বা গ্রামে লোকজন দেখা যায় না প্রায়।
একটি নীল সাগর রঙের ভবনের সামনে এখন ইউরোপীয় সুন্দরীদের ফটোসেশন চলছে। এরা বোধ হয় ফটোসেশন করতেই এসেছেন! আমি আরও সরু হয়ে যাওয়া, আরও গাঢ় নীল হতে চাওয়া গলির দিকে এগোলাম। যত সরু গলি, ততই বিস্ময় জড়িয়ে ধরছে আমাকে; ততই গাঢ় হচ্ছে বাড়ির দেয়ালের নীল রং। একটি গলির ভেতরের গলিতে ঢুকে মনে হলো, আমার গায়ে কেউ নীল আকাশ মাখিয়ে দিয়েছে। সূর্য থেকে যে সামান্য রশ্মি আসছে, তা-ও কোন জাদুমন্ত্রবলে নীল হয়ে মাটিতে নামছে। একেকটি বাড়ি সরু ঢালু পথের সিঁড়ি দেওয়া কয়েক ধাপ পর পর দাঁড়িয়ে। বাড়ির সামনে ফুল গাছের টব। মাথার ওপরে সবুজ আঙুরলতা নেমে গেছে সিঁড়ি দিয়ে নিচের দিকে। মেঝেতেও নীল রং করা।
ভাবছি, এখানে আরও নিরালায় নীল সাগরের মতো গলিতে ডুব দেওয়া সম্ভব। ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে, হঠাৎ একটি বাড়ির সামনের পর্দা সরিয়ে একজন এসে দাঁড়ালেন আমার সামনে। বললেন, ‘তুমি কি এখানে বসবে?’ মরক্কোর স্থানীয় লোকজন খুবই রক্ষণশীল। বাইরের মানুষের সঙ্গে মিশতে অনিচ্ছুক। হঠাৎ এদের কী হলো? খেয়াল করে দেখি, বাড়ির সামনের খোলা উঠানটি একটি রেস্তোরাঁ। মরোক্কান স্টাইলে সাজানো। নিচু একটি টুলে চায়ের সরঞ্জাম রাখা। ছোট একটি কেতলি আর কাপ। তার সামনে নিচু কয়েকটি বসার টুল। দুপাশের দেয়ালে সাজানো আছে ফুলের টব। দেয়ালে ঝুলছে মরোক্কান বেতের তৈরি ওয়ালহ্যাংগিং। এদিকে আমারও মরোক্কান খাবার গ্রহণের সময় হয়ে এলো। ধীরস্থির নীল রঙের দুনিয়ায় বসে একটি বেলা পার করব, সেটি একসময় আমার স্বপ্নেই সীমাবদ্ধ ছিল।
আমি খাবার হিসেবে কুসকুস আর মাটন অর্ডার করেছি। খাবার তৈরি হয়ে আসতে কিছু সময় লাগবে। এর মাঝে মরোক্কান ঐতিহ্যবাহী পুদিনা চায়ে চুমুক আর নীলাম্বরে চোখ ভরিয়ে দিতে দিতে ভাবছি, পৃথিবী সত্যি সুন্দর ভীষণ।

ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top