দেহযতন I প্রিটি পিভল্ভ
শরীরচর্চার জগতে তুলনামূলক নতুন ধারণা এটি। শরীরে শক্তি তৈরি, নমনীয়তা বৃদ্ধি ও কার্যকরী ফিটনেসের সমর্থক
সোশ্যাল মিডিয়ার ফিডে সম্প্রতি ৫৬ বছর বয়সী আমেরিকান অভিনেত্রী জেনিফার অ্যানিস্টনের পাগলাটে ছবি ঘুরে বেড়াচ্ছে, তা-ও একটি ব্যায়ামরত অবস্থায়। প্রশ্ন জাগতেই পারে, ব্যাপারটি আসলে কী? ইন্টারনেটে ফর ইউ পেজ (এফওয়াইপি) বলে একটি টার্ম আছে, এটি এমন এক পেজ, যা ব্যবহারকারীর আগ্রহ ও কার্যকলাপের ভিত্তিতে কনটেন্ট সাজেস্ট করে। মূলত টিকটক ও অন্য কিছু প্ল্যাটফর্মে দেখা মেলে এর। এটি ব্যবহারকারীর জন্য ব্যক্তিগত ফিড তৈরি করে, যেখানে নতুন ও আকর্ষণীয় কনটেন্ট দেখানো হয়, যা ব্যবহারকারী আগে অনুসরণ করেননি। সেখানেও ট্রেন্ডিং ব্যায়াম হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে এই পিভল্ভ এক্সারসাইজ।
পিভল্ভ হলো পেলভিক ফ্লোরের পেশিগুলোকে শক্তিশালী করার একটি ব্যায়াম। এটি কেগেল ব্যায়াম নামেও পরিচিত। এর অনুশীলনের জন্য, আপনাকে প্রথমে পেলভিক ফ্লোরের পেশিগুলো চিহ্নিত করে, তারপর সেগুলো সংকুচিত ও শিথিল করতে হবে। পেলভিক ফ্লোরের প্রধান পেশি লিভেটর অ্যানি এবং ককিজিয়াস। লিভেটর অ্যানি আবার তিনটি পৃথক পেশির মাধ্যমে গঠিত—পিউবোকোক্সিজিয়াস, পাউবোরেকটালিস এবং ইলিওকোক্সিজিয়াস।
আজকাল ফিটনেস ও এভারগ্রিন বিউটির ওপর মনোনিবেশ করছেন অনেকে। জেনিফার এ ক্ষেত্রে বেশি বয়সী নারীদের অনুপ্রেরণাই বটে। তার পছন্দের ওয়ার্কআউট পিভল্ভ এখন বিজ্ঞানীদেরও মনোযোগ টানছে। মেডিসিন অ্যান্ড সায়েন্স ইন স্পোর্টস অ্যান্ড এক্সারসাইজে প্রকাশিত এক সমীক্ষায় ৪০ থেকে ৬০ বছর বয়সী ৭০ জন নারীর দিকে নজর দেওয়া হয়েছিল, যারা হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি (এইচআরটি) ব্যবহার করেননি। এই নারীদের দুটি দলে বিভক্ত করা হয়েছিল। প্রথম দলের নারীরা ১২ সপ্তাহ ধরে পিভল্ভ ওয়ার্কআউট এবং অন্য দলের নারীরা নিয়মিত ব্যায়ামের নির্দেশিকা অনুসরণ করেছিলেন। প্রতি সপ্তাহে ১৫০ মিনিটের কার্যকলাপ করেছিলেন তারা।
যেসব নারী পিভল্ভ ওয়ার্কআউট করেছিলেন, তাদের রেজাল্টে দেখা যায়, এই দেহচর্চায়—
নিতম্বের কার্যকারিতা ও শরীরের নিচের দিকে অংশের শক্তিতে ২০ শতাংশ উন্নতি ঘটেছে;
শরীরের নিচের অংশের ফ্লেক্সিবিলিটি ২১ শতাংশ বেড়েছে;
ভারসাম্য ও স্থিতিশীলতা বেড়েছে ১২-১৩ শতাংশ;
ওজন বাড়েনি; চর্বিহীন পেশি বেড়েছে।
‘ফ্রেন্ডস’ তারকা জেনিফার পিভল্ভ এক্সারসাইজ শুরু করেন ২০২১ সালে। তিনি এই প্রোগ্রাম কতটা পছন্দ করেন, তা শেয়ার করে বলেছেন, এটি তার শরীরকে শক্তিশালী ও সুস্থ রাখতে সহায়ক। আসলে পিভল্ভ এমন একটি নতুন ওয়ার্কআউট ট্রেন্ড, যা শরীরে শক্তি তৈরি, নমনীয়তা বৃদ্ধি ও কার্যকরী ফিটনেসকে সমর্থন করে। এ ধরনের ব্যায়াম দীর্ঘায়ু পেতে কাজে দেয়। এই দাবিগুলো সমর্থন করার মতো বেশ কিছু গবেষণা এরই মধ্যে রয়েছে। অবশ্য এই অনুশীলনের প্রতিষ্ঠা বেশি দিন আগে নয়, মাত্রই ২০১৭ সালে।
পিভলভের অর্থায়নে এবং যুক্তরাজ্যের এক্সেটার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের মাধ্যমে পরিচালিত ‘হেলথি এজিং ক্লিনিক্যাল স্টাডি’ প্রকাশ পেয়েছে আমেরিকান কলেজ অব স্পোর্টস মেডিসিন জার্নাল ‘মেডিসিন অ্যান্ড সায়েন্স ইন স্পোর্টস অ্যান্ড এক্সারসাইজ’-এ। তাতে জানা যায়, এই শরীরচর্চা শরীরের শক্তি, ভারসাম্য, স্থিতিশীলতা ও জীবন মান উন্নত করতে কার্যকর। শক্তি প্রশিক্ষণ সম্পর্কে আমরা যা সত্য বলে জানি, তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ গবেষণার ফল মিলেছে এতে; বিশেষ করে নারীদের জন্য বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাড়ের ঘনত্ব, পেশি ভর রক্ষা করার মতো বিষয়গুলো ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাই পিভল্ভ এক্সারসাইজ তাদের জন্য উপকারী হতে পারে।
সোশ্যাল সাইটগুলোতে পিভল্ভ সম্পর্কিত নানা কনটেন্টে নজরে দিলেই বোঝা যায়, এটি লো-ইনটেনসিটি কার্যকরী ওয়ার্কআউট। এর ভঙ্গিমা দৈনন্দিন নড়াচড়া; যেমন মোচড়ানো, শরীর বাঁকানোর মতো। পিলাটিসের মতো ব্যায়াম পিভল্ভ না হলেও এ দুটির কিছু সাদৃশ্য আছে।
পিভলভের প্রশিক্ষণ পরিচালক এবং জেনিফার অ্যানিস্টনের প্রশিক্ষক ড্যানি কোলম্যান লো-ইমপ্যাক্ট, হাই-রেজিস্ট্যান্স ওয়ার্কআউটের ওপর মনোযোগ দেন। তিনি বলেন, ‘পিভল্ভ ফাংশনাল ফিটনেস পদ্ধতি, যা আপনার জীবনের প্রতিটি পর্যায়ের জন্য শক্তি, গতিশীলতা ও স্থিতিশীলতা তৈরি করে। তুলনামূলক ঐতিহ্যবাহী ওয়ার্কআউটের বিপরীতে এটি শরীরকে গতির তিনটি স্তরের (স্যাজিটাল, ফ্রন্টাল ও ট্রান্সভার্স) মাধ্যমে সঞ্চালিত করে; একই সঙ্গে প্রতিরোধ সরঞ্জাম ও ভারী ওজন ব্যবহার করে পেশি ভর তৈরি, গতিশীলতার উন্নতি ও স্থিতিশীলতা বাড়াতে সাহায্য করে।’
উদ্যোক্তা ও ফিটনেস এক্সপার্ট র্যাচেল কাটজম্যান পিভল্ভ ফিটনেস ব্র্যান্ডের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও ভিশনারি। তিনিই এই ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠা করেন। নেপথ্য কারণ হিসেবে জানালেন, উচ্চ প্রভাবশালী ওয়ার্কআউট সেশনের কারণে তিনি ক্রমাগত ক্লান্ত হয়ে পড়তেন। ফলে এমন একটি ফিটনেস রুটিন খুঁজতে থাকেন, যা তার স্কোলিওসিসকে (মেরুদণ্ডের একটি পার্শ্বীয় বক্রতা) আর খারাপ করবে না। তিনি ফাংশনাল ফিটনেসের সঙ্গে পরিচিত হন; বাকিটা ইতিহাস!
কাটজম্যান এমন একটি ওয়ার্কআউট তৈরি করতে অনুপ্রাণিত হন, যা শরীরকে শাস্তির মতো কষ্ট দেওয়ার পরিবর্তে ক্ষমতায়িত করে। এভাবেই পিভল্ভ ধারণার জন্ম। ২০২৩ সালে এটি জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছায়। জেনিফার অ্যানিস্টনের একটি গার্ল নেক্সট ডোর ইমেজ আছে; সে বছর তার সঙ্গে ব্র্যান্ডটির অংশীদারত্ব এর জনপ্রিয়তাকে বেশ উন্নীত করে।
কোলম্যান বলেন, ‘পিভল্ভ ফাংশনাল মুভমেন্ট, রেজিস্ট্যান্স ট্রেনিং ও কারেকটিভ মুভমেন্ট প্যাটার্নকে একত্র করে কাজ করে, যাতে ঐতিহ্যবাহী উচ্চ-তীব্রতার ওয়ার্কআউটের মতো ক্লান্তি ছাড়াই শক্তি, গতিশীলতা ও স্থিতিশীলতা তৈরি করা যায়। চাহিদা অনুযায়ী আমাদের মাত্র ১৫ মিনিট থেকে এক ঘণ্টার বেশি সময়ব্যাপ্তির ওয়ার্কআউট রয়েছে, যেখানে দেড় সহস্রাধিক ওয়ার্কআউট বেছে নেওয়ার রয়েছে সুযোগ।’
প্রশ্ন জাগতেই পারে, পিভল্ভ আমাদের ঘাম ঝরানোর উপযোগী? এককথায় বললে, ‘হ্যাঁ’। আসুন, বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
টেকসই ও মৃদু প্রভাব
এক্সেটার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা অনুসারে, প্রথমত ও সর্বাগ্রে এটি একটি টেকসই ব্যায়াম পদ্ধতি, যা শরীরের জয়েন্টগুলোর ওপর মৃদু প্রভাব ফেলে। এটি প্রিপেরি ও পোস্ট-মেনোপজাল নারীদের জন্য আদর্শ। ‘মেনোপজ ও পেরিমেনোপজের সময় শরীরের সংযোগকারী টিস্যু পরিবর্তিত হয়,’ পিওর স্পোর্টস মেডিসিনের প্রধান ক্লিনিক্যাল অফিসার ও কনসালট্যান্ট ফিজিওথেরাপিস্ট ক্লেয়ার স্মল ব্যাখ্যা করেন। ‘এ কারণেই এই বয়সের নারীদের প্রায়শই জয়েন্টে ব্যথা ও টেন্ডনের (পেশিকে হাড়ের সঙ্গে সংযুক্তকারী তন্তুযুক্ত কলা) সমস্যা দেখা দেয়। পিভল্ভ যে শক্তি ও নমনীয়তা নিয়ে কাজ করে, তা সুস্থ টিস্যু বজায় রাখতে এবং ব্যথা এড়াতে সহায়ক।’
কার্ডিও ও রেজিস্ট্যান্স ট্রেনিংয়ের সংমিশ্রণ
সময়ের অভাব? আপনি কি কার্যকর ও সুষম ওয়ার্কআউট চাইবেন না, যা আপনার সময়ের সীমাবদ্ধতার মধ্যে সর্বোচ্চ ব্যায়ামের উপকারিতা দেবে? পিভল্ভ ঠিক এই কাজই করে। এটি ব্যস্ত নারীদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি। এই পদ্ধতিতে কার্ডিও (হিট ট্রেনিংয়ের আকারে) ও রেজিস্ট্যান্স—উভয় একত্র করা হয়েছে। ক্লেয়ার স্মল বলেন, ‘মেনোপজ ও পেরিমেনোপজের সময় নারীদের হরমোনের মাত্রার পরিবর্তন বিপাক, পেশি ও সংযোগকারী টিস্যুর গঠনকে প্রভাবিত করে—এ কথা অনেকে জানি। তাই এ সময়ে ব্যায়াম পদ্ধতিরও পরিবর্তন করা দরকার। নারীদের জন্য রেজিস্ট্যান্স ট্রেনিং করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা পেশি ও শক্তি তৈরি করে; আর এতে হিট এক্সারসাইজের মতো কার্ডিও সাহায্য করে। এটি হার্ট সুস্থ, হাড় শক্তিশালী ও পেশি ভর সর্বোত্তমভাবে বাড়াতে সহায়ক; ফলে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বজায় থাকে।’
ফাংশনাল ফিটনেস উন্নতি
জীবনের যেকোনো পর্যায়ে দেহচর্চার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো তাতে চর্চাকারীর ফাংশনাল স্ট্রেন্থের প্রয়োগ ঘটানো। ‘পিভলভের সাহায্যে আপনি আজীবন স্থিতিস্থাপকতার জন্য শক্তি, গতিশীলতা ও স্থিতিশীলতার উন্নতি ঘটাতে পারবেন,’ বলেন কোলম্যান। আরও বলেন, ‘জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে আপনি শক্তির উন্নতি দেখতে শুরু করবেন, যেমন পরেরবার কিছু তুলতে, গলফ ক্লাব দোলাতে, ঘোরাতে কিংবা কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাতে স্বচ্ছন্দবোধ করবেন। পিভল্ভ শরীরকে তিনটি গতির স্তরে প্রশিক্ষণ দেয়, ঠিক যেমন আপনি দৈনন্দিন জীবনে যেভাবে নড়াচড়া করেন; তাতে শক্তির কার্যকারিতা ও অনুভূতি নিহিত থাকে।’
চর্চাযোগ্যতা ও অগ্রগতিশীলতা
‘পিভল্ভ যে কারও জন্যই সেরা বাছাই,’ কাটজম্যান জোর দিয়ে বলেন। তার মতে, যারা আঘাত থেকে সেরে উঠছেন, অন্য ওয়ার্কআউট ধারণায় ক্লান্তি বোধ করছেন, ফিটনেস যাত্রা সদ্য শুরু করেছেন অথবা পরবর্তী স্থায়ী ওয়ার্কআউট খুঁজছেন—সবার জন্যই প্রযোজ্য। পিভল্ভ প্রগতিশীল ওয়ার্কআউট, যা চর্চাকারীদের নিজ নিজ প্রয়োজনীয় ফল পেতে পরিবর্তনের মাধ্যমে স্তরভেদে অগ্রগতি এনে দেয়।
ওয়ার্কআউটের ট্রেন্ড যত এগোচ্ছে, অন্যান্য ট্রেনিংয়ের তুলনায় পিভল্ভ বেশি আলোচিত ও আকর্ষণীয় হচ্ছে। তবে যদি এর চর্চা করতে চান, কোনো ট্রেইনার বা ফিটনেট এক্সপার্টের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট
