টেকসহি I সাক্ষরতার শক্তি
৮ সেপ্টেম্বর। আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। মানবসভ্যতার অগ্রগতি সচল রাখতে সাক্ষরতার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। লিখেছেন সুস্মিতা চক্রবর্তী মিশু
দোকানি: ধানের বীজ আগের ট্যাকার সুদ লইয়া ৮০০ টাকা হইছে। এইখানে আঙুলের ছাপ দাও।
মীনা: বাবা, থামো! সে ৮০০ টাকা ল্যাখে নাই, ১৮০০ লেখছে!
দোকানি: তাই নাকি? আইজকাল চোখে ভালো দেখি না, সাংঘাতিক ভুল।
দোকানি খাতায় খানিক কাটছাঁট করার পর মীনাকে দেখিয়ে বলেন, অহন ঠিক আছে? মনে হইতাছে, তুই ইশকুলে যাস।
মীনার বাবা: হ, মীনা ইশকুলে যাইয়া অনেক দরকারি জিনিস শিখতাছে।
ওপরের সংলাপগুলো কি আপনাকে শৈশবের কোনো স্মৃতি মনে করিয়ে দিল? হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন; এসব সংলাপ মীনা কার্টুনের। সেই জনপ্রিয় শিশুতোষ কার্টুনে সহজ ভাষায় তুলে ধরা হয়েছিল, পড়ালেখা না জানলে কীভাবে মানুষ প্রতারিত হয়, অধিকার হারায় কিংবা সমাজে পিছিয়ে পড়ে। একই সঙ্গে শেখানো হয়েছিল নারী-পুরুষ সবার জীবনে শিক্ষার গুরুত্ব; যা নির্দেশ করে, সাক্ষরতা শুধু ব্যক্তিগত নয়; আর্থসামাজিক উন্নতির জন্যও অপরিহার্য।
সহজ ভাষায়, সাক্ষরতা মানে হলো পড়তে ও লিখতে পারার ক্ষমতা; কিন্তু এর গভীরতা অনেক। এটি মানুষকে তথ্য বোঝার, বিশ্লেষণ করার এবং নিজের জীবন ও সমাজের বিষয়ে সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার শক্তি দেয়। আজকের ডিজিটাল যুগে, কাগজ-কলমের শিক্ষার পাশাপাশি সংখ্যা, তথ্য ও ডিজিটাল কনটেন্ট বোঝার ক্ষমতাও সাক্ষরতার অংশ।
সাক্ষরতা শুধু শিক্ষার মূল ভিত্তি নয়; মানবাধিকারেরও একটি মৌলিক অংশ। এটি মানুষকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে সক্রিয় করে, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা গড়ে তোলে এবং স্বাধীনভাবে নিজের অধিকার ও দায়িত্ব পালন করতে শেখায়। যে ব্যক্তি সাক্ষর, তিনি কেবল পাঠ্যবইয়ের তথ্যই জানেন না; ভুয়া খবর চিনতে, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মূল্যায়ন করতে এবং চারপাশের বিশ্বকে সচেতনভাবে উপলব্ধি করতে পারেন। তাই ১৯৬৭ সাল থেকে প্রতিবছর উদ্যাপিত হয় আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস (ইন্টারন্যাশনাল লিটারেসি ডে)। ১৯৬৫ সালে ইরানের তেহরানে অনুষ্ঠিত বিশ্ব শিক্ষামন্ত্রীদের সম্মেলনে সাক্ষরতা প্রসারের সুপারিশ করা হয়। এর পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৬৬ সালে ইউনেসকোর ১৪তম সাধারণ অধিবেশনে প্রতিবছরের ৮ সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস ঘোষণা করা হয়।
সারা বিশ্বের জন্য দিবসটি গুরুত্বপূর্ণ তো বটেই, বাংলাদেশের জন্যও সমানভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সাল থেকে দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় উদ্যাপিত হয়ে আসছে। এর উদ্দেশ্য হলো নীতিনির্ধারক, বাস্তবায়নকারী এবং সাধারণ জনগণকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে ন্যায়সংগত, শান্তিপূর্ণ ও টেকসই সমাজ গঠনে সাক্ষরতার গুরুত্ব কতটা অপরিহার্য।
এত অগ্রগতির পরও ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী অন্তত ৭৩৯ মিলিয়ন তরুণ ও প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এখনো মৌলিক সাক্ষরতার অভাবে ভুগছেন। একই সময়ে প্রতি ১০ জন শিশুর মধ্যে ৪ জন ন্যূনতম পাঠ দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। জরিপে দেখা যায়, ২০২৩ সালে বিদ্যালয়ের বাইরে থাকা শিশু ও কিশোর-কিশোরীর সংখ্যা প্রায় ২৭২ মিলিয়ন। তাই দিবসটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সাক্ষরতা শুধু পড়ালেখা শেখার বিষয় নয়; এটি একটি মৌলিক মানবাধিকার, যা ব্যক্তিগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য অপরিহার্য।
চলতি বছর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস উদ্যাপিত হচ্ছে ‘ডিজিটাল যুগে সাক্ষরতা উন্নয়ন’ প্রতিপাদ্য ঘিরে। প্রযুক্তি ও ডিজিটালাইজেশন আজ আমাদের শেখার ধরন, জীবনযাপন, কাজ ও সামাজিক যোগাযোগের পদ্ধতি আমূল বদলে দিয়েছে। এই পরিবর্তন যেমন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিচ্ছে, তেমনি চ্যালেঞ্জও তৈরি করছে—আমরা কীভাবে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছি, তার ওপরই নির্ভর করছে এর ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রভাব।
ডিজিটাল সাক্ষরতা বলতে মূলত বোঝায় প্রযুক্তি ব্যবহার করে তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ, সংরক্ষণ ও সঠিকভাবে উপস্থাপনের সক্ষমতা। এটি শুধু কম্পিউটার বা স্মার্টফোন চালানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার, ভুয়া তথ্য শনাক্ত করার দক্ষতা, অনলাইন গবেষণা করার সামর্থ্য, এমনকি ভার্চুয়াল যোগাযোগেও দায়িত্বশীল আচরণকে এর অংশ হিসেবে ধরা হয়। তাই ডিজিটাল সাক্ষরতা মানে নিরাপদ, সৃজনশীল ও দায়িত্বশীলভাবে ডিজিটাল জগতে অংশগ্রহণের ক্ষমতা।
ডিজিটাল টুলস প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য তৈরি করছে শিক্ষা গ্রহণের নতুন সুযোগ। তবে এই ডিজিটাল পরিবর্তন নতুন ধরনের বৈষম্যের ঝুঁকিও তৈরি করছে, যেখানে মানুষ শুধু প্রথাগত শিক্ষার ঘাটতিতেই নয়, বরং ডিজিটাল জ্ঞান ও সম্পৃক্ততার অভাবেও পিছিয়ে পড়তে পারে। এর পাশাপাশি গোপনীয়তা, নজরদারি, পক্ষপাতমূলক তথ্য ও পরিবেশগত প্রভাব নিয়েও নতুন উদ্বেগ সৃষ্টি হচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে সাক্ষরতা অর্জন আগের চেয়ে আরও জরুরি হয়ে উঠেছে। শুধু কাগজে পড়া-লেখার দক্ষতা নয়; ডিজিটাল সাক্ষরতার মাধ্যমে মানুষ নিরাপদ ও দায়িত্বশীলভাবে ডিজিটাল কনটেন্টে প্রবেশ, বোঝা ও মূল্যায়নের সুযোগ পেয়েছে; যার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে গড়ে উঠেছে গভীরভাবে চিন্তাভাবনার প্রবণতা এবং ভুয়া খবর ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ত্যাগ করে সঠিক তথ্য যাচাইয়ের সক্ষমতা।
জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) পূরণের জন্য সাক্ষরতা দক্ষতা অর্জনকে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা বিষয়ে এসডিজির ৪ নম্বর লক্ষ্যমাত্রায় বলা হয়েছে, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক মানসম্মত শিক্ষা এবং সবার জন্য শেখার সুযোগ নিশ্চিতকরণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) গবেষণায় দেখা গেছে, সাক্ষরতা বৃদ্ধির মাধ্যমে শিশুমৃত্যু হ্রাস, মাতৃস্বাস্থ্য উন্নয়ন, দারিদ্র্য হ্রাস এবং নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব। এ জন্য শুধু প্রাথমিক শিক্ষাই নয়; বরং প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষার সুযোগ, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, নারীশিক্ষায় সমতা এবং আজীবন শিক্ষাব্যবস্থার ওপর গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী বর্তমানে প্রাপ্তবয়স্ক সাক্ষরতার হার গড়ে প্রায় ৮৭ শতাংশ। তবে অঞ্চলভেদে এর পার্থক্য বেশ স্পষ্ট। উন্নত দেশগুলোতে প্রায় শতভাগ মানুষ সাক্ষর হলেও উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে এখনো সাক্ষরতার ঘাটতি রয়ে গেছে। ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও পূর্ব এশিয়ার উন্নত দেশগুলোতে সাক্ষরতার হার ৯৫ থেকে ১০০ শতাংশের মধ্যে। উদাহরণস্বরূপ, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইউরোপের বেশির ভাগ দেশের প্রায় সবাই শিক্ষিত। অপরদিকে, দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশে এখনো উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ নিরক্ষর। আফ্রিকার বেশ কিছু দেশে সাক্ষরতার হার মাত্র ৬০ শতাংশের কাছাকাছি, যেখানে নারীশিক্ষায় বৈষম্য প্রকট।
ডিজিটাল শিল্পায়নের ফলে শিক্ষায়, কাজের ক্ষেত্রে এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বড় পরিবর্তন এসেছে। ফলে সাক্ষরতার গুরুত্ব আরও বেড়েছে। বাংলাদেশে ডিজিটাল সাক্ষরতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ ডিজিটাল সাক্ষরতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করেছে। এ ছাড়া ব্র্যাক, গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংকসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এ লক্ষ্য পূরণে কাজ করছে।
বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার বাড়ছে; তবে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। গ্রামীণ এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগের অভাব, প্রযুক্তির প্রতি অনাগ্রহ, প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাব ইত্যাদি সমস্যা রয়েছে। এসব সমস্যা সমাধানে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন।
বাংলাদেশ সরকার শিক্ষার প্রসারে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সকল শিশুর জন্য বিনা মূল্যে ১২ বছর পর্যন্ত শিক্ষা প্রদান, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা, শিক্ষার মান উন্নয়নে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বাড়ানো এবং শিক্ষার্থীদের শেখার আগ্রহ বাড়াতে ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ তৈরি ও বিতরণ করা। এসব উদ্যোগ কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ সহজে সাক্ষরতার হার ১০০ শতাংশে উন্নীত করতে পারবে এবং ডিজিটাল যুগে টেকসই অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে।
ডিজিটাল যুগে সাক্ষরতা অর্জন না করলে আমরা ভবিষ্যতের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে পারি। তাই সবার উচিত, এই লক্ষ্য অর্জনে অংশগ্রহণ করা এবং একটি সাক্ষর জাতি গঠনে অবদান রাখা।
ছবি: ইন্টারনেট
