skip to Main Content

কভারস্টোরি I পঞ্জিকা পরম্পরা

মানুষ একটা শৃঙ্খলার মধ্যে তার দিনগুলো পার করতে চায়। এখান থেকেই পঞ্জিকার জন্ম। অভিধানে ‘পঞ্জিকা’ শব্দের অর্থ দেওয়া আছে: ‘তিথি নক্ষত্র তারিখ প্রভৃতিজ্ঞাপক পুস্তক’। কিন্তু শুধু এটুকু দিয়ে পঞ্জিকার পরিচয় পূর্ণ হয় না। পঞ্জিকা দীর্ঘদিনের অভ্যস্ত বাঙালির পথনির্দেশিকা। পুরাণ-ঐতিহ্য-বিজ্ঞানের সমন্বয়ে এর শরীর তৈরি হয়েছে। আর মন তৈরি হয়েছে ধর্ম, বিশ্বাস ও আচারাদি দিয়ে। পঞ্জিকা ও উৎসব: বাঙালির বিশ্বাস, বোধ ও সম্মিলনের চিহ্ন ঘিরে বিস্তারিত লিখেছেন তারিক মনজুর

সব মানুষ একদিনে, একই ক্ষণে জন্মগ্রহণ করে না। তার জন্মক্ষণের সঙ্গে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের গ্রহ-নক্ষত্রের এক বা একাধিক যোগ থাকে। এর মধ্য দিয়ে সেই মানুষটির শুভাশুভ নির্ধারিত হয়। এখান থেকে জ্যোতিষশাস্ত্রেরও জন্ম। আকাশের জ্যোতিষ্ক ও গ্রহ-নক্ষত্রগুলো পৃথিবীকে প্রভাবিত করে, সেগুলো পৃথিবীর মানুষকেও প্রভাবিত করে। তাই প্রত্যেক মানুষের জন্য শুভাশুভ লগ্নও আলাদা হতে পারে। একজন মানুষের জন্মতিথি তার রাশিকে নিয়ন্ত্রণ করে। সেই অনুযায়ী মানুষের ভাগ্য পুরোপুরি মানুষের হাতে থাকে না। স্রষ্টার শক্তি ও ক্ষমতাকে মেনে নিতে হয়।
মানুষ বিভিন্ন কারণ, বিষয় বা বিশ্বাসকে উপলক্ষ করে উৎসব-অনুষ্ঠান উদ্‌যাপন করে। উৎসব-অনুষ্ঠান মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্মিলন ঘটায়, তাদের মধ্যে শুভ বোধ উজ্জীবিত করে। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট উৎসব উদ্‌যাপনের মধ্য দিয়ে জীবনযাপনে একধরনের শৃঙ্খলা আনতে চায়। তার ধর্মবিশ্বাস তাকে চালিত করে সুন্দর কাজে। এসব কাজের মধ্য দিয়ে সমাজ ও পৃথিবী সুন্দর হয়।
প্রাচীনকাল থেকে ভারতবর্ষের রয়েছে নিজস্ব রীতিনীতি ও আদর্শ। মানুষের মধ্যে কাল বা সময়ভাগের ধারণাটি এসেছে আরও আগে। আদিকাল থেকেই দিন-তারিখ, মাস, বছর হিসাব রাখার শুরু। ধীরে ধীরে এই দিন-তারিখ-মাসের সঙ্গে পূজা-পার্বণের সময় যুক্ত হয়েছে পঞ্জিকায়। পঞ্জিকায় থাকে বার, তিথি, নক্ষত্র, যোগ ও করণ—এই পাঁচটি বিষয় বা অঙ্গ। এ কারণে সংস্কৃতে পঞ্জিকাকে বলা হয় ‘পঞ্চাঙ্গ’। বাংলায় এটি পঞ্জি, পঞ্জিকা বা পাঁজি নামে পরিচিত।
বছর গণনার পদ্ধতি সব দেশে এক রকম নয়। বিভিন্ন দেশে বা অঞ্চলে বিভিন্ন পদ্ধতিতে বছর গণনা করা হয়। মানুষ দিনের পরিবর্তন বুঝতে পারে চাঁদ-সূর্য দেখে। তাই বছর গণনার পদ্ধতিতে চাঁদ-সূর্যের ভূমিকা রয়েছে। আরবি হিজরি সাল গণনায় চাঁদের গতি ও পরিবর্তনকে মাস গণনার ভিত্তি করা হয়েছে। আবার ইংরেজি খ্রিস্টাব্দ গণনায় সূর্যের গতি ও অবস্থান বছর গণনার ভিত্তি হয়েছে। আর বাংলা তারিখ গণনায় আকাশের চাঁদ, সূর্য ও নক্ষত্রের ভূমিকা রয়েছে।
বৈদিক যুগের ঋষিরা ঋতুভেদে নানা রকম উৎসব উদ্‌যাপন করতেন। সেগুলো আজ থেকে অন্তত আড়াই হাজার বছর আগের ঘটনা। সেই সময়ে ঋষিদেরকে ঋতুভাগ করে নিতে হয়েছে। ঋতুভিত্তিক বছরকে তারা উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়ন—এই দুই ভাগে ভাগ করেছেন। সূর্য উত্তর দিকে অবস্থান করাকে উত্তরায়ণ এবং দক্ষিণ দিকে যাত্রা করাকে দক্ষিণায়ন বলা হয়। প্রাচীন ঋষিরা বছরকে ১২টি ভাগে ভাগ করেন। এগুলো হলো তপঃ, তপস্যা, মধু, মাধব, শুক্র, শুচি, নভস্, নভস্য, ইষ, ঊর্জ, সহস্ ও সহস্য। তপঃ থেকে শুচি পর্যন্ত ছয় মাস উত্তরায়ণের কাল। আর নভস্ থেকে সহস্য পর্যন্ত ছয় মাস দক্ষিণায়নের কাল। তবে ধারণা করা হয়, এ রকম মাস ভাগের ব্যাপারটি আরও আগের। খুব সম্ভব যজুর্বেদের কালে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে এভাবে বছরকে বারো ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
তিথির প্রচলন হয়েছে আরও পরে। তবে তিথির গণনা শুরু হওয়ার আগে পূর্ণিমা, অমাবস্যা ও অষ্টকা বিবেচনায় ছিল এ অঞ্চলের মানুষের। কৃত্তিকা নক্ষত্র থেকে গণনা করে ২৭-২৮টি নক্ষত্রকে ভ-চক্রকে ভাগ করা হয়েছে। এটাই এ অঞ্চলের পঞ্জিকা গণনার আদি রূপ। বৈদিক সাহিত্যে ফাল্গুনি পূর্ণিমার উল্লেখ পাওয়া যায়। এ থেকে ধারণা করা যায়, তখন চান্দ্রমাস গণনার প্রচলন ছিল।
সময় যত এগিয়েছে, মানুষ মহাকাশ ও গ্রহ-নক্ষত্রকে আরও নিবিড়ভাবে বুঝতে শিখেছে। ফলে মানুষ ধীরে ধীরে যে পঞ্জিকায় অভ্যস্ত হতে থাকে, তা আরও বেশি বিজ্ঞানসম্মত হয়েছে। এক হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে পঞ্জিকায় বছর আরম্ভ হতো উত্তরায়ণ দিন থেকে। সেই পঞ্জিকায় ১২টি চান্দ্রমাস দেখা যায়। এ ছাড়া ৩০টি তিথি এবং ২৭টি নক্ষত্র গণনা করা হতো। তখন প্রতি ৫ বছরে একটি যুগ হিসাব করা হতো। একটি পঞ্জিকায় ৫ বছরের নির্দেশনা থাকত।
তখনো সূক্ষ্ম হিসাবে তিথি গণনার রূপ গড়ে ওঠেনি। মোটামুটি একেকটি দিনকে এক তিথি ও এক নক্ষত্র এভাবে হিসাব করা হতো। চাঁদের অবস্থান ঠিক রাখার জন্য মাঝে মাঝে এক-একটি তিথি হিসাব থেকে বাদ দেওয়া হতো। ৫ বছরে যুগ গণনার হিসাব ছাড়া অন্য কোনো বছর গণনার প্রথা তখনো এ অঞ্চলে গড়ে ওঠেনি। অন্তত দেড় হাজার বছর ধরে এই বেদাঙ্গ-জ্যোতিষ পঞ্জিকা কালগণনা ও পূজা-পার্বণের সময় নিরূপণে ব্যবহার করা হতো।
পঞ্জিকার উন্নতি সাধনের জন্য জ্যোতিষি ও পণ্ডিত ব্যক্তিগণ নানাভাবে ভূমিকা রেখেছেন। খ্রিস্টীয় চার বা পাঁচ শতকে তারা আরও সূক্ষ্ম গণনার কৌশল আয়ত্ত করেন। এ কাজে যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, তাদের মধ্যে আছেন আর্য ভট্ট, বরাহ মিহির, ব্রহ্ম গুপ্ত প্রমুখ। তারা পঞ্জিকাকে জ্যোতির্বিদ্যার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করেন। গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান, লগ্ন, ক্ষণ, তিথি এগুলোর পূর্তিকাল পঞ্জিকায় উপস্থাপন করেন। ওই সময় থেকে মানুষের ধারণায় আসে, প্রতিটি মুহূর্ত প্রতিটি মানুষের জন্য একই রকম শুভ নয়। কারণ, একই সময়ে দুটি মানুষের জীবনে দুই রকম ঘটনা ঘটে।
পঞ্জিকা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রন্থ। মানুষের কাছে এর মূল্য অপরিসীম—যদি তা মান্য করে চলা যায়। পঞ্জিকা অধিক গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে এর সঙ্গে সূর্যের অবস্থান ও পরিবর্তনকে বিবেচনায় নেওয়ার পরে। ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ আধুনিক পঞ্জিকার জনক। ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ গ্রন্থের ভিত্তিতে পরবর্তী সময়ে গণনাপদ্ধতি চালু হয়। পঞ্জিকার মধ্যে তখন থাকত বার, তিথি, নক্ষত্র, যোগ ও করণ। এই পঞ্চাঙ্গ লেখা হতো তালপাতায়। কারণ, তখনো কাগজ বা লেখার অন্য মাধ্যম আবিষ্কার হয়নি। গণক ঠাকুর বা ব্রাহ্মণরা বছরের শুরুতে গ্রামে গ্রামে গিয়ে মানুষকে তিথি-নক্ষত্রের ব্যাপারগুলো জানাতেন। মানুষের সুবিধার জন্য এসব পাঁজি যত্নসহকারে সংরক্ষণ করা হতো। তখন ছাপাখানা ছিল না; তাই হাতে লিখেই পঞ্জিকার অনুলিপি তৈরি করা হতো। পাঁজির বিবরণ বা গণনা অনুযায়ী মানুষ পূজা-পার্বণ ও ধর্মকর্ম করত।
পঞ্জিকা লেখার বিশেষ পদ্ধতি রয়েছে। প্রথম স্তম্ভে উপর থেকে নিচের দিকে কিছু সংখ্যা লেখা হয়। এগুলো বার, তিথি, দণ্ড, পল ও বিপল নির্দেশ করে। যেমন, ২/৭/৫৬/৩৩/৩৭ বলতে বোঝানো হয়: সোমবার, সপ্তমী তিথি, ৫৬ দণ্ড, ৩৩ পল এবং ৩৭ বিপল। অর্থাৎ ২ মানে সোমবার, আর ৭ মানে সপ্তমী তিথি। ঘণ্টা দেখানো হয় এভাবে: ঘ ৪/১১/৩৭। এটি দিয়ে বোঝানো হয় সন্ধ্যা থেকে ৪ ঘণ্টা ১১ মিনিট ৩৭ সেকেন্ড পর্যন্ত সপ্তমী তিথির স্থায়িত্ব থাকবে। এই সময়ের পরে অষ্টমী তিথি শুরু হয়ে যাবে। এভাবে ৬০ দণ্ডে ২৪ ঘণ্টা হয়।
সাহিত্যে বা সাধারণ ভাষা ব্যবহারে দণ্ড, তিথি, পল—এসব শব্দের ব্যবহার আছে। যেমন, এক দণ্ড অপেক্ষা না করেই সে চলে গেল। সুনির্দিষ্টভাবে ধরলে এক দণ্ড = ২৪ মিনিট। মধ্যযুগের বৈষ্ণব কবিতায় আছে: ‘দুহু কোরে দুহু কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া।/ তিল আধ না দেখিলে যায় যে মরিয়া॥’ রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের আকুতি প্রকৃতপক্ষে সকল প্রেমিক-হৃদয়ের অনুভূতি।
পঞ্জিকার দ্বিতীয় স্তম্ভের শুরুতে যে সংখ্যা থাকে, সেটি নক্ষত্র নির্দেশ করে। নক্ষত্রের মধ্যে আছে অশ্বিনী, ভরণী, কৃত্তিকা এ রকম ২৭টি। প্রতিটির নির্দিষ্ট নম্বর আছে। যেমন, ১৩ সংখ্যা দিয়ে হস্তা নক্ষত্রকে নির্দেশ করা হয়। এর সময়কাল দং ৪১/২৩/৪ রা ঘ ১০/৭/২৪। তৃতীয় স্তম্ভের প্রথম সংখ্যাটি বিভিন্ন যোগ নির্দেশ করে। যোগও নক্ষত্রের মতো ২৭টি। প্রতিটি যোগের আলাদা আলাদা নম্বর আছে। যেমন ২০ নম্বর দিয়ে শিবযোগ বোঝায় এবং এর সময়কাল দং ৪৬/১৫/১২ রাত ঘ ১২/৪/১৫। এ সময়ের করণ হচ্ছে গর, যেটি পঞ্চম করণ। পঞ্চম করণের পর ষষ্ঠ করণ, যার নাম বণিজ করণ। বণিজ করণ চলে গলে আসে সপ্তম করণ, যেটির নাম বৃষ্টিকরণ।
এ ছাড়া পঞ্জিকার প্রতি পৃষ্ঠার বাম দিকে চন্দ্র কোন রাশিতে আছে, তা লেখা থাকে। যেমন ‘চন্দ্রো কন্যায়াং’ লেখার অর্থ চন্দ্র কন্যা রাশিতে আছে। এ ছাড়া কয়েকটি স্তম্ভ থাকে। যেমন র ৩/১/৪১/১২। এখানে র মানে রবি, ৩ মানে কর্কট রাশি এবং সময় হলো ১ ডিগ্রি ৪১ মিনিট ১২ সেকেন্ড। অর্থাৎ রবি গ্রহ ওই তারিখে ১ ডিগ্রি ৪১ মিনিট ১২ সেকেন্ডে কর্কট রাশিতে ছিল।
বোঝা যাচ্ছে, পঞ্জিকায় অনেক কিছুর বিবরণ থাকে। তাই একে সংকেতের মাধ্যমে দেখানো হয়। যেমন, র (৭) মানে হলো রবি ৭ নম্বর নক্ষত্র পুনর্বসুতে আছে। আবার চং (১৩) মানে হলো চন্দ্র রয়েছে ১৩ নম্বর নক্ষত্র হস্তায়। শব্দ সংক্ষেপের জন্য বাংলা ভাষায় ং, ঃ ব্যবহারের রীতি খুবই পুরানো। এখন পর্যন্ত ব্যবহারিক জীবনে তারিখ বোঝাতে তাং, নম্বর বোঝাতে নং, মোহাম্মদ বোঝাতে মোঃ ইত্যাদির ব্যবহার দেখা যায়।
জ্যোতিষশাস্ত্র বিকাশ লাভ করে তিন-সাড়ে তিন হাজার বছর আগে। এর আগে পঞ্জিকায় গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান লেখা হতো না। মানুষের জ্ঞানের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চাঙ্গের সঙ্গে গ্রহের অবস্থানও পঞ্জিকায় লেখা হতে থাকে। পঞ্জিকা মানুষের দৈনন্দিন ও বার্ষিক কর্ম এবং ধর্মবোধ ও বিশ্বাসের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। মানুষের প্রয়োজন ও চাহিদার ভিত্তিতে এখন পঞ্জিকায় রাশিফলও মুদ্রিত হতে দেখা যায়।
বাংলাদেশে বর্তমানে যে বাংলা ক্যালেন্ডার প্রচলিত, তার সঙ্গে ইংরেজি ক্যালেন্ডারের ভেদ দেখা যায় না। এখন প্রতিবছরই ১ বৈশাখ শুরু হয় ১৪ এপ্রিলে। এভাবে, চৈত্র মাস শেষ হয় ১৩ এপ্রিলে। আবার ইংরেজি মাসগুলোর মতো এখন বাংলা মাসও সুনির্দিষ্টভাবে ৩০ বা ৩১ দিনে হয়। যেমন বৈশাখ থেকে আশ্বিন পর্যন্ত ছয়টি মাস ৩১ দিনে। আর ফাল্গুন ২৯ দিনে। তবে বাংলা বর্ষপঞ্জি গণনার সনাতন নিয়মে কোন বছরের কোন মাস কত দিনে হবে, তা আগে থেকে নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। সনাতন পদ্ধতিতে কোনো কোনো মাস ২৯ দিনে বা ৩২ দিনেও হতে পারে।
বাংলা বর্ষপঞ্জিকে সৌর বৎসরের সঙ্গে সমন্বিত করা হয়েছে। তবে পঞ্জিকায় চাঁদের তিথি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পূর্ণ চান্দ্রমাসের স্থায়িত্ব ২৯ দিন ১২ ঘণ্টা ৪৩ মিনিট ১২ সেকেন্ড। এটিকে মোটামুটিভাবে সাড়ে ২৯ দিন হিসাব করা হয়। চাঁদ ৩৬০ ডিগ্রি অতিক্রম করে সাড়ে ২৯ দিনে। অর্থাৎ চাঁদ এক দিনে বা ২৪ ঘণ্টায় অতিক্রম করে ৩৬০ ÷ ট ২৯.৫ = ১২.২ ডিগ্রি। তার মানে, এক দিনে চাঁদ পশ্চিম দিগন্তের ১২.২ ডিগ্রি উপরে ওঠে।
আবার, চাঁদ যখন অস্ত যায়, তখন তার সময় লাগে ৪৮ মিনিটের বেশি। কারণ, ১ ডিগ্রি অতিক্রম করতে সময় লাগে ৪ মিনিট। এই হিসেবে ১২.২ ডিগ্রি অতিক্রম করতে সময় লাগে ১২.২ গুণ ৪ = ৪৮.৮ মিনিট। তবে চাঁদের অস্তমিত হতে সর্বোচ্চ ৫১ মিনিট পর্যন্ত সময় লাগে। অর্থাৎ প্রথম দিনের চাঁদ ৫১ মিনিটের বেশি পশ্চিম আকাশে থাকতে পারে না।
পঞ্জিকা অনুযায়ী উৎসব-অনুষ্ঠান
কথায় বলে, বারো মাসে তেরো পার্বণ। বাস্তবে বারো মাসে অসংখ্য উৎসব-অনুষ্ঠান উদ্‌যাপিত হয়। হিন্দুধর্ম অসংখ্য উৎসব ও উদ্‌যাপনের জন্য পরিচিত। প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় উৎসবগুলো রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং নতুন অর্থ ধারণ করছে। এসব উৎসব জীবনের সমৃদ্ধির প্রতীক এবং মানুষের বন্ধনকে আরও শক্তিশালী করার উপায়। পঞ্চাঙ্গ বা পঞ্জিকা অনুসারে উদ্‌যাপিত হয় এমন কিছু উৎসবের বিবরণ দেওয়া যাক এবার।
একটি উৎসবের নাম হর্তালিকা তেজ। এটি শিব-পার্বতীকে উৎসর্গ করে পালন করা হয়। নেপাল ও উত্তর ভারতের নারীরা এটি পালন করে থাকেন। আরেকটি উৎসব গণেশ চতুর্থী। দশ দিন ধরে উদ্‌যাপন করা হয়। পৃথিবীতে গণেশের আগমনকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য। শেষ দিনে গণেশকে বিসর্জন দেওয়া হয়। বিষ্ণুকে স্মরণ করে উদ্‌যাপন করা হয় অনন্ত চতুর্দশী। নবরাত্রি নয় দিন ধরে উদ্‌যাপিত উৎসব, যেটি দুর্গাকে উৎসর্গ করে পালন করা হয়। তবে দুর্গাপূজা মূলত পাঁচ দিনের—শরৎ নবরাত্রির ষষ্ঠ থেকে দশম দিন পর্যন্ত।
হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব দশেরা। এ দিন অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তির জয় ঘোষণা করা হয়। করবা চৌথ নারীদের একটি প্রথা। করবা চৌথ পালন হিসেবে বিবাহিত নারীরা স্বামীর মঙ্গল কামনায় সারা দিন উপবাস করেন। এটি দাম্পত্য সম্পর্ককে শক্ত ও মোহময় করে।
মানুষ ধন-সম্পদ ও সমৃদ্ধি চায়। এ জন্য ধনের দেবী হিসেবে লক্ষ্মীকে বিবেচনা করা হয়। ধনতেরাস এমনই একটি উৎসব। এই উৎসবে লক্ষ্মী ও কুবেরকে প্রার্থনা করা হয় যাতে ঘরের সম্পদ বৃদ্ধি পায়। ধনতেরাস উৎসবের দিন মূল্যবান জিনিস ঘরে আনা হয়, যাতে সামনের দিনগুলোও সমৃদ্ধিতে কাটে। দীপাবলি আরেকটি জনপ্রিয় উৎসব। এটি ৫ দিন ধরে পালন করা হয়। প্রথম দিনের নাম ধনতেরাস। এরপর একে একে আসে নরক চতুর্দশী, দিওয়ালী, গোবর্ধন পূজা ও ভাইদুজ।
নরক চতুর্দশীকে ছোটো দিওয়ালীও বলে। পরের দিন দিওয়ালী উদ্‌যাপনের জন্য এ দিন প্রস্তুতি নেওয়া হয়। দিওয়ালীকে দীপাবলিও বলে। দীপাবলি উৎসবে আলো জ্বালানো হয়। কামনা করা হয়, এই আলো মানুষের জীবনকেও আলোকিত করবে। দীপাবলি উৎসর্গ করা হয় লক্ষ্মী ও কালীকে। গোবর্ধন পূজা উদ্‌যাপিত হয় দীপাবলির পরের দিন। দিনটি মূলত কৃষ্ণকে উপলক্ষ করেই পালিত হয়। এর পরের দিনকে বলে ভাইদুজ বা ভাইফোঁটা। এ দিন বোন তার ভাইয়ের কপালে তিলক কাটে। এর মধ্য দিয়ে ভাইয়ের জন্য বোন প্রার্থনা করে। এটি পারিবারিক বন্ধনকে দৃঢ় করে।
চার দিনব্যাপী একটি উৎসব ছট পূজা। এটি প্রাচীন ভারতীয় একটি উৎসব। মূলত পূর্ব ভারতের নারীরা এই উৎসব উদ্‌যাপন করে থাকেন। আরেকটি উৎসব শ্রাবণ সোমবার ব্রত। শ্রাবণ মাসকে উৎসর্গ করা হয় শিবকে। শিবের জন্য নারীরা উপবাস করে থাকেন। মূলত এর মধ্য দিয়ে তারা শিবের আশীর্বাদ কামনা করেন।
জন্মাষ্টমী একটি বড় উৎসব। ভগবান বিষ্ণু চাঁদের অষ্টমী তিথিতে মথুরায় জন্মগ্রহণ করেন। অত্যাচারী রাজা কংসকে দমনের জন্য কৃষ্ণ পৃথিবীতে আগমন করেন। কৃষ্ণের জন্ম হয়েছে রাজা কংসের কারাগারে। দেবকী ও বসুদেবকে রাজা কংস বন্দী করে রেখেছিল। কারণ, কংসের কাছে ভবিষ্যদ্বাণী হয়েছিল—এদের অষ্টম সন্তান তাকে হত্যা করবে। কংস এরপর একে একে দেবকীর ছয়টি নবজাতক সন্তানকে হত্যা করে। কিন্তু সপ্তম সন্তান আর অষ্টম সন্তানকে হত্যা করতে পারেনি। ঝড়বৃষ্টির রাতে কৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করেন এবং সেই রাতেই তাকে মথুরার কারাগার থেকে নদী পার করে গোকুলে নিয়ে যাওয়া হয়। কৃষ্ণ সেখানে বেড়ে ওঠেন যশোদা-নন্দের ঘরে। বড় হওয়ার পর কৃষ্ণ মথুরায় ফিরে রাজা কংসকে বধ করেন।
উত্তর ভারত ও নেপালের নারীরা কাজরী তেজ পালন করে থাকেন। এটি শিব-পার্বতীকে উৎসর্গ করা একটি উৎসব। ভারতজুড়ে জনপ্রিয় একটি উৎসব রাখী বন্ধন। এটি ভাই-বোনের সম্পর্ককে দৃঢ় করে। এদিন বোনেরা ভাইয়ের হাতে রাখি পরিয়ে দেয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে এই উৎসব উদ্‌যাপন করতেন।
নাগ পঞ্চমী আরেকটি উৎসব। উৎসবটি নানা কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। প্রাচীনকাল থেকেই সাপকে শক্তির প্রতীক মনে করা হয়। একসময়ে মনে করা হতো, পৃথিবী রয়েছে একটি বড় সাপের মাথায়। সেই সাপের অসংখ্য ফণা, সেগুলোর উপরে পৃথিবী দাঁড়িয়ে আছে। আবার বাংলা অঞ্চলে বহুকাল ধরেই মনসা পূজা চালু রয়েছে। মনসাকে মনে করা হয় সাপের দেবী। তার জন্ম হয়েছে শিবের ঔরসে। মর্ত্যে মনসা তার পূজা চালু করার জন্য নদীয়ার চাঁদ সদাগরকে আহ্বান করেছিল। কিন্তু চাঁদ সদাগর রাজি না হওয়াতে মনসা একে একে তার সব কটি পুত্রসন্তানকে বিয়ের রাতে দংশন করে। সপ্তম পুত্র লখিন্দরকে বাসররাতে সাপে কাটলে বেহুলা স্বামীকে নিয়ে স্বর্গে যায় এবং স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে আনে। তারপর বেহুলার অনুরোধে চাঁদ সদাগর মনসা পূজা দিতে রাজি হয়।
হিন্দু ধর্মে বুদ্ধকে মনে করা হয় ভগবান বিষ্ণুর একটি অবতার। সেদিক থেকে বৌদ্ধ পূর্ণিমার দিনে উৎসব উদ্‌যাপিত হয়। তবে আরেকটি পূর্ণিমা আছে যেদিন গুরুকে ভক্তি নিবেদন করা হয়। এর নাম গুরু পূর্ণিমা। আরেকটি অনুষ্ঠান আশাদী একাদশী বা দেবসায়ানী একাদশী। জগন্নাথ রথযাত্রা আরেকটি উৎসব যেখানে বহু মানুষের সম্মিলন ঘটে। রথে করে এ দিন জগন্নাথ পৃথিবীতে আসেন। আবার অক্ষয় তৃতীয়া বছরের এমন একটি মুহূর্ত যে সময়টি সবকিছুর জন্য শুভ হয়ে ওঠে।
বিশাখা নক্ষত্র যখন আকাশে থাকে, তখন বৈশাখী উৎসব উদ্‌যাপিত হয়। পাকিস্তান আমলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চিহ্ন হিসেবে পূর্ববাংলায় ব্যাপক সমারোহে বৈশাখী উৎসব উদ্‌যাপিত হয়েছে। এই উৎসবটি এখন ধর্ম-বর্ণ-জাতিভেদ হারিয়ে বাঙালির সম্মিলিত উৎসবে পরিণত। এদিন মানুষ ভালো রান্না করে খায় এবং বছরের অন্য দিনগুলোও এমনিভাবে যাতে ভালো খেতে পারে, সেই কামনা করে।
হনুমান জয়ন্তী উদ্‌যাপন করা হয় ভগবান হনুমানের জন্মদিনকে স্মরণ করে। অঞ্চলভেদে দিনটি পালনের পার্থক্য রয়েছে। আরেকটি উৎসব রাম নবমী। রাম হলেন ভগবান বিষ্ণুর সপ্তম অবতার। রামের কাহিনিকে অবলম্বন করেই ‘রামায়ণ’ লিখিত হয়েছে। এই কাহিনিতেই হনুমানের সঙ্গে রামের বন্ধুত্বের কথা আছে। লঙ্কার অধিপতি রাবণকে পরাজিত করে রাম তার স্ত্রী সীতাকে উদ্ধার করে আনেন। এই কাহিনি এখনো মানুষকে আবেগে উদ্বেলিত করে।
রং ছড়ানোর উৎসবের নাম হোলি। এখন পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে নানা মাত্রায় উদ্‌যাপন করা হয়। আবার শিব-পার্বতীর বিয়ের দিনটি উদ্‌যাপন করা হয় মহা শিবরাত্রি হিসেবে। সরস্বতী পূজা উদ্‌যাপিত হয় বসন্ত পঞ্চমীতে। মনে করা হয়, বসন্ত পঞ্চমীতে সরস্বতী পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন। সরস্বতীকে বলা হয় বিদ্যা ও কলার দেবী। সরস্বতী, লক্ষ্মী, কার্তিক ও গণেশ—এরা চারজন শিব-পাবর্তীর চার সন্তান। এর মধ্যে গণেশের দেহ মানুষের, কিন্তু মাথা হাতির। শিব কোনো এক ক্রোধের মুহূর্তে গণেশের মাথা কেটে ফেলেন; পরে হাতির মাথা দিয়ে সেখানে জোড়া দেওয়া হয়।
এসবের বাইরে রয়েছে আরও অনেক উৎসব-অনুষ্ঠান। যেমন চৈত্রের চাঁদ, উগাদি, গুডি পডবা, নবরাত্রি, হোলিকা দহন, পোঙ্গল, উত্তরায়ণ, মকরসংক্রান্তি, লোহরি ইত্যাদি। তবে পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে আরও অনেক উৎসব ও অনুষ্ঠান রয়েছে। এসব উৎসব ও রীতির সঙ্গে মানুষের বিশ্বাস গভীরভাবে জড়িয়ে থাকে। কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থা কৃষি-সম্পর্কিত অনেক উৎসবেরও জন্ম দিয়েছে।
প্রায় প্রতিটি উৎসবে অশুভ শক্তিকে পরাজিত করে শুভ শক্তির জয় ঘোষণা করা হয়। মানুষ সভ্যতা ও সময়ের একেকটি দশা পার করেছে, উৎসব-অনুষ্ঠানেরও ধীরে ধীরে রূপান্তর ঘটেছে; কিন্তু নিজেদের কখনো অপর থেকে আলাদা করেনি। মানুষ নিজেকে আলাদা করেনি মানুষ থেকে; প্রকৃতি থেকেও।

লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মডেল: সাফা কবির
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: সাফিয়া সাথী
ছবি: কৌশিক ইকবাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top