এডিটর’স কলাম I দাতব্য দৃষ্টান্ত
অনুদান শুধু বিপন্ন মানুষকেই সুরক্ষা দেয় না; দাতার মনে প্রশান্তির অনুভূতি এনে দিতেও ভূমিকা রাখে
‘মানুষ বড়ো কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও,/ মানুষই ফাঁদ পাতছে, তুমি পাখির মতো পাশে দাঁড়াও,/ মানুষ বড় একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও।’ কবিতায় এমন উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। জানা কথা, পৃথিবীর সকল মানুষের জীবন সমান সুবিধাসম্পন্ন হয় না। জীবনের দৌড়ে কেউ কেউ এগিয়ে যান খুব বেশি; কেউবা পিছিয়ে পড়েন অনেকটুকু। যারা পিছিয়ে পড়েন, তারা বিপদগ্রস্ত কিংবা বিপন্ন; সুবিধাপ্রাপ্তদের একটুখানি সহায়তা তাদের পারে জীবনতরী পাড়ি দেওয়ার প্রয়োজনীয় রসদ জুগিয়ে দিতে। এ জন্য দাতব্য উদ্যোগে আর্থিক অনুদান দেওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম।
দুই
সম্মিলিতভাবে সাধ্যমতো অপরের পাশে দাঁড়ানোর বোধ থেকে চ্যারিটি বা দাতব্যের ধারণার উৎপত্তি। সরল অর্থে, দাতব্য মানে অভাবী, অসুস্থ বা দুর্বল মানুষদের অর্থ, খাদ্য বা অন্য যেকোনো ধরনের সাহায্য প্রদানে কাজ করা সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান। কোনো ধরনের লাভ করা নয়; বরং পরোপকারই এর মূল উদ্দেশ্য। দাতব্যের মূলে কাজ করে দান বা সাহায্য করার ধারণা; তথা বিপন্ন মানুষকে সাংগঠনিকভাবে সাহায্য করার মতো উদারতা দেখানো। দাতব্য সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য সমাজসেবা তথা মানবসেবা করা; মুনাফা অর্জন নয়। উদাহরণ হিসেবে কোনো দাতব্য হাসপাতালের কর্মকাণ্ডকে গণ্য করা যেতে পারে, যেটি গরিব ও অসহায় রোগীদের বিনা মূল্যে বা নামমাত্র খরচে চিকিৎসাসেবা দেয়। এমন প্রতিষ্ঠানের খরচ জোগানো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তিমানুষ তিনি যতই ধনবান হোক, সম্ভব হয় না। তাই সামর্থ্যবান অনেকে মিলে তাতে ছোট ছোট আর্থিক অনুদান দিলে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান পরিচালনা সহজতর হয়ে ওঠে।
তিন
আগ্রহ থাকলেও বিভিন্ন নেতিবাচক প্রচারণার কারণে অনেকে নানা সময় দাতব্যে অংশ নেওয়া থেকে পিছু হটেন। দাতব্যের নামে প্রতারণার উদাহরণ যে একেবারেই নেই, তা নয়। তবে কোন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের অধীনে আপনি দান করছেন কিংবা অর্থ সংগ্রহে ভূমিকা রাখছেন, সেটি চোখ-কান খোলা রেখে যাচাই করে নেওয়া সম্ভব। কেননা, অনুদান শুধু বিপন্ন মানুষকেই সুরক্ষা দেয় না; দাতার মনে প্রশান্তির অনুভূতি এনে দিতেও ভূমিকা রাখে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দাতব্যকর্মে অর্থ অনুদান এর দাতার জন্য একটি বড় ধরনের মুড-বুস্টার হিসেবে কাজ করে। গবেষণা বলছে, অপরকে সহযোগিতা করার ফলে মস্তিষ্কে আনন্দের অনুভূতি সক্রিয় হয়। যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা চ্যারিটিজ এইড ফাউন্ডেশন (সিএএফ) পরিচালিত এক জরিপ থেকে জানা যায়, তাতে অংশ নেওয়া ২০ শতাংশেরই অভিমত, ভালো অনুভূতি কাজ করে বলে তারা দাতব্যে অনুদান দেন। আরও জানা যায়, ৯৬ শতাংশ দাতারই উপলব্ধি, অনুদান দেওয়ার মাধ্যমে তারা নৈতিক দায়িত্ব পালন করেছেন। শুধু তা-ই নয়, দানশীলতা একজন মানুষকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে তোলে। এই উদারতার জন্য সমাজে তিনি বিশেষ মর্যাদার ব্যক্তিত্বে তথা দৃষ্টান্তে পরিণত হন। তা ছাড়া দানের পরিমাণ যেমনই হোক, প্রতিটি যোগ হয়ে সম্মিলিতভাবে বেশ বড় অঙ্ক হয়ে ওঠে, যার মাধ্যমে বহু ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলা সম্ভব।
চার
সামর্থ্য ও আগ্রহ আছে বলেই আবেগে ভর দিয়ে যেকোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের হাতে নিজের উপার্জিত টাকা তুলে দেওয়াও ঠিক নয়। কিছু মূল বিষয় আগে থেকে যাচাই করে নেওয়া শ্রেয়। সংস্থাটির উদ্দেশ্য-বিধেয়, শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত কর্মকাণ্ড, তাদের স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, আর্থিক স্বচ্ছতা ইত্যাদি পরখ করে নেওয়া চাই। বহু ভুঁইফোড় দাতব্য সংস্থা যেমন বিদ্যমান, তেমনি পরীক্ষিত অনেক প্রতিষ্ঠানও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। দাতা হিসেবে আপনার অনুদান এ দুয়ের মধ্যে দ্বিতীয় দলের অর্থভান্ডারেই জমা হোক, নিশ্চয় তা চাইবেন আপনি। আজকের আধুনিক দুনিয়ায় এমন প্রতিষ্ঠান যাচাই করে নেওয়া খুব একটা দুরূহ নয়।
পাঁচ
‘ছোট ছোট বালুকণা, বিন্দু বিন্দু জল, গড়ে তোলে মহাদেশ, সাগর অতল’—খুব চেনা প্রেরণাদায়ী পঙ্ক্তিমালা। তেমনি আমাদের খুব সামান্য অনুদানই পুঞ্জীভূত হয়ে ভূমিকা রাখতে পারে অনেকের জীবন সুরক্ষায়। এমন উদ্যোগের তাৎপর্য ছড়িয়ে দিতে, জাতিসংঘের নির্দেশনায়, ৫ সেপ্টেম্বর পালিত হয় আন্তর্জাতিক দাতব্য দিবস (ইন্টারন্যাশনাল চ্যারিটি ডে)।
সামর্থ্যবান সবার দানের হাত যথাসম্ভব উদার হোক। তার সুফল পাক পিছিয়ে পড়া মানুষ। ভালো থাকুন।
