skip to Main Content

প্রাগৈতিহাসিক I মৌর্য সাম্রাজ্যের খাদ্য সমাচার

এই উপমহাদেশের সুদূর অতীতের সেই শাসনব্যবস্থা বর্তমান রন্ধনশৈলীতে কখনো পরোক্ষ আবার কখনো প্রত্যক্ষ ছাপ ফেলে রেখেছে। কেমন ছিল দুই হাজারের অধিক বছর আগেকার সেই খাদ্যসংস্কৃতি

মৌর্য সাম্রাজ্যের শাসনকাল ৩২২ থেকে ১৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য (খ্রিস্টপূর্ব ৩৪০-২৯৮) ও অশোকের (খ্রিস্টপূর্ব ২৭৩-২৩২) মতো শাসকদের দোর্দণ্ডপ্রতাপ ভারতীয় উপমহাদেশের বেশির ভাগ অংশে বিস্তৃত ছিল। এর অর্থনীতি নির্ভরশীল ছিল মূলত উর্বর গঙ্গা সমতটে স্থায়ী কৃষিকাজের ওপর। এ জন্যই গড়ে উঠেছিল উন্নত সেচ অবকাঠামো, সড়কপথ ও রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধান। দক্ষ পানি ব্যবস্থাপনা ও মৌসুমি ফসল আবর্তনের কারণে কৃষি উৎপাদনে ধান, গম, ডালসহ নানা ফসলের আবাদ হতো।
‘কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র’ হলো রাষ্ট্র পরিচালনা, রাজনীতি, অর্থনৈতিক নীতি ও সামরিক কৌশল-সম্পর্কিত একটি প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃত গ্রন্থ। এই গ্রন্থ অনুসারে, মৌর্য প্রশাসন কৃষি ও খাদ্য সরবরাহ বণ্টন তত্ত্বাবধান ও খাদ্য অর্থনীতির দেখভাল করার জন্য কর্মকর্তা নিয়োগ করত। কসাইখানা নিয়ন্ত্রণ, লবণ, চিনি ও গাঁজানো পানীয় উৎপাদন নিশ্চিত করা ছিল তাদের অন্যতম প্রধান কাজ।
প্রধান খাবার ও ঋতুগত বৈচিত্র্য
মৌর্যদের খাদ্যাভ্যাস ঋতুর ওপর নির্ভরশীল ছিল। শীতকালে খাবারের ক্ষেত্রে বাজরা ও ভাতের প্রাধান্য ছিল; আবার মটর, মুগ ও মসুরের মতো ডালের সঙ্গে খাওয়ার জন্য গ্রীষ্মকালে গম ও যবের গুরুত্ব বাড়ত। উন্নত জাতের বার্লির পাশাপাশি দ্রাকা ও ভারাকা জাতীয় নতুন ধানের জাতের প্রবর্তন ঘটেছিল সে যুগে। পূর্ববর্তী যুগের তুলনায় এ সময় গমের গুরুত্বও বাড়ে। গ্রুয়েল (কম গুরুত্বপূর্ণ শস্য থেকে তৈরি দই) ও গ্রোট (আকারে বড় একধরনের শস্য) সাধারণ মানুষের খাবার ছিল; এসব আবার কখনো কখনো দইয়ের সঙ্গে খাওয়া হতো। এ ছাড়া মুগ ডাল (মুগগা), মসুর (মাসুর), মটর (মাশা)সহ বিভিন্ন জাতের সাধারণ ডালও জায়গা পেয়েছিল প্রধান খাদ্যশস্যের তালিকায়। প্রাচীন ভারতীয় অর্থনীতিবিদ, দার্শনিক, রাজ-উপদেষ্টা এবং বিখ্যাত গ্রন্থের রচয়িতা কৌটিল্য ওরফে চাণক্য (খ্রিস্টপূর্ব ৩৭০-২৮৩) লিপিবদ্ধ করেছেন, সেই আমলে বছরে প্রায়ই তিনবার ফসল ফলানো হতো, যা নিবিড়ভাবে পরিচালিত কৃষি ব্যবস্থার ইঙ্গিত দেয়।
দুগ্ধজাত পণ্য, মাংস, ফল ও মিষ্টান্ন
গরু, মহিষ ও ছাগলের দুধ; সেই সঙ্গে মাখন, দই ও ঘি দৈনন্দিন খাবারের পাশাপাশি নানা আচার-অনুষ্ঠানেও ব্যবহারের চল ছিল; বিশেষ করে শিশু, গর্ভবতী নারী ও অসুস্থতা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া ব্যক্তিদের খাদ্যতালিকায় এসব অন্তর্ভুক্ত করা হতো। যদিও সনাতন, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের নিরামিষভোজীদের প্রভাব ছিল; তবে মাংস একদমই পাতে উঠত না, এমন কথা বলা যাবে না; বিশেষ করে মাছ, ছাগল ও হাঁস-মুরগির মাংস জায়গা পেত খাদ্যতালিকায়। অবশ্য মাংস ভক্ষণের অধিক চল ছিল যোদ্ধা এবং বিশেষ শ্রেণির কিছু মানুষের মধ্যে। কসাইখানার সুপারিনটেনডেন্টের মতো রাজ্যের আমলাদের কাজ ছিল মাংস সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা।
মিষ্টি খাবারের ক্ষেত্রে মধু ও আখের উৎপাদিত পদার্থ; যেমন রস, কাঁচা চিনি (গুঁড়া), চিনির মিছরি এবং পরিশোধিত রূপের ওপর নির্ভর করা হতো; বিশেষ করে অভিজাতদের মধ্যে এসব মিষ্টান্নের জনপ্রিয়তা বেশি ছিল। আম, কলা, ডালিম ও মৌসুমি ফল ছিল উন্নত জলখাবার। ব্যবসায়ীরা বাজারে ঋতু অনুসারে বিভিন্ন ধরনের ফল রাখতেন তাদের দোকানে।
মসলা ও ভেষজ মিশ্রণ
মৌর্য রাঁধুনিরা বিভিন্ন ধরনের দেশীয় মসলা ও ভেষজ মিশ্রণ ব্যবহার করতেন। এগুলোর মধ্যে ছিল হলুদ, জিরা, ধনে, সরিষা, শুকনো আম, ভোজ্য কর্পূর ও ত্রিকটু (লম্বা মরিচ, গোলমরিচ, শুকনো আদা), ত্রিজাতক (দারুচিনি, এলাচি, তমালা) এবং পঞ্চকোলার (লম্বা মরিচের শিকড়, আদা ও অন্যান্য শিকড়) মতো মিশ্রণ। মরিচ ও গোলমরিচ বাণিজ্য কেন্দ্রগুলো থেকে আমদানির পাশাপাশি আঞ্চলিকভাবেও উৎপাদন করার চল ছিল। টমেটোর প্রচলন তখনো ঘটেনি বলে আদা, গোলমরিচ ও মরিচের (পিপ্পালি) চাহিদা ছিল বেশি।
ভারতীয় পরম্পরাগত ঔষধি ব্যবস্থা আয়ুর্বেদের প্রাচীন গ্রন্থ ‘চরক সংহিতা’য় পরিমিত ও সুষম পুষ্টির ওপর জোরারোপ লক্ষ করা যায়। খাবারের পছন্দ ঋতু, স্বাদের গুণমান (মিষ্টি, টক, নোনতা, তেতো, ঝাল, কষা), শারীরিক চাহিদা ও স্বাস্থ্যের অবস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হতো।
রান্নার পদ্ধতি ও সরঞ্জামাদি
মৌর্য যুগে রান্নার জন্য মাটির ও ধাতব পাত্র ব্যবহার করা হতো। এর মধ্যে ছিল মাটির চুলা ও তন্দুরের মতো চুলা, পেষণকারী পাথর, বেকিং প্লেট (তাওয়া) এবং ব্রোঞ্জ বা তামার তৈরি কংস চুলা বা কাং বেড-স্টোভের মতো প্রাথমিক রান্নার পাত্র। সাধারণ রান্নার পদ্ধতির মধ্যে ছিল ভরজিতা (স্কিউয়ারে মাংস ভাজা), পিশতা (মাংসকে প্যাটি করা), প্রতাপ্ত (মসলা দিয়ে ভাজা) এবং শুল্য (গ্রিল করা)। ভাত বিভিন্ন উপায়ে তৈরি করা হতো; যেগুলোর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ক্ষীরৌদন (সাধারণ দুধ দিয়ে), খিচুড়ি (ডাল দিয়ে), মাংসৌদন (মাংস দিয়ে), তিলৌদন (তিল দিয়ে), দধিওদন ও টকরা (দই দিয়ে)। সুরা নামে একধরনের পানীয় ছিল, যা যব, বাজরা, চাল, আখ, খেজুর বা ফল দিয়ে তৈরি করে গাঁজানো হতো। এর উৎপাদন ও বিপনন রাষ্ট্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত ছিল। অর্থশাস্ত্রের দ্বিতীয় বইতে সুরার তত্ত্বাবধায়ক সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়েছে। এটির ব্যবস্থাপনা এবং করের দায়িত্বে কারা ছিলেন, ওই গ্রন্থসূত্রে তা-ও জানা যায়।
সাধারণ বনাম রাজকীয় ভোজ
বেশির ভাগ মানুষের প্রতিদিনের খাবারের মধ্যে ছিল ভাত বা বাজরা, ডালের স্যুপ বা ডাল, দই, শাকসবজি ও অল্প পরিমাণে ঘি বা মাখন। ধনী বা অভিজাত পরিবার ফল, মিষ্টি (মধু বা চিনিযুক্ত ক্যান্ডি) ও মাঝে মাঝে মাংস বা মাছ যোগ করত।
প্রায়শই মেঝেতে বসে, হাতে খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। কলা পাতা, সাধারণ মাটির বা ধাতব থালায় পরিবেশন করা হতো খাবার। বিপরীতে, রাজকীয় ভোজগুলোতে ছিল ব্যাপক আয়োজন। সেখানে মসলাদার তরকারি, মধু-চিনিযুক্ত মিষ্টান্ন, বিভিন্ন সুস্বাদু খাবার, গাঁজানো সুরা ও আমদানি করা ওয়াইন পরিবেশনের চল ছিল।
গ্রিকদের কাছে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য পরিচিত ছিলেন সান্দ্রোকোত্তোস বা আন্দ্রাকোত্তাস নামে। অন্যদিকে মেগাস্থিনিস (খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০-২৯০) ছিলেন প্রাচীন গ্রিসের একজন পর্যটক ও ভূগোলবিদ। তিনি এশিয়া মাইনরে জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে সিরিয়ার রাজা সেলিয়াকাস ১-এর রাজকীয় দূত হিসেবে ভারতীয় রাজা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজদরবারে দায়িত্ব পালন করেন। তার দরবারে থাকাকালীন মেগাস্থিনিস উল্লেখ করেছিলেন, এই অঞ্চলের উর্বরতা বছরে নানাবিধ ফসল উৎপাদনের সুযোগ করে দিয়েছে। যদিও তিনি দৈনন্দিন খাবারের বিবরণ দেননি; তবে জমির প্রাচুর্যের প্রশংসা করেন, যা পাটলিপুত্রের মতো শহরে খাদ্য প্রাচুর্যের ইঙ্গিত দেয়।
খাদ্য ও ধর্মীয় প্রভাব
সনাতন, বৌদ্ধ ও জৈন নীতিগত শিক্ষা মৌর্য খাদ্য সংস্কৃতিকে রূপ দিয়েছে। অহিংসার ধারণা এবং খাদ্যতালিকাগত ব্যবস্থা গরুর মাংস বর্জনকে প্রভাবিত করেছিল। শিক্ষিত ও আধ্যাত্মিক শ্রেণির মধ্যে মূলত নিরামিষ জীবনধারাকে উৎসাহিত করা হয়েছিল। একই সময়ে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র নিয়ন্ত্রিতভাবে মাংস খাওয়ার অনুমতি এবং পশু জবাইয়ের জন্য প্রশাসনিক কাঠামো নির্দিষ্ট করার প্রসঙ্গ তুলে ধরেছে। এটি নিরামিষভোজী এবং যারা উভয় ধরনের খাবার খান, তাদের বাস্তবসম্মত সহাবস্থানের ইঙ্গিত দেয়।
আয়ুর্বেদিক খাদ্যাভ্যাস, বিশেষ করে মিতাহার নীতি, ছয়টি স্বাদ তথা মিষ্টি (মধুর), টক (অম্ল), নোনতা (লবণ), ঝাল (কটু), তেতো (তিক্ত) ও কষার পরিমিতকরণ এবং ভারসাম্য বজায় রাখার সুপারিশ করেছিল। ঋতুগত সমন্বয় ও মেজাজ, বয়স, পেশা এবং স্বাস্থ্যের সঙ্গে খাবারের সামঞ্জস্যের মতো বিষয়গুলো মৌর্য যুগে ব্যাপকভাবে বিবেচিত হতো।
সামাজিক স্তরবিন্যাস ও টেবিল শিষ্টাচার
সাধারণ মানুষ সাধারণ খাবার খেতেন। ডাল ও দই দিয়ে ভাত বা বাজরার গুঁড়া; মাঝেমধ্যে সবজি বা ফলের টুকরা। বিপরীতে, অভিজাত ও রাজপরিবারের সদস্যরা বৈচিত্র্যময় খাবার উপভোগ করতেন। মাংস, মিষ্টি, ফল, চিনি, মসলাদার ভাত এবং রাজদরবারের উৎসব ও আনুষ্ঠানিক ভোজসভায় গাঁজানো পানীয় জায়গা পেত।
খাদ্য বিতরণে রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে ছিলেন খানসামাহ। কসাইখানা নিয়ন্ত্রণ, পানীয় উৎপাদন, লবণ, চিনি ও শস্যের ভান্ডার পরিচালনায় তিনি সুপারিনটেনডেন্টের ভূমিকা পালন করতেন। দাম নিয়ন্ত্রণ ও মান নিশ্চিত করার জন্য শাকসবজি, ফুল, বস্ত্র ও অন্যান্য পণ্যের ওপর কর নির্ধারণ করা হয়েছিল। হাতে খাওয়া, পাতা বা হাতে তৈরি প্লেটে খাবার পরিবেশন করা এবং দলবদ্ধভাবে বসার ব্যবস্থা ছিল খাদ্য শিষ্টাচারের অন্তর্ভুক্ত। এগুলো সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে শক্তিশালী করেছিল। ধারণা করা হয়, রাজকীয় টেবিলে সম্ভবত স্বাস্থ্য ও মর্যাদা বিবেচনায় খাবার পরিবেশন জন্য কাঁসার মতো পলিশ করা ধাতু দিয়ে তৈরি বিশেষ পাত্র ব্যবহার করা হতো।
রন্ধনসম্পর্কীয় উত্তরাধিকার
মৌর্য সাম্রাজ্যের খাদ্যসংস্কৃতিকে পরবর্তীকালের ভারতীয় উপমহাদেশীয় রন্ধনপ্রণালি অনেকটাই অনুকরণ করেছিল। সনাতন, বৌদ্ধ ও জৈন ঐতিহ্যের মাধ্যমে প্রতিদিনের খিচুড়ি-ধাঁচের খাবার, মসুর ডালের স্যুপ, ভাতের বৈচিত্র্য ও দুধকেন্দ্রিক খাবারগুলো টিকে ছিল। মসলার ধরন ও মিশ্রণ আয়ুর্বেদিক ও ধর্মীয় গ্রন্থে পাওয়া প্রাথমিক রেসিপিগুলোর প্রতিধ্বনি।
পরবর্তী মধ্যযুগীয় ইসলামিক যুগ ও মোগল শাসনকালে মরিচ, টমেটো, নতুন নানাবিধ সবজি ও পারস্যের রান্নার কৌশল প্রবর্তিত হলেও মৌর্য রন্ধনসম্পর্কীয় ভিত্তি শস্য, ডাল, দুগ্ধজাত পণ্য, মসলা, মধু ও গাঁজানো পানীয় এই উপমহাদেশীয় খাদ্যসংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়ে যায়।

 ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি ও চিত্রকর্ম: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top