তনুরাগ I দশপুষ্পম
দশের সম্মিলিত শক্তি। তাতেই ত্বকের দীপ্তি, দেহের পুনর্জাগরণ আর মনের প্রশান্তি। তেল, লেপ, স্নানজল বা ভেষজ বডির্যাপ রূপে
প্রকৃতির ভেষজ ভান্ডারে লুকিয়ে আছে অসংখ্য অমূল্য রত্ন, যেগুলো যুগের পর যুগ ধরে মানুষের সুস্থতা ও সৌন্দর্যের অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী হয়ে উঠেছে। দক্ষিণ ভারতের সমৃদ্ধ আয়ুর্বেদিক ঐতিহ্যে এমনই এক অনন্য ভেষজ সংমিশ্রণ হলো দশপুষ্পম। দশ প্রকার ভিন্ন ভিন্ন গাছ ও ফুলের সমাহার থেকে গড়ে ওঠা এই ভেষজ মিশ্রণকে কেবল একটি চিকিৎসা উপাদান হিসেবে নয়, বরং এক সম্পূর্ণ জীবনধারার অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
আজকের বিশ্বে যেখানে স্কিন কেয়ারের সংজ্ঞা প্রায়শই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে কেমিক্যালভিত্তিক প্রসাধনীতে, সেখানে দশপুষ্পম আবারও ফিরিয়ে আনছে প্রাকৃতিক যত্নের আস্থা; বিশেষত বডি স্কিন কেয়ারে এর কার্যকারিতা নতুনভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করছে, যা একদিকে ঐতিহ্যকে জীবিত রাখছে, অন্যদিকে আধুনিক সৌন্দর্যচর্চায় যোগ করছে ভিন্নমাত্রা।
দশপুষ্পম কী
‘দশ’ মানে দশটি, আর ‘পুষ্পম’ মানে ফুল। নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এর আসল তাৎপর্য—দশটি ভিন্ন ভিন্ন ভেষজ ফুলের অনন্য সমন্বয়। দক্ষিণ ভারতের আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাপদ্ধতিতে এই দশপুষ্পমকে বলা হয় প্রকৃতির এক বিশেষ উপহার, যা দেহ ও ত্বক—উভয়ের সামগ্রিক যত্নে ব্যবহার হয়ে আসছে যুগের পর যুগ।
সাধারণত দশপুষ্পমে যে ভেষজ গাছগুলো ব্যবহৃত হয়, সেগুলো হলো—
করুকা (Cyperus rotundus): প্রদাহ ও ব্যথা উপশমে কার্যকর।
নিলাপানা (Curculigo orchioides): ত্বকের তারুণ্য ধরে রাখতে সহায়ক, শক্তি ও প্রাণশক্তি বাড়ায়।
থিরুথালি (Tragia involucrata): চুলকানি ও ত্বকের অ্যালার্জি কমায়।
পুথিরি (Biophytum sensitiuvm): অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ, ত্বকের কোষ পুনর্গঠনে সহায়ক।
মুকুটি (Aerva lanata): শরীর ডিটক্সিফাই করে, প্রস্রাবজনিত সমস্যায় উপকারী।
কারুকিল্লা (Evoluvlus alsinoides): মানসিক চাপ কমায়, ঘুম ভালো করে, ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায়।
কান্না (Ipomoea sepiaria): শারীরিক দুর্বলতা কাটায়, ত্বক মসৃণ করে।
ভেলিপ্পালা (Emilia sonchifolia): ক্ষত নিরাময় ও প্রদাহ কমাতে কার্যকর।
অর্কপুষ্পম (Desmodium gangeticum): রক্ত বিশুদ্ধ করে, শরীরের ভেতর থেকে দূষণমুক্ত করে।
উপ্পুকন্নি (Ipomoea reniformis): ত্বকের দাগ হালকা করে, শুষ্কতা কমায়।
প্রতিটি ভেষজের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে—কারও মূল প্রদাহ কমায়, কারও পাতা ত্বক উজ্জ্বল করে, আবার কারও ফুল শরীরকে ডিটক্সিফাই করে। তবে এগুলো একত্রে ব্যবহার করলে কার্যকারিতা বহুগুণ বেড়ে যায় এবং ত্বক ও শরীরের সর্বাঙ্গীণ যত্নে চমৎকার ফল দেয়।
পুরানো পাতায়
কেরালার আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাশাস্ত্রে দশপুষ্পম শুধুই ভেষজ মিশ্রণ নয়, বরং প্রজন্মান্তরে প্রবাহিত এক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। কয়েক শতাব্দী আগে থেকে এটি বিশেষ করে নারীর প্রসব-পরবর্তী যত্নে অপরিহার্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। প্রসবের পর মায়ের শরীরে যে শারীরিক পরিবর্তন ঘটে—পেশি ঢিলে হয়ে যাওয়া, ত্বকে দাগ বা স্ট্রেচমার্ক তৈরি হওয়া—এসব সমস্যার সমাধানে দশপুষ্পম অয়েল ছিল নির্ভরযোগ্য ভরসা। শুধু মায়ের যত্নই নয়, নবজাতকের ক্ষেত্রেও দশপুষ্পমের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। বিশ্বাস করা হতো, শিশুর জন্মের পর প্রথম কয়েক মাস প্রতিদিন শরীরে দশপুষ্পম তেলের হালকা মালিশ করলে হাড় শক্ত হয়, ত্বক কোমল থাকে, আর শরীর রোগ প্রতিরোধে সক্ষম হয়। সময়ের সঙ্গে ব্যবহার পদ্ধতিতে কিছুটা পরিবর্তন এলেও আজকের দিনে দশপুষ্পম আবারও আধুনিক স্কিন কেয়ার ও বডি কেয়ার রুটিনে অপরিহার্য হয়ে উঠছে। ত্বক মসৃণ, উজ্জ্বল ও দাগমুক্ত রাখতে এটি এখন কেবল ঐতিহ্যের অংশ নয়, বরং আধুনিক বিউটি ইন্ডাস্ট্রির এক মূল্যবান সংযোজন।
ত্বকের গভীরে আর্দ্রতা
শরীরের ত্বকেরও মুখের মতো নিয়মিত আর্দ্রতার প্রয়োজন হয়। বাজারে পাওয়া সাধারণ ময়শ্চারাইজার যেখানে শুধু বাইরের স্তরে কাজ করে, সেখানে দশপুষ্পম তেল ভেতর অব্দি কোষে পুষ্টি ও আর্দ্রতা জোগায়। ফলে ত্বক হয় নরম, মসৃণ ও দীর্ঘস্থায়ীভাবে উজ্জ্বল।
দাগ ও স্ট্রেচমার্ক হালকা করা
গর্ভধারণের পর কিংবা হঠাৎ ওজন বেড়ে গেলে শরীরে স্ট্রেচমার্ক পড়া স্বাভাবিক। দশপুষ্পম তেলের প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ভেষজ উপাদান ত্বকের ইলাস্টিসিটি বাড়িয়ে দেয়, ফলে দাগ ও স্ট্রেচমার্ক ধীরে ধীরে হালকা হয় এবং ত্বক ফিরে পায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।
বডি ব্রণ ও র্যাশ প্রতিরোধ
শুধু মুখ নয়, অনেক সময় পিঠ, বুক বা কাঁধেও ব্রণ দেখা দেয়। দশপুষ্পম তেলের প্রদাহনাশক গুণ বডি ব্রণ কমাতে কার্যকর। একই সঙ্গে ঘাম, ধুলো বা গরমের কারণে হওয়া র্যাশ এবং ঘামাচি থেকেও ত্বককে আরাম দেয়।
অ্যান্টি-এজিং বডি কেয়ার
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের ত্বকেও ভাঁজ, ঝুলে পড়া ভাব ও নিস্তেজতা দেখা দেয়। নিয়মিত দশপুষ্পম তেল মালিশ করলে রক্তসঞ্চালন বাড়ে, ত্বক টান টান হয়, আর বার্ধক্যের ছাপ অনেকটা বিলম্বিত হয়। এটি প্রাকৃতিক অ্যান্টি-এজিং কেয়ার হিসেবে বিশেষভাবে জনপ্রিয়।
সূর্য থেকে সুরক্ষায়
রোদে থাকার ফলে হাত, ঘাড় বা পা সহজে কালচে হয়ে যায়। দশপুষ্পম এই সানবার্ন ও ট্যান দ্রুত নিরাময় করে, ত্বকের দাগ হালকা করে এবং পোড়া ভাব থেকে মুক্তি দেয়। গ্রীষ্মকালে সান-কেয়ারের জন্য এটি এক অসাধারণ বিকল্প।
মৌসুমি যত্নে
গরমকালে দশপুষ্পম তেল ঘামাচি, ফুসকুড়ি ও অতিরিক্ত তাপজনিত জ্বালাপোড়া থেকে আরাম দেয়; শীতে এটি প্রাকৃতিক ময়শ্চারাইজার হিসেবে কাজ করে, ত্বকের শুষ্কতা ও রুক্ষতা প্রতিরোধ করে। আবার বর্ষার আর্দ্র মৌসুমে এই ভেষজ তেল ত্বককে অ্যালার্জি ও ফাঙ্গাল ইনফেকশনের ঝুঁকি থেকে সুরক্ষা দেয়। ফলে বছরের প্রতিটি ঋতুতেই ত্বকের সঠিক যত্নে দশপুষ্পম তেল হয়ে ওঠে ভরসার সঙ্গী।
ব্যবহার পদ্ধতি
শরীরের ত্বকের সম্পূর্ণ যত্ন নিতে দশপুষ্পম একটি প্রাকৃতিক ও কার্যকর উপায়। গোসলের আগে হালকা গরম করে তেল দিয়ে সারা শরীরে ২০ মিনিট মালিশ করলে রক্তসঞ্চালন বাড়ে, ত্বকের কোষ ভেতর থেকে পুষ্টি পায় এবং ত্বক হয় কোমল, মসৃণ ও দীপ্তিময়। পাশাপাশি এটি মানসিক প্রশান্তি দেয় এবং দিনের চাপ কমাতে সাহায্য করে। প্রসব-পরবর্তী নারীদের জন্য দশপুষ্পম তেল বিশেষভাবে কার্যকর। নিয়মিত মালিশে পেশির শিথিলতা কমে, ত্বক টান টান থাকে এবং প্রসব-পরবর্তী দাগ ও স্ট্রেচমার্ক ধীরে ধীরে হালকা হয়। শুকনা দশপুষ্পম গুঁড়া সামান্য চিনি বা সমান পরিমাণ বেকিং সোডার সঙ্গে মিশিয়ে তেল দিয়ে ঘষলে এটি প্রাকৃতিক বডি স্ক্রাব হিসেবে কাজ করে, মৃত কোষ দূর করে এবং ত্বক উজ্জ্বল ও মসৃণ রাখে। একইভাবে, দশপুষ্পম পাতা বা মূলকে তেল বা নারকেল তেলের সঙ্গে হালকা গরম করে কয়েক ঘণ্টা রেখে ব্যবহার করলে ত্বক গভীরভাবে হাইড্রেটেড ও পুষ্ট হয়। হাত বা পায়ের ত্বকের জন্য দশপুষ্পম পাউডার দই বা হালকা তেলের সঙ্গে মিশিয়ে প্যাক হিসেবে ব্যবহার করলে শুষ্কতা দূর হয় এবং ত্বক কোমল থাকে। সূর্যের ক্ষতি থেকে সুরক্ষার জন্য দশপুষ্পম পাউডার, অ্যালোভেরা জেল ও নারকেল দুধ মিশিয়ে তৈরি প্যাক লাগানো যায়, যা ত্বক ঠান্ডা করে এবং সানবার্ন বা ট্যান হালকা করতে সাহায্য করে। এইভাবে দশপুষ্পম তেল ও প্যাকের নিয়মিত ব্যবহার শুধু ত্বককে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল রাখে না, বরং পুরো শরীরের স্বস্তি, নমনীয়তা ও সতেজতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
অন্যান্য উপকারিতা
দশপুষ্পম শুধুই বডি কেয়ারে সীমাবদ্ধ নয়; এটি শরীরের অন্যান্য দিকেও বিস্তর সুবিধা দেয়। নারীস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে এটি বিশেষভাবে কার্যকর—হরমোন ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে, মাসিকের অনিয়ম কমায় এবং প্রসব-পরবর্তী হরমোনের ভারসাম্য পুনরুদ্ধারে সহায়ক হিসেবে কাজ করে। মানসিক প্রশান্তির জন্যও এটি অপরিহার্য; নিয়মিত দশপুষ্পম তেল মালিশ শরীরের সঙ্গে সঙ্গে মনকেও শান্ত করে; অনিদ্রা, উদ্বেগ ও অস্থিরতা কমাতে কার্যকর। তা ছাড়া চুলের যত্নে এটি অত্যন্ত সহায়ক—খুশকি কমায়, চুল পড়া রোধ করে এবং চুল ঘন ও মসৃণ রাখে। দশপুষ্পম তেল শরীর, চুল ও মন—তিন দিকেই সামগ্রিক সুস্থতা ও সতেজতা দেয়।
সতর্কতা
দশপুষ্পম তেল ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু সতর্কতা মেনে চলা গুরুত্বপূর্ণ। বাজার থেকে খাঁটি এবং অরিজিনাল কেরালার ব্র্যান্ডের তেল কিনতে হবে; ঘরে তৈরি করতে চাইলে শুকনা ভেষজ নিয়ে তিলের তেলে হালকা সেদ্ধ করে ছেঁকে ব্যবহার করা যায়। শিশুর জন্য অবশ্যই কেমিক্যালমুক্ত ভ্যারিয়েন্ট ব্যবহার করতে হবে। অতিসংবেদনশীল ত্বকে ব্যবহার করার আগে প্যাচ টেস্ট করা গুরুত্বপূর্ণ, এবং দীর্ঘমেয়াদি অভ্যন্তরীণ ব্যবহার (যেমন ক্বাথ বা সেবন) শুধু আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকের পরামর্শে করা উচিত। গর্ভাবস্থায় চিকিৎসকের অনুমতি ছাড়া দশপুষ্পম তেল বা প্রস্তুত পণ্য ব্যবহার করা উচিত নয়।
শিরীন অন্যা
মডেল: প্রিয়ন্তী
মেকওভার: পারসোনা
জুয়েলারি: ক্যানভাস বাই তন্বী কবির
ছবি: কৌশিক ইকবাল
