skip to Main Content

ছুটিরঘণ্টা I নিউইয়র্কের তিন দ্বীপ

রুজভেল্ট আইল্যান্ড, কনি আইল্যান্ড ও সিটি আইল্যান্ড। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের আশপাশের তিনটি দ্বীপ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত দ্বীপগুলো ঘুরে এসে লিখেছেন ফারুক আহমেদ

রুজভেল্ট আইল্যান্ড
নিউইয়র্কে সুউচ্চ দালানের ফাঁকে এমন সব বিনোদন কেন্দ্র, অবসরযাপনের জায়গা আছে যে, তাতে চমকে যেতে হয়। যেখানে মনে হবে দালান আর কংক্রিটের স্থাপনা ছাড়া আর কিছু নেই, সেখানে বাঁক ঘুরেই দেখা যাবে, বড়সড় এক সবুজ উদ্যান দাঁড়িয়ে। তেমনি একটি অবকাশযাপনের জায়গা রুজভেল্ট আইল্যান্ড। ম্যানহাটনের উঁচু উঁচু অট্টালিকার ভেতর এক অপরূপ দ্বীপ। নিউইয়র্কের যে কেউ সারা দিন এখানে কাটিয়ে দিতে পারবেন। তার জন্য বিরাট কোনো আয়োজন করে যেতে হবে, এমন নয়। খুব নিকটে, সাবওয়ে ধরে বা ট্রামওয়ে দিয়ে ঠিক পৌঁছে যাওয়া সম্ভব।
তবে জায়গাটা ছোট্ট একটি দ্বীপ, সমুদ্রের সঙ্গে সংযোগ থাকা ইস্ট রিভারের মাঝখানে এর অবস্থান। নদীর একদিকে ম্যানহাটন, অন্যদিকে কুইন্স। মূল ভূমি থেকে রুজভেল্টে সরাসরি আসার একমাত্র পথ হচ্ছে সাবওয়ে। নিউইয়র্ক মেট্রোর এফ ট্রেনে চড়ে, টানেলের নিচ দিয়ে ট্রেনটি এখানে পৌঁছায়। এখানকার স্টেশন ভূমি থেকে প্রায় ১০০ ফুট নিচে। সাবওয়েতে রুজভেল্ট স্টেশনের কাছাকাছি এলে কিন্তু আপনি এমনি এমনি টের পেয়ে যাবেন। কেননা এখানে নদীর নিচ দিয়ে ট্রেন যাওয়ার সময় কান ধরে আসে; মনে হয় কানে কিছু একটা চেপে ধরল।
রুজভেল্ট আমাদের যাওয়া হয় ট্রামওয়েতে চড়ে। এটা ম্যানহাটন থেকে ইস্ট রিভার পার হয়ে রুজভেল্টে নামে। এই ট্রামওয়ে হলো রুজভেল্ট পৌঁছার এক আনন্দযাত্রা। ইস্ট রিভারের ওপর দিয়ে যখন হাওয়ায় ভেসে ভেসে যায়, তা বিরাট সুখানুভূতির উদ্রেক করে। এ ছাড়া ফেরিও আছে শুনেছি। পরে দেখলাম, ফেরিতে করে বহু মানুষই ইস্ট রিভার প্রদক্ষিণ করছেন, মানে নৌবিহারে যাচ্ছেন। এ রকম নৌবিহার নিউইয়র্কের অনেক জায়গায় দেখা যায়। এর কারণ, নিউইয়র্কের বুক চিরে এদিকে-ওদিকে অসংখ্য নদী চলে গেছে। এগুলো সমুদ্রের সঙ্গে সন্ধিযুক্ত। ফলে নদীগুলো খরস্রোতা, খুব প্রাণচঞ্চল।
রুজভেল্টের মতো নিউইয়র্কের জনপ্রিয় জায়গাগুলো আমরা কোনো না কোনোভাবে দেখে ফেলি। এই ট্রামওয়ে, যেটা ম্যানহাটনের সঙ্গে রুজভেল্টকে যুক্ত করেছে, তা যারা ‘স্পাইডারম্যান’ সিনেমাটা দেখেছেন, তাদের ঠিকই দেখা হয়েছে গেছে। এ ছাড়া হলিউডের আরেক সাড়াজাগানো সিনেমা ‘২০০২’-এও এই ট্রামওয়ে দেখতে পাওয়া যায়। সিনেমা থেকে বাস্তবে এসে স্বাভাবিকভাবে উত্তেজনা খানিক বেশি পাওয়া যায়, তাতে কিন্তু সন্দেহ নেই।
গেল বছরের মে মাসে ১৫ দিনের আমেরিকা ভ্রমণের প্রায় পুরোটা সময় আমি থেকেছি জোনাকি আপা-শ্যামল ভাইয়ের লং-আইল্যান্ডের বাসায়। মুক্তধারা নিউইয়র্ক বইমেলায় যোগ দেওয়ার ফাঁকে এক সকালে আমাকে নিয়ে শ্যামল ভাই বেরিয়ে পড়েন। প্রথম দর্শন স্ট্যাচু অব লিবার্টি (তার বর্ণনা এখানে নেই), তারপর রুজভেল্ট আইল্যান্ড। ট্রামওয়ে দিয়ে রুজভেল্টে যাওয়াটা হাওয়ায় ভেসে যাওয়ার মতো, নিচে ওয়েস্ট রিভার, ডানে-বামে সুউচ্চ অট্টালিকার সারি আর ট্রামওয়েতে মানুষের গিজগিজ। এতে ওঠার পর শ্যামল ভাই বললেন, ‘কাচের পাশে চলে যান, তাহলে দেখতে পাবেন।’ আমি তার পরামর্শে, চেপেচুপে কোনোমতে কাচঘেঁষে দাঁড়াতে সক্ষম হই। কিন্তু পথ তো মাত্র কয়েক মিনিটের; ফলে কিছু বোঝার আগেই নেমে যেতে হলো। শুধু ট্রামওয়ে থেকে দেখতে পেলাম কিছু নৌযান নদী বরাবর যাচ্ছে, আর দেখতে পেলাম রুজভেল্টের সবুজ গাছের সারি ও হাতছানি।
রুজভেল্ট আইল্যান্ডে ব্যক্তিগত গাড়ি নেই; আছে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট। বাসে মানুষের কিছু চাপ দেখা গেলেও আইল্যান্ডটি একদম ছিমছাম। উঁচু দালানই বেশি; আর সবুজ ঘাস এবং পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া তীব্র স্রোতের ইস্ট রিভার। বাসটি দ্বীপের পূর্ব দিকের শেষ স্টপেজে আমাদের নামিয়ে দিলে আরও পূর্ব দিকে হাঁটতে শুরু করি।
বাপ-ছেলে হবে সম্ভবত, বড়শি নিয়ে বসেছেন মাছ ধরতে। খরস্রোতা নদীতে বড়শি ফেলে রেখেছিলেন। আমরা যখন ওদের কাছে পৌঁছালাম, ঠিক তখনই একটা বড় মাছ, তা হাঙরও হতে পারে, শক্ত বড়শির সুতা ছিঁড়ে নিয়ে গেল। এই ঘটনা দেখার জন্য আমরা মিনিটখানেক দাঁড়িয়ে আবার হাঁটতে শুরু করি। হেঁটে হেঁটে যখন একদম পূর্ব প্রান্তে পৌঁছে গেছি, তখন নদীর ওপারেই ম্যানহাটনের বিরাট বিরাট দালানের সারি দেখা গেল। আর এই পূর্ব প্রান্তটা সরু হতে হতে একদম ছোট হয়ে নদীতে মিশে গেছে। এখানেই একটা সবুজ পার্ক, যার পূর্ব প্রান্তে ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ তৈরি করা হয়েছে। সেখানে নানা রকম স্থাপনার সঙ্গে রুজভেল্টের একটি মূর্তিও আছে। এখানকার নানা রকম স্থাপনার সবই ব্রোঞ্জের তৈরি। যেন একটি ছোটখাটো স্কাল্পচার পার্ক।
এই স্মৃতিসৌধের সঙ্গে আমাদের একটি যোগসূত্র তৈরি হয়ে গেল। রুজভেল্ট স্মরণে এই পার্ক ও স্মৃতিসৌধের নকশা করেন বিখ্যাত স্থপতি লুই আই কান, যিনি আমাদের জাতীয় সংসদের নকশাকার। এই স্থপতির জীবিতকালে এর নকশা হলেও তা বাস্তবায়িত হয় তার মৃত্যুর বেশ কিছু বছর পর। রুজভেল্টের এই পূর্ব প্রান্তের অপূর্ব পার্ক ও স্মৃতিসৌধ দেখলে মনে হবে নদীর ভেতর ভাসমান কোনো জাহাজ। আর ইস্ট রিভার ঘিরে একের পর এক রিভারক্রুজের জাহাজ পার হতে দেখা গেল। ওখান থেকে আমরা ফিরে এলাম সাবওয়ে চড়ে। যেন মাটির অনেক গভীরে নেমে গিয়েছি আমরা, গা ছমছম!
কনি আইল্যান্ড
নিউইয়র্ক সিটি ঘিরে অসংখ্য দ্বীপ। মোড় ঘুরে, সুউচ্চ দেয়াল পেরিয়ে দ্রুতই সামনে এসে হাজির হয় এসব দ্বীপের সারি। আটলান্টিক মহাসাগরের ভেতর ঢুকে যাওয়া পৃথিবীর রাজধানীর দ্বীপগুলো একেকটা মুগ্ধতার সরোবর যেন। কসমোপলিটান, কিন্তু প্রাণবন্ত-অবারিত স্বস্তি ও সৌন্দর্য লেগে আছে এসবে। কনি আইল্যান্ড তেমনই একটি জায়গা। যার নাম আইল্যান্ড হলেও বাস্তবে মেইনল্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত। দ্বীপ নয়, তবে দ্বীপেরই আত্মীয় বলা যায় একে- উপদ্বীপ।
কনি আইল্যান্ড নিউইয়র্কবাসী এবং এ শহরে বেড়াতে আসা পর্যটকদের কাছে বিশেষ আকর্ষণের। এর অবস্থান ব্রুকলিনের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে। যাওয়ার প্রধান দুটি মাধ্যমের একটি হলো ব্যক্তিগত গাড়ি, অন্যটি মেট্রো মানে সাবওয়ে। ব্যক্তিগত গাড়ির ক্ষেত্রে নিউইয়র্কের সবখানে একই সমস্যা, পার্কিং। এখানেও তা-ই, গাড়ি রাখার বড় জায়গা থাকা সত্ত্বেও। ফলে পার্কিংয়ের জায়গা খুঁজে খুঁজে জীবন হয়রান হয়ে যায়। আর ভুল জায়গায় রাখলে টিকিট, মানে গুনে গুনে ৬০ ডলার জরিমানা!
আমরা, মানে বন্ধু শাকিল আর আমি রওনা হই সাবওয়ে ধরে। ব্রঙ্কস থেকে সাবওয়েতে এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগে। প্রথম আপার মানে মাটির ওপরে, এরপর প্রায় সবটাই মাটির নিচ দিয়ে, তারপর শেষ মুহূর্তে মাটি ফুঁড়ে আবার ওপরে উঠে রেল। নিউইয়র্কের সাবওয়ে আরেক রহস্য। এফ ট্রেন, আই ট্রেন, ডি ট্রেন- এ রকম অনেক ট্রেন রয়েছে। নিচেই স্টেশনে নেমে এক ট্রেন থেকে আরেক ট্রেন বদল করতে হয়। নতুন কারও পক্ষে যথাযথভাবে এই বদল সম্ভব নয়। আস্তে আস্তে বুঝতে পারা যায়, কোন ট্রেন আপনাকে কোথায় নিয়ে যাবে। নিচে ট্রেনের তিন স্তরে প্ল্যাটফর্ম। এক স্তর থেকে অন্য স্তরে গিয়ে উঠে গেলেই যে ঠিক জায়গায় পৌঁছে যাব, এমন নয়। আপডাউন আছে; আছে বিবিধ নামের ট্রেন। যাহোক, ডি, এফ, এন ও কিউ- এই চার ট্রেন যায় কনি আইল্যান্ডে। এসব ট্রেনের শেষ গন্তব্যস্থল এই উপদ্বীপ। গন্তব্যভেদে এখানে আসার ট্রেন একেক জায়গা থেকে একেকটা।
আমাদের বয়ে আনা ট্রেনটি যখন নিচ থেকে মাটির ওপর উঠল, জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখি সমুদ্রের নীল জল। দেখা গেল সৈকতজুড়ে বিশাল থিমপার্কের নানা অনুষঙ্গও। আমেরিকায় এসে এটাই আমার প্রথম সৈকত দেখা। ফলে ট্রেন থেকেই যেটুকু নজরে আসে, তা দেখতে দেখতে ট্রেন স্টেশনে এসে দাঁড়িয়ে গেল।
সাবওয়ে থেকে নেমে সরাসরি চলে যাওয়া যায় সৈকতে। স্টেশন পেরিয়ে বড় একটি রাস্তা, যেখানে বিভিন্ন রুটের বাস দাঁড়িয়ে আছে, তা পেরোতেই বালুকাবেলায় পা পড়ল। আমরা যখন পৌঁছাই, তখন প্রায় বিকেল। কনি আইল্যান্ডের এই বিচ সমুদ্রস্নান আর সানবাথের জন্য বিখ্যাত। আমেরিকান শ্বেত সুন্দরীরা গায়ে লোশন লাগিয়ে বালুতে শুয়ে থাকেন। গায়ে কিছু থাকে না; থাকলে রোদ তো ঠিকমতো লাগবে না। ফলে তাদের এই শুয়ে থাকা দেখার মতোই দৃশ্য। না দেখার মতো করে সবাই দেখে। তারা সানবাথ করেন আর সি-বাথ, মানে সমুদ্রস্নান।
আমরা দুই বন্ধু যখন পৌঁছালাম, ততক্ষণে স্নান করার দৃশ্যাবলির সমাপ্তি ঘটেছে; ধীর পায়ে সূর্য নেমে যাচ্ছে পশ্চিমের দিকে। সৈকতজুড়ে সিগাল উড়ে বেড়াচ্ছে আর ছড়ানো-ছিটানো কিছু মানুষ। দু-একজন পানিতে তখনো আছেন। এখানকার সিগাল মানুষ পেলে দল বেঁধে তার ওপর জড়ো হয়, পাখা ঝাপটায়। ঢাকার আশপাশে শীতের আগে আগে গেলে, সন্ধ্যায় মাথার ওপর অনেক মশা যেমন জড়ো হয়ে ভনভন করে, তেমনি এখানকার পাখিগুলো। সাদা পাখার ঝাপটায় এমনভাবে ঘিরে রাখে, যেন অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। এ রকম দৃশ্যের ভেতর দিয়েই আমরা হাঁটতে শুরু করি সৈকত ধরে। খানিকটা সামনে একটা লম্বা ব্রিজ, যা সমুদ্রের ভেতর অনেকটা ঢুকে গেছে। সে ব্রিজ ধরে অনেকে হাঁটছেন। যারা প্রেমিক-প্রেমিকা, তারা হাত ধরাধরি করে; যারা পরিবার, তারা বাচ্চাদের হাত ধরে। ব্রিজের একদম শেষ মাথায় বসেছেন কয়েকজন মাছশিকারি, বড়শি নিয়ে। এসব বড়শিতে বড় বড় মাছ ধরা পড়ে। এরা আসেন সারা দিনের জন্য। মাছ ধরে গাড়ি ভরে নিয়ে যান। আমরা দুজন সেই ব্রিজের কাঠের পাটাতনে বসে থাকি বেশ কিছুক্ষণ।
কনি আইল্যান্ডের এই সৈকতের দৈর্ঘ্য ৫ দশমিক ৬ কিলোমিটার। এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত কাঠের অপূর্ব পাটাতন। এই পাটাতন ধরে সৈকতের প্রায় পুরোটা ঘুরে ফেলা যায়। আবার এই ওয়াকওয়ে থেকে সৈকতে নেমে যেতে চাইলেও টুপ করে নেমে পড়া সম্ভব। কনি আইল্যান্ডের মূল আকর্ষণ দুটি; একটি হলো এর সৈকত, অন্যটি থিমপার্ক। সৈকতের বিরাট এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছে লুনা নামে থিমপার্কটি। সৈকত ও পার্ক ঘিরে সারা বছর নানা ইভেন্ট লেগে থাকে। কনসার্ট, ওয়ার্কশপ, শো (ফায়ার, গোস্ট, সি) বা অ্যাকটিভিটিজের শেষ নেই। শুধু থিমপার্কেই পুরো একটা দিন কাটিয়ে দেওয়া সম্ভব। নানা রকম রাইড রয়েছে এতে; এক্সট্রিম থেকে শুরু করে বাচ্চাদের জন্য।
কনি আইল্যান্ডের এই সৈকত ও ব্রিজ বহু বিখ্যাত চলচ্চিত্রে ঢুকে আছে। হলিউড ও বলিউডের অনেক সিনেমায়ই এই সৈকত উপস্থিত। হলিউডের ‘ব্রুকলিন’, ‘ওয়ান্ডার হুইল’ বা এ রকম অনেক সিনেমার শুটিং হয়েছে এখানে। আমাদের কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের তুলনায় খুব বেশি বড় না হলেও এত সব আয়োজন এই সৈকত ঘিরে, তা দেখে শেষ করা যাবে না।
কনি আইল্যান্ডে প্রথম পা পড়ে জিওভানি দা ভেরাজ্জানো নামের এক ইতালীয় নাবিকের। প্রথম বসবাস শুরু করেন ডাচ থেকে আসা অভিবাসীরা। এরপর আস্তে আস্তে এতে নানা দেশের মানুষের বসবাস বাড়তে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের অভিবাসীদের একটা অংশ এখানে বাস করে। একটা সময় কনি আইল্যান্ডে নিউইয়র্কবাসী আসতেন ভগ্ন স্বাস্থ্য উদ্ধারে। কেননা এখানকার সমুদ্রের বায়ু স্বাস্থ্যের জন্য বিশেষ উপকারী।
আমরা পুরো বিকেল ও সন্ধ্যা সমুদ্রসৈকতে ঘুরে বেড়ালাম। ওয়াকওয়ে ধরে সান্ধ্যভ্রমণে এসেছেন অনেকে। রাতের কনি আইল্যান্ডের আরেক চেহারা। বার বা ক্যাসিনিওগুলো জেগে ওঠে। সামারে চলে নানা রকম প্রদর্শনীর নাইট শো। এ ছাড়া বড় বড় কনসার্টও হয়ে থাকে এই সৈকতে। চারদিকে পানশালা, নানা রকম খেলনার দোকান, রেস্টুরেন্ট, স্যুভেনির শপ ছড়ানো-ছিটানো রয়েছে। তা থেকে খুঁজে আমরা একটা রেস্টুরেন্টে মুরগি ও ভেড়ার মাংসের এক মধ্যপ্রাচ্যীয় খাবার খেয়ে নিলাম। আরও কিছুক্ষণ থেকে চলে এলাম সাবওয়ে স্টেশনে। ট্রেন দাঁড়িয়েই ছিল। কনি আইল্যান্ডও নিজের মতো দাঁড়িয়ে আছে তার বহুবিধ তৎপরতা নিয়ে। আমরা সন্ধ্যার অন্ধকারে জেগে থাকা অদূরে সমুদ্রকে রেখে শহরের দিকে রওনা হলাম।
সিটি আইল্যান্ড
দ্বীপটি দেখা হলো অকস্মাৎ। দুপুরে দাওয়াত, বন্ধু শাকিলের বোনের বাসায়; সকালটা ফ্রি। এমন এক সময়ে দুই বন্ধু বেরিয়ে পড়ি। কোথায় যাব, জানি না। একটা বাসে চড়ে প্রথম স্টারলিং থেকে গেলাম পেলহ্যাম বে পার্কে, ওখান থেকে বাস বদলে রওনা হই সিটি আইল্যান্ডের দিকে।
নিউইয়র্ক সিটি মূল যে চার ভাগে বিভক্ত, তার একটি হলো ব্রঙ্কস। সিটি আইল্যান্ড পড়েছে ব্রঙ্কসে। নিউইয়র্কের মতো এমন বিশাল শহরে পেলহ্যাম বে থেকে সিটি আইল্যান্ডের দিকে যেতে গিয়ে বাস ঢুকে পড়ে জঙ্গল পথে। বিশাল রাস্তা, রাস্তার পর ঘাস মোড়ানো অনেকটা জায়গা, তারপর জঙ্গল। এই জঙ্গলে বা খোলা জায়গায় হরিণ ঘুরে বেড়ায়। মানুষ বা গাড়ির দিকে ওদের ভ্রুক্ষেপ নেই। নিজের মতো ঘুরে বেড়ায়, ঘাসের ভেতর মুখ গুঁজে দিন পার করে।
পেলহ্যাম বে থেকে সিটি আইল্যান্ড বিশ মিনিটের পথ। এই পথে আমার সঙ্গেও দেখা হয়ে গেল একটা ছোট্ট হরিণের। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ভেতর বাসের জানালা দিয়ে দেখা গেল জঙ্গল ঘেঁষে হরিণটা দাঁড়িয়ে আছে। পথের দুধারে এত গাছ যে, এখানে পৌঁছে গেলেই শরীর শান্ত হয়ে ওঠে। আর এগোতে এগোতে দেখতে পাওয়া যায়, গাছের ফাঁক গলে সমুদ্র উঁকি দিচ্ছে। এমন সবুজে মোড়ানো পথ পেরিয়ে বাস কিছু সময়ের মধ্যে সিটি আইল্যান্ড ব্রিজে পৌঁছে যায়। ব্রিজটিই মূল ভূমির সঙ্গে দ্বীপের সংযোগরেখা। পেরোলেই মনে হবে, ঢুকে পড়েছি আটলান্টিকের বুকে।
ছোট্ট একটি দ্বীপ, লম্বায় দেড় মাইল আর চওড়া আধা মাইল। তিন দিকে সমুদ্র, আরেক দিকে নিউইয়র্কের সঙ্গে যুক্ত ব্রিজ। বহু বছর আগে এই জায়গার নাম ছিল ব্ল্যাক ডগ আইল্যান্ড। পরবর্তীকালে বদলে গিয়ে নাম হয়েছিল পাইন আইল্যান্ড। তবে ১৭৬১ সালে বেঞ্জামিন পালমার এই দ্বীপ কিনে নিলে এর নাম হয় নিউ সিটি আইল্যান্ড। এ নামেই এখনো পরিচয় টিকিয়ে রেখেছে দ্বীপটি। ইউরোপীয় উপনিবেশ আমেরিকায় বিস্তার ঘটলে এখানেও তার প্রভাব পড়ে। সেসব অভিবাসী এখানে এসে বসতি স্থাপন করেন ১৭ শতকের দিকে। একটা সময়ে মাছ ধরার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এই দ্বীপ। তা ছাড়া দ্বীপটি জাহাজ নির্মাণ ও ইয়ট তৈরির জন্য বিশেষ জনপ্রিয় ছিল। মার্কিন যুদ্ধজাহাজও নির্মিত হতো এখানে। জাহাজ নির্মাণ এবং তার ইতিহাস নিয়ে একটি জাদুঘরও আছে দ্বীপে। কেউ চাইলে তা দেখতে পারেন। এটি সপ্তাহের শনি ও রোববারÑ এই দুই দিন খোলা থাকে।
দ্বীপের রাস্তায় গাড়ির চাপ নেই বললেই চলে। শহর থেকে বাস আসে, আবার ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়েও আসেন অনেকে। নিউইয়র্কের বেশির ভাগ জায়গায় পার্কিং একটা বড় সমস্যা; কিন্তু এখানে তা মনে হলো না। এখানে তীরের সঙ্গে লাগোয়া একটি জায়গা রয়েছে। যেখানে বসে সামনের সমুদ্র দেখা যায়। এই জায়গায় প্রচুর সিগাল আর কবুতর বসে আছে। দ্বীপের রাস্তায় নানা ফুল গাছ জায়গাটাকে বর্ণিল করে রেখেছে। আর সমুদ্রের যেটুকু অংশ এখান থেকে নজরে আসে, তাতে প্রচুর ইয়ট ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। কেউ চাইলে পুরো দ্বীপ হেঁটেই পাড়ি দিতে পারেন।
সমুদ্রের সৌন্দর্যের সঙ্গে এখানকার রেস্টুরেন্টগুলোর সৌন্দর্যও চমকে দেবে। এখানে নানা রকম সি-ফুড পাওয়া যায়। এসব রেস্তোরাঁ খুবই জনপ্রিয় এর সুস্বাদু খাবারের জন্য। টাটকা অয়েস্টার, ক্ল্যাম, লবস্টার, কড ফিশ কিংবা চিংড়ি- সামুদ্রিক এসব মাছের নানা পদ এখানে পাওয়া যায়। রেস্তোরাঁগুলোর ইন্টেরিয়র এত সুন্দর-পরিপাটি যে, চোখ ফেরানো মুশকিল!
যারা ইয়ট ভাড়া করতে কিংবা সমুদ্রবিলাসে যেতে চান, তাদের জন্য এই দ্বীপ একটি জনপ্রিয় গন্তব্য। সমুদ্রবিলাসের তুলনায় শৌখিন মৎস্যশিকারিদের কাছেও এটি জনপ্রিয়। এখানে মাছ ধরার সরঞ্জামের একটি দোকান দেখলাম, নানা জিনিসে পরিপূর্ণ। এখান থেকে তীর ঘেঁষে পাথরের ওপর বসা মৎস্যশিকারিদেরও দেখা গেল। মাছ যারা ধরছেন, তাদের এ উপমহাদেশের মানুষ বলেই মনে হলো। বন্ধু জানাল, মাছ শিকারের জন্যও এখানে লাইসেন্স লাগে। যার লাইসেন্স আছে, তিনি আমেরিকার যেকোনো লেক বা এমন জায়গায় মাছ ধরতে পারেন। কিন্তু অনেকে ধরেন চোরাইভাবে; কেউ কেউ জাল ফেলে ধরেন, নিষেধ থাকা সত্ত্বেও। তবে যেখানেই আপনি মাছ শিকারে যান না কেন, মাছের অভাব হবে না। হাসি মুখে ফিরবেন, সেটা প্রায় নিশ্চিত।
এই দ্বীপের জনসংখ্যা ৪ হাজার। তারা একই সঙ্গে সমুদ্রের ভেতর থাকছেন; থাকছেন নিউইয়র্ক শহরের বিশাল অট্টালিকার ভিড়েও। এখানকার কমিউনিটি তাদের সমুদ্রঘেরা জীবনের সাংস্কৃতিক বোধ, চিত্রকলা, হস্তশিল্পচর্চা অব্যাহত রেখেছে বহু বছর ধরে। এই দ্বীপে আমরা ঘণ্টা দুয়েক অবস্থান করে ফিরলাম ফিরতি বাসে। শহর থেকে এই সামান্য দূরত্বে এমন সুন্দর জায়গা, ভাবা যায় না!
ছবি: লেখক ও ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top