রম্যরস I তবু বিয়ে-সুমন্ত আসলাম
বিয়ের আগে
সাবিত জিজ্ঞেস করল রিনিকে, ‘ভালোবাসা আসলে কী?’ রিনি গদগদ হয়ে উত্তর দিল, ‘যার শুরু আছে, শেষ নেই।’
সুযোগ পেলেই মিথ্যা বলা এবং বউ আর নিজে মিলে টু বি কন্টিনিউ ঝগড়ারত আমার বন্ধু নিয়াজ বলে, ‘ভালোবাসা থেকে বিয়ে, তারপর কিছুটা দিন সংসারে যত্রতত্র সাঁতার, তারও পর হাল ছেড়ে দেওয়া; একে বলে—একজীবনের সবচেয়ে সাহসী অভিযান, বিপজ্জনক যাত্রাও!’ আর যাকে আমরা মিচকে শয়তান বলি, সেই রিটন বলে, ‘বিয়ে হলো এমন একটা জায়গা, যেখানে মানুষ নিজে নিজেই জেলে যায়, তার আগে মস্ত একটা হাঁ করে দু-চারটা মিষ্টি খেয়ে নেয়।’
বিয়ের দিন
খুব গম্ভীর প্রকৃতির ছেলে আমার বন্ধু বাসিদ। তুমুল আড্ডা দিতাম আমরা একসময়। প্রচণ্ড একটা কৌতুক বলল কেউ, হেসে খুন আমরা সবাই, কিন্তু বাসিদ আগের মতোই—হাসি তো দূরের কথা, ঠোঁট দুটোও স্থির তার, বাঁকা হয়নি একটুও। আমাদের মাঝখানে কেউ হয়তো তখন বলে উঠল, ‘বাসিদ, একটু আগে প্রচণ্ড হাসির একটা কৌতুক বলা হয়েছে, একটু হাস, প্লিজ।’ কৌতুকের কথা শুনে নয়, ওই বন্ধুর অনুরোধে ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠল তার একবার। এ যেন হাসি নয়, হাসির প্রস্তুতি, শুরু না হতেই শেষ।
বাসিদের নিজের বিয়ের দিন এক অন্য রকম মানুষ সে। মানুষজন আসছে, কথা বলছে তার সঙ্গে, প্রতিটি কথার উত্তরে সে হাসছে। আমি ওর পাশে বসে বললাম, ‘এত হাসছিস যে আজ!’ বাসিদ হাসতে হাসতেই বলল, ‘শেষ হাসিগুলো হেসে নিচ্ছি, দোস্ত, স্বাধীনতার হাসি।’
‘তো এ রকম ঘামছিস কেন?’
বাসিদ নিজের দিকে তাকিয়ে, গায়ের শেরওয়ানিটা ভালো করে দেখে বলল, ‘বিয়ের পর সংসারের জ্বালায় প্রতিদিনই তো ঘামতে হবে, সেই ঘামের প্র্যাকটিস করছি, আজ থেকেই, এই বিয়ের দিন থেকেই।’
রাকা আমাদের সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী। লিকলিকে অবয়ব, চটপটে স্বভাব। বিয়ের দিন। ওর চেয়ে বেশি ওজনদার একটা শাড়ি পরে বসে আছে ও। কেমন স্থবির। ওর কাছ ঘেঁষে বসলাম, ‘কিরে, তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন! মৃত মানুষের মতো বসে আছিস!’
রাকা একটা হাত রাখে আমার বাহুতে। পরম বন্ধুত্বে বলে, ‘অধিকাংশ মেয়েই সংসার করতে গিয়ে মরে যায়। তারা শারীরিকভাবে মরে, মানসিকভাবে মরে, রান্নাঘরে মরে, শ্বশুরবাড়ির মানুষের সামনে মরে। সবচেয়ে বেশি মরে স্বামীর অবহেলায়। সেই মরণে যেন কষ্ট না হয়, তার প্রস্তুতি নিচ্ছি।’
বিয়ের পর
ভালোবাসার শেষ পরিণতি অনেকে বিয়েতে নিয়ে যেতে চায়। আবেগ আর অস্থিরতার প্রবল উদ্গিরণে ছেলেটা বলে, ‘তুমি ছাড়া আমি অচল, আমার দিনই কাটে না।’ মেয়েটির চোখে তখন বিশ্বাসের পাহাড়। নরম আর লাজুক স্বরে সে প্রতি-উত্তর দেয়, ‘তাই?’
বিয়ের পর সেই ছেলে অফিস বা কাজ সেরে যখন বাসায় ফেরে, ক্লান্তিজনিত স্বর তার কণ্ঠে, ‘একটু একা থাকা দরকার আমার, শান্তি চাই আমি।’ মেয়েটি তখন গজগজ করে বলে, ‘একা তো এখানে নাই, পাশের ফ্ল্যাটে থাকে। শান্তিও নাই এখানে, ও বান্দরবানে বেড়াতে গেছে।’
ভালোবাসার শুরুতে তারা দুজন প্রায় একসঙ্গে একে অপরকে একদিন বলেওছিল, ‘তুমি ছাড়া আমি বাঁচব না।’ তারপর একদিন বিয়ে করল। তারও বছরখানেক পরে তারা ছোট ছোট নিশ্বাস ছাড়ে, নিশ্বাস ঘন-গভীর হয়, মাঝরাতে যখন তখন ঘুম ভেঙে যায়, তারপর উদাস জানালায় দাঁড়িয়ে একে অন্যের অনুপস্থিতিতে একা একাই নিজেকে বলে, ‘কীভাবে বেঁচে আছি আমি এখনো!’
বিয়ের পর কিছুদিন পরস্পরের ভাষা থাকে সুষম, পরিমিত—সোনা, চাঁদ, পাখি, বেবি, প্রিয়, প্রিয়া, প্রিয়তম, প্রিয়তমা ইত্যাদি। কয়দিন পর সেগুলো দাঁড়ায়—‘শুনছো, কোথায় আছো তুমি, কই যে থাকো!’ তারও কয়দিন পর—‘এই, লবণদানিটা খুঁজে পাচ্ছি না…ঘর এমন অগোছালো কে যে রাখে।’
মুঠোফোনের এই দাপটে প্রথম দিকে মেসেজ আদান-প্রদান হয় এভাবে—‘তোমার বিরহে আমি আকাশে তারা হয়ে যাচ্ছি, একা একা এই পথ নাহি শেষ হয়।’ পরের দিকে—‘বাসায় আসার সময় এক কেজি বেগুন, সয়াবিন তেল, চিনি আর চা নিয়ে এসো।…ভালো কথা—অনেকক্ষণ ধরে ফোন দিচ্ছি তোমাকে, রিসিভ করছো না কেন?’
বিয়ের প্রথম দিকে ছেলে উত্তর দিত—‘অফিসের কাজে একটু ব্যস্ততা যাচ্ছে।’ সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা লিখত—‘আচ্ছা আচ্ছা, কাজ করো…সরি, বিরক্ত করলাম।’ কয়দিন পর একই কারণ দেখালে ওপাশ থেকে লেখা আসে—‘ব্যস্ত না ছাই! অফিসের কোনো মেয়ে কলিগের সঙ্গে গল্প করছো নিশ্চয়ই, এটা আমি না দেখেও বুঝতে পারছি।’
মাহমুদ নামে আমার যে এক বন্ধু আছে, কিছুটা সংসারবিমুখ সে। সংসারের প্রতি দায়িত্ব আছে তার; কিন্তু সংসারে বেশিক্ষণ থাকতে চায় না। সুযোগ পেলেই বাসার বাইরে এসে আমাদের সঙ্গে আড্ডা দেয়। ঘরে যে তার বউ ভালো চা বানায়, তা খায় না; বাইরে এসে টং দোকানের চা খায় কনডেন্সড মিল্ক দিয়ে। নুডলস আর পাকোড়া ভালো লাগে না ঘরে; ডাল আর আলুপুরি খায় ফুটপাতে। সেই অবস্থায় একদিন ফোন করল তার বউ। সে জানাল—লাকির সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে সে।
চুপচাপ শুনল বউ। জেনে নিল, কোথায় আড্ডা দিচ্ছে।
একটু পর বউ এসে হাজির। দেখে—লাকি কোনো মেয়ে নয়, পুরুষ।
বিয়ের ভবিষ্যৎ
সক্রেটিস বলেছিলেন, তুমি যদি একজন ভালো বউ পাও, তাহলে হবে সুখী। আর যদি খারাপ বউ পাও, তাহলে হবে দার্শনিক। সক্রেটিস সম্ভবত তার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলেছেন। কিন্তু খারাপ স্বামী কিংবা ভালো স্বামী নিয়ে কি কেউ কখনো কিছু বলেছে? বলেছে। আমার বান্ধবী জেসমিন বলেছে—ভালো স্বামী পেলে তুমি হবে ভালো চা বানানেওয়ালা, আর খারাপ স্বামী পেলে তুমি হবে ফেসবুকের ভালো স্ট্যাটাসদাতা।
বিয়ের ভবিষ্যৎ বিষয়ে হতাশাবাদীরা মনে করেন—ডিভোর্স। তাদের মতে, অনেক আলো জ্বালিয়ে বিয়ের কাজ সারা হয়; তারপর আলো নিভে যায়, নিভিয়ে দিতে হয়। অনেক আশা আর স্বপ্ন নিয়ে মানুষ বিয়ে করে; কিন্তু সেই আশা আর স্বপ্ন ভঙ্গ হলে সেই বিয়ে আর টেকে না; ভেঙে যায়, ভেঙে দিতে হয়।
আচ্ছা, পশুপাখির মধ্যে ডিভোর্স হয় না কেন?
কারণ, তারা বিয়ে করে না।
একটি গল্প
বনের রাজা সিংহ বিয়ে করবে। সাজ সাজ রব বনে। রাজা একদিন হুংকার দিয়ে বলল, ‘সবাইকে আমার বিয়েতে আসতে হবে। আসার সময় ব্যাগে করে আমার প্রিয় খাবার নিয়ে আসবে সবাই। এটাই আমার প্রতি তোমাদের গিফট।’
নির্দিষ্ট দিন বিয়ে হলো। সবাই হাতে করে ব্যাগে উপহার আনল বনের রাজার জন্য।
মাসখানেক পর বনের সবাই দেখল, রাজা মশাই একটা ব্যাগ হাতে বাড়ি থেকে বের হচ্ছে। সবাই অবাক—ব্যাপার কী?
ভয় ভয় পায়ে বানর এগিয়ে গেল। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে বলল, ‘রাজা মশাই, আপনার হাতে কী?’
আগে হলে হুংকার নিয়ে উঠত সিংহ। আজ উত্তর দিল, ‘ব্যাগ।’
পাশ থেকে শিয়াল এগিয়ে এলো। কাঁচুমাচু গলায় বলল, ‘ব্যাগ নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?’
‘বাজারে।’ সিংহ উত্তর দিল।
‘আপনাকে তো কখনো বাজারে যেতে দেখিনি, বাজারে গিয়ে কী করবেন?’ বানর প্রশ্ন করল আবার।
‘বাজার করব।’ সিংহ উত্তর দিল।
‘আপনি বাজার করবেন!’ চমকে উঠল বানর।
হাঁটা থামাল সিংহ। একটু ঘুরে তাকাল বানরের দিকে। বিষণ্ন চেহারাটা আরও বিষাদগ্রস্ত করে বলল, ‘প্রতিটি পুরুষের জন্মই হয়েছে প্রথমে বিয়ে করা, তারপর প্রতিদিন বাজার করার জন্য।’
‘কিন্তু আপনার গলার স্বর এমন বিড়ালের মতো শোনাচ্ছে কেন?’ শিয়াল আরেকটু এগিয়ে এলো সামনের দিকে।
‘বিয়ের পর সব পুরুষই বিড়াল হয়ে যায়। তার গলার স্বর মিঁউ মিঁউর মতো শোনায়। বিয়ে কর, সংসার কর…’, আবার হাঁটা শুরু করল সিংহ, ‘…তখন বুঝতে পারবি ব্যাপারটা।’
‘বিয়ের পর পুরুষের যদি এমন অবস্থা হয়, মেয়েদের তাহলে কী অবস্থা হয়?’ বানর শঙ্কিত গলায় জিজ্ঞেস করল।
‘মেয়েরা বিয়ের পর হয় দায়িত্বশীল, আর পুরুষের কাছ থেকে সঠিক কাজটা আদায় করাও একটা মহান দায়িত্ব।’ কিছুটা আড়ালে, পেছন পেছন আসা সিংহী হঠাৎ সামনে এসে বলল, ‘দুজন মিলেই যেমন বিয়ে, দুজন মিলেই তেমন সংসার।’
তবু বিয়ে
‘বিয়েই একমাত্র যুদ্ধ, যেখানে আপনি শত্রুর সঙ্গে ঘুমান’—ফরাসি এক সাহিত্যিক বলেছিলেন।
এর মানে হচ্ছে, আপনি পুরুষ হলে আপনার স্ত্রী আপনার শত্রু, আর মেয়ে হলে আপনার স্বামী আপনার শত্রু। বালাই ষাট—স্বামী বা স্ত্রী শত্রু হতে যাবে কেন, যখন একসঙ্গে থাকে! শত্রু হয় তখন, যখন দূরে চলে যায় পরস্পর। এই শত্রুতে পরিণত হওয়াটা হচ্ছে অপরিপক্বতা, অপরিণত বুদ্ধির প্রতিফলন। একটু, একটু স্থির ও শান্ত হয়ে ভাবলেই বোঝা যায়, মনে উঁকি দেয়—এই মানুষটার সঙ্গে আমি থেকেছি; ভাগ করেছি সুখ-দুঃখ; প্রতিদিন না হোক, অপ্রত্যাশিত সুখে সময় কাটিয়েছি মাঝে মাঝেই; তারপর চোখ দুটো বুজে ফেলা।
হালের মার্কিন অভিনেত্রী অ্যাঞ্জেলিনা জোলি বলেছেন, ‘বিয়ের পর যত সময় পেরোবে, বুঝবেন একসঙ্গে থাকার জন্য কেবল ভালোবাসাই যথেষ্ট নয়; এর সঙ্গে আরও নানা কিছু জরুরি।’
এই নানা কিছু নিয়ে নানা জনের নানা মত থাকতে পারে। তারপরও প্রথম সেই ‘ভালোবাসা’টাই জরুরি; কারণ, এই ভালোবাসাকে ঘিরে থাকে সুখ, সম্মান, শ্রদ্ধা আর একসঙ্গে টিকে থাকার মূল উপাদান।
আমাদের পুরোনো বাবা-মা, মানে ৫০-৬০ বছর আগের বাবা-মা, কিংবা তারও আগের বাবা-মায়েরা কেবল এই ‘ভালোবাসা’টাই বুঝতেন। তাই তো তাদের অলৌকিক সুখে চাঁদ ঝিলিক দিত তেঁতুলপাতায়, পুকুর-জলে, চোখ-মুখ-কপাল আর এলোচুলে!
ইলাস্ট্রেশন: সংগ্রহ
