দেহযতন I পোশাক ভেবে শরীর গঠন
শরীরের আকার যেমন, সেই অনুযায়ী বিয়ের পোশাক মেনে নিতে কারও কারও আপত্তি থাকে না। কারও আবার পোশাকের প্রতি অধিক গুরুত্ব, কিন্তু অনেক সময় তাতে বাদ সাধে দেহ। তাই শরীর গড়ার দিকে আগে থেকে মনোযোগ রাখেন তারা। এ ক্ষেত্রে শুধু ডায়েটই যথেষ্ট নয়, পরিকল্পিত ওয়ার্কআউট ও ফিটনেস রুটিনও জরুরি
বিয়ে ঘিরে বর-কনের কেন ওয়ার্কআউট দরকার? তা বুঝতে বৈজ্ঞানিক কারণ এবং ফিটনেস বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য বিবেচনায় আনা জরুরি। ‘বিয়ের আগে শুধু কার্ডিও এক্সারসাইজ বেশি করব’—এই মনোভাবে চললে শরীরের পেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। নিয়মিত রেজিস্ট্যান্স ট্রেনিং (যেমন ওয়েট বা বডিওয়েট) পেশি বৃদ্ধিতে কার্যকরের পাশাপাশি মেটাবলিজম বাড়ায়। মেটা-অ্যানালাইসিসের সমীক্ষায় দেখা গেছে, রেজিস্ট্যান্স ট্রেনিংয়ের ফলে শরীরে উল্লেখযোগ্যভাবে শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং এর সঙ্গে স্ট্রেন্থ ওয়ার্কআউট যোগ করলে ফ্যাট লস ও পেশিরক্ষার সম্ভাবনা বাড়ে।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত হলো, ‘ট্রেন স্মার্টার, নট হার্ডার’। অর্থাৎ বেশি নয়; বরং সঠিক ও পরিকল্পিতভাবে ওয়ার্কআউট করা শ্রেয়। সেলিব্রিটি ট্রেইনার ইয়াসমিন করাচিওয়ালা বলেছেন, ওয়ার্মআপ ও ডাইনামিক স্ট্রেচিং দিয়ে শরীর প্রস্তুত করা জরুরি। সুতরাং সঠিক ওয়ার্কআউট করলে পেশি গঠন ও টোনিং হবে, শরীরে সুন্দর আকৃতি ফুটে উঠবে, মেটাবলিজম হাই থাকবে, অর্থাৎ বিশ্রামের সময়ও বেশি ক্যালরি বার্ন হবে। ফলে পোশাক ভালোভাবে বসবে, ফিটিং ঠিক হবে। আর তা থেকে বাড়বে আত্মবিশ্বাস।
যারা বিয়ের আগে ওয়ার্কআউট পরিকল্পনা করবেন, তাদের জন্য সময়, শারীরিক অবস্থা এবং লক্ষ্য বুঝে একটি হারমোনাইজড পরিকল্পনা দরকার। শরীরচর্চায় নির্দিষ্ট কিছু ওয়ার্কআউট যুক্ত করলে সুফলের সম্ভাবনা বাড়ে।
স্কোয়াট
এটি একটি কমপাউন্ড এক্সারসাইজ; অর্থাৎ এতে একসঙ্গে একাধিক পেশি জড়িত। স্কোয়াট করলে কোয়াডিসেপস (ঊরুর সামনে), হ্যামস্ট্রিং (ঊরুর পেছনে), গ্লুটাস (নিতম্ব) এবং পায়ের অন্যান্য পেশি সক্রিয় হয়। স্কোয়াটের সঙ্গে সার্বিক ব্যায়াম, সঠিক খাদ্য ও পর্যাপ্ত বিশ্রাম যুক্ত হলে চর্চাকারী একটি টোনড শরীর পেতে পারেন। ফলে বিয়ের সময় কাপড়ে তাকে ভালো দেখাবে। পেশি গঠন ও শরীরের কার্ভ অংশের উন্নতি ঘটলে পছন্দের পোশাক শরীরে আরও সুন্দর ছাপ ফেলবে। তবে পোশাকের কাট ও ফ্যাব্রিক (ফিট, স্ট্রেচি, সিলুয়েট) অনেক বড় বিষয়। সুন্দর পোশাক এবং ফিট দেহের সমন্বয় থাকলে বিয়ের মতো বিশেষ দিনে দেখাবে আরও শোভনীয়।
বিয়ের আগে স্কোয়াট চর্চা করলে শরীর টোনড হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে; বিশেষ করে যদি সঠিক ফর্মে এবং ওয়েট ও অন্যান্য এক্সারসাইজ মিলিয়ে পরিমিত ও নিয়মিত অনুশীলন করা হয়। অবশ্য শুধু স্কোয়াটেই সবাই একই ধরনের ফল পাবেন না; পার্থক্য তৈরি হতে পারে বডি টাইপ, খাদ্যাভ্যাস, বংশগতি, বিশ্রাম ইত্যাদির কারণে।
লাঞ্জ
এই দেহচর্চায় শরীরের গঠন উন্নত হয়; বিশেষ করে নিতম্ব, ঊরু ও পায়ের পেশি সুন্দরভাবে গড়ে ওঠে। ফলে বিয়ের দিন বর কিংবা কনের সাজে আপনার শরীর আরও টোনড ও আকর্ষণীয় দেখাবে। লাঞ্জ এক্সারসাইজ পায়ের পেশি বিশেষভাবে মজবুত করে; কোয়াডস, হ্যামস্ট্রিং ও গ্লুটস শক্তিশালী হয়। এটি পশ্চার ভালো করে; শরীর সোজা ও সুষম রাখে। শরীরের নিচের অংশ সুগঠিত ও ফিট দেখায়। ক্যালরি বার্ন করে এই ব্যায়াম ওজন কমাতে সহায়ক ভূমিকা রাখে; পাশাপাশি স্ট্যামিনা বাড়ায়।
বিয়ের দু-তিন মাস আগে থেকে এর চর্চা শুরু করা মঙ্গল। প্রতিদিন না হলেও সপ্তাহে ৩-৪ দিন লাঞ্জ এক্সারসাইজ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। রিভার্স লাঞ্জ, সাইড লাঞ্জ, ওয়াকিং লাঞ্জ, জাম্পিং লাঞ্জ বহুল প্রচলিত। তবে চর্চার ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা জরুরি।
শুরুতে খুব বেশি এক্সারসাইজ করবেন না; মাত্রা ধীরে ধীরে বাড়ানো শ্রেয়।
হাঁটুর ব্যথা থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
স্ট্রেচিং এমনভাবে করা চাই, যেন পেশিতে টান না পড়ে।
পুশআপ
বিয়ের আগে পুশআপ এক্সারসাইজ করলে শরীরের গঠন কিছুটা সুন্দর ও ফিট দেখাতে পারে; বিশেষ করে যদি নিয়মিত ও সঠিকভাবে এর চর্চা করা যায়। তবে মনে রাখা দরকার, শরীর গঠনের জন্য সময় ও ধারাবাহিকতা প্রয়োজন।
পুশআপ এক্সারসাইজের ফলে বুকের গঠন উন্নত হয়, এটি বুকের পেশি শক্তিশালী করে এবং বুক উঁচু ও ফিট দেখায়। তা ছাড়া হাত ও কাঁধের শেপ ভালো হয়; বয়স বা ক্লান্তিভাব ছাড়াই হাত ও কাঁধে টান টান ভাব আসে। এর ফলে নিজেকে সুগঠিত ও আত্মবিশ্বাসী মনে হয়, যা বিয়ের দিনে চলাফেরায় স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়। পুশআপ করলে শরীরের ওপরের অংশে পোশাক ফিটিং ভালো হয়। বিয়ের ৩০-৪৫ দিন আগে এর চর্চা শুরু করলে ভালো ফল মিলতে পারে। প্রতিদিন বা সপ্তাহে ৫ দিন অনুশীলন করা শ্রেয়।
এই শরীরচর্চায় যদি নতুন হয়ে থাকেন, তাহলে প্রতিদিন ৮-১০টি করে ২ সেট চর্চা করতে পারেন। পরে ধীরে ধীরে সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে; অর্থাৎ ১৫-২০টি করে ৩ সেট। ভুলভাবে এর অনুশীলন করলে পিঠ বা কাঁধে ব্যথা হতে পারে। বেশি করলে এক দিন পর মাংসপেশিতে ব্যথা হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে অতিরিক্ত ব্যথা হলে বিশ্রামই উত্তম।
ডাম্বেল রো
এই দেহচর্চা শরীরের গঠন আরও সুন্দর ও টোনড করে তোলে; বিশেষ করে এটি পিঠ, কাঁধ ও বাহুর পেশি গঠনে সহায়ক। এর অনুশীলনের ফলে বিয়ের পোশাকে আরও আকর্ষণীয় ও সুগঠিত দেখানোর সম্ভাবনা বাড়ে।
ডাম্বেল রোর উপকারিতার তালিকায় রয়েছে, এতে পিঠের গঠন ভালো হয়। ফলে সোজা ও সুগঠিত পিঠে যেকোনো পোশাক ভালো দেখায়। জামার হাতা বা স্লিভলেস পোশাকে ফিট বাহু ও কাঁধ চমৎকার লাগে। পশ্চার বা অঙ্গবিন্যাস দারুণ হয়। বিয়ের ছবি বা ভিডিওতে সোজা দাঁড়ানো ও চলাফেরায় সুন্দর দেখায়। চর্বি কমে এবং পেশি গঠিত হয়; ফলে শরীর ঝরঝরে দেখায়।
প্রতিদিন নয়, বরং সপ্তাহে ৩-৪ দিন এর অনুশীলন করা শ্রেয়।
সঙ্গে যদি কিছু কার্ডিও এক্সারসাইজ যুক্ত করতে এবং ডায়েট নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন, দ্রুত ফল পাবেন।
শুরুতে হালকা ওজন (২-৫ কেজি) উত্তোলন করা উত্তম; পরে ধীরে ধীরে ভার বাড়াতে পারেন।
ডাম্বেল রোর সঙ্গে স্কোয়াট, পুশআপ, বাইসেপ কার্লসহ আরও কিছু ব্যায়াম যুক্ত করলে পুরো শরীর সুন্দরভাবে গঠিত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। এতে বিয়ের যেকোনো পোশাকে আরও স্টাইলিশ দেখাবে।
ডেডলিফট
এর চর্চায় শরীর আরও সুগঠিত ও মজবুত হয়; বিশেষ করে পিঠ, কোমর, ঊরু ও নিতম্ব। এই ব্যায়াম সম্পূর্ণ শরীরের শক্তি ও কাঠামো ঠিক রাখতে সাহায্য করে।
ডেডলিফট এক্সারসাইজ করলে কোমর ও পিঠ সোজা থাকে, ফলে পোশাকে আকর্ষণীয় দেখায়।
পেছনের অংশ ও ঊরুতে টান পড়ে, ফলে শরীরের শেপ ভালো হয়।
পিঠ ও কোর শক্তিশালী করায় বিয়ের সময় দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকা, ছবি তোলা—সবকিছু সহজ লাগে।
এর চর্চায় মেটাবলিজম বাড়ে; ফলে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে।
ডেডলিফটের পাশাপাশি পুষ্টিবিদের পরামর্শ মেনে স্বাস্থ্যকর খাবার (প্রোটিন, শাকসবজি, পানি) গ্রহণ এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া জরুরি। অতিরিক্ত স্ট্রেস এড়িয়ে চলা মঙ্গল। এই শরীরচর্চায় শুধু শরীরের সৌন্দর্য বাড়ে না; আত্মবিশ্বাসও বাড়ে, যা বিয়ের দিন আপনাকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলবে।
বিয়ের আগে কোনো নতুন ভারী ওয়ার্কআউট শুরু করলে শরীরের প্রতিক্রিয়া ভালোভাবে নিরীক্ষণ করা চাই। ওয়ার্কআউট ফর্ম ঠিক রাখতে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট
