skip to Main Content
suluk-shondhan-nov-into

সুলুকসন্ধান I রান্নায় কুমড়াগুঁড়া যুক্ত হলো যেভাবে

সাড়ে তিন হাজার বছর আগে বর্তমান ইন্দোনেশিয়ার বান্দা দ্বীপের মাটির হাঁড়িতে লুকানো জায়ফল আজকের কুমড়াগুঁড়ার পূর্বসূরি। প্রাচীন স্বাদ কীভাবে আধুনিক কাপে পৌঁছাল, জানা যাক বিস্তারিত

প্রতিবছর শরৎ এলে সুপারশপের তাকগুলো যেন একরাশ সোনালি সুবাসে ভরে যায়। পাম্পকিন পাই থেকে শুরু করে ক্যান্ডি কর্ন—সবকিছুতেই ঘ্রাণ ছড়ায় সেই পরিচিত মসলা; যা শুধুই স্বাদ নয়, ইতিহাসেরও সাক্ষী। জায়ফল, দারুচিনি, আদা আর লবঙ্গ—এই চমৎকার মিশ্রণই তৈরি করে পাম্পকিন স্পাইস বা কুমড়াগুঁড়া ফ্লেভারের সেই উষ্ণ, আরামদায়ক ছোঁয়া। অবাক করা বিষয় হলো, এই মসলা বহু যুগ ধরে মানুষের খাবার, ওষুধ আর আধ্যাত্মিক আচারে উপস্থিত; শুধু স্বাদ নয়, সভ্যতার সুবাস বয়ে আনে।
ঠান্ডা বাতাস আর হালকা সোনালি আলোতে এক কাপ কফি বা কেকের সঙ্গে এই সুবাস মিলিয়ে দেয় প্রাচীন মানুষের স্বাদবোধের গল্প, যা আজও আধুনিক কাপে অস্তিত্বমান। কুমড়াগুঁড়ার সেই নস্টালজিক ঘ্রাণ ক্ষুধা নিবারণ করে তো বটেই; সঙ্গে আবহ, স্মৃতি ও ইতিহাসকে একসঙ্গে বুনে তৈরি করে স্বাদ ও সংস্কৃতির সংযোগ। তবে এখানেই আসল প্রশ্ন, এই কুমড়াগুঁড়ার স্বাদের গল্প শুরু হলো কোথা থেকে? কেন এই মসলার গন্ধ শরতের প্রতীক হয়ে উঠল? আর কীভাবে এক মসলার সংমিশ্রণ আজ বিশ্বজুড়ে একটি সাংস্কৃতিক ট্রেন্ড তৈরি করল? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে যেতে হবে কয়েক হাজার বছর পেছনে; ইন্দোনেশিয়ার এক ছোট দ্বীপে, যেখানে মাটির হাঁড়িতে প্রথম মেশানো হয়েছিল জায়ফল, যা আজও এই কুমড়াগুঁড়ার প্রাণ।
পাত্রে পাওয়া রহস্য
ইন্দোনেশিয়ার বান্দা দ্বীপের ছোট্ট দ্বীপ পুলাউ আইয়ে প্রত্নতত্ত্ববিদদের হাতে ধরা পড়েছিল এক বিস্ময়। সাগরের ঢেউ আর আগ্নেয়গিরির ছাইয়ের নিচে মাটির হাঁড়ির টুকরো খুঁজে পাওয়া যায়; যার গায়ে লেগে থাকা একফোঁটা গুঁড়ার ভেতর লুকিয়ে ছিল মানুষের প্রাচীন স্বাদবোধের এক সমৃদ্ধ ইতিহাস। বিজ্ঞানীরা বিশ্লেষণ করে দেখলেন, কোনো সাধারণ গুঁড়া নয়; ওটা জায়ফল। আর এই আবিষ্কার বলে দিল, মানুষ আজ থেকে ৩ হাজার ৫০০ বছর আগে থেকে জায়ফল ব্যবহার করত খাবারে।
এর আগে ধারণা করা হতো, জায়ফলের ব্যবহার শুরু হয়েছিল প্রায় ১ হাজার ৫০০ বছর আগে, বাণিজ্য বিস্তারের যুগে। কিন্তু এই প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ দেখিয়ে দিল, মসলার প্রতি মানুষের ভালোবাসা আরও আগে থেকে। প্রত্নতত্ত্ববিদেরা রাসায়নিক বিশ্লেষণে দেখেছেন, হাঁড়ির গায়ে পাওয়া যৌগগুলো আধুনিক জায়ফলের তেলের উপাদানের সঙ্গে মিলে যায়। অর্থাৎ প্রাচীন মানুষও রান্নায় ঠিক সেই গন্ধটাই চাইত, যা আজও আমাদের মিষ্টি বা কফির কাপে খুঁজে ফিরি।
বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন, পুলাউ আইয়ের বাসিন্দারা হয়তো তখন রান্না, ওষুধ কিংবা ধর্মীয় আচারেও এই মসলা ব্যবহার করতেন। স্থানীয় আদিবাসীরা মসলার গন্ধকে ভাবতেন পবিত্রতার প্রতীক, যা খারাপ আত্মাকে দূরে রাখে। এই আবিষ্কার শুধু এক টুকরো মাটির গল্প নয়; বরং মানুষের স্বাদবোধের বিবর্তনের ইতিহাস।
সুবাসে গড়া সাম্রাজ্য
ইতিহাসের অনেক সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে অস্ত্রের জোরে; কিন্তু কিছু সাম্রাজ্য তৈরি হয়েছিল গন্ধের টানে। বান্দা দ্বীপের জায়ফল, শ্রীলঙ্কার দারুচিনি, ভারতের আদা আর মালুকুর লবঙ্গ—এই চার মসলা মিলেই গড়া হয়েছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত বাণিজ্যপথ, ‘স্পাইস রুট’। সেই পথের প্রতিটি ধাপে ভেসে বেড়াত নৌকার তলায় লুকানো সুবাস, যা একসময় শুধু রান্নাঘর নয়, রাজনীতিরও দিকনির্দেশ করেছিল। বান্দা দ্বীপের পাহাড় ঘেরা উপকূল থেকে শুরু হয়ে সেই মসলার গন্ধ পৌঁছে যেত মধ্যপ্রাচ্যের ব্যস্ত বাজারে, আফ্রিকার তীরে, তারপর ভূমধ্যসাগরের বন্দর পেরিয়ে ইউরোপের রাজপ্রাসাদে। মসলার এক দানা তখন ছিল সোনার চেয়ে দামি। ইতিহাস বলে, এক পাউন্ড জায়ফলের দাম ছিল সাতটি মোটাতাজা গরুর সমান।
এই বাণিজ্য শুধু স্বাদের জন্য নয়; ছিল একধরনের ক্ষমতার প্রতিযোগিতাও। তখন মসলা ছিল বিলাসিতা, ধনীদের মর্যাদার প্রতীক; এমনকি ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। দারুচিনি দিয়ে রাজাদের দেহে সুগন্ধি লাগানো হতো, লবঙ্গ দেওয়া হতো রাজকীয় ওষুধে, আর জায়ফলকে ধরা হতো এমন এক অলৌকিক মসলা হিসেবে, যা দেহ থেকে মন্দ আত্মা তাড়াতে পারে। তখন ইউরোপের শীতল আবহে খাবারে স্বাদ আনতে কিংবা পচন রোধে মসলার প্রয়োজন ছিল ভীষণ। ফলে দূরপ্রাচ্যের এই গন্ধের জগৎ হয়ে উঠেছিল তাদের লোভের কেন্দ্রবিন্দু।
এই গন্ধের জন্যই তৈরি হয়েছিল নতুন সমুদ্রপথ; জন্ম নিয়েছিল অভিযানের যুগ। আরব বণিকেরা শতাব্দীর পর শতাব্দী মসলার বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন, কিন্তু ইউরোপ চেয়েছিল সেই পথ নিজের হাতে নিতে। তখনই পর্তুগিজ, ডাচ, স্প্যানিশ, ইংরেজ—সব শক্তিধর জাতি ঝাঁপিয়ে পড়ে ভারত মহাসাগরের পথে। বান্দা দ্বীপের মতো ছোট্ট এক ভূখণ্ড হয়ে ওঠে বিশ্বরাজনীতির দাবার গুঁটি।
ভাবা যায়, একফোঁটা গন্ধের টানে মানুষ পার হয়ে গেছে মহাসাগর, ঝুঁকি নিয়েছে জীবন, গড়েছে আর ভেঙেছে রাজ্য! মসলার সুবাস যেন শুধু খাবারে নয়; ঢুকে পড়েছিল ইতিহাসের রক্তপ্রবাহে। এখনো যখন রান্নাঘরে জায়ফল ঘষে দিই বা দারুচিনি ফোটে চায়ের কাপে, তখনো তার ভেতর মিশে থাকে সেই প্রাচীন অভিযানের গন্ধ—যে ঘ্রাণ একদিন পৃথিবীর মানচিত্র পাল্টে দিয়েছিল।
জায়ফল নিয়ে যুদ্ধ, উপনিবেশ ও ইতিহাস
ইতিহাসে একফোঁটা সুবাসের জন্য লড়াই হতে পারে—এটাই প্রমাণ করে বান্দা দ্বীপের কাহিনি। ষোড়শ শতাব্দীতে ডাচ আর ব্রিটিশরা একে অপরের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয় জায়ফলের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য। ডাচরা হাড়ভাঙা চেষ্টা করে দ্বীপ দখল করে রাখে, স্থানীয় মানুষদের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর অভিযান চালায়, আর জায়ফলের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করে। এমনকি ব্রিটিশদের সঙ্গে দর-কষাকষি করে তারা তাদের নিউ আমস্টারডাম, বর্তমান নিউইয়র্ক, ছাড়িয়ে দেয়—পরিবর্তে পায় পুলাউ রান, সেই বান্দার ছোট দ্বীপ, যা তখন বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান মসলার উৎস। একমুঠো মসলার বিনিময়ে পরবর্তীকালে গড়ে ওঠে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর।
কেবল বান্দা দ্বীপ নয়; জায়ফল ও অন্যান্য মসলার লোভের কারণে ইউরোপের বড় বড় সাম্রাজ্য নৌযাত্রা শুরু করে। সমুদ্রপথে দূরদূরান্তের অভিযান, নতুন উপনিবেশ স্থাপন, শহর দখল—সবকিছুই হয়েছিল একফোঁটা সুবাসের টানে। ডাচ, ব্রিটিশ, পর্তুগিজ—সব শক্তিধর দেশের নীতি, অর্থনীতি আর সামরিক কৌশলও তখন নির্ধারিত হচ্ছিল এই জায়ফলের ওপর।
স্বাদের মনস্তত্ত্ব
কেন এক কাপ কফিতে দারুচিনি ছুড়ে দিলে কিংবা কেকের ওপর জায়ফল ঝরালে মনটা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি আরামদায়ক অনুভব করে? এর পেছনে আছে স্বাদের মনস্তত্ত্বের জটিল খেলা। দারুচিনি আর জায়ফলের উষ্ণ মিশ্রণ আমাদের সংবেদন স্নায়ুকে সরাসরি টেনে আনে—একধরনের আরাম, সুরক্ষা আর নস্টালজিয়ার অনুভূতি তৈরি করে। শরৎ ও হেমন্তে হালকা ঠান্ডা বাতাস, শুকনো পাতা আর গাছের সোনালি আলো—এসব বাহ্যিক উদ্দীপনা মিলিয়ে দেয় খাবারের গন্ধের সঙ্গে। তখন কেবল স্বাদ নয়; স্মৃতি আর আবেগও জাগে।
মানব মস্তিষ্কে খাবারের সঙ্গে আবেগ ও স্মৃতির সংযোগ বহু প্রাচীন। গবেষকেরা বলেন, এই স্পাইসি-সুইট কম্বিনেশন আমাদের শরীরকে হালকা উত্তেজনা দেয়, যা সান্ত্বনার অনুভূতিকে বাড়িয়ে তোলে। তাই শুধু আমেরিকায় নয়, বিশ্বব্যাপী এমন আবহাওয়া মানেই কুমড়াগুঁড়ার চাহিদা ঊর্ধ্বমুখী। এক কাপ গরম পানীয় বা কেকের কুমড়াগুঁড়ার স্পর্শে মানুষ শুধু খাওয়ায় তৃপ্ত হয় না; বরং মুহূর্তের জন্য পুরোনো স্মৃতি, উষ্ণতা ও সান্ত্বনার গল্পে হারিয়ে যায়।
বাংলার স্বাদে পাম্পকিন স্পাইস ছোঁয়া
আজ যখন আমেরিকান কেক বা কফিতে পাম্পকিন স্পাইস সুবাস ছড়ায়, অনেক বাঙালি হয়তো ভাবেন, এটা কোনো নতুন ট্রেন্ড। কিন্তু বাস্তবে আমরা বহুদিন ধরে সেই স্বাদের সঙ্গে পরিচিত। বাংলার রান্নাঘরে দারুচিনি, লবঙ্গ, জায়ফল আর আদা—এই চার মসলা মিষ্টি, পায়েস, লাড্ডু কিংবা রোস্টে না থাকলে স্বাদটা যেন জমে না! ছোটবেলায় দাদি বা মা যখন খেজুরের লাড্ডুতে দারুচিনি মেশাতেন কিংবা দুধের পায়েসে জায়ফল ছিটাতেন, সেই স্বাদ ঠিক সেই কুমড়াগুঁড়া ফ্লেভারের সঙ্গে মিলে যায়।
অন্যদিকে ভাজা খাবারে, যেমন আলুর চপ বা চিকেন কারিতে সামান্য দারুচিনি বা আদার ব্যবহার খাদ্যের গন্ধকে এমন এক উষ্ণতা দেয়, যা মসলা-বিশ্বের ইতিহাসকে আমাদের কাছে টেনে আনে। অর্থাৎ আমরা নিজেদের অজান্তে আধুনিক কুমড়াগুঁড়া ফ্লেভারের অংশ হয়ে আছি। এটি শুধু খাবারের স্বাদ নয়; বরং আবহ, স্মৃতি ও আবেগের সঙ্গে মিশে এক প্রাচীন ও আধ্যাত্মিক ইতিহাসের পুনরুজ্জীবন ঘটাচ্ছে। তাই বলা যায়, পাম্পকিন স্পাইস নতুন নয়, এটি আমাদের পুরোনো স্বাদের আধুনিক রূপ, যা আধুনিক কাপে ঢুকে এসেছে; কিন্তু এর মূল গন্ধ, ইতিহাস আর আবেগ বাংলার রান্নাঘরে হাজার বছর ধরে খাচ্ছে ঘুরপাক।

 সুবর্ণা মেহজাবীন
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top