প্রাগৈতিহাসিক I আজটেক আহার্য
আজটেক ছিল একটি মেসো-আমেরিকান সভ্যতা, যা ১৩০০ থেকে ১৫২১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আধুনিক মেক্সিকোর মধ্য ও দক্ষিণ অঞ্চলে বিকাশ লাভ করে। এর কেন্দ্রে ছিল আধুনিক মেক্সিকো সিটি। এই সভ্যতা মূলত সামরিক বিজয় ও কূটনৈতিক জোটের মাধ্যমে একটি বিশাল অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করত। চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যে এই সাম্রাজ্য পৌঁছেছিল সর্বোচ্চ শিখরে
আজটেক সভ্যতার সেরা শাসক নির্দিষ্টভাবে বলা মুশকিল; তবে দ্বিতীয় মন্টেজুমাকে সম্ভবত সবচেয়ে বিখ্যাত ও গুরুত্বপূর্ণ শাসক ধরা হয়। তিনি ১৫০২ থেকে ১৫২০ সাল পর্যন্ত আজটেক সাম্রাজ্যের নবম রাজা ছিলেন এবং তার শাসনকালে সাম্রাজ্য বিস্তার ও ক্ষমতায়নে শিখরে পৌঁছেছিল। অবশ্য তার শাসনামলের শেষেই স্প্যানিশদের হাতে এই সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।
এই সভ্যতার অধিবাসীদের খাদ্যাভ্যাস ছিল আধুনিক মানুষের কাঠামোগত রান্না, কৃষি ও সামাজিক কাঠামোর একটি চমৎকার প্রকাশ। পুষ্টি বিবেচনার পাশাপাশি তা তাদের সামাজিক শ্রেণিবিভাগ, ধর্ম, আচার-অনুষ্ঠান ও রন্ধনপ্রণালির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিল।
অনেকের ধারণা, একুশ শতকের খাদ্যাভ্যাস প্রাচীন সংস্কৃতিগুলো থেকে খানিকটা হলেও উন্নত; তবে আজটেকদের বিবেচনায় এটি সম্ভবত সত্য নয়! ইতিহাসবিদদের মতে, ১১০০ খ্রিস্টাব্দের আগে কয়েকটি স্থানান্তরিত কুবেই (প্রাচীন সিরিয়ার জনগোষ্ঠী) মেক্সিকোতে স্থায়ী হতে শুরু করে। সেখানে ছোট ছোট ‘নগররাষ্ট্র’ গড়ে ওঠে, যার প্রতিটিতে ছিল আলাদাভাবে শাসনকারী একজন শাসক (স্থানীয় ভাষায় যাকে বলা হতো ‘ত্লাতোয়ানি’), যিনি একটি অভিজাত পরিষদ (মহল) পরিচালনা করতেন। এই নগররাষ্ট্রগুলো যত বড় ও সমৃদ্ধ হতে থাকে, ক্ষমতাধরেরা শাসনে তত বেশি আধিপত্য বিস্তার করেন। দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথম দশকের শেষের দিকে মেক্সিকোতে কয়েকটি স্বাধীন সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে। এসব সাম্রাজ্যের মধ্যে তেনোচতিৎলানে প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যটি সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল। এই অঞ্চলের যোদ্ধারা আশপাশের নগররাষ্ট্রগুলোকে দমন করে শাসকদের, বিশেষত দ্বিতীয় মন্টেজুমাকে এমন ক্ষমতা দেন, ফলে তিনি মেক্সিকোর বিশাল ভূখণ্ডে আজটেক আদর্শ ও ধর্ম প্রচারে সক্ষম হন।
আজটেক জাতি কৃষি ও ব্যবসায় অত্যন্ত দক্ষ ছিল। তাদের এই সভ্যতা ১৩৪৫ সালে বিশেষভাবে বিকশিত হয়, যা অসামান্য স্থাপত্য ও শিল্পকর্মের জন্যও সুপরিচিত। ইতিহাসবিদদের কাছে আশ্চর্যের বিষয়, ১৫২১ সালের আগস্টে স্প্যানিশ বিজেতা হেরনান কর্তেস ও তার সৈন্যদের হাতে আজটেক রাজধানীর পতন ঘটে। এক তত্ত্ব অনুযায়ী, কর্তেসের এক সৈন্যের মাধ্যমে তেনোচতিৎলানে আসা ব্যাধি গুটিবসন্ত এই সাম্রাজ্যের পতনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ওই রোগে এত বেশি আজটেক যোদ্ধার মৃত্যু ঘটে, ফলে তারা স্প্যানিয়ার্ডদের আক্রমণ প্রতিরোধে অক্ষম হয়ে পড়েন। এ রকম কিছু না হলে আজটেকরা সম্ভবত জিতে যেতেন; কারণ, এই ব্যাধি হানা দেওয়ার আগে তাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বেশ উন্নত ছিল।
আজটেক শাসনামলে বিশাল অঞ্চলে কৃষিকাজ হতো। তাদের খাদ্যতালিকার মূল উপাদান ছিল ভুট্টা, শিম ও কুমড়া। এসব খাদ্য উপাদানের সঙ্গে মরিচ ও টমেটো যোগের চল ছিল। ওই সভ্যতার রাজধানী তেনোচতিৎলানের অবস্থান ছিল টেক্সকোকো হ্রদের কাছে। টেক্সকোকো হলো মেক্সিকো উপত্যকার একটি প্রাচীন হ্রদ ব্যবস্থা, যা বর্তমান মেক্সিকো সিটির কাছে একটি বিশাল এলাকা হিসেবে বিদ্যমান। ঐতিহাসিক হ্রদটির বেশির ভাগ অংশের পানিই এখন নিষ্কাশিত হয়ে গেছে। হ্রদটি এর ফলে শহর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে এর অবশিষ্টাংশ এবং একটি প্রাকৃতিক জলাভূমি এখনো অস্তিত্বমান। আজটেক যুগের অধিবাসীরা এই হ্রদ থেকে ক্রেফিশ-সদৃশ প্রাণী একোসিলসের শৈবাল স্পিরুলিনা সংগ্রহ করতেন এবং সেগুলো ব্যবহারে কেক বানাতেন। মাংস সামান্য পরিমাণে খাওয়ার প্রচলন থাকার কারণ, আজটেক খাদ্য মূলত নিরামিষভিত্তিক ছিল। তবে তারা ফড়িং, ম্যাগুয়ে ওর্ম, পিঁপড়ে ও লার্ভার মতো কীটপতঙ্গ খেতেন। আজও মেক্সিকোর কিছু অঞ্চলে এসব কীটকে নান্দনিক খাবার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিছু বন্য শিকার ভক্ষণেরও চল ছিল; যেমন বন্য পাখি, গফার, গ্রিন ইগুয়ানা, একোলোটেল (একধরনের স্যালাম্যান্ডার), হরিণ প্রভৃতি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা মুরগির জাত সংরক্ষণের মাধ্যমে টার্কি ও হাঁস পালন শুরু করেন। বুনো মাশরুম ও অন্যান্য ফাঙ্গাসও ব্যবহৃত হতো অনেক ডিশে; এর মধ্যে ছিল হুইৎলাকোচে, যা কিনা ভুট্টায় জন্মানো মাশরুমবিশেষ। এই সুস্বাদু ফাঙ্গাস আজকের দিনের মেক্সিকান রান্নায়ও জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে।
আজটেকরা খাবারে স্বাদ দেওয়ার জন্য আশ্চর্যজনক পরিমাণে ভেষজ ও মসলা ব্যবহার করতেন। প্রায় সব খাবারেই সক্রিয়ভাবে ব্যবহৃত হতো মরিচ। এই খাদ্য উপাদানকে তারা শুষ্ক ও গুঁড়া আকারে সংরক্ষণ করতেন। আরও ছিল কুলান্ট্রো, যার স্বাদ বর্তমান ধনেপাতার চেয়ে কড়া; টাটকা ও শুকনা—উভয় রূপে ব্যবহৃত হতো। দারুচিনি এবং অর্কিড থেকে তৈরি ভ্যানিলা—দুটোই পানীয়ে স্বাদ যুক্ত করতে ব্যবহারের চল ছিল। স্বাদবর্ধক অন্যান্য খাদ্য উপাদানের মধ্যে ছিল এচিয়োতে, ইপাজোতে, হোজা সান্তা, গার্লিক ভাইন লিফ, অলস্পাইস এবং অ্যাভোকাডো পাতা। বিস্তৃত বিভিন্ন দেশীয় উদ্ভিদও আজটেক খাদ্যতালিকার অংশ ছিল। অনেক ধরনের খাদ্যযোগ্য উদ্ভিদ বন্যভাবে জন্মাত এবং পরে সংগ্রহ করা হতো। অবশ্যই ভুট্টা ছিল সেগুলোর অন্যতম প্রধান। ধারণা করা হয়, ভুট্টার বিভিন্ন জাত মেক্সিকোতে ৬ হাজার বছরের বেশি সময় ধরে আবাসিকভাবে চাষ করা হয়। আজটেক সভ্যতার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যশস্য ছিল এটি। প্রায় প্রতিটি খাবারে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষ তা উপভোগ করতেন। এমনকি এটি সম্মানিত খাদ্যশস্য হিসেবে বিবেচিত হতো। সেন্ট্রাল মেক্সিকোতে ভুট্টার বিভিন্ন জাত জন্মাত; যেমন হলুদ, লাল, রঙিন, সাদা, কালি ছোপযুক্ত এবং নীল খোসাযুক্ত। আরও বেশ কিছু জাতের ভুট্টা ইতিহাসে নথিভুক্ত রয়েছে।
আজটেকরা রোমাঞ্চকরভাবে নিক্সটামালাইজেশন নামে একটি প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেছিলেন। এতে শুকনো ভুট্টাকে অ্যালকালিন দ্রবণে (যেমন চুনের পানিতে) ভিজিয়ে তারপর রান্না করা হতো। এর ফলে একটি রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটায় ভুট্টা আরও পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ খাদ্যে রূপান্তরিত হতো। এককথায়, নিক্সটামালাইজেশন আদতে পুষ্টিগুণকে আরও সহজে দেহে গ্রহণযোগ্য করে তুলত, যে প্রক্রিয়া আজও ব্যবহৃত হয়।
ভুট্টা ফসল আজকের মতো আজটেক যুগেও আবহাওয়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতো। যেহেতু এই খাদ্যশস্য ওই সভ্যতার মানুষদের জীবনধারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তাই তারা ভুট্টার দেবতা সেন্তিওতলের পূজা করতেন। তাদের বিশ্বাসমতে, সেন্তিওতল ছিলেন একজন তরুণ যোদ্ধার প্রতিনিধি, যার মাথা থেকে ভুট্টাগাছের শাখা ও কাণ্ড মাটিতে প্রবেশ করেছিল। তার সম্মানে এবং সম্ভবত এই খাদ্যশস্যকে নিরাপদে রাখতে আজটেক নাগরিকেরা রক্তদান রীতি পালন করতেন। প্রায়শই নিজেদের বাড়িও রক্তে রঞ্জিত করা হতো। এই দেবতাকে সম্মান জানাতে আজটেক তরুণীরা ভুট্টার বীজের নেকলেস পরতেন। ফলন শেষে, খেত থেকে বাকি থাকা শস্য ও বীজ সংগ্রহ করে সেন্তিওতলের মূর্তির সামনে রাখার রেওয়াজ ছিল, যাতে পরবর্তী মৌসুমে সেগুলো রক্ষা পায়।
ফুয়াদ রূহানী খান
চিত্রকর্ম: সংগ্রহ
