রসনাবিলাস I বিফপ্রেমীদের আড্ডাখানা
পরিবেশ, আবহ আর খাদ্যসম্ভারে অভিনবত্ব ছড়ানো এক রেস্তোরাঁ। মেলে ১০টি পদ, সবই গরু থেকে গড়া। ঘুরে এসে লিখেছেন আল মারুফ রাসেল
গনগনে শারদ দুপুরে হাজির হলাম রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বর্ধিত অংশে। এই এলাকায় আকাশছোঁয়ার অভিলাষ নিয়ে দালানকোঠা সব উঠতে শুরু করেছে কেবল, পুরোপুরি গ্রামের গন্ধ মিইয়ে যায়নি এখনো। তাই তো আশপাশে বেশ কিছু গরুর খামার। এলাকার নাম হাক্কার পাড়। কচুরিপানায় ভরে থাকা এক খালের ওপরের হাক্কা বা সাঁকোর কারণে এই নামকরণ। রিকশাওয়ালার ভুলের কারণে এই সাঁকো পার হতে হলো, নইলে বছিলা বাসস্ট্যান্ড থেকে আরাম করে গাড়িতেই চলে আসা যায় বিফওয়ালায়।
বিফওয়ালা, গরুর মাংসপ্রেমীদের কাছে ইতিমধ্যে পরিচিতি পেয়েছে শুধুই বিফে তৈরি দেশি সব খাবারের আয়োজনের কারণে। বিফওয়ালার যাত্রা শুরু গত বছরের শুরুতে, যখন ঢাকার বেশ কিছু রেস্টুরেন্টে গরুর মাংস বিক্রি বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। অনেকটা সেই প্রেক্ষাপটেই এই রেস্তোরাঁর যাত্রা শুরু, কেবল গরুতে তৈরি বিভিন্ন পদ দিয়ে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে তাদের একটা সুবিধা ছিল, নিজেদের গরুর খামার, আহলান অ্যাগ্রো। মোটামুটিভাবে নিজেদের গরুর মাংস দিয়েই শুরু থেকে খাবার রান্না করে আসছেন তারা।
অনেক গরুর খামারের মাঝে বিফওয়ালার অবস্থান। একেবারে প্রথাগত রেস্টুরেন্ট নয় এটা। রেস্টুরেন্টের সাইনবোর্ড দেখে ভেতরে ঢুকতেই খোলা উঠোন। ডানে অফিসঘর, বামে চেয়ার টেবিলে বসার ব্যবস্থা। আর নাক বরাবর হেঁসেল। সেটা সামলাচ্ছেন পুরান ঢাকার চকবাজার এলাকার বাবুর্চি মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন। অফিসে বসে কথা হচ্ছিল বিফওয়ালার উদ্যোক্তা সাগর হাসনাতের সঙ্গে। তিনিই একে একে বলে গেলেন শুরুর গল্প। একে তো শহরে গোমাংসের দাম বাড়তি, তার ওপর বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট থেকে বিফ মেনু হারিয়ে যেতে থাকলে তিনি এ নিয়ে ভাবতে শুরু করেছিলেন, আর তারই ফসল বিফওয়ালা। এটাকে তিনি তার পলিটিক্যাল স্ট্যান্স হিসেবেও ভাবতে ভালোবাসেন। তার ভাষ্যে, এটাকে কেউ রেস্টুরেন্ট ভেবে এলে একটা ধাক্কা খাবেন নিশ্চিতভাবে। বরং উত্তর ভারতীয় ধাবার সঙ্গে তুলনা করলেই ভালো হয় বলে মনে করেন। তার কাছে বিফওয়ালা মূলত পারিবারিক সময় কাটানো, সমমনাদের আড্ডা, বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা, আইডিয়া শেয়ারিং সেন্টার। অফিসের পেছনে একটা ঘরও রয়েছে, যেখানে খানিকটা আরবীয় কায়দায় বসে খাবার ভাগাভাগি করা হয়; সঙ্গে চলে আড্ডা।
মেনুতে কোনো আহামরি চটকদারি নেই। এ ব্যাপারে উদ্যোক্তা সাগর হাসনাতের বক্তব্য, ‘রেস্টুরেন্টে গরুর মাংস খেতে গেলে যে দুশ্চিন্তাগুলো আসে—মাংসের মান কেমন, ঠিকমতো জবাই করা কি না, আমদানি করা প্যাকেটজাত মাংস কি না, সেগুলো পাশে সরিয়ে রেখে যেন একজন ভোজনরসিক নিশ্চিন্তে মাংস খাওয়াটা উপভোগ করতে পারেন, মাংসের নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তা না করে। এখানে যে মাংস রান্না করি, সেই ষাঁড় বিভিন্ন গ্রাম থেকে সংগ্রহ করে পালা হয় আমাদের নিজেদের খামারে, নিরাপদ খাবার খাইয়ে। জবাই করা হয় ধর্মীয় সব অনুশাসন মেনে। রান্নার মসলা থেকে শুরু করে সবকিছুই নিজেদের। রান্নাও হয় লাকড়ির চুলায়, যেটা ঢাকা শহরের আর কোথাও করে কি না সন্দেহ। শুদ্ধ মসলা আর আমাদের দেশীয় কালিনারি হেরিটেজ দিয়ে যতটুকু করা সম্ভব, সেটাই করি; বাড়াবাড়ি কিছু করা হয় না বিফওয়ালায়।’
আপাতত এখানে ফিক্সড একটাই মেনু। বিফ থালি। দুজন ও চারজনের জন্য—দুভাবে অর্ডার করা যায়। ঝরঝরে সাদা পোলাও বা তেহারি কিংবা শাহি পরোটার সঙ্গে থাকে দশ পদের সংগত। অবশ্য নল্লি আর ভুঁড়ি ভাজা শেষ হয়ে যাওয়ায় আমি পেলাম আট পদ—লাল ভুনা, কালা ভুনা, মগজ ভুনা, কলিজা ভুনা, ঝুরা মাংস, পায়া, মাংসের আচার ও ডালগোশ। তবে দশ পদ পুরিয়ে দিয়েছিলেন তারা দুটো পদের পুনরাবৃত্তি করে। পদগুলো এলো ধোঁয়া উড়িয়ে, ধুনগার পদ্ধতিতে। ফলে খাবারে পোড়া কাঠ-কয়লার সুঘ্রাণ লাকড়ির চুলায় রান্না খাবারগুলোতে দুর্দান্ত এক অ্যারোমা যোগ করেছিল। কী দিয়ে শুরু করা হবে, সেটা নিয়ে ভাবতে বসতে হলো; কারণ, এখানে সবই গরুর পদ। শুরুর পদ বা শেষের পদ বলে কোনো খাবারকে বিশেষায়িত করা যায় কি? তাই হালকা মসলা থেকে ভারী মসলায় যাওয়ার তরিকাটাই শ্রেয় মনে হলো। প্রথমে পায়া, কম তেল ও মসলার—পরোটার সঙ্গেই এর সংগতটা দারুণ হয়, অন্তত আমাদের পোলাও বা ভাতের চেয়ে। তারপরও শুরুর পদ হিসেবে মন্দ নয়। এরপর মগজ ভুনা। গরুর মগজ এমন একটা খাবার, যেটা ঠিকভাবে রান্না করলে খারাপ হওয়ার শঙ্কা নেই। অল্প মসলা, ফলে মগজের স্বাদটা নষ্ট হয়নি। কলিজা ভুনাটাও দারুণ। ঝরঝরে পোলাওয়ের সঙ্গে ভালোই লাগছিল। সঙ্গে পাতের পাশে রাখা মাংসের আচার অল্প অল্প করে মিশিয়ে নিলে চমৎকার লাগে। আচারের রসুন, খানিকটা শক্ত চর্বিওয়ালা মাংস, একটুখানি কাঁচা মরিচে কামড় দিয়ে খেতে খেতেই খেয়াল হলো, এটাই শেষ নয়, খেতে হবে আরও অনেক কিছু। ডালগোশ ব্যাপারটা পরে খাওয়ার নিয়ম হলেও লাল ভুনা আর কালা ভুনার স্বাদ মুখে রেখে দেওয়ার অভিলাষে তাকে আগেই পেটে যেতে হলো। মাখা মাখা ডালে চর্বি, হাড়সহ মাংসও দারুণ। অনেকে চর্বি বলে পাশে ঠেলে দিলেও ডালে মূল স্বাদটা আনেই এই চর্বি গলা তেল আর হাড়। এর সঙ্গে আচার আর ঝুরা মাংসটা মাখিয়ে নিতেই স্বাদ খুলে যায়। এদের ঝুরা মাংসটা আমাদের ঘরের ঝুরা মাংসের চেয়ে খানিকটা আলাদা, একটু কোমল, নরম ধরনের। এরপর বাকি রইল দুই ভুনা, লাল ভুনা ও কালা ভুনা।
লাল ভুনার স্বাদটা ঠিক রেস্টুরেন্টের মতো নয়, যেমনটা সচরাচর আমরা খেয়ে থাকি। রেস্টুরেন্টের চেয়ে এর স্বাদ অনেকটা ঠিক দাদি-নানিদের হাতের রান্নার মতো। কালা ভুনাটাও চলনসই। আহামরি ভালো বলব না; কারণ, চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের স্থানীয়দের হাতে রান্না ছাড়া ভালো কালা ভুনা প্রায় দুর্লভ ব্যাপার। তবে যদি ঢাকার কালা ভুনার কথা বলি, তাহলে এটাকে প্রথম সারিতেই রাখতে হবে। বিফওয়ালার খাবারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, খুব বেশি ঝালও না, আবার একেবারে ঝাল নেই—সেটাও না; মাঝামাঝি একটা জায়গায় রাখা হয়েছে সবার কথা মাথায় রেখে। সব মিলিয়ে এই যে ১০ পদের বিফ আইটেম, সঙ্গে পরোটা, তেহারি বা সাদা পোলাও—যা-ই নেওয়া হোক না কেন, ডিল হিসেবে কিন্তু খারাপ না—দুজনের ১ হাজার ৪৯৯ টাকা হিসেবে। দুজন বলে যে পরিমাণ সাদা পোলাও আমাকে দেওয়া হলো, তা দিয়ে অনায়াসে তিনজনের খাওয়া হয়ে যায়।
গরু খাওয়ার এই আয়োজনে শামিল হতে চলে যেতে পারেন বিফওয়ালায়। এরই মধ্যে দুটো আলাদা বিফ ফেস্টিভ্যাল করা হয়ে গেছে এর উদ্যোগে; সামনে শীতকালেই আরেকটি নামবে। এ ছাড়া ২৫-৩০ জনের জমায়েতের জন্য পুরো রেস্টুরেন্টও বুকিং দিতে পারেন যে কেউ। বিফওয়ালা বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে ক্যাটারিংও করে থাকে। চাইলে পছন্দসই গরু বা ছাগল কিনে নিতে পারেন রেস্টুরেন্টের লাগোয়া খামার থেকে।
ঠিকানা: বিফওয়ালা, বছিলা গার্ডেন সিটি, চন্দ্রিমার হাক্কার পাড়, বছিলা, মোহাম্মদপুর, ঢাকা। ফোন: ০১৭৫৭০৩১৪৪০। ফেসবুক: beef.wala.bd।
ছবি: লেখক
