ফিচার I বড়দিনের ভুলে যাওয়া স্বাদ
প্রতিটি উৎসবের সঙ্গেই জড়িয়ে থাকে বিশেষ কিছু খাবার। যার শিকড় বহু পুরোনো। কিছু খাবার আবার সময়ের প্রবাহে হারিয়ে যায় অগোচরেই। ক্রিসমাসের এমনই কিছু পদের তালাশে ফুয়াদ রূহানী খান
শীতের ভোরে হালকা কুয়াশা। দূরে কোথাও গির্জার ঘণ্টাধ্বনি। বাতাসে মিশে থাকা দারুচিনির ঘ্রাণ। এসব হলো ক্রিসমাস বা বড়দিনের প্রাথমিক আভাস। আজকের প্রজন্মের কাছে ক্রিসমাস মানেই চকচকে কেক, ক্রিমে মোড়ানো পেস্ট্রি, রঙিন লাইট আর ইনস্টাগ্রাম-ফ্রেমে বন্দী ডিনার টেবিল। কিন্তু একসময় এই উৎসবের মানে ছিল ঘরোয়া উষ্ণতা, গন্ধে ম-ম রান্নাঘর, আর এমন সব খাবার, যেগুলোর নামই আজ অনেকে ভুলে গেছেন। ফিরে যাওয়া যাক সেই পুরোনো সময়ের বড়দিনে, যেখানে কেক ছিল না বেকারির শেলফে; বরং তৈরি হতো নানা মসলার ঘ্রাণে ভরা গরম চুলার পাশে; যেখানে টেবিলে জায়গা পেত শুকনা ফল, ঘরে বানানো পানীয় বিশেষ, আর হাতে লেখা রেসিপির উত্তরাধিকার।
ক্রিসমাস পুডিং: ধৈর্যের প্রতীক
আজকাল ডেজার্ট বললেই চোখে ভাসে চকলেট মুস বা টিরামিসুর ছবি। কিন্তু একসময় ক্রিসমাসের মিষ্টান্ন মানে ছিল ক্রিসমাস পুডিং। এ এমন এক খাবার, যা যতটা সুস্বাদু, তার চেয়ে বেশি ঐতিহ্যের প্রতীক। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে এই পুডিং আমাদের উপমহাদেশেও ছড়িয়ে পড়ে। খ্রিস্টান পরিবারগুলোতে ডিসেম্বরের শুরুতে এটি তৈরির প্রস্তুতি শুরু হতো। শুকনা ফল, বাদাম, খেজুর, কিশমিশ, কমলার খোসা, দারুচিনি ও জায়ফল মিশিয়ে রাখা হতো ব্র্যান্ডি বা পানীয় বিশেষে। কখনো এক সপ্তাহ, কখনো এক মাস ধরে। এই মিশ্রণকে বলা হতো পুডিং মিক্স’, যা একটি পরিবারের গোপন সম্পদ! ক্রিসমাসের আগের রাতে সবাই মিলে পুডিং বানানোর সময় প্রত্যেক সদস্য পালা করে নাড়ত মিশ্রণটা, আর সঙ্গে একটি করে গোপন ইচ্ছা পেশ করত। এখনকার কেক মেশিনে তৈরি জগতে সেই পারিবারিক রীতি আর টিকে নেই বললেই চলে।
রোস্ট মাংস: ঘ্রাণেই উৎসব
রোস্ট টার্কি আজও পশ্চিমা ক্রিসমাস টেবিলের প্রাণ; কিন্তু আমাদের দেশে একসময় রোস্ট ডাক, মাটন পাই বা বিফ স্টেক ছিল ক্রিসমাস ভোজের প্রধান আকর্ষণ। কলকাতার পুরোনো অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পরিবারগুলোর রান্নাঘরে এখনো গল্প হয়ে বেঁচে আছে ‘রেলওয়ে মাটন কারি’ বা ‘ডেভিলড চিকেন’। এই খাবারগুলো শুধু স্বাদ নয়; সময়েরও সাক্ষী। একসময় উৎসব মানেই ছিল পাড়াজুড়ে মাংসের গন্ধে ম-ম করা বিকেল। আজকের দিনে যেখানে রেস্টুরেন্টের ক্রিসমাস বুফে অনেকের উৎসবের অংশ, সেখানে সেই ধীরে রান্না করা রোস্টের জায়গা যেন হারিয়ে গেছে।
মিন্স পাই: মধুর স্মৃতি
মিন্স পাই শব্দযুগল শুনলেই এখন অনেকে ভেবে নেন, এটি নিশ্চয় মাংসের কোনো পদ! অথচ আসল মিন্স পাই ছিল একেবারে আলাদা কিছু; ফল, বাদাম, মসলা ও চিনি মিশিয়ে তৈরি একধরনের পেস্ট্রি, যার ভেতরে থাকত উৎসবের উষ্ণতা। ব্রিটিশ শাসনামলে মিন্স পাইয়ের রেসিপি এসেছিল কলকাতার ক্রিসমাস টেবিলে। আঠারো ও উনিশ শতকের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পরিবারগুলো এই পাই বানাত ছোট ছোট প্যানে, ওপরে ক্রুশচিহ্ন এঁকে। বিশ্বাস ছিল, যে যত বেশি পাই খাবে, আসন্ন বছরে তার ভাগ্য তত ভালো যাবে! আজকের দিনে খুব কম ঘরেই মিন্স পাই তৈরি হয়। কেকের ঝলমলে দোকানগুলো এই ঐতিহ্যকে গ্রাস করেছে। অথচ এর মধ্যেই ছিল সেই পুরোনো কলকাতার ক্রিসমাসের স্বাদ, যেখানে খাবার কোনো তাড়াহুড়ো নয়; ধীর, উষ্ণ সময়ের গল্প বয়ে বেড়াত।
বয়েলড কেক: ফ্রুট কেকের আদি সংস্করণ
আজকের দিনে ফ্রুট কেক ক্রিসমাসের অপরিহার্য প্রতীক। কিন্তু জানেন কি, একসময় এই কেক বেক নয়, বরং সেদ্ধ করা হতো? এই বয়েলড বা সেদ্ধ কেক তৈরি হতো ঘন দুধ, চিনি, ডিম, শুকনা ফল, দারুচিনি, লবঙ্গ ও গলানো মাখন যোগে। তৈরিতে সময় লাগত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। চুলার ওপর বসানো বড় হাঁড়িতে, কাপড় দিয়ে ঢেকে, ধীরে ধীরে ফোটানো হতো কেকের মিশ্রণ। ফল? এক অদ্ভুত স্নিগ্ধ, ঘন ও আর্দ্র কেক—যার প্রতিটি টুকরায় ছিল শীতের ছোঁয়া। এখন আমরা সহজে বেকারি থেকে রেডিমেড ফ্রুট কেক কিনে ফেলি; কিন্তু সেই সেদ্ধ কেকের ঘ্রাণ আজও বহু খ্রিস্টান পরিবারের প্রবীণদের মনে নস্টালজিয়া জাগায়।
ক্রিসমাস কারি: মসলার মেলবন্ধন
ক্রিসমাস মানেই কেবল পাশ্চাত্যের রোস্ট নয়; বরং স্থানীয় স্বাদের সঙ্গে তার এক চমৎকার সংমিশ্রণ। কলকাতা, ঢাকা, চট্টগ্রাম কিংবা গোয়ার রান্নাঘরে তৈরি হতো বিশেষ ক্রিসমাস কারি; যেখানে মুরগি বা মাটন রান্না হতো নারকেল দুধ, দারুচিনি, লবঙ্গ, গোলমরিচ আর কিশমিশের মিশ্রণে। এই খাবারের বিশেষত্ব ছিল এর সুবাস; যা পুরোপুরি ভারতীয় নয়, আবার ইউরোপীয়ও নয়। এ ছিল এক সত্যিকারের সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন, যা আজকের ক্রিসমাস মেনুতে খুব একটা দেখা যায় না।
শিশুদের জন্য ঘরে বানানো কুকিজ ও শর্টব্রেড
আজকের শিশুরা হয়তো জানে না, একসময় ক্রিসমাসের আনন্দ মানেই ছিল ঘরে কুকিজ বানানো। দাদি বা মা সকালে ময়দা, চিনি আর মাখন মেখে বানাতেন শর্টব্রেড কুকিজ, আর শিশুরা হাতে ছাঁচ নিয়ে বানাত তারকা, ঘণ্টি কিংবা ক্রুশ আকৃতি। এই কুকিজগুলো বানানোর সময় ঘর ভরে যেত হাসি আর মিষ্টি গন্ধে। অথচ এখন কুকিজ আসে প্যাকেট খুলে, লেবেলসহ!
হারিয়ে যাওয়া রেসিপি, হারানো গল্প
প্রতিটি খাবারের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে একেকটি গল্প। নানি-দাদির হাতের গোপন কৌশল, মায়ের মাপের নির্ভুলতা কিংবা ছেলেবেলার কোনো মিষ্টি প্রতিশ্রুতি। আধুনিক জীবনের তাড়াহুড়োয় সেই গল্পগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। এখন রেসিপি আসে ইউটিউব থেকে, ভালোবাসা আসে ইমোজিতে, আর উৎসব সীমাবদ্ধ থেকে যায় ছবির ফ্রেমে! তবু ক্রিসমাসের সেই পুরোনো রান্নাঘরগুলো এখনো আছে—কোথাও কোনো শান্তিপ্রিয় শহরের পুরোনো পাড়ায়, যেখানে কেউ না কেউ চুলায় আগুন জ্বালিয়ে দারুচিনির গন্ধে ভরিয়ে রাখেন ঘর।
ফিরে দেখা ঐতিহ্যের গুরুত্ব
ভুলে যাওয়া খাবারগুলো ফিরিয়ে আনা মানে শুধু স্বাদ পুনরুদ্ধার নয়; বরং এক হারানো সময়কে আবারও ছুঁয়ে দেখা। এগুলো আমাদের শেখায়—উৎসব কেবল বাহ্যিক আয়োজন নয়; পারস্পরিক সংযোগের গল্পও। হয়তো আজও আমরা ঘরে বিশেষ পানীয় বানাতে পারি, কিংবা সন্তানদের নিয়ে একদিন বেক করতে পারি পুরোনো ধাঁচের ক্রিসমাস পুডিং। তাতে শুধু রান্না হবে না; ফিরে আসবে এক উষ্ণ অনুভব, এক মানবিক সংযোগ।
ছবি: ইন্টারনেট
