skip to Main Content

ত্বকতত্ত্ব I ভিটামিন প্যাচ

জীবনযাত্রার কারণে ত্বকযত্নে এর চাহিদা বাড়ছে। প্রয়োগ সহজ; যথেষ্ট ঝামেলাহীন। কিন্তু কিছু ঝুঁকির কথাও এড়ানোর নেই উপায়

ভিটামিন গ্রহণ অনেকের কাছে দৈনন্দিন চ্যালেঞ্জ। গামি ভিটামিন দেখতে আকর্ষণীয় হলেও স্বাদে ঠিক ক্যান্ডির মতো আনন্দ দেয় না; আর বড় আকারের ট্যাবলেট গিলে খাওয়া অনেক সময় অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে। প্রতিদিন পর্যাপ্ত ফল, শাকসবজি গ্রহণ করাও ব্যস্ত জীবনে সব সময় সম্ভব হয় না। ফলে নিয়মিত ভিটামিন গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা থাকা সত্ত্বেও তা বজায় রাখা কঠিন হয়।
এই বাস্তবতার মধ্যেই বাজারে আসে ভিটামিন প্যাচ। এটি একটি ছোট স্টিকারের মতো পণ্য, যা চামড়ায় সেঁটে দিলে ধীরে ধীরে ভিটামিন শরীরে পৌঁছে যায় বলে দাবি করা হয়। একে গিলতে হয় না, মিশ্রণ করতে হয় না; এমনকি পানি খোঁজারও দরকার নেই। ব্যবহারকারীর জন্য এটি যেন ভিটামিন গ্রহণের আরও সহজ, ঝামেলাহীন একটি বিকল্প। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এগুলো কি সত্যিই কাজ করে? নাকি আরেকটি ওয়েলনেস ট্রেন্ড? এই লেখায় তুলে ধরা হয়েছে ট্রান্সডারমাল প্রযুক্তির ইতিহাস থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক গবেষণার সূত্র ধরে, কোন ধরনের ভিটামিন প্যাচ কার্যকর হতে পারে, তার বিশ্লেষণ এবং জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ব্যবহারকারীদের অভিজ্ঞতা।
ট্রান্সডারমাল প্যাচ কী
এ এমন ধরনের বাহ্যিক ওষুধ বা পুষ্টি সরবরাহ পদ্ধতি, যা ত্বকের ওপর লাগানো থাকে এবং সেখান থেকে সক্রিয় উপাদান ধীরে ধীরে রক্তপ্রবাহে পৌঁছে যায়। এর ধারণা কিন্তু একেবারেই নতুন নয়। ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিসর ও ব্যাবিলনে ভেষজ মলম, ওষুধ মেশানো পট্টি বা প্লাস্টারের মতো উপকরণ ব্যবহৃত হতো, ত্বকে প্রয়োগের পর যেগুলো ধীরে ধীরে কাজ করত। আধুনিক চিকিৎসায় ট্রান্সডারমাল প্যাচের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি আসে ১৯৭৯ সালে, যখন মোশন সিকনেসের ওষুধ প্রথমবার এই পদ্ধতিতে অনুমোদন পায়। এরপর নিকোটিন ত্যাগে সহায়তা, ব্যথা নিয়ন্ত্রণ, জন্মনিয়ন্ত্রণসহ আরও কিছু চিকিৎসায় প্যাচ নিয়মিত ব্যবহৃত হতে থাকে।
তবে ত্বকের ওপর কিছু আটকে দেওয়া মানেই যে তা শরীরে শোষিত হবে, তেমনটি নয়। ত্বক স্বাভাবিকভাবে খুব সুরক্ষিত স্তর তৈরি করে রাখে; তাই কোনো উপাদানকে ভেতরে যেতে হলে নির্দিষ্ট আণবিক আকার, লিপিড দ্রবণীয়তা এবং বিশেষ ফর্মুলেশনের দরকার পড়ে। অনেক ভিটামিনের অণু বড় কিংবা পানিতে দ্রবণীয় হওয়ায় ত্বক দিয়ে প্রবেশ করানো কঠিন। তাই এখন বাজারে থাকা ভিটামিন প্যাচগুলোর কার্যকারিতা নির্ভর করে ব্যবহৃত প্রযুক্তি, উপাদানের ধরন এবং ত্বকে শোষণ বাড়ানোর জন্য কী ধরনের এনহ্যান্সার ব্যবহার করা হয়েছে, তার ওপর। এ কারণে একেকটি প্যাচের কার্যকারিতা একেক রকম হতে পারে।
নতুন ট্রেন্ড নাকি কার্যকর সমাধান
অনলাইন শপ থেকে শুরু করে স্থানীয় ফার্মেসি—সবখানেই এখন ভিটামিন প্যাচের রমরমা। বিভিন্ন ব্র্যান্ড দাবি করে, সামান্য একটি প্যাচই নাকি হ্যাংওভার কমাতে, মুড ভালো করতে, এনার্জি বাড়াতে কিংবা ঘুমের উন্নতি ঘটাতে সহায়ক। এমনকি অনেকে বলেন, এটি পোকামাকড়ের কামড় ঠেকাতে কিংবা অ্যাথলেটিক পারফরম্যান্স বাড়াতে সক্ষম। এসব প্যাচে সাধারণত ভিটামিন বি, সি, ডি, ক্যাফেইন, মেলাটোনিন, বিভিন্ন অ্যাডাপ্টোজেন ও হারবাল এক্সট্র্যাক্ট ব্যবহৃত হয়, যা দ্রুত শোষণের সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতিগুলো কতটা বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে আছে?
এখনো এ নিয়ে গবেষণা খুবই সীমিত। ২০২২ সালের একটি ছোট পরিসরের গবেষণায় দেখা যায়, গ্যাস্ট্রিক বাইপাস করানো রোগীদের মধ্যে, যারা ভিটামিন প্যাচ ব্যবহার করেছেন, তাদের ভিটামিন ডি, বি১ এবং বি১২-এর রক্তস্তর ট্যাবলেট গ্রহণকারীদের তুলনায় কম ছিল। এই ফল ইঙ্গিত দেয়, সব ধরনের ভিটামিন ত্বকের মাধ্যমে দেহে পর্যাপ্ত মাত্রায় প্রবেশ করতে পারে না এবং তা প্যাচের কার্যকারিতা উপাদানের ধরন, ফর্মুলেশন ও ত্বক-শোষণ প্রযুক্তির ওপর অনেকটাই নির্ভর করে। ফলে বাজারে প্রচুর দাবি থাকলেও এগুলোর কার্যকারিতা সম্পর্কে এখনো বৃহৎ আকারে ও নিশ্চিতভাবে বলা মুশকিল।
এক্সপেরিমেন্টাল ডারমাটোলজিস্ট রিভিউ
সাম্প্রতিক গবেষণা ভিটামিন প্যাচকে নিয়ে কিছু আশাব্যঞ্জক দিক তুলে ধরলেও সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট। এক্সপেরিমেন্টাল ডারমাটোলজিস্টে প্রকাশিত একটি রিভিউ জানায়, নির্দিষ্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করলে ত্বকের ব্যারিয়ার ভেদ করে কিছু পুষ্টি উপাদান দেহের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে। তবে তথ্য এখনো অপর্যাপ্ত; তাই দীর্ঘমেয়াদি ও বড় আকারের গবেষণা জরুরি। সব ভিটামিন ট্রান্সডারমাল পন্থায় শোষিত হয় না; বিশেষ করে পানি-দ্রবণীয় অনেক ভিটামিন ত্বকের বাধায় আটকে যেতে পারে। অন্যদিকে আরেকটি বিএমজি গবেষণা জানিয়েছে, ৮ সপ্তাহ ভিটামিন ডি প্যাচ ব্যবহারের পর অংশগ্রহণকারীদের গড় ভিটামিন ডি মাত্রা ২২% পর্যন্ত বেড়েছিল। এই ফল অবশ্য আশাব্যঞ্জক।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভিটামিন প্যাচকে এখনো মূল পদ্ধতির বদলে তৃতীয় বিকল্প ভাবাই যুক্তিযুক্ত। তারা জানান, মুখে খাওয়া অনেক ভিটামিন পাকস্থলীর অ্যাসিডে নষ্ট হয়ে যায়; বমিভাবের মতো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি করতে কিংবা সেগুলো গুণমান নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হতে পারে। অন্যদিকে শট ও আইভি ইনফিউশন দ্রুত ও কার্যকর হলেও সবার পক্ষে বারবার ক্লিনিকে যাওয়া কিংবা ইনজেকশন গ্রহণ করা বাস্তবসম্মত নয়। তাই প্যাচ ব্যবহার সহজ; এর ঝুঁকি তুলনামূলক কম এবং এটি কিছু ক্ষেত্রে সহায়ক অ্যাড-অন হতে সক্ষম। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ফ্যাট-সোলিউবল ভিটামিন যেমন এ, ডি, ই, কে এই পন্থায় সবচেয়ে সম্ভাবনাময়। তবে ঝুঁকিও আছে! এগুলো যেহেতু ডায়েটারি সাপ্লিমেন্ট হিসেবে বিক্রি হয়, এফডিএ অনুমোদনের প্রয়োজন পড়ে না; ফলে ভুল ডোজ, কম মান, অতিরিক্ত ব্যবহারে টক্সিসিটি, অ্যালার্জি বা র‌্যাশ হতে পারে। ত্বক তৈলাক্ত বা লোমশ হলে প্যাচ ভালোভাবে বসে না; আবার এর দামও তুলনামূলক বেশি।
বাস্তবতা বনাম প্রত্যাশা
ব্যবহারকারীদের অভিজ্ঞতায় ভিটামিন প্যাচ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। ভিটামিন ডি প্যাচ ব্যবহারকারীরা জানাচ্ছেন, পিল খাওয়ার অভ্যাস না থাকলে এটি বেশ সুবিধাজনক। প্যাচটি ঘাম, সওনা বা শাওয়ারের মধ্যেও টিকে থাকে এবং অনেকে এনার্জি বাড়ার অনুভূতি পেয়েছেন। তবে সত্যিকারের প্রভাব বুঝতে রক্ত পরীক্ষা জরুরি। মেলাটোনিন প্যাচ ব্যবহারকারীরা জানান, ঘুমের মানে তেমন বড় পরিবর্তন না এলেও এর ব্যবহার সহজ এবং তুলনামূলকভাবে নিরাপদ মনে হয়েছে। আবার বি১২ প্যাচ ব্যবহারকারীরা হালকা এনার্জি বুস্টের কথা বলেছেন, পাশাপাশি চিকিৎসকের কাছে নতুন প্রযুক্তি দেখানোর মজাও থাকে। ব্যারিয়ারের মতো ব্র্যান্ড প্যাচগুলোকে ক্ষুদ্র ট্যাটুর মতো ডিজাইনে তৈরি করছে, যা পানিরোধী এবং ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা ধরে ত্বকে রাখা যায়; ফলে অনেকের কাছে এটি কার্যকারিতা ও ফ্যাশনের মিশ্রণে একটি ট্রেন্ডি অ্যাকসেসরির মতো।
অবশ্য প্যাচকে সবার জন্য সমানভাবে কার্যকর বা নিরাপদ ভাবা ঠিক নয়। পিল গিলতে অসুবিধা হয়, গ্যাস্ট্রিক বা পেটের সমস্যা আছে, নিয়মিত ট্যাবলেট নিতে ভুলে যান, অথবা ব্যস্ততায় শট/আইভি নেওয়া সম্ভব নয়—এমন ব্যক্তিদের জন্য এটি একটি ব্যবহারবান্ধব বিকল্প হতে পারে। কিন্তু যাদের একাধিক সাপ্লিমেন্ট একসঙ্গে চলছে, লিভার বা কিডনির সমস্যা আছে, ত্বক অত্যন্ত সংবেদনশীল, কিংবা বড় ডোজের ভিটামিন গ্রহণ করেন, প্যাচ ব্যবহারের আগে তাদের অবশ্যই বিশেষ সতর্ক থাকা জরুরি। কারণ, ভুল ডোজ বা অতিরিক্ত ব্যবহারে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি থেকেই যায়।
ভিটামিন প্যাচ ‘বেটার দ্যান নাথিং’ হতে পারে; তবে এর ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করা অনুচিত। সুষম খাদ্য, প্রয়োজন অনুযায়ী সাপ্লিমেন্ট এবং সন্দেহ হলে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ—এই তিনটি হলো স্বাস্থ্য বজায় রাখার কার্যকর ভিত্তি। নতুন কোনো প্যাচ ব্যবহারের আগে অবশ্যই ডাক্তারকে জানানো উচিত; একই সঙ্গে একাধিক প্যাচ ব্যবহার এড়ানো শ্রেয় এবং ত্বকে জ্বালাপোড়া, লালচে ভাব বা অ্যালার্জি দেখা দিলে তৎক্ষণাৎ সরিয়ে ফেলা চাই। পাশাপাশি প্যাচের ব্র্যান্ড, ল্যাব টেস্টিং এবং মান যাচাই করে নেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ; যাতে নিরাপদ ও কার্যকর পণ্য পাওয়া নিশ্চিত করা যায়।

 শিরীন অন্যা
ছবি: সংগ্রহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top