তনুরাগ I লাবণ্যে পূর্ণপ্রভা
ত্বকযত্নে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে রেড লাইট থেরাপি। বলিরেখা, ব্রণ, দাগ এবং বয়সের ছাপ কমাতে এই চিকিৎসা পদ্ধতি পাচ্ছে জনপ্রিয়তা। কার্যকারিতা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে পুরোপুরি ঐকমত্য না এলেও ত্বকের নবযৌবন ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে এটি সম্ভাবনাময় হিসেবে বিবেচিত
রেড লাইট থেরাপিতে মূলত লো-লেভেল লেজার বা আলো ব্যবহার করা হয়, যা ত্বকের গভীরে প্রবেশের মাধ্যমে কোষকে পুনরুজ্জীবিত করে। এই থেরাপিকে ফোটোবায়োমডুলেশন, কোল্ড লেজার থেরাপি বা সফট লেজার থেরাপিও বলা হয়।
যেভাবে সূচনা
এই থেরাপির প্রতি আগ্রহের শুরুটা মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার হাত ধরে। গেল শতকের নব্বইয়ের দশকে সংস্থাটি মহাকাশে উদ্ভিদের বৃদ্ধি নিয়ে গবেষণায় প্রথম রেড লাইট প্রযুক্তি ব্যবহার করে। পরবর্তী সময়ে দেখা যায়, এই আলো নভোচারীদের ক্ষত নিরাময়েও ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। মহাকাশে থাকাকালীন নভোচারীদের পেশি ক্ষয় ঘটা এবং ক্ষত দেরিতে শুকানোর মতো সমস্যা দেখা দেয়, যার কারণ মূলত প্রাকৃতিক সূর্যালোকের অভাব। গবেষণায় দেখা যায়, নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যরে লাল আলো কোষীয় কার্যক্রমকে উদ্দীপ্ত করে এই ঘাটতি কিছুটা পুষিয়ে দিতে সক্ষম। নাসার সেই গবেষণাই পরবর্তীকালে চিকিৎসা ও সৌন্দর্যচর্চায় রেড লাইট থেরাপির বাণিজ্যিক ব্যবহারের পথ খুলে দেয়।
কার্যকারিতা ও পদ্ধতি
রেড লাইট থেরাপির কার্যকারিতার মূল ভিত্তি হলো, এটি কোষের শক্তিঘর হিসেবে পরিচিত মাইটোকন্ড্রিয়াকে উদ্দীপ্ত করে। নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যরে লাল আলো যখন ত্বকের গভীরে প্রবেশ করে, তখন কোষের মাইটোকন্ড্রিয়া সেই আলোক শক্তি শোষণ করে নেয়। এর ফলে অ্যাডিনোসিন ট্রাইফসফেট উৎপাদন বাড়ে, যা কোষে শক্তির সরবরাহ ঘটায়। এতে কোষের মেরামত প্রক্রিয়া দ্রুত হয় এবং নতুন কোষ তৈরি হতে সহায়তা করে।
এই থেরাপি ত্বকে কোলাজেন উৎপাদন বাড়াতে সাহায্য করে, যা ত্বকের দৃঢ়তা ও স্থিতিস্থাপকতা বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য। এর পাশাপাশি এটি ফাইব্রোব্লাস্ট কোষের সংখ্যা এবং ত্বকে রক্তসঞ্চালন বাড়ায়, যা ত্বকের সার্বিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়।
যেসব সমস্যায় ব্যবহৃত
রেড লাইট থেরাপি বিভিন্ন ধরনের ত্বকের সমস্যার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
কোলাজেন উৎপাদন বাড়িয়ে ত্বকের বলিরেখা ও সূক্ষ্মরেখা কমাতে সাহায্য করে;
ত্বকের প্রদাহ কমিয়ে ব্রণের প্রকোপ কমাতে এটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম;
কোষ পুনরুৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়ে ক্ষত নিরাময় দ্রুত এবং পুরোনো দাগ হালকা করতে সহায়তা করে;
প্রদাহরোধী বৈশিষ্ট্যের কারণে সোরিয়াসিস, রোসেসিয়া ও একজিমার মতো ত্বকের সমস্যা প্রশমিত করতে সহায়ক এটি;
অ্যান্ড্রোজেনেটিক অ্যালোপেশিয়া বা বংশগত চুল পড়ার সমস্যার বিপরীতে চুলের ঘনত্ব ও বৃদ্ধি বাড়াতে কিছু গবেষণায় এর ইতিবাচক ফল পাওয়া গেছে।
বিতর্ক ও গবেষণা
বিশেষজ্ঞদের মতে, রেড লাইট থেরাপির কার্যকারিতা এখনো পুরোপুরি প্রমাণিত নয়। বেশির ভাগ গবেষণা ছোট পরিসরে করা হয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রিত গ্রুপের অভাব ছিল। তাই এর ফল নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য আরও বড় আকারের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রয়োজন। তবে এখন পর্যন্ত পাওয়া গবেষণার ফল বেশ আশাব্যঞ্জক এবং এই বিষয়ে আগ্রহ ক্রমশ বাড়ছে।
নিরাপত্তা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
স্বল্প মেয়াদে ও সঠিক নির্দেশনায় ব্যবহার করলে রেড লাইট থেরাপি সাধারণত নিরাপদ হিসেবেই বিবেচিত। এটি একটি নন-ইনভেসিভ বা অনাক্রমণাত্মক চিকিৎসাপদ্ধতি এবং এতে সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি ব্যবহার করা হয় না। তবে ভুল বা অতিরিক্ত ব্যবহারে ত্বকে জ্বালাপোড়া বা চোখের ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি থাকে। গাঢ় ত্বকের অধিকারীদের ক্ষেত্রে হাইপারপিগমেন্টেশনের ঝুঁকি থাকতে পারে; তাই ব্যবহারের আগে চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
বর্তমানে বাজারে ঘরে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন ধরনের রেড লাইট ডিভাইস; যেমন মাস্ক, প্যানেল ও হ্যান্ডহেল্ড ওয়ান্ড পাওয়া যায়। এই ডিভাইসগুলো সাধারণত নিরাপদ হলেও পেশাদার যন্ত্রের তুলনায় কম শক্তিশালী হওয়ায় কাক্সিক্ষত ফল পেতে বেশি সময় লাগতে পারে। ঘরে ব্যবহারের ক্ষেত্রে চোখের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং প্রস্তুতকারকের নির্দেশনা মেনে চলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অন্যান্য শারীরিক সমস্যায়
ত্বকের সমস্যা ছাড়াও আরও কিছু শারীরিক অসুস্থতার ক্ষেত্রে রেড লাইট থেরাপির ব্যবহার নিয়ে গবেষণা চলছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে:
আর্থ্রাইটিস ও টেন্ডোনাইটিসের মতো জয়েন্টের ব্যথা ও প্রদাহ কমানো;
ক্যানসারের কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে মুখে ঘা হওয়া প্রতিরোধ করা;
পেশি মেরামত ও ব্যথা কমাতে সহায়তা করা।
তবে ওজন কমানো, সেলুলাইট দূরীকরণ কিংবা মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে এর কার্যকারিতার কোনো শক্তিশালী বৈজ্ঞানিক প্রমাণ এখনো মেলেনি।
রেড লাইট থেরাপি ত্বকের বিভিন্ন সমস্যার জন্য একটি সম্ভাবনাময় চিকিৎসা হলেও এটি সবার জন্য উপযুক্ত না-ও হতে পারে। এর কার্যকারিতা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয় এবং কাক্সিক্ষত ফল পেতে একাধিক সেশনের প্রয়োজন পড়ে, যা সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ। স্বাস্থ্যবিমা সাধারণত এই চিকিৎসার খরচ বহন করে না।
এই চিকিৎসা শুরুর আগে একজন অভিজ্ঞ চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ বা কসমেটিক থেরাপিস্টের সঙ্গে পরামর্শ করে নিজের ত্বকের জন্য এটি কতটা উপযুক্ত, তা জেনে নেওয়া আবশ্যক।
ঘরে ব্যবহারের কেনা যন্ত্র কি নিরাপদ
অনলাইন শপে এখন রেড লাইট থেরাপির অনেক যন্ত্র পাওয়া যায়। এগুলো সাধারণত নিরাপদ হলেও চিকিৎসকের ব্যবহৃত পেশাদার যন্ত্রের তুলনায় কম কার্যকর হতে পারে। ফলে কাক্সিক্ষত ফল না-ও মিলতে পারে। যদি ঘরে ব্যবহারের জন্য যন্ত্র কেনেন, তবে অবশ্যই চোখ সুরক্ষিত রাখুন, নির্দেশনা মেনে ব্যবহার করুন এবং যন্ত্রের যত্ন নিন।
ঘরে রেড লাইট থেরাপি ডিভাইস ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে চলা জরুরি। ব্যবহারের আগে ত্বক সম্পূর্ণ পরিষ্কার এবং শুষ্ক করে নেওয়া চাই। ত্বকে কোনো ধরনের মেকআপ, লোশন বা ক্রিম থাকা উচিত নয়; কারণ, এগুলো আলোর কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত করতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো চোখের সুরক্ষা। ডিভাইস ব্যবহারের সময় এর সঙ্গে দেওয়া বিশেষ প্রতিরক্ষামূলক চশমা বা আই শিল্ড পরা চাই, যাতে আলো চোখে সরাসরি প্রবেশ করে কোনো ক্ষতি করতে না পারে।
সাধারণত, প্রতিটি সেশন ১০ থেকে ২০ মিনিটের হয়ে থাকে এবং সপ্তাহে তিন থেকে পাঁচ দিন ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়। ভালো ফলের জন্য নিয়মিত ও ধারাবাহিক ব্যবহার অপরিহার্য। যেকোনো ধরনের অস্বস্তি বা ত্বকে জ্বালাপোড়া হলে ব্যবহার বন্ধ করে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক।
আলোর শক্তিকে কাজে লাগিয়ে শরীরের কোষ পুনরুজ্জীবিত করার ধারণাটি হয়তো সাই-ফাই সিনেমার মতো শোনায়; কিন্তু রেড লাইট থেরাপি সেই কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে। এটি কেবল একটি স্কিন কেয়ার ট্রেন্ড নয়; বরং বায়ো-হ্যাংকিংয়ের জগতে এক নতুন দিগন্ত, যা আমাদের শেখাচ্ছে কীভাবে প্রযুক্তির সাহায্যে প্রকৃতির শক্তিকে ব্যবহার করে নিজের শরীরের সেরা সংস্করণ অর্জন সম্ভব। সৌন্দর্যচর্চা থেকে শুরু করে শারীরিক নিরাময় পর্যন্ত এর যাত্রাপথ এখনো অনেকটাই উন্মোচিত হওয়ার অপেক্ষায়, তা অবশ্য বলা বাহুল্য।
স্বর্ণা রায়
মডেল: আনসা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: জিয়া উদ্দীন
