ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন I বিশ্ববাজার ২০২৫
ফ্যাশনের ফিরে আসার বছর। ১৯৯০ আর ২০০০—দুই-ই ফিরেছে প্রবল প্রতাপে। সার্কুলার ইকোনমি, এথিক্যাল সোর্সিং এবং ট্রান্সপারেন্ট সাপ্লাই চেইন প্রাধান্য পেয়েছে। কোলাবরেশন, ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর, টেক-ড্রিভেন ইনোভেশন ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ফ্যাশনকে আরও প্রাসঙ্গিক করেছে
আন্তর্জাতিক ফ্যাশন বাজার ২০২৫ সালে ছিল ঘটনাবহুল। এর মাঝেও আলাদা গুরুত্ব পেয়েছে কিছু বিষয়।
টেকসই তত্ত্ব ও সার্কুলার ইকোনমি
করোনাকালের পর থেকে বিশ্ব ফ্যাশন দুনিয়া ধরণীর প্রতি ভালোবাসা নিয়ে বেশ সচেতন। এ বছর এটি মূল উপজীব্য হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে আরও জোরালোভাবে। বড় ব্র্যান্ডগুলো কেবল কথা নয়; বাস্তব পরিবর্তনের পথে যাত্রা করেছে। ক্লিন ম্যাটেরিয়াল, স্বচ্ছ সাপ্লাই চেইন আর বর্জ্য হ্রাসে বিনিয়োগ করছে তারা। এর পেছনে অবশ্য ক্রেতা চাহিদাও গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান ক্রেতাদের মধ্যে মিলেনিয়াল আর জেনারেশন জেডের সংখ্যাই বেশি। তারা নৈতিকতা আর স্টাইল—দুটিই চায়। পরিবেশবান্ধব ট্যাগের পাশাপাশি আলোচনায় এসেছে সার্কুলার মডেল। অর্থাৎ রিপেয়ার, রিইউজ, রিজেনারেটিভ ডিজাইন। বায়ো-ফ্যাব্রিক থেকে আপসাইকেলড কতুর, আজকের নিউ লাক্সারি মানেই লো-ইমপ্যাক্ট।
প্রযুক্তি, তথ্য ও ডিজিটাল ফ্যাশন
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তা নেওয়া হয়েছে ডিজাইন, ট্রেন্ড প্রেডিকশন অ্যানালিটিকস, ভার্চুয়াল ট্রাই-অন, ডিজিটাল গার্মেন্টস—সবখানেই। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স চালিত ফোরকাস্টিং ব্র্যান্ডকে বুদ্ধিদীপ্তভাবে ডিজাইন করতে সাহায্য করছে। ভার্চুয়াল ফ্যাশন শো ও অগমেন্টেড রিয়েলিটিতে শপিং অভিজ্ঞতা ক্রেতাদের কাছে এক নতুন সংযোগ তৈরি করছে। এমনকি সাপ্লাই চেইন পর্যায়েও ডিজিটালাইজেশন বাড়ছে; উদ্দেশ্য গতি ও নির্ভুলতা।
অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিকল্পনা
ফ্যাশন এ বছর শুধু তারুণ্যকে ঘিরে আবর্তিত হয়নি; বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলো আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি বৈচিত্র্য জাহির করেছে। বয়স, জেন্ডার ও ভূগোলের সীমা ছাড়িয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজাইন পেয়েছে গুরুত্ব। জেন-জি, মিলেনিয়ালদের পাশাপাশি পঞ্চাশোর্ধ্বদের সিলভার জেনারেশনের জন্যও কাজ করা হয়েছে।
মেইড উইদ লাভ
টেকনোলজির দাপটের মাঝেও পৃথিবী আবার ফিরে তাকাচ্ছে হাতে বানানো, ঐতিহ্যবাহী নকশার এমব্রয়ডারির পুনরুজ্জীবনে। উল আর কুসি-কাঁটার প্রতি ভালোবাসা ফিরেছে। হ্যান্ড ব্লক, বাটিকেও ফিরেছে মনোযোগ। প্যারিসের ব্র্যান্ডগুলোতে দেখা যাচ্ছে হ্যান্ড এমব্রয়ডারির ব্যবহার। জাপানি লেবেলগুলোর ফোক টেক্সটাইল রিইন্টারপ্রিটেশন ক্রাফট আবারও লাক্সারির আসনে ফিরেছে। ভারত আর পাকিস্তানের ফ্যাশনেও জারদৌসির ঘটেছে দাপুটে প্রকাশ।
গ্লোবাল রানওয়ে হাইলাইটস
প্যারিস ফ্যাশন উইকে এবারে ৭৪টি রানওয়ে শো আর ৩৪টি প্রেজেন্টেশন ছিল। যেখানে রেডি-টু-ওয়্যার থেকে শুরু করে কতুর কালেকশন—সবই দেখা গেছে। শিয়াপারেল্লি আর লুই ভিতোঁ বিশেষভাবে নজর কেড়েছে। ক্রাফটসম্যানশিপ, টেইলারিং আর ফ্যান্টাসি-স্টাইল স্টোরিটেলিং—সবই ছিল।
সিউল ফ্যাশন উইক আন্তর্জাতিকভাবে ক্রমেই পরিচিত হচ্ছে কে-ফ্যাশন, স্ট্রিটওয়্যার প্রভাব এবং নতুন উদ্ভাবনের জন্য। কীভাবে ফ্যাশনের শক্তি প্রচলিত পশ্চিমা বিশ্বের বাইরে ছড়িয়ে পড়ছে, তা প্রকাশ পাচ্ছে। তৈরি হচ্ছে গ্লোবাল ফিউশন।
মিলান ফ্যাশন উইকে দেখা গেছে উদ্ভাবন আর বিলাসিতার সংমিশ্রণ। সাহসী ডেবিউ, উজ্জ্বল কালেকশন এবং ইনোভেশন ও লাক্সারির এক অনন্য মিশ্রণ। মিলান এখনো লাক্সারি ফ্যাশনের কেন্দ্র, আর সেখানকার কালেকশনগুলোর বিবর্তন দেখলেই বোঝা যায় গ্লোবাল হাই-ফ্যাশনের দিকনির্দেশনা।
ভিক্টোরিয়া’স সিক্রেটের ফ্যাশন শোতে ছিল তারকার মেলা। তাদের মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়েছে ব্র্যান্ডের নতুন রূপ। শুধু লঞ্জারি শো নয়; মাল্টি প্ল্যাটফর্ম ক্রস জেনার এন্টারটেইনমেন্ট ইভেন্ট হিসেবেও সামনে এসেছে। বিশেষ আকর্ষণ ছিলেন মডেল জেসমিন। তিনি অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় অংশ নিয়েছেন ক্যাটওয়াকে। আলট্রা-গ্ল্যামের সঙ্গে যুক্ত সাহসী স্টেটমেন্ট প্রকাশিত হয়েছে তার উপস্থাপনায়।
ইন ট্রেন্ড
২০২৫ সালে ফ্যাশন হয়ে উঠেছে গতি, টেক্সচার ও ড্রামাটিক ডিজাইনের সম্মিলন। ডিজাইনাররা এমন উপাদানকে আলিঙ্গন করেছেন, যা শুধু দৃষ্টিনন্দন নয়; পরিধানেও ঘটিয়েছে প্রাণের সঞ্চার। ফ্রিন্জ, পালক, রাফলস এবং স্তরবিন্যস্ত কাপড়—সবকিছুই রানওয়ে ও ফ্যাশন এডিট দখল করেছে; পোশাককে দিয়েছে প্রতিটি পদক্ষেপে প্রবহমানতা, ঘূর্ণন ও পরিবর্তনের ক্ষমতা। ইভনিং গাউন, ককটেল ড্রেস ও স্ট্রিটওয়্যার—সবকিছুতে এই ফিচারগুলো অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। স্ট্রিটওয়্যারও খেলাধুলার ছোঁয়া পেয়েছে। স্তরবিন্যস্ত ফ্রিন্জ জ্যাকেট, রাফল হুডি ও পালকযুক্ত অ্যাকসেসরিজ দৈনন্দিন লুকে যোগ করেছে উচ্ছ্বাস ও টেক্সচার।
গেল শতকের শেষ ও চলতি শতকের শুরুর দশকের ফ্যাশন ফিরে এসেছে দারুণভাবে। ডিজাইনার ও ব্র্যান্ডগুলো অতীতের আইকনিক সিলুয়েটকে মডার্ন টুইস্ট দিয়ে নতুনভাবে তুলে ধরেছে। লো-রাইজ প্যান্ট, ক্রপ টপ এবং ছোট হ্যান্ডব্যাগ রানওয়েতে প্রায় সর্বত্রই দেখা গেছে। এফোর্টলেস কুল ও মিনিমালিজমের ঘটেছে প্রত্যাবর্তন। এই অ্যাসথেটিক কেবল পোশাকে নয়; অ্যাকসেসরিজ ও ফুটওয়্যারেও ছড়িয়ে পড়েছে। চাঙ্কি স্নিকার্স, প্ল্যাটফর্ম স্যান্ডেল, সূক্ষ্ম চেইন-লিংক জুয়েলারি আবার বসেছে মসনদে। অ্যাকটিভ ওয়্যারের বাজার কলেবরে বেড়েছে। সন্ধি করেছে আরামদায়কতার সঙ্গে। ট্র্যাকসুট, ওভারসাইজড হুডি, লোগো-এম্বেলিশড পিস ২০০০-এর দশকের অরিজিনাল আরবান কালচারকে স্মরণ করিয়েছে। মিলান থেকে সিউল পর্যন্ত রানওয়ে শোগুলো এই যুগের উজ্জ্বল রঙের প্যালেটকে করেছে আলিঙ্গন। প্যাস্টেল পিঙ্ক, নিয়ন গ্রিন, মেটালিক সিলভার নজর কেড়েছে।
২০২৫ সালের ফ্যাশনে নিয়ন ব্রাইটস, জুয়েল টোনস থেকেছে চর্চায়। ডিজাইনাররা বহু বছরের মিনিমালিজমকে ছেড়ে দিয়ে প্লেফুল ম্যাক্সিমালিজমের দিকে ঝুঁকেছেন; যা ফ্যাশনে সাহসী, প্রাণবন্ত ও রঙিন দৃষ্টিকোণ ফিরিয়ে এনেছে।
স্টার কোলাব
এ বছর ফ্যাশনের দুনিয়ায় দেখা গেছে গ্লোবাল আইকনদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে নিয়োগের প্রবণতা; যা শুধু মার্কেটিং নয়, ব্র্যান্ডের ভ্যালু ও কৌলিক শক্তিকে তুলে ধরে। ফেন্ডির সঙ্গে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে যুক্ত হয়েছেন অস্ট্রেলিয়ান গায়ক বাং চান। লাক্সারি হাউসগুলো কে-পপ ও গ্লোবাল ইয়ুথ কালচারের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে—এই সিদ্ধান্ত থেকে এমন ধারণা করা যায়। একই পথে হেঁটেছে বোটেগা ভেনেটাও। ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে চুক্তিবদ্ধ করেছে ইয়াং জিয়ং ইনকে। এমন গ্লোবাল আইকন বেছে নেওয়ার কারণ হিসেবে জানা যায়, ব্র্যান্ডকে আন্তর্জাতিক বিশ্বে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা।
হারানো সুর
এ বছর ফ্যাশন দুনিয়া হারিয়েছে ইতালির ফ্যাশন আইকন জর্জিও আরমানিকে। ৪ সেপ্টেম্বর, ৯১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। সফট-শোল্ডার টেইলারিং, আনলাইনড জ্যাকেট এবং মিউটেড প্যালেটের মাধ্যমে নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য আভিজাত্যের সংজ্ঞা নতুনভাবে স্থাপন করেছিলেন এই কিংবদন্তি। তিনি এমন একজন ডিজাইনার ছিলেন, যিনি সৃজনশীল প্রতিভা আর ব্যবসায়িক বুদ্ধিমত্তা মিলিয়ে রেড কার্পেট, বোর্ডরুম এবং দৈনন্দিন পোশাকের দৃশ্য প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন।
সারাহ্ দীনা
ছবি: ইন্টারনেট
