skip to Main Content

কভারস্টোরি I বৈশ্বিক পোশাকশিল্প

নতুন সব উদ্ভাবনী প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলছে সমকালীন দুনিয়ার ফ্যাশনশিল্প। এ বছরে তার হিসাবনিকাশ নিয়ে লিখেছেন অতনু সিংহ

বিশ্বায়িত নয়া-উদার বাজার অর্থনীতি প্রতিনিয়ত নিজেকে বদলে নিচ্ছে। বাজার, বিনিয়োগ, ভোক্তা, ক্রেতা এবং সমাজ-রাজনীতির নানা ফ্যাক্টরে প্রতি মুহূর্তেই রূপ ও আঙ্গিকে বদল আনছে বাজার অর্থনীতির বিশ্ব লগ্নি পুঁজিবাদ। একে মাথায় রেখে বিশ্ববাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত ইন্ডাস্ট্রিগুলোর বাণিজ্য-অ্যাজেন্ডাও বদলে যাচ্ছে নানাভাবে। গ্লোবাল বাজার অর্থনীতিতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির মাধ্যমেই বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। অথবা বলা যায়, এই ইন্ডাস্ট্রির সাম্প্রতিক গতিপ্রকৃতির মধ্যেই ফুটে উঠেছে গ্লোবাল মার্কেট ইকোনমির চেহারা। ২০১৮ সালে বিশ্বজুড়ে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির বেশ কিছু নতুন আদল চোখে পড়ছে। বিজনেস অব ফ্যাশন ও ম্যাকিন্সে অ্যান্ড কোম্পানি এই বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির জন্য ২০১৭ সালটা ছিল একটু কঠিন। কিন্তু নানা প্রতিকূলতা প্রতিহত করে উন্নতির সূচক ছিল ঊর্ধ্বমুখী। এ বছরে নানা দুর্যোগের মাঝেও ফ্যাশন ইনডেক্সকে পুনরুদ্ধার করা হয়। ২০১৮ সালে ম্যাকিন্সে গ্লোবাল ফ্যাশন ইনডেক্স প্রজেক্ট বিশ্ব ফ্যাশনশিল্পের প্রবৃদ্ধি ৩.৫ থেকে ৪.৫ শতাংশে উন্নীত করেছে। কিন্তু সব অঞ্চলে বা সব ক্ষেত্রে তা সমানভাবে ঘটেনি। এশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উদীয়মান ইউরোপীয় দেশগুলো এবং লাতিন আমেরিকার ফ্যাশন মার্কেটের মাধ্যমে সামগ্রিকভাবেই ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির শ্রীবৃদ্ধি অব্যাহত। এসব জায়গার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিজনেস অব ফ্যাশন ও ম্যাকিন্সের বিশ্বব্যাপী ফ্যাশন সমীক্ষা বা গ্লোবাল ফ্যাশন সার্ভের ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে ইতিবাচক সাড়াও দিয়েছেন।
উল্লিখিত সমীক্ষা থেকে সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ, ফ্যাশন ডিজাইনার এবং বিশেষজ্ঞদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ ও গবেষণার মাধ্যমে ২০১৮ সালজুড়ে গোটা বিশ্বে ফ্যাশনের শিল্পকে আকৃষ্ট করার দশটি প্রধান প্রবণতা চিহ্নিত করা হয়েছে। তিনটি প্রধান শ্রেণিতে এগুলো বিভক্ত- বিশ্ব অর্থনীতি, ভোক্তা বা কনজ্যুমারের রুচি ও যাপনের বদল এবং গ্লোবাল ফ্যাশনব্যবস্থার বেশ কিছু বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
এই সমীক্ষা ও গবেষণা থেকে বোঝা যাচ্ছে, ২০১৮ সাল ফ্যাশন প্লেয়ারদের জন্য আরও চ্যালেঞ্জিং বছর। কিন্তু যারা নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন, নতুন নতুন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আকর্ষণীয় ডিজাইন প্রস্তুত করছেন, যারা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এবং কালোত্তীর্ণ ভাবনা ও ডিজাইনের সমন্বয়ে ফ্যাশনকে সৃজনশীল করে তুলতে চান, তাঁদের জন্য ২০১৮ সাল আশাব্যঞ্জক।
ম্যাকিন্সে ফ্যাশন-স্কোপের মতে, ২০১৮ সালজুড়ে বিশ্বের মোট পোশাক ও জুতার অর্ধেকের বেশি তৈরি হবে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার বাইরে। উদীয়মান বাজারের দ্রুতগামী শহরগুলো ফ্যাশনশিল্পের জন্য হয়ে উঠছে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। সুসংহত বিক্রয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং লাভজনক প্রক্রিয়ার দিক থেকে উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দেবে এসব নতুন বাজার। গ্লোবাল ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে এভাবে বাজারের অনেক নতুন নতুন পকেট উঠে আসতে পারে।
সবচেয়ে মজার বিষয়, রোবটিকস, সাইবার জগৎ, মোবাইল ইন্টারনেট ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো বিষয়গুলো ফ্যাশনসহ পুরো ইন্ডাস্ট্রিকেই নতুন করে নিজেদের সাজিয়ে নেওয়ার চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। আন্তসীমান্ত ব্যবসা যত বাড়ছে, ততই স্থানীয় বাণিজ্যিক ও শিল্পোদ্যোগীদের কাছে বাণিজ্য ব্যবস্থা জটিল হয়ে পড়ছে। কঠিন প্রতিদ্ব›িদ্বতার মুখেও পড়তে হচ্ছে তাদের। কিন্তু এই প্রতিযোগিতা ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনীর সঙ্গে যারা নিজেদের মানিয়ে নিতে পারছে, তাদের সাফল্যের সম্ভাবনাও ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য।
সাইবার ব্যবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠা ভোক্তা সমাজের কাছে ডিজিটাল বাণিজ্য ও বিপণন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দক্ষিণ এশিয়ার কনজ্যুমাররা এখন গড়ে দৈনিক ৮ ঘণ্টা অনলাইনে সম্পৃক্ত থাকেন। এই সময়টুকুর মধ্যে রয়েছে সামাজিক মাধ্যমে বা সোশ্যাল মিডিয়া, ভিডিও স্ট্রিমিং ও অনলাইনে পণ্য পছন্দ করা কিংবা কেনাকাটার মতো বিষয়। এখনকার ক্রেতারা ডিজিটাল চ্যানেলের মাধ্যমে কেনাকাটা পছন্দ করছেন। এসব ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ক্রেতাদের কেনাকাটায় পরিচিত একরৈখিক ধরনকে বদলে দিয়ে বহুমাত্রিক করে তুলেছে। এ ক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার, ক্রেতারা পণ্য কেনাকাটা সুসংগত ব্র্যান্ডের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চান।
আমাজন থেকে জাপোসের মতো প্রথম ডিজিটাল-ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম এবং আলিবাবা অনলাইনের মাধ্যমে বাণিজ্য বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানোর জন্য যাবতীয় পদক্ষেপ অব্যাহত রেখেছে। বেশির ভাগ ক্রেতা চান, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পণ্য ও পরিষেবা তাদের হাতে চলে আসুক। তারা দ্রুত ডেলিভারি আশা করে। যেমন ফারফেচ ও গুচির মধ্যে অংশীদারিত্বের অনলাইন-বাণিজ্যে নির্দিষ্ট কিছু শহরে দোকান থেকে ৯০ মিনিট বা তার কম সময়ে গ্রাহকের বাড়িতে পণ্য ডেলিভারি হচ্ছে।
ক্রেতারা এখন অনেকাংশেই জ্ঞাপন মাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল। ফিলিপাইন, ব্রাজিল ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে জানা গেছে, তারা এই প্ল্যাটফর্মে প্রতিদিন গড়ে তিন ঘণ্টা সময় ব্যয় করছেন। ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে তাই সোশ্যাল মিডিয়ার গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। কেনাকাটার সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলছে সামাজিক মাধ্যমগুলো।
২০১৮ সালের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির গতিপ্রকৃতিকে নির্ধারণ করছে যে ১০টি বিষয়:
নির্ধারণযোগ্য অনির্দিষ্টতা
ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং আগাম অনির্দিষ্টতাই অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রের এই মুহূর্তের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। ফ্যাশন কোম্পানি ও তার কর্মকর্তারা এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে তাদের কাজকর্ম পরিচালনা করছেন। এ ছাড়া আজকের ফ্যাশনকে একদিকে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অন্যদিকে সৃজনশীলভাবে চিত্তাকর্ষক করে তোলার কাজেও তাদের মনোযোগ লক্ষণীয়।
গ্লোবালাইজেশন রিবুট
নানা জায়গায় জাতীয়তাবাদের নব-উত্থান, বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনৈতিক প্রবণতার মধ্যেও আন্তসীমান্ত যোগাযোগ ও ডিজিটাল তথ্যপ্রবাহের মাধ্যমে বিশ্বায়নের অর্থনীতিকে নতুন মাত্রায় সম্প্রসারিত করা হচ্ছে। গ্লোবাল বাণিজ্য ক্ষেত্রকে নতুন উদ্যমে সাজিয়ে তোলা হচ্ছে। যা চ্যালেঞ্জিং কিন্তু প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজারে ডিজিটাল তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে উদার অর্থনীতির শিকড়কে সুগভীরে পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে। ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির মাধ্যমেও বাজারকে এভাবে নতুন চেহারা দেওয়া হচ্ছে।
এশীয় পরিচিতির উত্থান
বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ ই-কমার্স ইউনিকর্ন, গ্লোবাল অনলাইন রিটেল সেলসের অর্ধেক আর অগণন ডিজিটাল ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে এশিয়া আর পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকছে না। এশিয়ান শিল্প ও বাণিজ্যের উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে বিশ্ববাণিজ্যে সামনের সারিতে উঠে আসছে। ফ্যাশন এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ইন্ডাস্ট্রি।
ব্যক্তিগত হয়ে ওঠা
পণ্যকে গুণগতভাবে মানসম্পন্ন করে তোলার পাশাপাশি ব্র্যান্ডকে ক্রেতার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সঙ্গে সম্পর্কিত করে তোলার ওপর জোর দিচ্ছে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি। ভোক্তার ব্যক্তিগত পরামর্শকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
প্ল্যাটফর্ম
গ্রাহক, ভোক্তা ও ক্রেতারা প্রডাক্ট অনুসন্ধানের জন্য প্রতি মুহূর্তে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ক্রমাগত নজর রাখছেন। তাই তাদের সুবিধা ও পছন্দমতো বিশেষ বিশেষ অফার তৈরির ধারা শুরু হয়েছে।
এই বিক্রয় চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে কীভাবে ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোকে আরও আকর্ষণীয় উপায়ে ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়, সেই পথ বের করার গবেষণায় ব্যস্ত রয়েছে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি।
মোবাইল নির্ভরতা
এ মুহূর্তে গোটা বিশ্বের কনজ্যুমারদের মোবাইল নির্ভরতা ক্রমশ বাড়ছে। বিশেষত, এশিয়া, লাতিন আমেরিকার ভোক্তা সমাজে এই প্রবণতা মাত্রাতিরিক্ত। বিষয়টি মাথায় রেখে মোবাইলের মাধ্যমে অনলাইন পেমেন্টের সুবিধাকে সুরক্ষার সঙ্গে বেশি করে ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দিতে চায় ফ্যাশন কোম্পানিগুলো। যাতে বিশ্বব্যাপী মোবাইল পেমেন্টের মাধ্যমে ভোক্তারা ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর প্রতি আরও বেশি আকৃষ্ট হয়।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ
ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির প্রতিটি স্তরকে বিশেষ মানসম্মত করে তুলতে নেতৃস্থানীয় উদ্ভাবকেরা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সাহায্য নিচ্ছেন। ইন্ডাস্ট্রির কাজের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বাস্তবসম্মত প্রয়োগ।
স্থায়িত্বের বিশ্বাসযোগ্যতা
ব্র্যান্ড থেকে শুরু করে তার সাপ্লাই চেইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে এমন পরিকল্পনা করা হচ্ছে, যাতে ইন্ডাস্ট্রির দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও স্থায়িত্বের ছাপ থেকে যায়। ফাইবার স্টেজ থেকে শুরু করে বিপণন ও বিক্রয় পর্যায় অবধি প্রতি স্তরে স্বচ্ছতা ও স্থায়িত্বের বিষয়ে জোর দেওয়া হচ্ছে। এবং প্রডাক্টকে টেকসই করে তোলার পাশাপাশি তার পুনর্ব্যবহারের বিষয়টি মাথায় রাখছে ফ্যাশন কোম্পানিগুলো। পাশাপাশি জোর দেওয়া হচ্ছে করপোরেটদের সামাজিক দায়িত্ব বা সিএসআরের ওপর। এভাবে সামগ্রিক অর্থনীতির অবিচ্ছিন্ন অঙ্গ হিসেবে অর্থনীতির মূলনীতিগুলোর কথা মাথায় রেখেই পরিচালিত হচ্ছে এ মুহূর্তের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি।
অফ-প্রাইস প্রতারণা
বিপণন বা বিক্রি চ্যানেলগুলোর অফ-প্রাইসের ব্যাপারে ফ্যাশন কোম্পানিগুলো এ মুহূর্তে সজাগ। এ ক্ষেত্রে বিক্রির চ্যানেলগুলো যে মিথ তৈরি করে, সে সম্পর্কে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি সচেতন। কারণ, এই অফ-প্রাইসের কারণে নানা সময়েই বড়সড় ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হয়েছে ফ্যাশন কোম্পানিগুলোকে।
উদ্ভাবনী চিন্তা ও নতুন পথচলা
সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সৃজনশীল ভাবনার মাধ্যমে উদ্ভাবনী শক্তি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিকে। পাশাপাশি ঐতিহ্য ও চিরায়ত ভাবনাকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সৃজনশীলতা ও সংস্কৃতির মেলবন্ধনকে পাথেয় করে এগিয়ে যাচ্ছে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি। পাশাপাশি বাণিজ্যিক অংশীদারিত্ব ও নতুন বিনিয়োগ আগামীর দিকে পথ চলতে সাহায্য করছে কোম্পানিগুলোকে।
২০১৮ সালে বিশ্ব ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির ৪টি প্রবণতা:
খুচরা ব্যবসার অন্য ক্ষেত্রগুলোর মতো গত পাঁচ বছরে ফ্যাশন শিল্পের ট্রেন্ডও প্রায় একই রকম। যদিও এরও নিজস্বতা রয়েছে। পোশাকের ব্র্যান্ডের কথাই ধরা যাক। এ ক্ষেত্রে সরাসরি ক্রেতার হাতে পণ্য পৌঁছে দিয়ে তার চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য তৈরি করে অনেকটাই সাফল্য অর্জন করেছে গ্লোবাল ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি।
বাজারে প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে ক্লায়েন্ট ও বিক্রেতাদের কাছ থেকে বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে, ভোক্তারা বছরের পর বছর কীভাবে নতুন নতুন বিষয়কে ফ্যাশনের সঙ্গে সংযুক্ত করে। তাদের বক্তব্য থেকে ২০১৮ ফ্যাশন শিল্পের শীর্ষে থাকা ৪টি প্রবণতাকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
জনাকীর্ণ বাজার ও প্রতিযোগিতা
আজকের খুচরা বাজারে প্রতিযোগিতার মধ্যে এগিয়ে যাওয়াটাই এক বড় চ্যালেঞ্জ। শুধু ভোক্তার পরিবর্তিত রুচির সঙ্গে ব্র্যান্ডকে সংগতিপূর্ণ করে তোলাই নয়; পাশাপাশি, অন্য হাউজগুলোর সঙ্গে পাল্লা দেওয়া ও ক্রেতার হাতে সরাসরি পণ্য পৌঁছে দেওয়া কঠিন বটে। এবং আমাজনের মতো বিক্রয় প্ল্যাটফর্মে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাটাও সহজ নয়।
হিসাবশাস্ত্রের এক কর্মকর্তা অস্টিন রাইডারের বক্তব্য, ‘পোশাকের প্রতিযোগিতায় প্রতি টনপিছু প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে। হাই এন্ড পোশাকের ব্র্যান্ড, ফার্স্ট ফ্যাশন ও অন্যান্য সস্তা বিকল্প থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়। আমাজনে পোশাকের বিপণন ও বিক্রি নিম্নমুখী হতে শুরু করেছে- ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির জন্য এটাও উদ্বেগের বিষয়।’
প্রতিযোগিতার বিষয়ে বলতে হলে অবশ্যই আমাজনের কথা আসে। গত বছরে, ই-কমার্স জায়ান্ট নতুন বাজার ধরার জন্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। অ্যান্ডি ফ্লাইয়ার এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের একজন অ্যাকাউন্টস এক্সিকিউটিভ। তার বক্তব্য, আমাজন এবার অস্ট্রেলিয়ায় চালু হয়েছে। তবে এ মুহূর্তে এটা ফ্যাশন ও পোশাকশিল্পের জন্য বড় হুমকি নয়, কিন্তু ভবিষ্যতের কথা শুধু সময় বলতে পারবে।
নতুন বাজার ধরার পাশাপাশি, আমাজন পোশাকশিল্পে নিজেকে সংযুক্ত করে আরও বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে। গত দুই বছরে এই কোম্পানি চুপচাপ নিজের ফ্যাশন লাইন চালু করার পাশাপাশি ২০১৭ সালের শেষের দিকে নিজস্ব অ্যাথলেটিক পোশাক গুডস্পোর্টসকে বাজারে এনেছে। অস্টিন যোগ করেন, ‘ফ্যাশনের পরামর্শদাতা হিসেবে আমাজনের সঙ্গে কাজ শুরু করে অ্যালেক্সা। ব্যক্তিগত পোশাক উপদেষ্টা হিসেবে অ্যালেক্সা এই আমাজনকে বেশ কিছু পরামর্শ দেয়। এর ফলে ট্র্যাডিশনাল ব্র্যান্ড ও রিটেইল ব্যবসায়ীদের আরও বেশি সংকটের মুখে পড়তে হয়েছে। সম্প্রতি আমাজন ঘোষণা দিয়েছিল, পোশাক ও আনুষঙ্গিক বিভাগের জন্য ফি বাড়ানো হয়েছে। পোশাক বিক্রির ক্যাটাগরিকে আমাজনে সবচেয়ে ব্যয়বহুল করে তোলা হয়।
বোঝা যাচ্ছে, ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি বিশেষভাবে প্রতিযোগিতামূলক। এবং এর পরিবর্তনের কোনো পূর্বাভাস নেই। প্রতিমুহূর্তে ব্র্যান্ডগুলোকে আপডেট করা প্রয়োজন। অভিনবত্ব না থাকলে যেকোনো ব্র্যান্ড প্রতিযোগিতায় পেছনের দিকে চলে যায়।
অমনি-চ্যানেল ও ভোক্তার টাচপয়েন্ট
সামাজিক মাধ্যম, অনলাইন, মোবাইল এবং এগুলোর মাধ্যমে কনজ্যুমার জগৎ নির্মাণ- এই গোটা প্রক্রিয়ার নাম অমনি-চ্যানেল। এই অমনি-চ্যানেল কনসেপ্ট গোটা ফ্যাশনশিল্পকে পাঁচ বছর ধরে নিয়ন্ত্রণ করছে। এর মাধ্যমে ক্রেতা বা ভোক্তা জগতের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা পেয়েছে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি। একে ভোক্তার টাচপয়েন্ট হিসেবেও ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। গত বছর ফোর্বসে একটি নিবন্ধের শিরোনাম ছিল এমনই, ‘আমরা কি অমনি-চ্যানেলকে শুধু রিটেইল বা খুচরা বিক্রি নামে ডাকতে পারি না?’ বাস্তবতা এটাই, এই শব্দ ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে এতবার উচ্চারিত হয়েছে যে ইন্ডাস্ট্রির লোকেরা তা শুনতে শুনতে ক্লান্ত।
ব্রিক-এবং-মর্টার অনলাইন, সোশ্যাল মিডিয়া, মোবাইল ও গ্রাহক সেবা- এই বিষয়গুলোর ওপর ক্রেতা বা ভোক্তার টাচপয়েন্ট নির্ভর করে, অর্থাৎ ক্রেতা বা ভোক্তাসমাজের কতটা কাছাকাছি যাওয়া যেতে পারে, তা নির্ভর করে এই বিষয়গুলোর ওপর। তাই ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির অমনি-চ্যানেল কৌশলের ওপর যথেষ্ট জোর দেওয়া হয়।
দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন পোশাকের ক্লায়েন্টরা আলাদা ক্ষেত্রগুলোর ওপর ফোকাস করছে। উদাহরণস্বরূপ, সফল ক্লায়েন্ট ডিরেক্টর অ্যাশলি নোলসের কথায়, ‘কোনো ক্লায়েন্ট সফল মোবাইল অ্যাপ লঞ্চের জন্য কাজ করছেন, আবার কেউ হয়তো তাদের ইন-স্টোরের উন্নতির চেষ্টা করছেন। এ ক্ষেত্রে দুজনেই অমনি-চ্যানেলকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছেন।’ একইভাবে ফ্যাশন বিশেষজ্ঞ ম্যাডি জানাচ্ছেন, তাঁর ফ্যাশন ক্লায়েন্টরা মোবাইল ও অনলাইনের মাধ্যমে ব্যবসাগুলোকে দ্রুতগতিতে বাড়ানোর চেষ্টা করছে। যাতে আরও বড় ডেটা ব্যাংকের মাধ্যমে অনলাইনে ব্যবসার প্রসার ঘটানো যায়, একই সঙ্গে ইন-স্টোরের মাধ্যমেও ব্যবসায়িক প্রসারণ অব্যাহত থাকে।
গ্রাহকদের প্রতি ব্র্যান্ড আনুগত্য
গ্রাহক বা ক্রেতা কিংবা ভোক্তার কাছে নিজেদের ব্র্যান্ডটিকে ঠিকমতো পৌঁছে দেওয়ার পর খেয়াল রাখতে হয় কীভাবে ব্র্যান্ডের সঙ্গে ওই ভোক্তা বা ক্রেতাকে অবিচ্ছিন্ন করে রাখা যায়।
ফ্যাশনশিল্পের দ্রুত উদ্ভাবন এবং বৃদ্ধি রিটেইল জগৎকে বিশেষভাবে মানসম্মত করে তুলেছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ভোক্তা জগতের প্রত্যাশা পূরণের বিষয়টিকেও মানসম্মত করা হয়েছে। এই মুহূর্তে ব্র্যান্ড ও পণ্যগুলোর অফুরান তালিকা রয়েছে ক্রেতাদের হাতে। তাই নতুন গ্রাহক তৈরির প্রতিদ্বন্দ্বিতার চ্যালেঞ্জটিকে গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি নিজেদের গ্রাহক ধরে রাখার জন্য নতুন নতুন ব্র্যান্ড সামনে নিয়ে আসছে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি।
গ্রাহকদের প্রতি ব্র্যান্ড আনুগত্য ধরে রাখার জন্য সব রকম চেষ্টা করছে ফ্যাশন কোম্পানিগুলো। পুরস্কারের ঘোষণা, ডিসকাউন্ট বা বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা এবং সোশ্যাল মিডিয়া ও মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে গ্রাহকদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার পাশাপাশি ব্র্যান্ডগুলোকে আকর্ষণীয় ও মানসম্পন্ন করে তোলায় জোর দেওয়া হচ্ছে। এগুলো না করলে গ্রাহক বা ক্রেতা যে ধরে রাখা সম্ভব নয়, সে বিষয়ে ফ্যাশন কোম্পানিগুলো সজাগ।
তবে পণ্য ফেরত আসার সমস্যা ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির জন্য খুবই চ্যালেঞ্জিং। বিশেষ করে ই-কমার্সের ক্ষেত্রে উচ্চ হারের রিটার্নটি তাদের ক্লায়েন্টদের জন্য একটি সমস্যা হয়ে ওঠে। অনেক খুচরা বিক্রেতা বলেন, তাদের অনলাইনে বিক্রির ২০-৪০ শতাংশ ফিরিয়ে দেওয়া হয়। উল্টো দিকে, ৮৫ শতাংশ ভোক্তা বলছেন, তারা বিশেষত্বের কারণে তাদের পুরোনো ব্র্যান্ডে ফিরে যান। তবে গ্রাহকদের অভিজ্ঞতার রিভিউ রিপোর্টকে মাথায় রেখে ক্রেতার নির্দিষ্ট চাহিদা পূরণের মাধ্যমে রিটার্নটিকে এড়িয়ে যাওয়া অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব।
ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির লোকেরা ভালোই বুঝেছে, ভোক্তাদের বিশ্বাসকে মর্যাদা দিলে এবং তাদের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে তুললে ব্র্যান্ডের প্রতি ক্রেতারও আনুগত্য আসে।
ব্যক্তিগতকরণ
দেখা যাচ্ছে, ফ্যাশন ব্র্যান্ডের প্রতিযোগিতা, অমনি-চ্যানেল ও আনুগত্যের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা সহজ হচ্ছে ভোক্তার সঙ্গে ১ ঃ ১ অনুপাতে ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে। ফ্যাশন ও পোশাকের ক্লায়েন্টদের মধ্যে গ্রাহক অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই ব্যক্তিগতকরণের এই পন্থাকে ২০১৮ সালের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির বিশেষ ট্রেন্ড হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ম্যাকিন্সে। তাদের বক্তব্য, ব্যক্তিগতকরণ ও কার্যাভ্যাস গ্রাহকের জন্য এ মূহূর্তে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গবেষণায় দেখা গেছে, ৬৬ শতাংশ ফ্যাশন এবং পোশাকের ক্রেতা জানিয়েছেন, ব্যক্তিগত কেনাকাটার অভিজ্ঞতা ও ব্যক্তিগত স্তরে ব্র্যান্ডের ব্যাপারে নির্দিষ্ট প্রস্তাব তাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে এটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে ব্যক্তিগতকরণে এ শিল্পের বিপণন অস্পষ্ট বা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। যা গ্রাহকদের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে। বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, যেসব পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিগতকরণের কৌশলগুলো প্রয়োগ করেছে, তাদের বিক্রির হার এক ধাক্কায় ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা রিটেইল সেক্টরের থেকে তিন গুণ বেশি।
এই শিল্পে ভোক্তারা এমন জিনিসকে বেশি গুরুত্ব দেয়, যেগুলো তাদের ব্যক্তিগত স্টাইল স্টেটমেন্টের সহায়ক হয়ে ওঠে। তারা এমন পোশাক পছন্দ করেন, যেগুলোতে তাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য প্রকাশ পায়।
ম্যাকিন্সের ভবিষ্যদ্বাণী ছিল, ২০১৮ সালে পোশাকশিল্পটি ৩.৫ থেকে ৪.৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাবে। তবে এটি ফ্যাশন প্লেয়ারগুলোর মধ্যে সমানভাবে ঘটবে না। দেখা যাচ্ছে, মোটামুটিভাবে এই প্রবণতাই কার্যকর রয়েছে বিশ্ব ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে।
সোশ্যাল মিডিয়া, মোবাইল, ব্লগিং, অনলাইন ইত্যাদি ভার্চ্যুয়াল সেক্টরগুলোকে কেন্দ্র করে ব্যক্তিগত স্তর থেকে শুরু করে সামাজিক পর্যায়ে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি বিশ্বায়িত অর্থনীতিকে নতুন আঙ্গিক দিয়েছে।

মডেল: লাক্স সুপারস্টার মিম, অভিনেত্রী টয়া
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: সৈয়দ অয়ন ও ক্যানভাস
ওয়্যাড্রোব: নাবিলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top