রসনাবিলাস I চেনা ঠিকানায় অচেনা স্বাদ
একের ভেতর তিন- এই ধারণা নিয়েই রসনাযাত্রা শুরু। নগরীর ভোজনানুরাগীদের সে জন্য উজিয়ে যেতে হবে উত্তরায়। খাবারের এই নতুন ঠিকানার সন্ধান দিয়েছেন সামীউর রহমান
সকালবেলা হাঁটতে বেরিয়ে পথের পাশের চেনা চায়ের দোকানটা, অথবা বাড়িফেরার পথে সন্ধ্যায় পথের ধারের বাদাম বিক্রি করা কিশোর ছেলেটা; আত্মীয় না হলেও তো তারা ভীষণ আপন। অজান্তেই তাদের সঙ্গে গড়ে ওঠে এক অদৃশ্য বন্ধন। উত্তরার ‘লা-বাম্বা’ রেস্টুরেন্টটা অনেকের কাছেই ছিল তেমনই। আশির দশকের শেষ দিকে চার বন্ধু মিলে গড়ে তুলেছিলেন লা-বাম্বা, ঢাকার উপকণ্ঠের উত্তরা উপশহরবাসীকে সুখাদ্যের সন্ধান দিতে। লা-বাম্বা তাই অনেকের কাছেই প্রথম প্রেমের মতো এক স্মৃতিকাতরতার নাম। কিন্তু গত মাস ছয়েকে লা-বাম্বার খোঁজে যারা উত্তরা রাজলক্ষ্মী কমপ্লেক্স-সংলগ্ন ঠিকানায় হাজির হয়েছিলেন, শুরুতে তাদের চোখে নিশ্চিতভাবেই ছিল বিস্ময়। পুরোনো জায়গাটার খোলনলচে পাল্টে একেবারে ভিন্নরূপ। সেই রূপান্তরের গল্পটাই শোনালেন কাজী আশফাকুর রহমান। পুরোনো লা-বাম্বার জায়গায় তার তত্ত্বাবধানেই গড়ে উঠেছে এক ছাদের নিচে তিন রসনার সম্ভার। বার্গার, শেইক, ফ্রাইজ-ফাস্ট ফুড মেনুর আয়োজন নিয়ে ‘হ্যাংওভার’, নানান স্বাদের তাজা জুস ও মকটেলের পসরা নিয়ে জুসবার ‘পাম অ্যারোমা’ আর প্রাচ্যদেশীয় খাবারের ফাইন ডাইনিং ‘হুই লিগ্যাসি’।
কাজী আশফাকুর রহমানের জীবনের গল্পটা তার রেস্তোরাঁর পদের মতোই বহুবৈচিত্র্যে বর্ণিল। উত্তরখানের ছেলে কাজী আশফাকুর রহমান চোখের সামনে গড়ে উঠতে দেখেছেন উত্তরা উপশহরকে। বন্ধুর বহরেও বারো রকম মানুষ! আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে ফরাসি ভাষা শেখার আড্ডার বন্ধু থেকে শুরু করে রাজনীতির অলিন্দেও চেনামুখ কম নেই। ঢাকার রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীদের অনেকেই বন্ধুস্থানীয়। গুলশানের বিখ্যাত একটি রেস্তোরাঁয় কূটনীতিকদের পার্টি সামলাতে সামলাতে অভিজ্ঞ হয়ে ওঠা কাজী একটা সময় চাকরি নিয়ে পাড়ি জমান সিঙ্গাপুরে। নামি হোটেলের কনসিয়ার্জ বিভাগের চাকরি দিয়ে শুরু; এরপর ধাপে ধাপে উঠেছেন ওপরে। কাতার এয়ারওয়েজের বিজনেস ক্লাস যাত্রীদের হোটেল সুবিধা দেখাশোনা, রাজপরিবারের সদস্যদের অতিথি সামলানোর গুরুভার মায় সামলেছেন অনেক কিছুই ছোটখাটো গড়নের হাস্যোজ্জ্বল মানুষটি। বিদেশে স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়ার সুযোগ থাকলেও ফিরে এসেছেন দেশে। আরও কয়েকজনকে নিয়ে গড়ে তুলেছেন এই রসনাসম্ভার।
অন্দরসজ্জা নান্দনিক। আসনবিন্যাসেও অভিজ্ঞতার ছাপ। টোনাটুনিদের জন্য দুজনের টেবিল থেকে শুরু করে পারিবারিক ভোজের জন্য বড় পরিসরের আয়োজন- চাহিদানুগ আসন আর পরিসর বিন্যাস। তিনতলা ভবনের দুটো তলাজুড়ে ২৬০ জন পর্যন্ত আসনব্যবস্থা। তবে নজর কাড়ে বহিরাঙ্গন। ধবধবে সাদার মাঝে সবুজ কৃত্রিম ঘাসের কার্পেটে মোড়ানো উঠোনে সাজিয়ে রাখা চেয়ার-টেবিল, দেখলেই মনে হবে এক পেয়ালা কফি নিয়ে এখানে খানিকটা জিরিয়ে যাই। নৈশালোকে উঠোনটা সেজে ওঠে আলোর মালায়, তখন মনে হয় কোনো স্বপ্নদ্বীপ! বুর্জ আল খলিফা যাদের হাতে গড়া, সেই ইমার প্রপার্টিজের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন কাজী। বিশ্বের উচ্চতম দালানে সামলেছেন মধ্যপ্রাচ্যের নানা গোত্রের রাজ-অতিথিদের। তাই তো পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে খুবই সচেষ্ট। তিনতলাজুড়েই হেঁশেল, পাচকেরাও অভিজ্ঞ। ওয়াশরুমও ঝকঝকে, পরিপাটি।
একই ছাদের নিচে তিন ধরনের রসনার খাবার পরিবেশন করলেও বসার জায়গা নিয়ে কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। এক প্লেট ফ্রেঞ্চ ফ্রাই নিয়েও যে কেউই দিব্যি ফাইন ডাইনিংয়ে কাটিয়ে দিতে পারেন এক ঘণ্টা, তেমনি কেউ চাইলে খোলা উঠোনে বসেও নিতে পারেন মঙ্গোলিয়ান বিফ আর বাটার রাইসের স্বাদ। জুসবারের কার্যক্রম এখনো পুরোপুরি শুরু হয়নি, তবে যেকোনো খাবারের সঙ্গেই গলা ভেজানোর জন্য পাওয়া যাবে নানা স্বাদের তাজা ফলের রসে তৈরি মকটেল।
হুই লিগ্যাসির মেনুটা কাজী আশফাকের জীবনের মতোই বৈচিত্র্যে ভরা। অনেক দেশেই কাজ করেছেন এই কাজী, মেনুতেও তাই ভিয়েতনাম, থাই, রেঙ্গুন, মালয়েশিয়া, নেপাল…অনেক জায়গার নানা পদের উল্লেখ। নেপালি মোমোর নাম দেওয়া হয়েছে ‘হিমালয়ান মানি ব্যাগ’। রেঙ্গুন খাও-সুয়ে, ব্যাংকক ফ্রাইড চিকেন, ভিয়েতনামিজ ডিপ ফ্রায়েড রোল, পেনাং বিফ; অনেক খাবারেরই অস্তিত্ব আছে মেনুতে, ঠিক যেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানচিত্রে কেউ চিহ্নিত করে দিয়েছে জনপ্রিয় পর্যটন জায়গাগুলো। ভিনদেশি খাবারের সঙ্গে বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষেরই পরিচিতি ইন্দোচীনা রসনা দিয়ে। তাই অচেনা ঠেকবে না খাবারগুলো। বরং অনেক অতি পরিচিত খাবারেই পাওয়া যাবে নতুন কোনো টুইস্ট!
চেখে দেখা হয়েছিল টম ইয়াম স্যুপ। থাই স্বাদের এই স্যুপ ঢাকায় আরও শখানেক রেস্তোরাঁয় প্রতিদিন তৈরি হয়। ‘হুই লিগ্যাসি’তে তাহলে লোকে কেন আসবে? প্রশ্ন রেখেছিলাম উদ্যোক্তার কাছে। জবাব, ‘আমরা এই স্যুপে কোনো রকম পাউডার ব্যবহার করি না। তাজা হার্বস, সিফুড, মাশরুম ব্যবহার করা হয়।’ প্রমাণটা পাওয়া গেল প্রথম চুমুকেই। তাজা লেমনগ্রাসের মনকাড়া গন্ধটা ক্ষুধা যেন বাড়িয়ে দিল! দরাজ হাতেই স্যুপের বাটিতে ঢেলেছেন বাটন মাশরুম, তাজা চিংড়ি, নানান সুগন্ধি উপচার আর মুরগির বুকের মাংস। চিকেন স্টেক মিলে আছে রসালো স্টেক। সঙ্গে বাটার রাইস অথবা ফ্রায়েড রাইস আর সাঁতলানো সবজি। দ্রুতই বিফ স্টেকের সঙ্গে মিলবে ম্যাশড পটেটো। আছে মাছেরও হরেক পদ। হট অ্যান্ড সাওয়ার কিংবা লাইম সসে মাখানো ভাপে সেদ্ধ আস্ত মাছ আছে যেমন মেনুতে, তেমনি আছে কাঁকড়া ও স্কুইডের মতো সি ফুডও। কাজী জানালেন, টাটকা তাজা সামুদ্রিক মাছ পরিবেশন করেন তারা। গুলশানের তারকা রেস্তোরাঁগুলোতে যারা মাছ সরবরাহ করে, কাজীও সরবরাহ নেন তাদের কাছ থেকেই। মুরগি ও সবজি নেন অর্গানিক খাদ্যপণ্য উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে। আর মসলা ও সুগন্ধি পুরোটাই আসে দেশের বাইরে থেকে।
এ তো গেল হুই লিগ্যাসির রত্নভান্ডারের খোঁজ। হ্যাংওভার, অর্থাৎ ফাস্ট ফুড কাউন্টারে মূলত তিন ধরনের খাবার। বার্গার, ফ্রাইজ অ্যান্ড শেইক! বিফ ও চিকেনের ৫ ধরনের বার্গার আছে হ্যাংওভারে। একেকটায় একেক রকম চিজ ও সসের ব্যবহার। সুইট অ্যান্ড সাওয়ার ড্রেসিং, হানি মাস্টার্ড ড্রেসিং, ফ্লেম গ্রিলড- এসব চেনা স্বাদের পাশাপাশি আছে থাই রেভল্যুশন বার্গারও! যেখানে বার্গারের প্যাটিতে মেশানো হয়েছে শ্যামদেশীয় মসলা। কাজীই জানালেন, একটা বার্গারের পেছনে তিনি ২৩টা দেশে ঘুরেছেন! সেই গল্পটা না হয় খেতে গিয়েই শুনবেন। বার্গারের সঙ্গে ফ্রাইজ হিসেবে নেওয়া যাবে ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজ, পটেটো ওয়েজেস আর ওনিয়ন রিংস। ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ে আনা হয়েছে একটা দেশীয় ছোঁয়া, গরম তেলে ছাড়ার আগে আলুর গায়ে মাখানো হয়েছে ধনিয়া, পুদিনা কুচির প্রলেপ। গলা ভেজানোর জন্য আছে ওরিও শেক, হট চকলেট, কোল্ড কফির মতো বেশ কিছু পানীয়।
অবস্থান, অন্দরসজ্জা অনুপাতে কড়ি থাকছে বেশ সাধ্যের নাগালেই। এই প্রতিষ্ঠানে খাবার যারা টেবিলে এনে দেওয়ার কাজটা করছেন, তাদের বেশির ভাগই শিক্ষার্থী। পড়ছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাই ইচ্ছে করেই ৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জ দামের সঙ্গে রেখেছেন কাজী, তাতে করে পড়ালেখার খরচটা চালিয়ে নিতে পারছেন হুই লিগ্যাসির কর্মীরা। এই উদ্যোগকে সাধুবাদ না দিয়ে পারা যায় না।
বিদেশ-বিভুঁইতে দীর্ঘদিন কাজ করে দেশের টানে ফিরে আসা কাজী বিশ্বাস করেন, আন্তরিকতা আর সততা নিয়ে কাজ করলে কেউ বিফল হয় না। সেই শিক্ষা তিনি দিচ্ছেন সহকর্মীদেরও। তাই লা-বাম্বার খোঁজে এসে যারা অবাক হচ্ছেন, তারা ভেতরে ঢুকে খাবার চেখে দেখার পর ফিরে যাচ্ছেন পরিতৃপ্তি নিয়ে। আসছেন পুনর্বার।
লেখক: রসনারসিক, লিখিয়ে এবং দৈনিক কালের কন্ঠের সিনিয়র রিপোর্টার
ছবি: শাখাওয়াত হোসেন সাফাত