এই শহর এই সময় I চিত্র, চলচ্চিত্র
ভাষা আন্দোলনের শহর ঢাকা। শিল্প-সংস্কৃতিরও বটে। এ শহর কথা বলে যায়। এ শহরে কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়। তাই আত্মপ্রকাশের জন্য এই শহরের আরও এক ধরনের অপরিহার্য ভাষা চিত্রকলা আর চলচ্চিত্র।
এই দৃশ্যময় শহরে বসেছিল সিনেমার মেলা। বিশ্ব চলচ্চিত্রের মায়াদর্পণে বছরের প্রথম মাস হয়ে উঠেছিল রঙিন। ঢাকায় বিগত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে প্রতিবছর যে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তারই পরম্পরায় সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল সপ্তদশ ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব-২০১৯। জমকালো এই উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন দেশ-বিদেশের ১২০ জনের বেশি চলচ্চিত্রনির্মাতা ও সংশ্লিষ্টরা। ৯ দিন ধরে এই উৎসব চলেছে। প্রদর্শিত হয়েছে নেপাল, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান, ইরান, তুরস্ক, মঙ্গোলিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ড, স্পেন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক, জার্মান, চেক রিপাবলিক, বেলজিয়াম, চিলি, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, নেদারল্যান্ডস, আর্জেন্টিনা, লেবাননসহ বিশ্বের ৭২টি দেশের ২১৮টি চলচ্চিত্র। এবার বেস্ট চিলড্রেন ফিল্ম (বাদল রহমান অ্যাওয়ার্ড) পায় কাজাখস্তানের চলচ্চিত্র ‘লিটল প্রিন্স অব আওয়ার সিটি’। ৭৩ মিনিটের এ ছবি পরিচালনা করেছেন তালগাত টেমেনোভ। বেস্ট অডিয়েন্স অ্যাওয়ার্ড জিতেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পরিচালক সৃজিত মুখার্জির ছবি ‘এক যে ছিল রাজা’। এ বছর উইমেন ফিল্মমেকারস শর্টফিল্ম সেকশনে লন্ডনের ফাতেমে আহমাদির ছবি ‘বিটার সি’, উইমেন ফিল্মমেকারস স্পেশাল মেনশন সেকশনে লারা লির পরিচালনায় ‘বুরকিনাবে বাউন্টি’, বেস্ট ডকুমেন্টারি ইন উইমেন ফিল্মমেকারস সেকশনে লিসা গাজীর ছবি ‘রাইজিং সাইলেন্স’ এবং বেস্ট ফিচার ফিল্ম ইন উইমেন ফিল্মমেকারস সেকশনে ফিলিপাইনের নির্মাতা ডিনাইস ওহারার ছবি ‘মাম্যাং’ পুরস্কৃত হয়েছে। নারীজগৎ, নারী অধিকার ও নারীবিদ্যার সমাজ রাজনীতির চর্চা ও আলাপে এই ছবিগুলো গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক। বেস্ট ক্রিটিক ফিল্ম শাখায় পুরস্কার পেয়েছে নির্মাতা মাসুম আজিজের ‘সনাতন গল্প’ ছবিটি।বেস্ট স্ক্রিপ্ট ইন এশিয়ান কম্পিটিশন সেকশনে ফিলিপাইনের ছবি ‘সিগন্যাল রক’-এ রডি ভারা পুরস্কার পান। ছবিটি পরিচালনা করেছেন ছিটো রনো। বেস্ট সিনেমাটোগ্রাফি ইন এশিয়ান কম্পিটিশন সেকশনে কাজাখস্তানের ছবি ‘ডিপ ওয়েল’-এর জন্য রিফকাত ইবরাগিমভ পুরস্কার জিতেছেন।
ছবিটি পরিচালনা করেছেন ঝানবেক ঝেটিরোওভ। বেস্ট অ্যাকট্রেস ইন এশিয়ান কম্পিটিশনে তুরস্কের ছবি ‘সিরিয়াল কুক’-এর জন্য পুরস্কার পান ডেমেট ইভগার। এটি পরিচালনা করেছেন উমিট উনাল। বেস্ট অ্যাক্টর ইন এশিয়ান কম্পিটিশন সেকশনে তুর্কি ভাষার ছবি ‘ব্রাদারস অব সাইলেন্স’ পুরস্কার পায়। ছবিটি পরিচালনা করেছেন তাইলান মিনটাস। ইজিত এগ ইজার এ ছবির জন্য পুরস্কার পান। বেস্ট ডিরেক্টর ইন এশিয়ান কম্পিটিশন সেকশনে ইরানের ছবি ‘ড্রেসেশ’ পুরস্কার পেয়েছে। পরিচালক পুয়া বাদকোভে পুরস্কারটি পান। বেস্ট ফিল্ম ইন এশিয়ান কম্পিটিশনে সেন্ট্রাল এশিয়ার দেশ কায়ারজিস্তানের ‘দ্য সং অব দ্য ট্রি’ ছবিটি পুরস্কার পায়। ৯৩ মিনিটের এ ছবি পরিচালনা করেছেন এইবেক ডায়েরিবেকভ।
চলচ্চিত্র উৎসবের হাত ধরে যখন বৈশ্বিক শিল্পজগতের প্যানোরামার মুক্তাঙ্গন হয়ে উঠেছিল ঢাকার কলাজগৎ, ঠিক তখন চারুকলায় দেশীয় শিল্প-ঐতিহ্যের চর্চাও চলেছে সমানতালে। ঢাকার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দো ঢাকার লা গ্যালারিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘গুরু-শিষ্য : শিষ্য-গুরু’ শীর্ষক দলীয় চিত্র প্রদর্শনী। গুরু-শিষ্য পরম্পরা প্রথা হাজার বছরের বাংলার যথার্থ জ্ঞান বিনিময়ের অনস্বীকার্য ধারা। সে ধারায় উদ্বুদ্ধ ‘ওরিয়েন্টাল পেইন্টিং স্টুডিও’ নামক চারুসংঘের কাজ। এই স্টুডিওর তিনজন সদস্য মলয় বালা, জাহাঙ্গীর আলম ও অমিত নন্দী। তাঁরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় ও শওকাতুজ্জামানের শিল্পমানসে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত। প্রদর্শনীতে ধ্রুপদি ঘরানা থেকে শুরু করে সমসাময়িক প্রাচ্যচিত্রকলার নানান অনুষঙ্গ বিদ্যমান। পৌরাণিক উপাখ্যানের অনুষঙ্গ যেমন শকুন্তলা সিরিজচিত্র, রাধা-কৃষ্ণের প্রণয় ও মহাভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে শুরু করে বাংলার নিসর্গচিত্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ বিভিন্ন মনীষীর প্রতিকৃতি স্থান পেয়েছে। তা ছাড়া সমসাময়িক সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চিত্রের বাস্তবিক, বিমূর্ত, অর্ধ-বিমূর্ত, প্রতীকী এবং আধুনিক উপস্থাপনও রয়েছে এই প্রদর্শনীতে।
শুরুতেই বলা হয়েছিল, ঢাকার অন্তরাত্মাকে প্রকাশ করার অপরিহার্য ভাষা শিল্পকলা। তাই একে কেন্দ্র করে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা এখানে সর্বদা সক্রিয়। এই যেমন সম্প্রতি শিল্পী পীযূষকান্তি সরকার ওরিয়েন্টাল ওয়াশ পদ্ধতিতে মসলিনের শাড়িকে পেইন্টিংয়ের ক্যানভাসে রূপ দিলেন তাঁর প্রদর্শনীতে। ১৫টি শাড়িতে ওরিয়েন্টাল ওয়াশ পদ্ধতিতে শিল্পী প্রস্ফুটিত করেছেন ফুলের সঙ্গে জলের এক অপূর্ব সখ্য। শিল্পীর ভাষ্য, ‘পেইন্টিং কেনার সামর্থ্য অনেকের থাকে না। কিন্তু শখের বশে একটি শাড়ি হয়তো কেউ কেনার সামর্থ্য রাখে, আর যদি সেটা হয় পেইন্টিংয়ে করা শাড়ি, তাহলে সেই আনন্দ অন্য রকম।’ আর্টের প্রতি সবার আগ্রহ সৃষ্টির জন্য শিল্পীর এই প্রদর্শনীর আয়োজন।
স্টাফ রিপোর্টার