স্মরণ I একজন জাদুকর
বাংলা সংগীতের একজন জাদুকর আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে। কিংবদন্তি এই সুরস্রষ্টাকে নিয়ে ক্যানভাসের সঙ্গে কথা বলেছেন তাঁরই এক সহচর, বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ। তাঁরই বয়ান-
বুলবুল ভাইয়ের সঙ্গে পারিবারিক একটা সম্পর্ক ছিল আমার। আজিমপুরে তাঁর বাসায় প্রায়ই যেতাম। খালাম্মা রান্না করতেন। সবাই মিলে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া, তারপর আড্ডা, গল্প। শুধু সংগীত বা প্রফেশনাল বিষয়ে নয়; তিনি দুঃখ-বেদনা শেয়ার করতেন, গাইড করতেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে আমার এই বিষয়গুলো ছিল। চল্লিশ বছরের বেশি সময় ধরে তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক। কত দিন, কত রাত আমরা একসঙ্গে কাটিয়েছি। আমার পরিবারের চেয়েও তাঁর সঙ্গে বেশি সময় কাটিয়েছি। সংসার জীবনের আগে পুরো সময়টা তাঁর সঙ্গে কেটেছে। প্রতিনিয়ত দেখা কিংবা কথা হয়েছে। এমন দিনও গেছে, উনার সঙ্গে সাতবারের বেশি কথা হয়েছে। কাজ না থাকলে আমরা আড্ডা দিয়েছি। ক্লোজআপ ওয়ানে তো আমি প্রায় একটানা দেড় বছর ছিলাম তাঁর সঙ্গে। একসঙ্গে অনেক স্মৃতি রয়েছে আমাদের। তবে একটা কথা খুব মনে পড়ছে এখন। উনি মৃত্যুর কয়েক দিন আগে যখন কলকাতায় গেলেন, এই তো ভোটের কিছুদিন আগে, আমি তাঁকে বললাম- আমি একটু দিল্লি যাচ্ছি। আজমির শরিফে যাব। উনি বললেন, ‘আমি কলকাতায়। আমার চেক করানো কমপ্লিট। তুই কিন্তু আমাকে কথা দিয়েছিলি, আমি এইবার এসে তোকে নিয়ে যাব হার্ট চেক করাতে। তুই আমাকে সময় দিবি।’ আমি আগে একবার উনাকে বলেছিলাম, আমি কখনো হার্ট চেক করাইনি। আমি তাঁকে তুই করেই বলতাম। বললাম, ঠিক আছে বুলবুল ভাই, তুই আয়। এই কথা এখন খুব বেশি মনে পড়ছে।
বুলবুল ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম কাজ ছিল চলচ্চিত্রে। ‘ভাই আমার ভাই’ ছবিতে ইশতিয়াক আর আমি একসঙ্গে গেয়েছিলাম। এরপর থেকেই শুরু। এ ছাড়া তাঁর সবচেয়ে হিট গানগুলোর একটি ‘বাত্তি নাইরে’ গানটি আমার করা। এটা ‘ইতিহাস’ ছবির গান। তাঁর সঙ্গে অ্যালবামের কাজ করা হয়েছে অনেক। সংগীত জীবনে আজকের কুমার বিশ্বজিতের যতটুকু প্রাপ্তি, তার বিশাল অংশে বুলবুল ভাইয়ের অবদান রয়েছে। দুটো পুরো অ্যালবামের কাজ আমি তাঁর সঙ্গে করেছি, যেখানে ২৪টি গান ছিল। চলচ্চিত্রের গানের কথা বলতে গেলে হিসাব করতে পারবো না। তবে একটি দেশের গান করার সুযোগ হয়েছে তাঁর সঙ্গে। একাত্তরের বীরাঙ্গনাকে নিয়ে গানটি করা। গানটির নাম ‘জীর্ণ দেহের এক বৃদ্ধা নারী’। সে সময় দু-একবার টেলিভিশনেও প্রচারিত হয়েছে এই গান।
মিউজিশিয়ান বা কম্পোজার হিসেবে আমি তাঁকে মনে করি একটি ‘কমপ্লিট প্যাকেজ’। তিনি একাধারে একজন গিটারিস্ট, কিবোর্ডিস্ট, কম্পোজার, গীতিকার, গায়ক। এ ছাড়া কিছুদিন আগে তিনি ভায়োলিন শেখাও শুরু করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমি কাউকে মেলাতে পারবো না। কারণ, চলচ্চিত্রের গানের ক্ষেত্রে একটা বিশাল পরিবর্তন তাঁর হাত ধরে এসেছে। এ ছাড়া অ্যালবামের গানের মধ্যে ‘ও ডাক্তার’, ‘আমি জায়গা কিনবো বলে’, ‘অন্তর জ্বলে রে জ্বলে’, ‘যোজন যোজন দূরে’ ইত্যাদি গানের কথাই যদি বলি; তার বর্ণনা কিংবা প্রেমের যে বহিঃপ্রকাশ, অন্যদের থেকে আলাদা। আধুনিক বাংলা গানে একটি আলাদা ধারা এসেছিল তাঁর হাত ধরে।
আমি অন্য কাউকে ছোট করবো না। তবে অবশ্যই আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল অন্যদের থেকে আলাদা। উনি মিউজিক নিয়ে অনেক এক্সপেরিমেন্ট করতেন। বেশ কিছু গানে তিনি সেভেনথ কর্ডের ব্যবহার করেছেন। ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’ গানটির শুরুতেও রয়েছে সেভেনথ কর্ড। তাঁর অনেক বিষয়ই ব্যতিক্রমী ছিল। আজকের দিনের সঙ্গে তুলনার বিষয় এলে আমি বলবো, আমরা বিশ্বায়নের দোহাই দিয়ে আজকে ‘না ঘরকা, না ঘাটকা’ একটা অবস্থানের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। অত্যাধুনিক হতে গিয়ে নিজের শিকড়কে ভুলে যাচ্ছি।
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের স্বপ্ন, দৃষ্টিভঙ্গি, দেশের প্রতি ভালোবাসা, চলন-বলন, আদর্শিক দিক- সব কটি ছিল অন্য রকম। এত শৈল্পিক, এত দেশপ্রেমিক, এত আধুনিক চিন্তা এবং প্রতিভাধর একজন মানুষ ছিলেন তিনি। শিল্পের যে ডিগনিটি বা শিল্পীর যে ডিগনিটি, তা তিনি শেষ পর্যন্ত বজায় রেখেছেন। অনেক কিছুই তাঁর মনঃপূত হয়নি। তারপরও উনি কোনো দিন কোনো জায়গায় কম্প্রোমাইজ করেননি। এসব বিষয় থেকে নতুন প্রজন্মের অনেক কিছু শেখার আছে। তবে একটা কষ্ট উনি শেষ দিকে খুব বেশি অনুভব করেছেন। আমি সব ক্ষেত্রে বলবো না, কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের মিউজিকের যে দৈন্য- যেখানে আমরা অতি আধুনিক হয়ে পরনির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছি। আমাদের শিকড়, ভ্যালুজ, বাঙালিত্ব- এসব থেকে বের হয়ে আমাদের মিউজিকের যে সংকট চলছে তা হতাশাজনক। তাঁদের মতো মিউজিশিয়ান যদি পাঁচটা দিনও কাজ না করে বসে থাকেন, এত যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষের অভিমান হওয়াটা কিংবা কষ্ট পাওয়াটা স্বাভাবিক। তাঁর মৃত্যুর পর আমরা তাঁকে অনেক বেশি মূল্যায়ন করছি, অথচ বেঁচে থাকার সময়টাতে তাঁকে অনেকটা ইগনোরই করা হয়েছে। এই ক্ষণজন্মা মানুষগুলো পৃথিবীতে বারবার আসবেন না। আমাদেরকে তাঁরা গৌরবান্বিত করেছেন, বাংলা সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছেন। এঁদের কাছে আমরা ঋণী। একজন শিল্পী হিসেবে এবং শিল্পীদের প্রতিনিধি হয়ে তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি এবং তাঁর প্রতি সালাম জানাচ্ছি।
কুমার বিশ্বজিৎ
অনুলিখন: তাওসিফ আহমেদ