ইভেন্ট I মেট্রোপলিশের বাইরে বারো বছর
আমাদের কর্মব্যস্ত মেট্রোপলিশ জীবনের বাইরে, কুষ্টিয়া শহরের অদূরে স্মরণ মাৎস্যবীজ খামারে বারো বছর ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে একটি আর্টক্যাম্প। নীরবে, নিভৃতে। মেট্রোপলিশ জৌলুশ, ইজমের বাদানুবাদ, মুনশিয়ানার দাপট ইত্যাদি ছাপিয়ে বাঙালির সহজিয়া দর্শনের এক যৌথ মিথষ্ক্রিয়ার সন্ধান মেলে এখানে। আর্টক্যাম্প আয়োজনের প্রচলিত ছকের বাইরে, প্রথাগত কর্মকান্ড অনুসরণ না করে শিল্পভাবনা প্রকাশের নতুন পথ সন্ধানের উদ্দেশ্য সামনে রেখে বারো বছর আগে কুষ্টিয়ায় শুরু হয়েছিল ‘ক্র্যাক ইন্টারন্যাশনাল আর্টক্যাম্প’। ২০০৭ সালে। শুরু থেকে এই আর্টক্যাম্পে চিত্রশিল্পী, কণ্ঠশিল্পী, গবেষক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকর্মী, ফটোগ্রাফার, কবি, বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষসহ শিল্পের নানা শাখায় বিচরণকারী গুণীজনের অংশগ্রহণের পথ খুলে দেওয়া হয়।
প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসের ২৫-৩০ তারিখ ক্যাম্পটি অনুষ্ঠিত হলেও এ বছর বাংলাদেশের নির্বাচনের কারণে এটি অনুষ্ঠিত হয় জানুয়ারি মাসের ৬-১২ তারিখ। বাংলাদেশসহ ভারত, নেপাল, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, নেদারল্যান্ডস ও যুক্তরাষ্ট্রের ১৯ জন তরুণ শিল্পী অংশগ্রহণ করেন এবারের আর্টক্যাম্পে। অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা হলেন ভারতের মোহাম্মদ তালহা ওয়াহিদ, শিল্পী আগারওয়াল, সৌম্যদীপ রায়, নেপালের আমান মহার্জন, নবিনা সুনুওয়ার, নিকাশ ইয়োনজান, ইন্দোনেশিয়ার আজিজ আমরি, রন কেনেথ মারকাডো, ফিলিপাইনের সিজ গোমেরা, নেদারল্যান্ডসের রাইনা রোডিনা ভ্যান ডার মিয়ার, যুক্তরাষ্ট্রের সোফি রে লি এবং বাংলাদেশের কনক আদিত্য, মুয়িজ মাহফুজ, মৃদুলকান্তি গোস্বামী, নাজমুল হোসেন নয়ন, এস এম রিয়াদ, অনন্ত কুমার দাশ, সাগর জাহিদ ও আনান।
ক্র্যাক আর্টক্যাম্পের প্রধান আকর্ষণ বিচিত্র শিল্পানুষঙ্গের প্রদর্শনী। এখানে অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা নিজেদের প্রজেক্ট নির্মাণ করার জন্য যেমন ব্যবহার করেন শব্দ সম্পাদনার আধুনিক প্রযুক্তি, তেমনি শিল্প নির্মাণের জন্য ব্যবহার করেন ক্যাম্পের চারদিকে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন উপকরণ। একদিকে যেমন দেখা যায় প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পীদের গৎবাঁধা ফর্ম থেকে বেরিয়ে এসে কাজ করার প্রচেষ্টা, অন্যদিকে লক্ষ করা যায় অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পীর নিজস্ব ফর্মের কাজ কিংবা একজন স্বভাবশিল্পীর স্থানীয় উপকরণে তৈরি সাদামাটা ইনস্টলেশন আর্টও। প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পীদের সঙ্গে চারুশিল্পের জগৎ থেকে বহুদূরের, ভিন্ন জগতের বাসিন্দা কণ্ঠশিল্পী, কবি, ফটোগ্রাফার কিংবা থিয়েটার অ্যাকটিভিস্টদের অথবা ‘অশিল্পী’দের বিভিন্ন শিল্পকর্ম একই সারিতে প্রদর্শিত হয় এখানে, আর্টক্যাম্পের চিরায়ত ঢং ভেঙে। ফলে অংশগ্রহণকারী সবাই নিজেদের বিভিন্ন শিল্পানুষঙ্গ এবং পুরো আয়োজনটির সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান। সৃজনে মগ্ন হন।
এই বহুমাত্রিক আর্টক্যাম্প ২০১৮ সালে পদার্পণ করেছে বারো বছরে। ২০০৭ সালে এটি যাত্রা শুরু করে দুজন শিল্পীর হাত ধরে। একজন শাওন আকন্দ, অন্যজন দেলোয়ার হোসেন। এরপরে ২০০৯ সালে ঢাকায় শিল্প ও সংস্কৃতিবিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র (সিআরএসি) এই আয়োজনের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে এটিকে আন্তর্জাতিক রূপ দেয়। বর্তমানে ক্র্যাক আর্ট ট্রাস্ট এই আর্টক্যাম্প পরিচালনা করে থাকে।
অনার্য তাপস
ছবি: আতাহার হোসেন সুরজো