আলাপন I আমার জীবনে সব ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটেছে লেখক হয়ে ওঠার জন্যই – রাশিদা সুলতানা
বাংলাদেশে প্রথম দশকের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথাসাহিত্যিক রাশিদা সুলতানা। কবিতাও লেখেন। বর্তমানে তিনি জাতিসংঘের একজন কর্মকর্তা। পেশাসূত্রে থাকেন সুদানে। স্বাধীনতা, স্বনির্ভরতা, ব্যক্তিত্ব ও সৃজনশীলতা- এই বিষয়গুলো তাঁর সৃষ্টি, কর্ম ও ব্যক্তিজীবনে মুখ্য হয়ে আছে। ক্যানভাসের পক্ষ থেকে তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতায় অতনু সিংহ
সুদান থেকে মাঝেমধ্যে দেশে ফেরেন রাশিদা। ঢাকায় তাঁর নিবাস বারিধারা ডিওএইচএসে। সেখানে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটান। বারিধারার ওই বাসাতেই আলাপ হচ্ছিল রাশিদার সঙ্গে। আলাপের সূচনা হলো তাঁর লেখকজীবনের শুরুটা ঘিরে।
কীভাবে তাঁর সিরিয়াস লেখাজীবনের শুরু- এ ব্যাপারে তিনি বলতে থাকলেন।
– ছোটবেলা থেকে কোনো দিন ভাবিনি আমি লেখক হবো। বরং ছোটবেলায় আমার সব সময় মনে হতো, যাঁরা লেখালেখি করেন তাঁরা বোধ হয় ঐশ্বরিক ক্ষমতাসম্পন্ন কেউ। আমার মতো সাধারণ মানুষ নন। তবে শৈশবে, কৈশোরে আমি বইয়ের পোকা ছিলাম। পাঠ্যক্রমের বইগুলোর চেয়ে আমি অনেক বেশি করে গল্প পড়তাম, উপন্যাস পড়তাম। ঈদসংখ্যাগুলোয় যত গল্প-উপন্যাস ছাপা হতো, পরীক্ষা সামনে থাকলেও সব পড়ে ফেলতাম। বিভিন্ন ফিকশনের চরিত্রগুলোকে নিয়েই আমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে। আমাদের সময়ে বাংলাদেশের মেয়েদের হয়তো এইটাই জীবন ছিল। কারণ, তখন তো ইন্টারনেট ছিল না। আর ওই সময় মেয়েদের পরিবার থেকেও বাইরে বের হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা থাকতো। ক্লাস সেভেন-এইটের পর থেকে বাইরে মাঠে গিয়ে খেলাধুলায় বা পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশায় তখন রেসট্রিকশন থাকতো। বাঙালি মুসলমান মেয়েদের বেড়ে ওঠার প্রসেসের মধ্যেই এটা ছিল। তাই আমাদের ছোটবেলায় বইটাই ছিল বাইরের জানালা, বেঁচে থাকার অবলম্বন। আমি ফিকশনের চরিত্রগুলোকে নিয়ে কল্পনা করতাম। স্কুল-কলেজে পড়ার সময় এমনও হয়েছে, লেখক যেখানে শেষ করেছেন, তারপর থেকে ওই চরিত্রগুলোকে আমি আমার কল্পনায় আরও এগিয়ে নিয়ে যেতাম। উপন্যাস পড়া শেষ হয়ে গেলে উপন্যাসের পরবর্তী ভুবন আমার মধ্যে কাজ করতো। কিন্তু আমি যে লিখতে পারি, সেটা কখনো মনে হয়নি। যদিও আমি ডায়েরি লিখতাম। এরপর আমি যখন অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারিনটেনডেন্ট অব পুলিশ পদে পেশাজীবন শুরু করি, সময়টা ২০০০ সাল হবে, গাজীপুরে আমার পোস্টিং হয়। গাজীপুরে খুবই নিঃসঙ্গতার মধ্য দিয়ে সময় কাটতো, অবসাদে ভুগতাম। বিকেলে হাঁটতে বের হতাম। এ রকম একটা সময় একদিন খুবই বিষন্ন ছিলাম। বলতে পারেন ওইটা আমার বিষন্নতম দিনগুলোর মধ্যে একটা। সবকিছু অর্থহীন লাগছিল। তখন হঠাৎ মনে হলো, কিছু একটা লিখি। যদিও তার আগে কবিতা লিখতে শুরু করেছি। তো আমি ওই মুহূর্তে কিছু একটা লিখতে চাইলাম, মনে যা আসে। তখনো আমার ধারণা, গল্প-উপন্যাস লেখা ঐশ্বরিক ক্ষমতার ব্যাপার। ডায়েরির মতো করেই লিখতে শুরু করলাম। একটানা বসে একটা গল্প লিখে ফেললাম। ওইটাই আমার প্রথম গল্প। নাম, ‘প্রত্যাখ্যাতা প্রতিশ্রুতা’। এই প্রথম গল্প লেখার পরেই টের পেলাম, আমার রঙহীন-বিবর্ণ পৃথিবীটা বদলে গেল। এরপর আমি নিয়মিত লিখতে শুরু করলাম। প্রথম আলোতেও নিয়মিত গল্প লিখতে থাকি।
প্রত্যেক লেখকেরই লেখাজীবনে একটা অন্তর্জগৎ থাকে। রাশিদার মধ্যেও সেটা রয়েছে। স্বগতোক্তির মতো করে অন্তর্জগৎকে বাইরের জগতের সামনে তিনি মেলে ধরেন। এখানে তাঁর ব্যক্তিগত শিল্পসত্তাই বড়। কিন্তু পেশাজীবনে প্রথমে পুলিশে, তারপর র্যাবে এবং বর্তমানে জাতিসংঘে তাঁকে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তিনি পূর্ণভাবে একজন সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক মানুষ। যেখানে সামাজিক, আইনি ও রাষ্ট্রীয়ভাবে জনসংযোগের মধ্যে তাঁকে থাকতে হয়। লেখকের অন্তর্ভুবন আর প্রশাসকের সামাজিক-রাষ্ট্রীয় জীবনের মধ্যে তিনি কীভাবে ভারসাম্য বজায় রাখেন? তিনি বললেন-
– যেখানেই আমি চাকরি করেছি, আমি আমার ভেতরের যে লেখকের পৃথিবীটা, ওইটা আমি যত্ন করে বাঁচিয়ে রেখেছি। আমি প্রশাসনিক কাজ যখন করেছি, সোশ্যাল ইন্টার্যাকশনের কাজ করেছি, সেগুলো যতœ করেই করেছি। অফিসের কাজ করার বাইরে তো আমি আমার পৃথিবীতেই ফিরে আসি, তখন নিজের লেখকসত্তাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আর অফিসের কাজে যদি দশ মিনিটও অবসর থাকে, তখন আমি লেখক রাশিদাই। তবে প্রশাসক সত্তার কাছে আমার লেখকসত্তা কমপ্লিমেন্টারি একটা রোল প্লে করেছে। কীভাবে করেছে বলছি। তুমি ভালো প্রশাসক হতে চাইলে তোমার অন্তর্দৃষ্টি থাকা জরুরি। এ ছাড়া সংবেদনশীল হওয়াটাও দরকার। কারণ, তোমার সিদ্ধান্তের ওপর অনেক মানুষের সুবিচার পাওয়ার বিষয়টা নির্ভরশীল। আর তাই লেখকসত্তাই আমার প্রশাসকসত্তাকে অনেক শক্তিশালী করেছে, সংবেদনশীল করেছে। লেখকসত্তার কারণেই আমি মানবিক প্রশাসক হিসেবে কাজ করতে পেরেছি। আমার চাকরিজীবন লেখকসত্তাকে প্রতিদিন সমৃদ্ধ করছে। নানা মানুষের সঙ্গে পরিচয়, নানা প্রতিকূলতা, চাকরির রাজনীতি- সবই আমাকে লেখক হিসেবে সমৃদ্ধ করে তুলছে। আমার জীবনের সব আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা- সবটাই ঘটেছে আমার লেখক হয়ে ওঠার জন্য।
গল্প আর উপন্যাস তাঁর জীবনের অনেকটা জায়গাজুড়ে। তাঁর উপন্যাস ‘সাদা বিড়ালেরা’, গল্পের বই ‘পরালালনীল’ সমকালীন সাহিত্যের সম্পদ হয়ে উঠেছে। লেখা নিয়ে নানা রকম পরীক্ষানিরীক্ষা তিনি করতে চান, আবার একই সঙ্গে পেশাজগতে তিনি একজন সফল পেশাজীবী নারী। প্রসঙ্গটা ইতিমধ্যেই কয়েকবার এসেছে। তা-ও বোঝার সুবিধার জন্য তাঁর পেশাজগতের দিকে একটু ডিটেইলে যাওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশের আঠারোতম বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে কাজ শুরু করেন গাজীপুরে, ক্রমে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ডেপুটি কমিশনার পদে (চলতি দায়িত্বে) সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্বভার সামলেছেন। জাতিসংঘের বিভিন্ন শান্তি মিশনে প্রায় চার বছর সেক্টর বা রিজিওনাল প্রশাসক হিসেবে কাজ করেছেন। তো এই আলাপে রাশিদার দুটি সত্তাই বারবার উঠে এসেছে।
বাংলাদেশের পুলিশ প্রশাসনে কাজের ক্ষেত্রে রাশিদা কী কী চ্যালেঞ্জ ফেস করেছেন জানতে চাওয়া হয়েছিল। উত্তরে রাশিদা বলেন-
– আমরা যখন পুলিশে যোগ দিই, তখন অনেক দিন পর বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে এএসপি হিসেবে মেয়েদের পুলিশে আসা। আমাদের আগে মাত্র ৫ জন সিনিয়র অফিসার তখন বাংলাদেশ পুলিশে ছিলেন। ওঁরা আমাদের থেকে ১০-১৫ বছর আগে জয়েন করেছিলেন। পরে এরশাদ এসে পুলিশে মেয়েদের যোগদান বন্ধ করে দেন। ১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে মেয়েদের পুলিশে আসার সুযোগ করে দেয়। পুলিশ একাডেমিতে ট্রেনিং করার সময় থেকে দেখেছি, প্রায় প্রতিদিন বাংলাদেশের কর্মজীবী নারীদের নানা প্রশ্ন ও পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়। একেকজন এসব প্রশ্ন ও পরীক্ষার মোকাবিলা করেন একেকভাবে। এসব সংগ্রামের ভেতর দিয়েই নারীরা তাঁদের যোগ্যতা প্রমাণ করে সম্মানজনক অবস্থানে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। প্যাট্রিয়ার্কাল সোসাইটির ছাপ প্রত্যক্ষভাবে পুলিশের অন্দরেও বিরাজমান ছিল। তবে এখন বোধ হয় এ রকম অবস্থার অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে।
বাংলাদেশের পুলিশ প্রশাসনে নিজের কোন কাজটাকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে চান তিনি, এটাও জানতে চাওয়া হলো। তিনি জানালেন, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে ডেপুটি কমিশনার থাকাকালীন উইমেন সাপোর্ট ডিভিশন শক্তভাবে দাঁড় করার পেছনে তাঁর বিশেষ অবদান ছিল। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রেপ ভিকটিম, সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট কিংবা ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের শিকার মেয়েদের কিংবা অ্যাসিড আক্রমণের শিকার মেয়েদের সুবিচার পাওয়ার লক্ষ্যে তিনি কাজ করেছেন। আর নির্যাতিত নারীদের এই কেসগুলো যাতে নারী পুলিশ আধিকারিকেরাই নিয়ন্ত্রণ করেন, সেই ব্যাপারটির পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের কাজ তাঁদের আমলেই শুরু হয় বলেও উল্লেখ করেন রাশিদা।
এবার লেখক রাশিদাকে তাঁর পছন্দের লেখকদের ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলো। তিনি বললেন-
– আমাদের কালে বই-ই ছিল বেঁচে থাকার অবলম্বন। তাই রবীন্দ্রনাথ থেকে তারাশঙ্কর, মানিক, বিভূতিভূষণ- এসবে ডুবে থাকতাম। পরে ধীরে ধীরে চেখভ, টলস্টয়, গোর্কি পড়া শুরু করি। আমাদের বাসায় বইয়ের যথাযথ জোগান থাকতো। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মপঁসা, কাফকা, মার্কেজ, গুন্টার গ্রাসের লেখা পড়তে খুব ভালো লাগতে শুরু করে। পরবর্তীকালে সলমন রুশদি, অরুন্ধতী রায়, বোর্হেসসহ আরও অনেক লেখকের ভক্ত হয়ে উঠি। শহীদুল জহির তখন থেকেই ভালো লাগতে শুরু করে। কিংবা জগদীশ গুপ্ত। সলমন রুশদি যেভাবে একসঙ্গে অনেক আখ্যানকে জাদুকরি ভঙ্গিমায় একসঙ্গে উপস্থাপন করেন, এটা আমার দারুণ লাগে। অনেক আখ্যান নিয়ে কাজ করা, একটা আখ্যান থেকে অন্য আখ্যানে শব্দ বয়ে যাবে- এমন লেখা পড়তে আমার খুব ভালো লাগে।
একজন নারী কোনো পুরুষের ওপর নির্ভর না করে নিজের মতো করে জীবনটা যদি চালাতে চান, এই উপমহাদেশে সেটা কতটা চ্যালেঞ্জের বলে রাশিদা মনে করেন, আমরা তাঁর কাছে জানতে চাইলাম। তিনি বললেন-
– অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এ ক্ষেত্রে। অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হলে নিজের মতো করে সব প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে যাওয়ার ব্যাপারে একটা আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়। না হলে এই সমাজে নিজের চারপাশের মানুষ আক্রমণ করতে থাকে।
বাংলাদেশে ইদানীং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে একঝাঁক নারীবাদী উঠে এসেছেন। এ ব্যাপারে রাশিদার মতামত জানতে চাইলাম।
– ফেসবুকে বা ওয়েবজিনে নারী-সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যেভাবে মেয়েরা কথা বলছেন, এইটা আমার কাছে খুবই ইতিবাচক মনে হয়েছে। তা ছাড়া এই নারীবাদীদের জীবনযাপন, শিক্ষা, জীবনবোধ- এগুলো বাংলাদেশের সাধারণ অনেক মেয়ের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে উঠছে। তারাও ভাবছে পড়াশোনা করে বিদেশ যাবো, সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আত্মনির্ভর হবো, বড় চাকরিবাকরি করবো…আমার মনে হয় বাংলাদেশে নারীবাদ চর্চা এ মুহূর্তে অনেক এগিয়ে।
ছবি: সজীব রাহমান
চমৎকার বয়ান। জীবন থেকে নেয়া অভিজ্ঞতার সহজ কথন। অন্য লেখকের জন্যও কিছু মেসেজ আছে। ধন্যবাদ রাশিদা সুলতানা
সুমি আপু কে অনেক ধন্যবাদ এমন কিছু কথা যা আগে জানা ছিলোনা তা জানানোর জন্য।
আপনার উপন্যাসিক,লেখক,সাহিত্যক হওয়ার পেছনে এতো কিছু লুকিয়ে ছিলো তা জেনেছি আর আলোকিত হয়েছি।
যাই হোক আপনার সাক্ষাৎকার এর ছবি টা আমাদের ই একজন ছোট ভাই তুলেছে
sajeeb rahman
দুর্দান্ত আলাপন! এক কথায় মুগ্ধকর উপস্থাপন!