টেকট্রেন্ড I ডিজিটাল যুগের সাইকেল জোবাইক
প্রযুক্তির বদৌলতে প্রয়োজনীয় সব সেবাই চলে এসেছে মোবাইল ফোনে। বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে। এগুলোয় গাড়ি, বাইক ও অ্যাম্বুলেন্স মেলে। এবার সাইকেলও যুক্ত হলো। নতুন এই সেবা নিয়ে লিখেছেন তৌহিদুল ইসলাম তুষার
কর্মব্যস্ত জীবনে সময়ের তালে ছুটে চলা মানুষের সঙ্গী হয়ে উঠছে সাইকেল। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন বলেছে, ঢাকায় যানবাহনের গড় গতিবেগ ঘণ্টায় সাত কিলোমিটারের কম। যানজট নিরসনের উদ্যোগ না নেওয়া হলে সাত বছর পর মানুষ হাঁটবে গাড়ির আগে। আর বুয়েটের শিক্ষার্থীদের গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকায় সাইকেলের গড় গতিবেগ ঘণ্টায় ১০ দশমিক ৬৪ কিলোমিটার। ঢাকার ছয়টি প্রধান বাণিজ্যিক এলাকায় অফিসগামী ৩০০ সাইকেল আরোহীর ওপর জরিপ করে এই তথ্য পাওয়া গেছে। সাইকেলচালকদের ৩৬ শতাংশ বলছেন, দ্রুত যাওয়া যায় বলে তারা অফিস যাতায়াতে সাইকেল ব্যবহার করছেন। এ ছাড়া আর্থিক সাশ্রয়, স্বাস্থ্যরক্ষা, বাসের অপ্রতুলতা ও নিরাপত্তাও এর কারণ। এই প্রয়োজন বিবেচনা করে যাত্রা শুরু করেছে জোবাইক। সেবাটি চালু করেছেন মেহেদী রেজা। বিশ্বের অনেক দেশেই বাহন হিসেবে সাইকেল বেশ জনপ্রিয়। অল্প দূরত্বের পথ পাড়ি দিতে অনেকেই নিয়মিত ব্যবহার করেন এই বাহন। কিন্তু আমাদের দেশে সাইকেল চালাতে অনীহা অনেকের।
বিষয়টি চোখে পড়ে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলিবাবার কর্মী মেহেদী রেজার। চাকরির সুবাদে তখন তিনি থাকতেন চীনে। সে সময় অফিসের কাজে ঢাকায় এসে মতিঝিলে জ্যামের যন্ত্রণায় পড়েন। ভাবলেন, সাইকেল ব্যবহার করে ঢাকায় চলাচল করা গেলে সময় নষ্ট কম হবে। কিন্তু অনেকেরই তা কেনার সামর্থ্য নেই, থাকলেও রক্ষণাবেক্ষণ বা পার্কিং নিয়ে ঝামেলা আছে। এ সমস্যা সমাধানে সাইকেল সেবা চালুর পরিকল্পনা করেন তিনি। বিষয়টি জানান স্কুলজীবনের বন্ধু আজহারুল কুদরত খান ও খান হেলালউজ্জামান অয়নকে। শুরু হয়ে গেল জোবাইকের কার্যক্রম। তিন বন্ধু ছাড়াও এতে অংশ নেন জোবাইকের মেক্সিকোর পাবলো আগুয়ারো ও ব্রাজিলের গালহাম প্রকিচ। আলিবাবায় মেহেদী রেজার সহকর্মী ছিলেন তাঁরা।
মনে করুন, মিরপুর ডিওএইচএসের ১ নম্বর গেট থেকে কেউ ১০ নম্বর রোডের ৩ নম্বর বাসায় যাবেন। গেটের পাশে থাকবে অনেক সাইকেল। স্মার্টফোনে থাকা নির্দিষ্ট অ্যাপের সাহায্যে সাইকেলটির তালা খুলে প্যাডেল চেপে চলে যেতে পারবেন নির্দিষ্ট গন্তব্যে। এরপর সাইকেলটি লক করে চলে গেলেন বাসায়। বাসার নিচে থাকা সেই বাহন কেউ দেখলেন এবং একইভাবে আনলক করে সাইকেল নিয়ে চলে গেলেন ডিওএইচএসের গেটে বা অন্য কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্যে। প্রাথমিক অবস্থায় কম দূরত্বের নির্দিষ্ট স্থানে সেবা পরিচালনা করছে জোবাইক। পরে বেশি দূরত্বেও সেবা দেওয়া হবে- জানালেন মেহেদী রেজা।
জোবাইকের সেবা নিতে প্রথমেই স্মার্টফোনে ইনস্টল করতে হবে জোবাইক অ্যাপ। অ্যানড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম উপযোগী অ্যাপটি গুগল প্লেস্টোর থেকে ডাউনলোড করা যাবে। নির্দিষ্ট তথ্য ও ব্যালান্স রিচার্জ করে ইনস্টলের পর অ্যাপটি চালু করলেই আশপাশে থাকা জোবাইকের সাইকেলের তথ্য জানা যাবে। এবার সাইকেলে থাকা কিউআর কোড স্ক্যান করলেই খুলে যাবে লক। সেটি চালিয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর পর লকটি ম্যানুয়ালভাবে হাত দিয়ে লক করতে হবে। জোবাইকের সাইকেল ব্যবহারের আগে ব্যবহারকারীর অ্যাকাউন্টে অর্থ রিচার্জ করে নিতে হবে। বর্তমানে যেসব এলাকায় এই সেবা চালু আছে, সেখানেই পাওয়া যাবে রিচার্জ সেন্টার। আপাতত অনলাইন ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে রিচার্জ করা যাবে না। বিকাশের মাধ্যমে এই সুবিধা চালু হবে শিগগিরই। আইওএস সংস্করণও নেই এখন। তাই আইফোনের গ্রাহকেরা জোবাইকের সেবা নিতে পারবেন না। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে আসবে আইওএস সংস্করণ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে জোবাইকের সাইকেল ব্যবহারের জন্য পাঁচ মিনিটে গুনতে হবে তিন টাকা। অ্যাপের মাধ্যমে সাইকেলের লক খোলার পরপরই শুরু হবে সময় গণনা। গন্তব্যে পৌঁছে ব্যবহারকারী সাইকেলটি লক করা পর্যন্ত এ গণনা চলতে থাকবে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্য এলাকায় জোবাইকের সাইকেল ব্যবহারের জন্য মিনিটপ্রতি খরচ হবে এক টাকা। মেহেদী রেজা জানান, শিক্ষার্থীদের বাড়তি সুবিধা দিতেই তাদের জন্য খরচ কিছুটা কম রাখা হয়েছে। ভবিষ্যতে সেবার পরিধি বিস্তারের পর খরচ আরও কমিয়ে আনা হতে পারে।
জোবাইকের সাইকেলগুলোর আকার ও নকশা একটু আলাদা। ডিজিটাল বাইসাইকেলের আদলে তৈরি সাইকেলগুলোতে রয়েছে অত্যাধুনিক লক, সোলার প্যানেল ও জিপিএস সিস্টেম। শেষেরটি অ্যাপে সাইকেলের অবস্থান জানার জন্যই। এমনকি চুরি হলেও জানা যাবে সাইকেলটির অবস্থান। সাইকেল চুরির পরে চোর জিপিএস সিস্টেমটি খুলে ফেললেও সাইকেলের অবস্থান জানা যাবে। কারণ এতে রয়েছে দুটি জিপিএস। একটি খুললেও ব্যাকআপ হিসেবে আরেকটি কাজ করবে। আকার ভিন্ন হওয়ায় চুরি করে রাস্তায় চালালেও জোবাইকের সাইকেল চেনা যাবে। তাই জোবাইকের সেবায় বর্তমানে ৩০০টির বেশি সাইকেল আছে। চুরির কোনো ঘটনা ঘটেনি এখনো।
ঢাকার মিরপুর ডিওএইচএসে চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি চালু হয়েছে জোবাইক সেবা। তবে এটা শুধু ডিওএইচএসের ভেতরে চালানো যাবে। সেবাটি গত বছরের ১১ জুলাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে যাত্রা শুরু করে। এরপর ভালো সাড়া পাওয়ায় সে বছরের ডিসেম্বরে চালু হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরেও সেবা দিচ্ছে জোবাইক। কক্সবাজারের কলাতলী, সুগন্ধা ও লাবণী পয়েন্টেও জোবাইকের সাইকেল পাওয়া যায়। এ বছরের ২৭ জানুয়ারি সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয় এই সেবা। প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, দেশের সব বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পাশাপাশি ঢাকার বিভিন্ন আবাসিক এবং বাণিজ্যিক এলাকায় চালু হবে জোবাইক সেবা। মেহেদী রেজা বলেন, কক্সবাজার বাংলাদেশের পর্যটন রাজধানী। এখানে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ভ্রমণ সহজ করতেই আমাদের এই উদ্যোগ। আশা করি দেশের ট্যুরিজম শিল্প এবং যোগাযোগব্যবস্থার ডিজিটাইজেশনে জোবাইক ভূমিকা রাখবে। আগামী বছরের মধ্যে আরও ২০ এলাকায় সেবার পরিধি বাড়ানো হবে।
প্রতিষ্ঠানটির বিজনেস ডেভেলপমেন্ট স্পেশালিস্ট ইস্তিয়াক আহমেদ শাওন জানান, বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির নিবন্ধিত ব্যবহারকারী রয়েছেন প্রায় ৫৭ হাজার। জোবাইকে প্রতিদিন চলাচল করছেন ২৫০০ থেকে ৩০০০ ব্যবহারকারী।
ছবি: ইন্টারনেট