ফিচার I সৃজনে সমান্তরাল
বিখ্যাত রুশ সাহিত্যিক ম্যাক্সিম গোর্কির মতে, আমার মধ্যে উত্তম বলে যদি কিছু থাকে, তার জন্য আমি বইয়ের কাছে ঋণী। বই নিঃস্বার্থ বন্ধু। সত্য সুন্দর আনন্দময় অনুভূতিতে মনকে আলোড়িত করে তোলে বই। বাংলাদেশে ফেব্রুয়ারি ভাষার মাস। প্রাণের মেলায় জমজমাট। ১৯৭২ সালে শুরুর পর পেরিয়েছে চার দশকের বেশি সময়। মধ্যবর্তী সময়ে স্কুল-কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীও বেড়েছে। কিন্তু যে সংখ্যায় বই প্রকাশিত হয়, তার মধ্যে নারী লেখকদের বই আসলে কতটা থাকে?
এই প্রশ্নে প্রকাশকদের একজন জানালেন, ২৫ শতাংশের বেশি হবে না। প্রবীণ যাঁরা আছেন তাঁদের বইয়ের প্রতি পাঠকের আগ্রহ আগে থেকেই দেখা যায়। তবে তরুণেরাও ভালো লিখছেন।
কোন ধরনের বিষয়গুলো নিয়ে বেশি লেখেন নারী লেখকেরা? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গল্প কবিতা উপন্যাসই মেলায় বেশি বিক্রি হয়।
এমনই কয়েকজন তরুণ নারী লেখকের সঙ্গে কথা বলে জেনে নেওয়ার চেষ্টা করেছি তাদের অভিমত।
মাহরীন ফেরদৌস বেশ কিছু বছর একুয়া রেজিয়া নামের আড়ালে থেকেই প্রকাশ করেছেন গল্প, উপন্যাস, ফিচার ও ভ্রমণকাহিনি। প্রকাশিত ছয়টি বইয়ের মধ্যে কিছু বিষাদ হোক পাখি, এই শহরে মেঘেরা একা ও মনোসরণি উপন্যাসের জন্য হয়েছেন পাঠকপ্রিয়। এবারের বইমেলায় এসেছে তার সপ্তম বই কাচবন্দি সিম্ফনি । লেখক মাহরীন ফেরদৌসের মতে, আমি আগের চেয়েও বেশি তরুণ নারী লেখকদের বই দেখতে পাচ্ছি মেলায়। আমি নিজে যেহেতু পেন্সিল নামের বেশ বড় একটি সাহিত্যচর্চার গ্রুপ এবং পেন্সিল পাবলিকেশনসের সঙ্গে জড়িত। বলা যায় আমাদের এবারের নবীন লেখক ও কবিদের বইয়ের মধ্যে নারী লেখকদের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য। এবং তাদের মধ্যে অনেকেই দারুণ লিখছেন। কবিতা, উপন্যাস কিংবা গল্প- কোনো কিছুতেই তারা পিছিয়ে নেই। আমি তো এটাকে ইতিবাচকভাবেই দেখি। তবে লেখার সঙ্গে সঙ্গে পড়ার অভ্যাসটাও অব্যাহত রাখতে হবে, তা না হলে সাহিত্যচর্চার প্রকৃত স্বাদটা পাওয়া যাবে না।
তরুণ নারী লেখক প্রসঙ্গে লেখক কিজ্জি তাহনিন বলেন, আমি প্রথমেই বলে নিচ্ছি লেখকের পরিচয় হিসেবে আমি নারী বা পুরুষ লেখক- এই বিভাজন করে দেখতে চাই না। তবু যদি নারী ও পুরুষ লেখকের অবস্থানের কথা বলা হয়, তাহলে আমি বলবো, আমার আশপাশে অনেক প্রতিশ্রুতিশীল লেখক আছেন যারা নারী। তাদের কাজের পরিধি আমাকে আকর্ষণ করে, অনুপ্রেরণা জোগায়। তারা শুধু ঘরের কাজের মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাহিত্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে নিজের আলোয় আলোকিত করেছেন চারপাশ। আমি নিজেকে শুধুই একজন লেখক হিসেবে পরিচয় দিই। আমাকে কখনো নারী হিসেবে সাহিত্যের ক্ষেত্রে বা বই প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনোরূপ বৈষম্যের সম্মুখীন হতে হয়নি। বইমেলায় নিজের প্রকাশিত বই নিয়ে বলেন, এবারের বইমেলাতেই আমার প্রথম বই প্রকাশিত হয়েছে। পাঠক সমাবেশ থেকে প্রকাশিত বইটির নাম হচ্ছে ইচ্ছের মানচিত্র । বইমেলা প্রসঙ্গে লেখক বলেন, এবারের আয়োজন বেশ গোছানো লেগেছে। বিশেষ করে শারীরিকভাবে অক্ষম মানুষের জন্য যে হুইলচেয়ারের ব্যবস্থা করা হয়েছে, তা খুবই ভালো লেগেছে।
সাহিত্যিক বদরুন নাহার বলছেন, নারী বা পুরুষ নয় বরং নতুন যে কারও জন্যই বই প্রকাশ খুব একটা সহজ নয়। তবে পাঠকের দিক থেকে আজকাল লেখক পুরুষ নাকি নারী, তা খুব একটা প্রভাব ফেলে না।
তবে সুপরিচিত লেখকদের বাইরে নতুন উঠে আসা নারীর বই প্রকাশে প্রকাশকদের মধ্যে অনীহা কাজ করে- এমন অভিযোগ মানতে রাজি নন প্রকাশকেরা। তাদের মতে, পান্ডুলিপি পেলে তারা বই প্রকাশ করেন এবং নারী লেখকদের বই তাদের প্রকাশনা থেকে সারা বছরই বিক্রি হয়। পুরোনো নারীদের মধ্যে অনেকেই জনপ্রিয়তা যেমন অর্জন করেছেন, তেমনি তাদের পথ ধরে নারী লেখকদের সংখ্যাও প্রতিনিয়ত বাড়ছে। আর একই সঙ্গে বিস্তৃত হচ্ছে নারীদের লেখার বিষয়বস্তুও।
পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে মুগ্ধ করে রাখেন আফরোজা সোমা। এ সময়ের একজন শক্তিমান কবি। এখন পর্যন্ত তার লেখা বই বেরিয়েছে তিনটি। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তার চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ পরমের সাথে কথোপকথন । ৪৫টি কবিতা নিয়ে এই বই। প্রকাশ করেছে বৈভব। প্রচ্ছদ করেছেন শতাব্দী জাহিদ। বইটি পাওয়া যাবে বইমেলার ৪২২ নম্বর স্টলে। আফরোজা সোমা বলেন, আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানমূলক কবিতাগুলোকে আপনি হয়তো সুফি দর্শন ও মরমি ঘরানার কবিতা ভাবতে পারেন। তবে এগুলো মূলত নিজের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়া ও আলাপনের সারাৎসার। আর প্রেম তো চিরকালীন বিষয়। রোম্যান্টিক সেই কবিতাগুলোয় রয়েছে বিরহ, বিচ্ছেদ ও মিলনের আকুতি।
আমি প্রথমেই বলবো, লেখালেখি কিংবা লেখকসত্তার ক্ষেত্রে নারী বা পুরুষ এভাবে আমি আলাদা করতে চাই না। আমি নিজেও একজন শুধুই লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চাই, বললেন লেখক জেসমিন মুননি। তবে যোগ করলেন, এর বাইরে বলতে গেলে অনেক নতুন নারী লেখক আসছেন, লিখছেন। কেউ কেউ ভালো করছেন। সার্বিক দিক থেকে আমি এটাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখি। এবারের বইমেলায় নিজের নতুন বই প্রসঙ্গে লেখক জেসমিন মুননি জানান, এবারের বইমেলায় শ্রাবণ প্রকাশনী থেকে আমার একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। নাম সোনার হরিণ ।
সাহিত্যিক ও প্রকাশকদের মতে লেখালেখিতে নারী এগিয়ে আসা যত বাড়বে, তেমনি করে তৈরি হবে পাঠকও। আর তাতে করে আরও সমৃদ্ধ হবে বাংলা বইয়ের ভান্ডার। নারী লেখকদের অনেকেই বলছিলেন, নারী লেখক তৈরিতে অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজক এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রধান পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির ভূমিকা রাখা উচিত। রাজধানীর স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক রিলেশন অফিসার সুপা সাদিয়া। একজন মা, একজন লেখক।
এ পর্যন্ত তার বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত প্রতিটি বই প্রয়োজনীয় ও উপকারী। বই পড়া শেষে পাঠকদের হতাশ করতে চাননি এই তরুণ নারী লেখক। তাঁর প্রকাশিত চতুর্থ বই ছিল ৭১-এর একাত্তর নারী । দেশ স্বাধীনের পেছনে ১৯৭১ সালের নারীদের অবদান নিয়ে প্রথমেই একটি কথা উঠে আসে বীরাঙ্গনা । তবে শুধু বীরাঙ্গনা নয়, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রতিটি ক্ষেত্রে ছিল নারীদের অবদান। মুক্তিকামীদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করার সঙ্গে বন্দুক হাতে যুদ্ধ পর্যন্ত করেছেন এ দেশের নারীরা। নারীদের সে অবদান এই জাতি যেন কোনোকালেই ভুলতে না পারে, সে কাজ করে যাচ্ছেন সুপা সাদিয়ার মতো লেখকেরা। ২০১৭ সালে দেশব্যাপী গল্প প্রতিযোগিতায় প্রথম হন মদিনা জাহান রিমি। আর তাতে পান দাঁড়িকমা-এক গল্পে তারকা খেতাব। ছোটবেলা থেকে সাহিত্যজগতে বিচরণের ইচ্ছে ছিল। জীবনের প্রথম বই প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালের একুশে বইমেলায়। ইনসমনিয়া উপন্যাসটি সে বছর পাঠকের মধ্যে সাড়া জাগায়।
লেখক সালেহীন শিপ্রা মনে করেন, তরুণ নারী লেখকের সংখ্যা তুলনামূলক বাড়ছে। তবে সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি নতুন লেখকদের লেখার মানের দিকেও দৃষ্টি দেওয়া জরুরি, এটাও উল্লেখ করেন। সেই সঙ্গে বলেন, নতুনদের অনেকেই ভালো লিখছে। বইমেলা ছাড়াও অনেক নতুন বা তরুণ নারী লেখকের বই বছরের বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়। যারা ভালো লিখছেন তারাই পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হচ্ছেন।
গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বইমেলায় প্রতিবছর তিন থেকে চার হাজার নতুন বই ছাপা হচ্ছে।
এবারের মেলায় অংশ নেওয়ার জন্য ৫৫০টি প্রকাশনা সংস্থা ও সংগঠনকে নির্বাচিত করেছে এর আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি। এগুলোর মধ্যে প্রকাশনা সংস্থার সংখ্যা প্রায় ৫০০। গতবারের তুলনায় এবারের মেলায় অংশ নিয়েছে ৪৫টির বেশি প্রকাশনা সংস্থা। বাংলা একাডেমির জনসংযোগ উপবিভাগের তথ্যানুযায়ী, ২০০২ সালে মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা সংস্থার সংখ্যা ছিল ২৪০টি, ২০০৩ সালে ২৬৭, ২০০৪ সালে ৩১২, ২০০৫ সালে ৩১৮, ২০০৬ সালে ৩১৭, ২০০৭ সালে ২৫৫, ২০০৮ সালে ২৩৬, ২০০৯ সালে ৩২৬, ২০১০ সালে ৩৫৬, ২০১১ সালে ৩৭৬, ২০১২ সালে ৪২৫, ২০১৩ সালে ২৭৪, ২০১৪ সালে ২৯৯, ২০১৫ সালে ৩৫১, ২০১৬ সালে ৪০২, ২০১৭ সালে ৪০৯ এবং ২০১৮ সালে ৪৫৫টি।
প্রকাশনা সংস্থা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি প্রতিবছরই বাড়ছে মেলায় নতুন বইয়ের প্রকাশনাও। ২০১৪ সালে মেলায় প্রকাশিত নতুন বইয়ের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৯৫৯টি, ২০১৫ সালে ৩ হাজার ৭০০, ২০১৬ সালে ৩ হাজার ৪৪৪, ২০১৭ সালে ৩ হাজার ৬৪৬ ও ২০১৮ সালে ৪ হাজার ৫৯১টি। এ হিসাব অনুযায়ী গত পাঁচ বছরে মেলায় নতুন বইয়ের সংখ্যা বেড়েছে দেড় গুণের বেশি। তবে এ হিসাব শুধু মেলার তথ্যকেন্দ্রে জমা পড়া বইভিত্তিক। প্রকাশিত বইয়ের প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে বেশি।
I গোলাম কিবরিয়া
ছবি: সংগ্রহ