সেলুলয়েড I রোমা
কাহিনি, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: আলফনসো কুয়ারন
প্রযোজনা: নিকোলাশ চেলিস ও আলফনসো কুয়ারন
ভাষা: স্প্যানিশ
অভিনয়ে: ইয়ালিতজা অ্যাপারিচিও, মারিনা দে তাভিরা, ন্যান্সি গার্সিয়া, ফার্নান্দো গ্রেদিয়াগা প্রমুখ
সিনেমাটোগ্রাফি: আলফনসো কুয়ারন
সম্পাদনা: আলফনসো কুয়ারন, অ্যাডাম গঘ
কস্টিউম: আনা টেরাজাস
দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ১৫ মিনিট ১৬ সেকেন্ড
সিনেমাকে কাব্যে উত্তীর্ণ করা শুধু গল্প বলা দিয়ে হয় না। বরং তা সম্ভব হয়ে ওঠে স্বতন্ত্র কারুভাষা, আঙ্গিক ও উপস্থাপনা দিয়ে। এবং রিয়েল টাইম-স্পেসের বাস্তবতাকে রিল টাইমের বাস্তবতায় রূপান্তরের মাধ্যমে শিল্পের সর্বোত্তম ফর্ম কবিতাকে ছুঁয়ে ফেলতে পারে চলচ্চিত্রমাধ্যম। আজকের দুনিয়ায়, এমন শিল্পকর্ম তৈরির সুযোগও কম। কিন্তু এটাই করলেন আলফনসো কুয়ারন। নেটফ্লিক্সের হয়ে বানালেন ‘রোমা’। হলিউডের রঙ-রূপ-রংঢঙের মঞ্চ থেকে সাদাকালো এই সিনে-কাব্য জিতে নিল অস্কার। হলিউড নিজে বেশির ভাগ সময়েই ডিকেন্সিয়ান ন্যারেটিভ আর গ্রাফিকসে বিনোদনের মালমসলা হিসেবে সিনেমা বানালেও অস্কারের মঞ্চ থেকে নানা সময়েই ভালো ছবিকে পুরস্কৃত করে এসেছে। যেমনটা ‘পথের পাঁচালী’।
বলা হয়, ‘রোমা’ হচ্ছে আলফনসো কুয়ারনের আত্মজীবনীমূলক ছবি। যাই হোক, এই ছবির আখ্যানের পরতে পরতে মিশে আছে নারীজীবন। তার অন্দরমহলের দৈনন্দিন সংগ্রাম, কখনো কখনো পুরুষের সিদ্ধান্তের পরোয়া না করেই তার এগিয়ে যাওয়া।
এই ছবির ডিটেইলিং দারুণ। সাদা-কালো হওয়ার কারণ এর ন্যারেটিভ। দুই নারীর জীবনের মতোই। কস্টিউম, মেকআপ ইত্যাদি সিনেমার বাস্তবতা ও তার সময়চেতনায় সম্পৃক্ত। শ্রেণি, সময়, মানসিক অবস্থা, সামাজিক প্রেক্ষাপট— প্রতিটি বিষয় পাত্রপাত্রীদের পোশাকে ও রূপসজ্জায় ফুটে উঠেছে। ক্যামেরা এবং অপ্রকাশ্য থাকা সম্পাদনা এই ছবির সম্পদ। সিনেমাটোগ্রাফি এবং এর সংগতে ছবির সম্পাদনা ও অডিওগ্রাফি যে চলচ্চিত্রকে কাব্যে উত্তীর্ণ করতে পারে, তা নতুন করে উপলব্ধির জন্য ‘রোমা’ দেখা প্রয়োজন। ছবির চিত্রগ্রহণ ও সম্পাদনায় রয়েছেন পরিচালক স্বয়ং। কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক এতে ব্যবহৃত হয়নি। ফিল্ম রিয়েলিজমের যথাযথ উপস্থাপনে বাহ্যিক মিউজিকের দ্বারস্থ না হয়ে ছবির একেকটি শট থেকে শুরু করে দৃশ্যে, দৃশ্যান্তরে মিজ-অঁ-সেনে সংগীত রচনা করেছেন পরিচালক। ক্লিও চরিত্রে ইয়ালিতজা অ্যাপারিচিও থেকে শুরু করে প্রত্যেক অভিনেতা-অভিনেত্রীই নিজের চরিত্রে অসাধারণ।
মেক্সিকোর একটি পরিবারের গৃহ পরিচারিকা ক্লিওদেগারিয়া গাতিয়েরেজের ওরফে ক্লিওকে কেন্দ্র করে এই ছবির আখ্যানের অধিকাংশ আবর্তিত। একদিকে ফুটবল বিশ্বকাপের উন্মাদনা, অন্যদিকে সত্তর দশকের উত্তাল রাজনৈতিক সময়ে মেক্সিকো-সংলগ্ন কলোনি রোমা শহরের একটি মধ্যবিত্ত পরিবার এই ছবির ভরকেন্দ্র। ওই পরিবারের গৃহকর্মী ক্লিও। যাবতীয় দায়দায়িত্ব সামাল দিতে হয় গৃহকর্ত্রী সোফিয়াকে। যদিও পরিবারের কাজকর্ম সামলান ক্লিও এবং তার সহকর্মী আদেলা। সোফিয়ার চার সন্তান। এই পরিবারেই থাকেন সোফিয়ার মা টেরেসা। সোফিয়ার স্বামী আন্তোনিও, পেশায় চিকিৎসক। পরিবারে সময় দেন না তিনি। বরং এক তরুণীর সঙ্গে সম্পর্কই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। সোফিয়াকে একা সামলাতে হয় ঘর-সংসার। আর পরিবারের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে ওঠা ক্লিও। ক্লিও ও আদেলার বয়ফ্রেন্ড ফারমিন। তারা ডেট করতে যান। বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে একান্ত সময় কাটিয়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন ক্লিও। মেক্সিকোয় তখন গৃহযুদ্ধের সময়। প্রেমিকের থেকে ভরসা পায় না ক্লিও। শহরের সন্ত্রস্ত এক মুহূর্তে প্রসববেদনা নিয়ে হাসপাতালে যেতে হয় ক্লিওকে। আন্তোনিও তার সন্তান প্রসবে এগিয়ে আসে, কিন্তু মৃত সন্তান প্রসব করে ক্লিও। এদিকে সমান্তরালে গৃহযুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, দ্রোহ… ছবির আখ্যানের খুঁটিনাটিতে না গিয়েও মোটাদাগে কাহিনির এইটুকু বলা যায়। যেখানে সমাজের দুই শ্রেণির নারী সোফিয়া ও ক্লিওর স্বামী কিংবা প্রেমিকের সঙ্গে সম্পর্কের সারবত্তা প্রায় এক। এবং তারা সম্পর্কের বিশ্বাসহীনতার মধ্যেও নিজস্ব দায়িত্ব পালন করে এগিয়ে নিয়েছেন ঘর-সংসার। গৃহযুদ্ধ, সমাজবিপ্লব, দ্রোহ—এসবের সমান্তরালে দুই নারীর ব্যক্তিগত জীবনযুদ্ধের অন্য রকম ফেমিনিস্ট আখ্যান তৈরি করেছেন পরিচালক। ১৯৭২ সালে নির্মিত ফেদিরোকো ফেলিনির ‘রোমা’ ছবির পর চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ঠাঁই করে নিল নেটফ্লিক্সের হয়ে বানানো আলফনসো কুয়ারনের ওয়েব সিনেমা ‘রোমা’।
অতনু সিংহ
কুইজ
১। ছবির প্রেক্ষাপটে মেক্সিকোতে কোন ইভেন্ট চলছে?
ক। অপেরা খ। বিশ্বকাপ ক্রিকেট গ। বিশ্বকাপ ফুটবল
২। ক্লিও ছাড়া আরেকজন পরিচারিকার নাম কী?
ক। মারিয়া খ। আদিলা গ। সোনারিটা
৩। এই ‘রোমা’র আগে আরেকটি ‘রোমা’ কে বানিয়েছিলেন?
ক। ফেলিনি খ। তারকোভস্কি গ। বার্গম্যান
গত সংখ্যার বিজয়ী
১. আফরিন সুলতানা এমিলি, দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী, ঢাকা।
২. নাজিফা হাসান, বাড্ডা, ঢাকা।
৩. সানজানা ইয়াসমিন, বিএম কলেজ, বরিশাল।