এই শহর এই সময় I শিল্পী ও শিকড়
যাঁর গানে সমস্ত ধরনের আধিপত্যের অবসানে এমন এক মানব সমাজ গড়ে তোলার কথা উচ্চারিত হয়েছিল, যেখানে ধনী-দরিদ্র, উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণ আর নারী-পুরুষের ভেদাভেদ থাকবে না, সেই লালন সাঁইয়ের গান বাংলা ভাষায় রচিত হলেও, আজ তা বিশ্বের নানা প্রান্তেই চর্চার বিষয়। আর তাই আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবসে শিল্পকলা একাডেমিতে ফরাসি ভাষায় সঙ্গীতায়োজনের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল লালন সাঁইয়ের গানের উপস্থাপনা। যাঁর কন্ঠে লালনগীতি বাংলা সংগীতচর্চার ইতিহাসে বিশেষ স্থান পেয়েছে, সেই ফরিদা পারভীন গেয়ে শোনালেন, ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’, ‘জাত গেল জাত গেল বলে’, ‘বাড়ির কাছে আরশীনগর’সহ বেশ কিছু লালনগীতি। আর তাঁর পাশাপাশি ফরাসি শিল্পী আধুম তাংক এবং ফরাসি সংগীত দল টিএমপ্লাসের উপস্থাপনা ছিল অনবদ্য। মোহাম্মদ মনসুরের সমসাময়িক কবিতার ফরাসি অনুবাদের গীতিরূপ তৈরি হয়েছে ফরাসি সুর¯স্রষ্টা ল্যোহঁ ক্যুনিওর সুরে। তাঁর সুরে আর মোহাম্মদ মনসুরের কবিতার ফরাসি অনুবাদের গীতিকাব্য উপস্থাপন করেন আধুম তাংক। আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দো ঢাকার আয়োজনে এই অনুষ্ঠানে সহযোগিতা করেছেন গন্ধর্বপুর ওয়াটার ট্রিটমেন্ট এসএনসি, বাংলাদেশে নিযুক্ত ফরাসি দূতাবাস, ল্য ব্যুহো এক্সপো এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি।
মার্চ মাসেই শেষ সপ্তাহে অবিন্তা গ্যালারি অব ফাইন আর্টসে প্রদর্শিত হলো শিল্পী সালমা জাকিয়া বৃষ্টির ‘অবারিত সম্ভাবনার বাঁধ ভাঙা পথ’ শীর্ষক একক চিত্র প্রদর্শনী। এখানে শিল্পীর আঁকা প্রায় ২৮টি চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হয়েছে। যেগুলোর মাধ্যম মূলত অ্যাক্রিলিক। একটি শব্দের সঙ্গে আমরা এখন খুবই পরিচিত। সেটি হলো, ‘স্পেশালি এবেইল্ড চিল্ড্রেন’। এই ধরনের শিশুর মনোজগৎই সালমা জাকিয়া বৃষ্টির আঁকা ছবির থিম।
বিশেষ ক্ষমতা ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে যেসব শিশু জন্ম নেয়, তাদের এই ‘স্পেশালি এবেইল্ড চিল্ড্রেন’ নামে পরিচয় করানো যেতে পারে। অথচ তারা আর পাঁচটা সাধারণ শিশুর মতো যেহেতু নয়, তাই তাদের সঙ্গে ‘মানসিক প্রতিবন্ধী’ শব্দটি যুক্ত হয়ে পড়ে অবলীলায়। নিষ্পাপ শিশুরা তাদের চারপাশের অধিকাংশ মানুষের দ্বারা ব্যাপকভাবে ভুল ধারণার শিকার হয়ে থাকে, এমনকি প্রথম পর্যায়ে পিতামাতাও তাদেরকে বুঝে উঠতে পারেন না। আর দশটা সাধারণ মানুষের চেয়ে আলাদা, এইসব শিশু পৃথিবীকে এক আলাদা দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যবেক্ষণ করে, কখনও কখনও তাদের দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে থাকে সবার চেয়ে একেবারেই আলাদা। কিন্তু তাতে তো একথা প্রমাণিত হয় না যে তারা অস্বাভাবিক। তাদের রয়েছে এক উচ্চমাত্রার বুদ্ধিবৃত্তি যা থেকে বোঝা যায় যে তারা স্বতন্ত্র বিচারক্ষমতার অধিকারী এবং নতুন নতুন সমস্যাকে সহজেই বুঝতে ও তার সমাধানে অত্যন্ত দক্ষ। আমাদের উচিত এইসব প্রতিভাধরকে বোঝার চেষ্টা করা এবং তাদের স্বতন্ত্র এই মস্তিষ্কের চলৎক্ষমতাকে লালন ও তার চর্চা করতে পৃষ্ঠপোষকতা করা, কেননা সত্যিটা তো এই যে, সভ্যতার শুরু হতে যেসকল বড় বড় বৈপ্লবিক বিবর্তন-পরিবর্তন ও আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে আজ পর্যন্ত মানবজাতির যে বিস্ময়কর অগ্রযাত্রা আমরা দেখতে পাচ্ছি, তা একমাত্র এমন প্রতিভাধর অস্বাভাবিক মানুষের জন্য, চিরাচরিত ধ্যানধারণার অধিকারী সাধারণ মানুষদের জন্য নয়। তাই ‘অবারিত সম্ভাবনার বাঁধভাঙা পথ’ (এ ওয়ে টু ব্রেক বিয়ন্ড) নামক শিল্পকর্ম প্রেরণা সঞ্চয় করেছে প্রতিবন্ধিতায় আক্রান্ত সেইসব শিশুর প্রত্যয়ে হতে, তাদের পিতামাতার আশা ও আকাঙ্ক্ষা হতে। গত ২২ মার্চ এই প্রদর্শনীটির উদ্বোধন হয়। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট শিল্পী কনকচাঁপা চাকমা এবং অবিন্তা গ্যালারি অব ফাইন আর্টস-এর প্রধান নিলু রওশন মোর্শেদ।
মার্চ মাসেই এই ঢাকা শহরে প্রদর্শিত হলো আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ চিত্রপ্রদর্শনী। তবে তা আলোকচিত্রের। আলোকচিত্রী সামসুল আলম হেলালের ফটোগ্রাফির এই প্রদর্শনীর শিরোনাম ছিল ‘হারানো শিকড়’। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে ২৩শে মার্চ থেকে প্রদর্শনী শুরু হয়। এখানে প্রদর্শিত ফটোগ্রাফিগুলোর মূল বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া বাস্তুচ্যুতি, তাঁদের ফেলে আসা যাপিত জীবনের অবশেষ এবং বাস্তুচ্যুতি সহিংসতার বৈশিষ্ট্য।
হারানো শিকড় বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে স্থানচ্যুতি সম্পর্কে কথা বলে। ১৯৬২ সালে জলবিদ্যুতের উৎস হিসেবে কাপ্তাই বাঁধ নির্মিত হয়েছিল। এর ফলে মানুষ তাঁদের ভূমি থেকে বাস্তুচ্যুত হয়। চাকমা রাজার প্রাসাদ কাপ্তাই হ্রদের গভীরে সমাহিত হয়। ‘অদৃশ্য হতে থাকা শেকড়ে’ থেকে একটি ‘চেয়ার’ সিংহাসনের প্রতীকী উপস্থাপনা হিসেবে ব্যবহার করে আলোকচিত্রের মাধ্যমে সেই স্মৃতি তুলে ধরা হয়েছে। উল্লেখ্য, সামসুল আলম হেলাল একজন ঢাকা ভিত্তিক ফ্রিল্যান্স ভিজুয়াল আর্টিস্ট। তিনি পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইন্সটিটিউট হতে আলোকচিত্র বিষয়ে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেছেন। তাঁর লক্ষ্য সামাজিক-সাংস্কৃতিকের সীমা অতিক্রম করা। রাজনৈতিক সমস্যাগুলো তাঁর মূল আগ্রহের বিষয়। তিনি খুঁজে ফেরেন পরিচয়, স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা। সাম্প্রতিক চর্চায় তিনি কাজ করেছেন আলোকচিত্র, ভিডিও এবং ইন্সটলেশন নিয়ে।
হেলাল ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো জুপ সোয়ার্ট মাস্টারক্লাস ২০১৬ এর একজন অন্যতম বিজয়ী। কুন্সটহালে জুরিখ, স্পিক লোকাল ২০১৭, কলম্বো আর্ট বিয়েনালে ২০১৬, ঢাকা আর্ট সামিট ২০১৬, ছবি মেলা ২০১২, ব্রনক্স জাদুঘর নিউ ইয়র্ক ২০১৫ ইত্যাদি দলীয় প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছেন তিনি। ২০১৮ সালের হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ফেলোশিপ প্রোগ্রামের অন্যতম ভিজিটিং আর্টিস্ট ছিলেন হেলাল।
স্টাফ রিপোর্টার
ছবি: সংগ্রহ