ফোকাস I আজকের নারীই আগামীর সুপারহিরো শুধু চাই একটু সচেতনতা
নারীত্বকে কেউ বলে দুর্বলতা! কেউ কেউ তাকে প্রকাশ করে শাড়ি বা নথ পরে। কেউবা রাখে ঘরে লুকিয়ে। বিশেষ করে মাসের সেই সময়গুলোতে— যখন কিনা তারা একটু একটু করে সন্তান জন্মদানে আরও সক্ষম হাতে থাকে। সেই ঋতুস্রাব নিয়ে কত সংশয়। তার কারণে জীবনের কত অপচয়! অথচ এত কিছুর পরেও নারী থেমে থাকেনি। নিজের মাঝে লুকানো সুপারপাওয়ারে নারী আজ এগিয়ে আসছে। বলছে নিজের কথা অসংকোচে। কী চাই তাদের এই সময়, কেন চাই— তা নিয়ে লিখেছেন রুম্পা সৈয়দা ফারজানা জামান
চেয়ারে আমার সব সময় একটা পলিথিন বিছানো থাকে। কারণ, এই চেয়ারে মাসে কয়েক দিন বসতে খুব অস্বস্তি লাগত। পিরিয়ডের যে দমকা একটা স্রোত থাকে, তাতে সব কাপড়ে দাগ লেগে যেতে পারে!— বলছিলেন এনজিও কর্মী ফারজানা। শুধু তা-ই নয়, ‘আপনার চেয়ারে পলিথিন কেন?’ ‘আপুর কিন্তু শুচিবায়ু আছে’— এসব শুনতে শুনতে চাকরির প্রথম সময়টা গেছে। বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এই ঠাট্টা কমলেও কমেনি বাঁকা চোখে তাকানো! কী অদ্ভুতভাবে মানুষগুলো মেয়েদের এই স্বাভাবিক নিয়মের সঙ্গে আজও বৈরী আচরণ করে যাচ্ছে। ওই ৪-৫ দিনের তীব্র বেদনা, নিউরনে অদ্ভুত আন্দোলন মেয়েগুলোকে জাগিয়ে রাখে কখনো সারা রাত, কখনো দাঁড় করিয়ে রাখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অথচ সেই সময়টায় সামাজিকভাবে কেউ কেউ অস্পৃশ্য, কেউ মজার বস্তু আবার কেউ নিতান্তই অবহেলার!
পিরিয়ড, যাকে বাংলা ভাষায় অনেকেই চেনে মাসিক বা ঋতুস্রাব হিসেবে। সেই সময়টায় যে কষ্ট থাকে সেই কষ্টের ফল কিন্তু এই মানব জনম! এই রক্তধারা যদি মেয়েদের দেহ থেকে না বের হতো, তাহলে হয়তো এই পৃথিবী একদিন হতো সন্তানহীন। এই স্রোতই পরবর্তী প্রজন্মের জন্মকে করে নিশ্চিত! অথচ সেই সময়টাকেই দিনের পর দিন ধরে হেসে উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে!
এর আগেই শমরিতার একটি গল্প বলা হয়েছিল। শমরিতার (ছদ্মনাম) স্বপ্ন ছিল দেশসেরা খেলোয়াড় হবার, সে মৃত্যুকে বরণ করে নেয় অসময়ে। জরায়ুমুখের ক্যানসারে। আর তার সূচনা ঘটে এই পিরিয়ড থেকেই।
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে পিরিয়ড এখনো ঢাকঢাক-গুড়গুড় অবস্থায় আটকে আছে ছেঁড়া কোনো কাপড়ে! বা অস্বাস্থ্যকর তুলার ভাঁজে।
এমনই এক অবস্থার কথা জানান কলোনিতে বড় হওয়া রওনক জাহান। তিনি হেসে বললেন, বারান্দায় কাপড় মেলাও যেত না লজ্জায়। আর প্যাড ফেলা তো রীতিমতো অন্যায়। কিশোরী মেয়েরা ভয়ে বাথরুমের জানালা দিয়ে ফেলতো। তাতে আরও লোকে গালমন্দ করতো। হাইজিন ফ্যাক্টরটা কখনো বাসা থেকেই শেখানো হয়নি।
কাপড়ের ব্যবহার শুধু আগে কলোনিতে ছিল তা নয়। এখনো দেশজুড়ে আনাচে-কানাচে দিনের পর দিন একই কাপড় ব্যবহার করার রীতি চলছে। এটি মূলত শুরু হয় সেই ‘লুকানোরা’ অভিপ্রায় থেকেই।
প্রথমত, স্যানিটারি প্যাডের দাম এবং ব্যবহারের রীতি না জানা থাকায় সে¦চ্ছাসেবকদের চেষ্টার পরেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে পিছিয়ে থাকে স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবহার। সম্প্রতি একটি জরিপে দেখা গেছে, গ্রামে বসবাসকারী প্রায় ৫১ দশমিক ৫ শতাংশ এবং শহরের প্রায় ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ মহিলা পিরিয়ডের সময় স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করেন না।
দ্বিতীয়ত, লজ্জা ও শঙ্কা থেকে স্যানিটারি প্যাড ব্যবহারে অনীহা অনেক দিন ধরেই। বরং কাপড়ের পাশাপাশি তুলা ব্যবহারও অনেকে অভ্যাসে পরিণত করে বিভিন্ন সময়ে। কিন্তু কাপড় যতটা অস্বাস্থ্যকর, ততটাই ক্ষতিকর তুলা বা সাধারণ টিস্যু। কারণ, এর ছোট ছোট অবশিষ্টাংশ যদি নারীর স্পর্শকাতর অঙ্গ দিয়ে প্রবেশ করে বা দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকে, তাহলে যেকোনো রকমের ইনফেকশন হতে পারে। যার মধ্যে জরায়ুমুখের ক্যানসার অন্যতম।
মাসিক ঋতুস্রাব যেমন গর্বের, সংকোচের নয়, তেমনই এই সময়ে শুধু ‘কোনোরকমে পার’ করা নয়— গুরুত্ব দেওয়ার সময় এসেছে সময়টিকে সচেতনতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার।
অনিয়মিত ঋতুস্রাব, অস্বাস্থ্যকরভাবে সময়টির যাপন এবং শারীরিক দুর্যোগের পাশাপাশি যা অবহেলিত, তা হচ্ছে ওই সময়ে মেয়েদের মানবিক ও শারীরিক টানাপোড়েন। সূত্র অনুযায়ী ৪০ শতাংশ স্কুলপড়ুয়া ছাত্রী অন্তত তিন দিন স্কুলে যেতে পারে না এই কারণে। ৬০ শতাংশ পোশাকশ্রমিক মাথা পেতে নেয় ভ্যাজাইনার ইনফেকশন।
শুধু তা-ই নয়! শুধু ঋতুমতী হবার কারণে গ্রামে-শহরাঞ্চলে হাজার হাজার মেয়েকে অল্প বয়সে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়। এসব ঘটনার পরেও যখন মেয়েরা উঠে আসে, চ্যাম্পিয়ন হয় ফুটবল বা হ্যান্ডবলে, তখন ভাবতেই হয় এই মেয়েগুলোই একেকজন সুপারহিরো— যাদের জন্ম কোনো কমিক বুকে নয়, এই দেশের বুকে এই মায়েদের গর্ভেই।
মেয়েদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে একাধিক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি কাজ করছে দেশীয় কিছু প্রতিষ্ঠানও, যারা স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে কম দামে স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরি করে বাজারজাত করছে।
বিভিন্ন উদ্যোগে বিনা মূল্যে সরবরাহ করা হচ্ছে স্যানিটারি প্যাড। শেখানো হচ্ছে ব্যবহারবিধি।
পাশাপাশি দেশজুড়ে কম দামে স্যানিটারি প্যাড বাজারজাত করার সঙ্গেই সচেতনতামূলক প্রচারণা করছে যারা, তার মধ্যে সেনোরা অন্যতম। সাধারণত দেখা যায় কোনো একজন তারকা হয়তো কোনো ব্র্যান্ড নিয়ে কথা বলে। কিন্তু সেনোরা বিশ্বাস করে, মেয়েদের মাঝে লুকিয়ে থাকা সেই সুপারহিরোদের ওপর, যারা নিজে নিজের কথা বলবে। যারা বলবে— তাদের পাশের বাড়ির মেয়েটার প্রতি কী করে যত্ন নেওয়া যায়। কারণ, সেই মেয়েটাই আগামীর মা।
এ কারণেই এবার সেনোরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাধারণ মেয়ে বলে লুকিয়ে থাকা অসাধারণ নারীদের কাছে আহ্বান করেন সেনোরার মডেল হয়ে সামনে আসার জন্য। পঞ্চাশ হাজারের বেশি শেয়ার হওয়া এই পোস্ট মেয়েদের, তার পরিবারকে আরও সচেতন করে তোলে। হয়তো ভাই বা বাবার হাত ধরেই মেয়েটি চলে আসে সেনোরার মাধ্যমে নিজেকে নারী হিসেবে সবার সামনে তুলে ধরতে।
কারণ, ঋতুস্রাব কোনো অভিশাপ নয়, বরং আশীর্বাদ। মা হওয়ার। এ জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই দিনে মেয়েদের ছুটি কার্যকর করা হয়েছে। ভারতে স্যানিটারি প্যাডের ওপর থেকে কর তুলে নেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশও পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্বের সঙ্গে। তাই ক্রিকেটে, ফুটবলে, অভিনয়ে বা সংগীতে, লেখায় বা আঁকায় নারী যেন একদিনও ঘরে বন্দি না থাকে স্বপ্ন বুকে চেপে— সেই জন্য প্রথম ধাপ সংকোচ থেকে সচেতনতার যাত্রা। সেই যাত্রায় সঙ্গী হোক বাবা, ভাই, স্বামী, প্রেমিক, শ্বশুর, বন্ধু— গোটা সমাজ! এই প্রত্যাশা আমাদের যেমন থাকছে, তেমনি থাকছে এই সচেতনতার প্রচারণায় জনপ্রিয় মুখের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি। আমাদের অভিজ্ঞতা এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক নয় বলেই প্রত্যাশাটা তাদের কাছে অনেক বেশি। নিশ্চয়ই সমাজবদলে তাদের ভূমিকা নতুন প্রজন্মের কাছে অনুসরণীয় হবে।