skip to Main Content

ছুটিরঘণ্টা I স্যান্তোরিনিতে সূর্যোদয়

আগ্নেয় পর্বতের কোলে পাথরে গড়া গ্রাম। সৈকত। গুহানিবাস। স্থানীয় খাবারের স্বাদ। সৌভিক দাসের লেখায় অনিন্দ্য অভিজ্ঞতার বয়ান

জাহাজটা যখন স্যান্তোরিনি দ্বীপের বন্দরে ভিড়লো, তখন রাত প্রায় তিনটা। আমার সঙ্গে আর যারা জাহাজ থেকে নামলেন, তাদের প্রত্যেককে কেউ না কেউ নিতে এসেছেন। দশ-বারো মিনিটের মধ্যে যে যার মতো গাড়ি চেপে বাড়ি চলে গেলেন। আমাকে নিতে কেউ আসেনি। কেই-বা আসবে? এথেন্স শহর থেকে সমুদ্রপথে পাঁচ শ মাইল দূরের এই গ্রামটায় কাউকে চিনি না আমি, আমাকেও চেনে না কেউ। শেষ জাহাজটা চলে যেতে না-যেতেই বন্দরের রেস্তোরাঁগুলো ঝাঁপ নামিয়ে দিলো। মূর্তির মতো বসে রইলো একটা কুকুর শুধু।
ভূমধ্যসাগরের বুকে জেগে ওঠা এই দ্বীপ মূলত আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত থেকে সৃষ্ট একটা বিশাল শিলাখন্ড। এই সুবৃহৎ পাথরের গুহাগুলোতে মানুষ প্রথম বসতি গড়েছিল সেই তাম্র যুগে, আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে। এখনো দ্বীপটার পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে বাসা বেঁধে মানুষ তৈরি করে চলেছে ছবির মতো সুন্দর সুন্দর গ্রাম। এ রকমই একটা গ্রামের নাম ‘ওইয়া’। সেই গ্রাম দেখতেই এত দূর আসা। গ্রিক সভ্যতার ইতিহাসে এই দ্বীপ অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। ইউরোপ মহাদেশের প্রথম বর্ণমালার হদিস পাওয়া যায় এই দ্বীপের আক্রোতিরি গ্রামে। অনেকটা মিসরীয় চিত্রলিপির মতো ছিল সেই বর্ণমালা।
ভোর হতে এখনো অনেক দেরি। বন্দর থেকে গ্রামের দিকে যাওয়ার লোকাল বাসটা আসবে দিনের প্রথম জাহাজের নোঙরের সময়ে। সমুদ্রের কিনারে একটা পাথরের ওপর বসলাম। সেখানে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের শব্দের সঙ্গে বাতাসের শব্দ মিলে সৃষ্টি হচ্ছে নৈসর্গিক সংগীত। দূরে পাহাড়ের গায়ের বাড়িগুলোতে জ্বলতে থাকা টিমটিম আলো দেখে নিজের বাসার কথা মনে পড়লো। তিন-তিনটি সমুদ্র পেরিয়ে সেই বাসস্থান আমার।
বন্দর থেকে মূল গ্রামের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। যেকোনো গ্রাম ঘুরে দেখার জন্য হাঁটতে আমার বেশ লাগে। যেখানে যা ভালো লাগে, একটু দাঁড়িয়ে মন দিয়ে দেখে নেওয়া যায়, নতুন বাতাসে ভর করে আসা বন্য কোনো ফুলের (অথবা রান্নার) সৌরভে প্রাণভরে প্রশ্বাস নেওয়া যায়, খানিকটা বিশ্রাম নিতে গাছের ছায়ায় বসলে শুনে নেওয়া যায় অচিন পাখির গান!
হাঁটতে হাঁটতে একটা ছোট বাজারের কাছে এসে পৌঁছলাম। দোকানপাট খুলতে শুরু করেছে তখন। প্রবীণ এক দম্পতিকে দেখলাম উঠোনের গাছগুলোতে জল দিচ্ছেন। ভোরের ঠান্ডা বাতাসে খিদেটাও বেশ টের পেলাম। একটা ছোট কিন্তু ছিমছাম রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসলাম। রেস্তোরাঁর মালিককে বেশ অতিথিপরায়ণ মনে হলো। আমি বসে বসে মেনু দেখছি, তিনি সহাস্যে খুব নরম দুটো পাউরুটি আর পনির দিয়ে গেলেন। গ্রিসের রেস্তোরাঁয় এই চর্চা খুব লক্ষণীয়। আপনি কিছু অর্ডার করুন বা না করুন, ওরা এই আতিথেয়তা ঠিকই করবে। সারা দিন অনেক হাঁটতে হবে জেনে আমি ভারী কোনো খাবারে না গিয়ে এক বোল গ্রিক স্যালাড দিতে অনুরোধ করলাম। খাবারটির বৈশিষ্ট্য হলো, সাধারণ শসা-টমেটোর পাশাপাশি এতে থাকে ওদের বিখ্যাত অলিভ এবং নানা রকমের গ্রিক স্পাইসের সঙ্গে কয়েকটা পনিরের টুকরো। এই পনিরগুলো ঢাকাইয়া পনিরের চেয়ে বেশ আলাদা। খেতে অনেকটা ক্রিমের মতো। স্যালাডের সঙ্গে অসাধারণ। খাবারের কিছুটা প্রশংসা করতেই, ভদ্রলোক একটা ছোট বাটিতে সাজিয়ে আরেকটা কী যেন স্যালাড আমার টেবিলে দিয়ে গেলেন। হেসে বললেন, আমাদের আরেকটা বিশেষ স্যালাড চেখে দেখো, এটা রেস্তোরাঁর সৌজন্যে। অসাধারণ সেই স্যালাড! স্যামন মাছের স্লাইসের সঙ্গে পাকা আম টুকরো টুকরো করে কেটে দেওয়া! দুটো একসঙ্গে মুখে দিলে কোমল একটা স্বাদ পেলাম। বাঙালির ছেলে আমি। মাছ ও আম দুটোই আমার অত্যন্ত প্রিয়। কিন্তু এই দুটো মিলে যে এ রকম অভাবনীয় স্বাদ হবে কে জানতো! অসামান্য আইডিয়া! আমের মিষ্টি গন্ধ স্যামনের কিঞ্চিৎ আঁশটে ভাবটা দূর করে দিচ্ছে, সঙ্গে এনে দিচ্ছে পরিমিত মিষ্টতা! আমি বাসায় ফিরে স্মোকড স্যামন আর গোপালভোগ আম কিনে আমার স্ত্রীকে এই স্যালাডটা বানিয়ে খাইয়েছি; বাংলায় ঐতিহ্যবাহী গ্রিক রসনা আমদানি করার জন্য বিশেষ প্রশংসিত হয়েছি। খাবারদাবারের ব্যাপারে গিন্নির প্রশংসা পাওয়া যে কতটা দুরূহ, তা নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছেন!
আবার শুরু হলো হন্টন! পুরো গ্রামটা পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে তৈরি বাড়িগুলো দিয়ে গড়ে উঠেছে; ফলে হেঁটে বেড়ানোটা বেশ বৈচিত্র্যময়। হাঁটতে হাঁটতে কখনো নেমে যেতে হয় একদম সমুদ্রের কিনারে, কখনো ওঠা হয়ে যায় পাহাড়ের চূড়ায়। সমুদ্রের বাতাসকে বুকে জড়িয়ে নেওয়া উইন্ড-মিলগুলোর (বায়ুকল) নিচেও নিজেকে আবিষ্কার করা যায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সাম্প্রতিক প্রযুক্তির উন্নয়নকে ব্যবহার করে এয়ারবিএনবি নামের একটি ব্যবস্থা প্রচলিত হয়েছে; যার মাধ্যমে অনেক বাড়ির মালিক তাদের বাসার একটা বা দুটো কক্ষ অতিথিদের জন্য উন্মুক্ত করে দেন; তাতে করে যেকোনো হোটেলের চেয়ে অনেক কম খরচে থাকা যায়। এই ব্যবস্থার সবচেয়ে ভালো দিকটি হলো, এখানে থাকলে স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবনের কিছুটা অংশ নিজের মতো করে যাপন করা যায়। এই যেমন সন্ধ্যাবেলা পাশের বাসার এক প্রৌঢ় দম্পতি বেড়াতে এসে তাঁদের সুখ-দুঃখের কথা জানালেন। সংগীতে আগ্রহ থাকলে সন্ধ্যাবেলা বারান্দায় বসে শুনে নিলেন সেই গ্রামের লোকগান। দিন শেষে খেতে পাবেন তাঁদেরই রান্না করা স্থানীয় খাবার। যেকোনো হোটেলের চেয়ে যা অনেক বেশি আন্তরিক।
হাঁটতে হাঁটতে সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো। আমি ছাড়াও কিছু পর্যটক ততক্ষণে আসতে শুরু করেছেন। আমি যেমন এথেন্স শহর থেকে সারা রাত জাহাজে দুলতে দুলতে ভোরের আগেই পৌঁছে গিয়েছি, সবাই তেমন নয়। অনেকে আশপাশের নানা দ্বীপ থেকে সকালে রওনা হয়েছেন। কাছাকাছির মধ্যে ‘ক্রিট’ নামের আরেকটা দ্বীপ রয়েছে যেটি পর্যটনের জন্য প্রসিদ্ধ। পর্যটকদের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে চললো পথের ধারের পসরা। একা কোথাও বেড়াতে গেলে আমি মূলত দুটো অ্যাজেন্ডা নিয়ে ঘোরাঘুরি করি। এক. স্থানীয় খাবারের জন্য প্রসিদ্ধ রেস্তোরাঁ, দুই. স্ত্রীর জন্য স্থানীয় অলংকারের স্টুডিও। হিরে জহরতের গয়না নয়। আমার সামর্থ্য এবং রুচির ঊর্ধ্বে (কিংবা নিম্নে)। আমার মূল আগ্রহ হচ্ছে স্থানীয় আদিবাসীদের ব্যবহৃত অলংকার। এগুলো সাধারণত সেই এলাকার সহজলভ্য পাথর, সামুদ্রিক উপকরণ এবং প্রাকৃতিক উপাদান থেকে তৈরি হয়। যা হোক, এই দ্বীপে ‘রক্তিম সৈকত’ (রেড বিচ) নামের একটা জায়গা আছে, যেখানে বালির রঙ অনেকটা পোড়া ইটের রঙের। বিশাল পাহাড়ের নিচে ছিমছাম এই সৈকতের কাছেই এক প্রবীণ শিল্পী নিজ হাতে তৈরি করা অলংকারের পসরা সাজিয়ে বসেছেন। আমি কিছুক্ষণ ধরে তাঁর সংগ্রহের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম! সামুদ্রিক ঝিনুক-নাভি, রুপা আর কাঠ দিয়ে কী অসাধারণ সব অলংকার গড়েছেন ভদ্রলোক।
– কোনো কিছু পছন্দ হলো?
ভদ্রলোকের সমুদ্রের মতো গম্ভীর কণ্ঠ শুনে ঘোর কাটলো! তাঁর চোখের দিকে তাকাতেই জিজ্ঞেস করলেন।
– তোমাকে এর আগে কোথায় দেখেছি বলো তো?
এই প্রশ্ন আমাকে প্রায় দেশেই শুনতে হয়। পাঞ্জাবি-পাজামা পরে ঘোরাঘুরি করি বলে হয়তো এই উপমহাদেশের অন্যান্য মানুষের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেন। আমি মজা করে বললাম,
– সিনেমাতে দেখে থাকবেন হয়তো!
– ঠিক তাই! কোন সিনেমাতে দেখেছি বলো তো?
– আপনি জুরাসিক পার্ক দেখেছেন?
– হ্যাঁ, দেখেছি। সেই যে ডাইনোসরদের দাপাদাপি?
– হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন! আমি সে সিনেমাতে একটা ডাইনোসরের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলাম।
– হাহ! হাহ! হাহ! বেশ বলেছ! তা কার জন্য গয়না খুঁজছ— বান্ধবী না স্ত্রী?
– দুটোই!
– দুজনের জন্য দুটো!
– আরে না না! আমার স্ত্রীই আমার বান্ধবী। একের ভেতর দুই! আপনার সবচেয়ে সুন্দর অলংকারটি দেখান।
ভদ্রলোক তাঁর সংগ্রহ থেকে একটা রুপার তৈরি পেনড্যান্ট বের করে দেখালেন। প্রাচীন গ্রিক শৈলীতে তৈরি রুপার বৃত্তের কেন্দ্রে সমুদ্রের গভীর থেকে তুলে আনা একটা ঝিনুক-নাভি বসানো। সহজ ও সুন্দর।
এই রক্তিম সৈকতের কাছে পাহাড়গুলোতে রয়েছে বেশ কয়েকটি প্রাকৃতিক গুহা। সমুদ্রের জলের তোড়ে পাথর ক্ষয়ে গিয়েই গুহাগুলো তৈরি হয়েছে বলে মনে হলো। বুদ্ধিমান মানুষ প্রাকৃতিক ঘরসদৃশ এই গুহাগুলোতে টেবিল চেয়ার পেতে রেস্তোরাঁ বানিয়ে ফেলেছেন। চমৎকার এই গুহায় কোনো এয়ারকন্ডিশনের প্রয়োজন হয় না। শীতকালে আগ্নেয়গিরির উত্তাপে ঘরের ভেতরটা উষ্ণ থাকে। পাহাড়ের পাথরগুলোই তাপ ধরে রাখার কাজ করে। আবার গ্রীষ্মকালে সেটাই হয়ে যায় নাতিশীতোষ্ণ। তখন দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। দেরি করে খেতে এসেছি; তাই পুরো রেস্তোরাঁটাই তখন ফাঁকা। জোয়ারের জল প্রায় দরজার কাছে এসে আছড়ে পড়ছে। আমি এই দ্বীপের আঞ্চলিক খাবারের জন্য অনুরোধ জানালাম। সমুদ্রের টাটকা মাছ কুটে ভিনেগারে ডুবিয়ে রেখে, পরে গোলমরিচের গুঁড়া ছড়িয়ে পরিবেশন করা হলো। সুশি ছাড়া অন্য কোনো রেসিপিতে কাঁচা মাছ খাইনি আগে। প্রথমে একটু অস্বস্তি হলেও এই দ্বীপের বাসিন্দারা হাজার বছর ধরে এই খাবার খেয়ে প্রথম বর্ণমালা প্রণয়ন করেছিলেন, ভেবে পুরো এক প্লেট সানন্দে সাবড়ে দিলাম।
ততক্ষণে বিকেল গড়িয়েছে গোধূলির দিকে। ক্যামেরা, কেনাকাটার ব্যাগ, জলের বোতল— সব গুছিয়ে বন্দরের এক কোণে গিয়ে বসি।
দেখি, সূর্যটা টুপ করে ডুবে গেল অতল জলে। রাত জাগবে বলে একে একে জ্বলে উঠলেন প্রহরী নক্ষত্রেরা। দূরে জাহাজের মাস্তুল দেখা যাচ্ছে। এবার ঘরে ফেরার পালা।

লেখক: জাতিসংঘের কর্মকর্তা; নেশা পরিব্রাজন।
Email: showvikbd@gmail.com
ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top