বিশেষ ফিচার I দাওয়াত-ই-কাশ্মীর
প্রকৃতির মতোই উপভোগ্য কাশ্মীরি খাবার। সবজি, মাছ আর মাংসের বিচিত্র পদ সেখানকার খাদ্যসংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। লিখেছেন পাঞ্চালি দত্ত
‘অগর ফিরদৌস বার রুই জমিন অসত
হামিন অস-তো হামিন অস-তো হামিন অসত’
কাশ্মীরের অপরূপ প্রাকৃতিক শোভা দেখে কবি আমির খসরুর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল ফারসি ভাষায় এই পঙ্ক্তি। যার সারমর্ম হলো: পৃথিবীতে স্বর্গ বলে যদি কিছু থাকে, তাহলে সেটা এখানে, সেটা এখানে, সেটা এখানে। কাশ্মীর অঞ্চলটি ফুল, ফল, লেক, নদী, পাহাড়, বরফ আর সবুজের মেলবন্ধনে এক স্বর্গোদ্যান, যেখানে মানুষের খাদ্যাভ্যাস গড়ে উঠেছে তার আবহাওয়া, শাকসবজি, মাছ-মাংসের সুলভতার ওপর; অঞ্চল অনুযায়ী প্রধানত এই ধরনের খাবারের অভ্যাসকেই বলা হয় আঞ্চলিক খাবার। সে জন্য কাশ্মীরি কুজিনে ড্রাই ফ্রুট, জাফরানের প্রচুর ব্যবহার হয়। ঠান্ডায় শরীরকে উষ্ণ রাখতে রান্নায় পর্যাপ্ত ঘি ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। এ ছাড়া বাঙালিদের মতো তারাও ব্যবহার করে সর্ষের তেল। তাদের খাবারের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, মাংস রান্নায় সবজির ব্যবহার। যেমন মাটনের সঙ্গে শালগম, চিকেনের সঙ্গে শাক, পদ্মমূল ইত্যাদি।
রমজানের পুরো এক মাসের রোজা কিংবা হিন্দুদের নবরাত্রির উপবাসই বলুন— যেখানে দেখেছি কোনো কোনো ভক্ত এই নয় দিন শুধু জল ছাড়া আর কিছু মুখে তোলেন না; অন্যদিকে রোজায় সেহরি ও ইফতারের আয়োজন থাকে। আমার মতো লোভী বা ভোজনরসিকের কাছে এটা সাংঘাতিক একটা প্রশ্ন— কীভাবে দিনের পর দিন এই বিশেষ দিনগুলোকে ঈশ্বর কিংবা আল্লাহর সঙ্গে একাত্ম হয়ে নিজেদের রসনার মতো রিপুকে সামলে তার সেবায় নিযুক্ত হয়ে মন-প্রাণ সঁপে দেন সেই আরাধনায়! চাট্টিখানি কথা নয়! যা হোক, রসনাপ্রেমিক মানুষ আমি। চলে আসি আবার খাবারের গল্পে। উপবাস ভঙ্গের পর কত ধরনের পদ যে তারা বানিয়ে থাকেন, তা ভেবে সত্যি, আমার নিজের এই অপারগতায় মাথা নুয়ে আসে। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে যখন দেখি এসব খাবারের ছবি… থাক গে এসব কথা!
এবারের সংখ্যায় কাশ্মীরি কুজিন নিয়ে লিখছি, রেসিপি শেয়ার করেছি। রান্না করুন, ভালো লাগবে নতুন স্বাদের এই ছোঁয়া পেলে।
ক্যানভাসে কাশ্মীরি কুজিন নিয়ে লিখছি, এর প্রধান কারণ, এত সমৃদ্ধ এই কুজিন হারিয়ে যাচ্ছে কালের অতলে। বিশেষ করে মোগলাই কিছু মসলাকে এমনভাবে এই কুজিনে যোগ করা হচ্ছে যে পদগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে গিয়ে ভীষণ সমস্যার সম্মুখীন হই। বুঝতে পারছিলাম না অরিজিনাল রান্নাটার চাবি কোথায়? অবশেষে একটু-আধটু পড়াশোনা করতে শুরু করি। পেয়ে যাই অনেক তথ্য, যার কিছুটা আজ ভাগ করে নেব আপনাদের সঙ্গে। খুব ইচ্ছে করে একবার চাক্ষুষ জায়গাটাকে ছুঁয়ে আসি, তার রসনার পরতে পরতে অনুভব করে আমার রান্নাঘরে নিয়ে আসি সেই অঞ্চলের কয়েক টুকরো স্বাদ। কিন্তু সেখানকার পরিস্থিতি কিছুটা হলেও আমার এই ইচ্ছেকে দমিয়ে রাখছে।
কাশ্মীরি কুজিনকে মূলত তিন ভাগে ভাগ করা হয়। কাশ্মীরি পন্ডিতদের খাবার, রাজা-মহারাজাদের খাবার এবং কাশ্মীরি মুসলমানদের খাবার। কাশ্মীরি পন্ডিতেরা মাংসভুক হলেও পেঁয়াজ ও রসুন খাবারে ব্যবহার করেন না। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রেসিপি পাল্টেছে কিছুটা। আজকাল পেঁয়াজ, রসুন একটু একটু তারাও দিতে শুরু করেছেন। তাদের খাবারে হিং এবং দই ভীষণভাবে ব্যবহৃত হয়। অনেক রান্নায় উপর-নিচ দুদিক থেকে আঁচ দিয়ে খাবারটি তৈরি করা হয়। উনিশ কিংবা কুড়ি শতকে কাশ্মীরি পন্ডিতদের বাড়িতে ওস্তাদ রাঁধুনিরা রান্না করতেন এবং গৃহিণীরাও রাঁধুনির ওপর ছিলেন নির্ভরশীল। ধীরে ধীরে এসব রান্না গৃহিণীরা রপ্ত করতে শুরু করেন এবং জিনিসের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে রাঁধুনিদের বেতন বাড়তে শুরু করলে, অনেকেই নিজের হাতে রান্নার দায়িত্ব তুলে নেন। বেশি টাকা উপার্জনে রাঁধুনিরাও বাড়ির কাজ ছেড়ে রেস্তোরাঁ, হোটেল এবং সরকারি চাকরিতে যোগ দিতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে বাড়িতে রাঁধুনি দিয়ে রান্নার চল উঠে যেতে শুরু করে। আজকাল কিছু কিছু কাশ্মীরি পন্ডিতের বিয়েবাড়িতে তাদের রান্নার উপস্থিতি টের পাওয়া যায়, তবে সেটাও ভীষণ কম।
কাশ্মীরি রাজ-রাজড়াদের খাবারকে শুধু ‘রিচুয়াল’ না বলে একটি অনুষ্ঠানরূপী খাবার বলে আখ্যা দিতে পারি; ছত্রিশ রকমের আইটেমকে একসঙ্গে যে ‘প্লেটার’ নাম দেওয়া হয়েছে, সেটা হলো ‘ওয়াজওয়ান’। ওয়াজ শব্দের অর্থ হলো শেফ এবং ওয়ান মানে দোকান, যেখানে নানা রকম রান্নার সামগ্রী পাওয়া যায়। ‘ওয়াজওয়ান’ প্লেটারে পনেরো থেকে ত্রিশ রকম থাকে শুধু মাংসের আইটেম। খাবারের স্টাইলটি হলো, চারজন করে মাটিতে কুশনের ওপর মুখোমুখি একসঙ্গে বসবে আর খাবার আসবে একটি বিশাল ধাতুর পাত্রে যাকে বলা হয় ‘ট্রামি’। একটি সুন্দর পাত্রে, কারুকার্যখচিত জগ থেকে জল ঢেলে হাত ধোয়ার যে ব্যবস্থা করা হয়, তাকে বলা হয় ‘তাশ-ত-নারি’। ধাতুর সেই পাত্রে থাকে ভাত, নানা রকম কাবাব, কোর্মা, রিস্তা, রোগান গোশত, আব গোশত, তাবাক মাজ, গুস্তাবা ইত্যাদি। দই এবং নানা রকম চাটনি ছোট ছোট মাটির পাত্রে পরিবেশন করা হয়। সমস্ত খাবার দস্তরখান বিছিয়ে তার উপর পরিবেশন করা হয় যা ওয়াজওয়ান-এর একেবারে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। বাঙালিদের মতো আঙুলের সাহায্যেই এই খাবার খাওয়ার রীতি। ‘কাহাবা’ অর্থাৎ গ্রিন টি খাবারের শেষে পান করার প্রথা রয়েছে।
এবার চলে আসি কাশ্মীরি মুসলিমদের খাবারের বিষয়ে। তৈমুরের শাসনকালে সমরকন্দ এবং মধ্য এশিয়ার কিছু ভাগ থেকে ১৫ শতকের গোড়ায় বিশেষ বিভাগে পারদর্শী প্রায় ১৭০০ ওস্তাদ কাশ্মীরে প্রবেশ করে, যেমন কারিগর, কাঠের মিস্ত্রি, ছুতোর, কার্পেট ও শাল বুননকারী, স্থপতি, সূচিশিল্পী ইত্যাদি। তাদের এই সৃজনশীলতা ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। খাবারে প্রধান হিসেবে নানা রকম মাংস তো রয়েইছে এবং অতি অবশ্যই চল রয়েছে পেঁয়াজ ও রসুনের।
কাশ্মীরি কুজিনে আদা বাটার পরিবর্তে আদা গুঁড়া, মৌরি গুঁড়া, দারুচিনি, বড় এলাচির গুঁড়া মসলা হিসেবে বিশেষত রান্নায় দেওয়া হয়। সুগন্ধিযুক্ত সরু চালের ভাত হচ্ছে তাদের প্রধান খাদ্য। এ ছাড়া নানা রকম রুটিও রয়েছে এই পছন্দের তালিকায়। ফ্রেশ মাছ দিয়েও রান্না হয় তাদের অসাধারণ কিছু পদ। ‘হাক’ বলে একধরনের শাক সারা বছর ওখানে পাওয়া যায় আর সেটা দিয়েও রান্না হয় নিরামিষ ও আমিষ পদ। আশা করি এই লেখা পড়লে কাশ্মীরি কুজিন রান্না করতে আপনাদের সুবিধে হবে। কারণ, রান্না আমরা যে অঞ্চলেরই করি না কেন, তার ইতিহাস একটু নাড়াচাড়া করলে দুটোর মিশেলে রান্না হয়ে ওঠে আরও সুস্বাদু। অথেনটিক কয়েকটি কাশ্মীরি রেসিপি শেয়ার করলাম। কম মসলা দিয়ে একটু অন্য স্টাইলে রান্না; আশা করি একঘেয়ে খাবার থেকে এর স্বাদ অন্য রকম লাগবে।
গুস্তাবা
পাঁঠার মাংস (বোনলেস, ছোট টুকরো করা) ১ কিলো, ঘি দেড় হাতা, পেঁয়াজ বাটা ১ চা-চামচ, আদা গুঁড়া ৪ চা-চামচ, মৌরি গুঁড়া দেড় চা-চামচ, দারুচিনি ২ টুকরো, বড় এলাচি ৫টা (গুঁড়া করা), নুন, টক দই ৭৫০ গ্রাম।
প্রণালি: মাংস হাতুড়ি দিয়ে ভালো করে থেঁতো করে পাল্পের মতো তৈরি করতে হবে। তাতে অল্প নুন, ১ চা-চামচ আদা গুঁড়া এবং বড় এলাচি দিয়ে ক্রমাগত থেঁতো করে মেশাতে হবে। এবার ছোট বল গড়তে হবে। মাংসের ফুটন্ত স্টকে বলগুলো দিয়ে ফোটাতে হবে যতক্ষণ না মাংস সেদ্ধ হয়। তুলে নিতে হবে স্টক থেকে। ফ্রাই প্যানে ঘি দিয়ে তাতে ভালো করে ফেটানো দই দিয়ে একদম কম আঁচে ফোটাতে হবে। রঙ লালচে হলে পর স্টকটুকু দিয়ে বাকি মসলা তাতে মেশাতে হবে। অল্প ফোটানোর পর কম আঁচে ১৫ মিনিট ফুটিয়ে নামিয়ে নিলেই তৈরি গুস্তাবা।
আব গোশত: মাটন ১ কিলো, দুধ ১ কিলো, ঘি ১ হাতা, বড় এলাচি ৫টা গোটা, পেঁয়াজ বাটা ১ টেবিল চামচ, রসুন ৪ কোয়া, মৌরি (গোটা) ৫ চা-চামচ, আদা গুঁড়া ২ চা-চামচ, দারুচিনি ৫ টুকরো, লবঙ্গ ৪টি, গোলমরিচ ১ টেবিল চামচ, নুন পরিমাণমতো।
প্রণালি: ১ লিটার জলে মাটন, মৌরি, রসুন, নুন এবং ১ চা-চামচ আদা গুঁড়া দিয়ে ফুটতে দিন যতক্ষণ না পর্যন্ত মাংস সেদ্ধ হচ্ছে। অন্য একটি কড়াইতে দুধ ও এলাচি ফুটতে দিন যতক্ষণ না তা চার ভাগের তিন ভাগ হয়ে আসছে। এবারে অন্য সব উপকরণ মেশান, ফুটতে দিন আর মাটনও মেশান। স্টক ছেঁকে কড়াইতে দিন এবং পাঁচ মিনিট ফোটান। আঁচ কমিয়ে আরও ১৫ মিনিট ফোটালেই ডিশ রেডি।
লেখক: কলকাতার হ্যাংলা হেঁশেলের সাংবাদিক
সূত্র: কাশ্মীরি রান্নার বই
ছবি: লেখক