ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন I গুণ গুঞ্জরণ
লোগোতে লুকিয়ে থাকে পরিচয়। সেখানে জৌলুশ আবশ্যক নয়। নিজস্বতার প্রকাশেই হতে পারে বোঝাপড়া
বুকের কাছে বড় আকারে কিংবা হ্যান্ডব্যাগের ক্যানভাসে জ্বলজ্বলে উপস্থিতিতে, আবার স্কার্ফ জুড়েও দীর্ঘ সময় ধরে লোগোর প্রকট প্রকাশ চোখে পড়েছে। মানুষের মনে জায়গা করে নেওয়ার প্রয়াসে ব্র্যান্ডিংয়ের এই ধারা হয়ে উঠেছিল মূল চাবিকাঠি। যুগ পাল্টাচ্ছে; চিৎকারে নয়, চুপিসারে গ্রাহকের মনে জায়গা নিতে পারলে ব্র্যান্ড হিসেবে মেলে সফলতা। বর্তমানে ব্র্যান্ডিংয়ে আর বিশালাকার লোগো নয়, একদম নিশ্চুপ আবেদনে নিজের নামের একটি অংশ জুড়ে দিতে পারলেই ব্যস!
মিনিমালিজম, ব্যক্তিগত অভ্যাস ও কারুশিল্পের অভ্যুত্থান বদলে দিচ্ছে ফ্যাশন-সংশ্লিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি। ফ্যাশনের নতুন কারেন্সি আসলে মিনিমালিজমের আভিজাত্য। উদাহরণ হতে পারেন ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ কিংবা বিলিয়নিয়ার ওয়ারেন বাফেট। ব্র্যান্ডের সবকিছু ওভার দ্য টপ যাওয়ার মূলনীতি ভেঙে দিয়ে গড়েছেন লেস ইজ মোরের প্রতিপাদ্য। বিশাল জায়গা জুড়ে থাকতে হবে, এমন কিছু নয়; বরং লোগো মানে ছোট একটি চিহ্ন, যা ব্র্যান্ডের সিগনেচার হিসেবে উপস্থিত। ট্রেন্ড এখন ‘ইফ ইউ নো, ইউ নো’। যদি ফ্যাশন-সচেতন হিসেবে আপনি লোগো কিংবা প্রতীকীর মর্ম বুঝতে না পারেন, তাহলে সেই মাথাব্যথা একান্তই নিজস্ব—এই স্লোগান যেন চুপিসারে জানিয়ে দিচ্ছে ব্র্যান্ডগুলো।
ক্রেতাদের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে ব্র্যান্ড নিয়ে আলোচনার ধরন। শুধু দামি বা লোগোখচিত পোশাক নয়, ক্রেতারা যে কাপড় পরছেন, তার পেছনের গল্প, তাতে জড়ানো সামাজিক দায়িত্ব নিয়েও ভাবছেন তারা। বিলাসিতা নয়, তাদের পছন্দের ব্র্যান্ডের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে কোনো মহৎ আন্দোলন বা চিন্তাধারা, লোগো গায়ে জড়ানোর আগে সে বিষয়েও ভাবেন ক্রেতারা। জেন-জিদের পোশাক বলে দেয়, কোন আন্দোলন বা উদ্দেশ্যের সঙ্গে তারা জড়িত। কালজয়ী কিছুর অংশ হওয়াই তাদের এই মানসিকতার মূল বলে জানা যায়।
একসময়ের একচেটিয়া ফ্যাশন বলতে ছিল শুধু লোগোর খেলা। লোগো উপস্থিত থাকা মানে আভিজাত্য, অহংকার, মর্যাদা ও আর্থিক অবস্থার প্রদর্শনী। সেই জায়গায় এসেছে বদল। মিলেনিয়াল ও জেন-জিরা নিজেদের আদর্শ ও মতাদর্শ নিয়ে কথা বলতে আগ্রহী। লোগো শো অফ করা এখন আর ট্রেন্ডি নয়। নিজেদের তুলে ধরতে তারা অনেকের মধ্যে এক নয়; বরং হয়ে যেতে চান অনেকেরই একজন। ব্র্যান্ডগুলোও এই চিন্তাধারাকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছে। তাই আগের মতো বিশালাকার নয়; বরং পোশাকের এক কোণে খুব সুনিপুণভাবে লোগো বসানোর কাজ করছে সন্তর্পণে। প্রচারের জন্য কোনো মনোগ্রাম নয়; প্রয়োজন বুদ্ধিদীপ্ত মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজির। এই কৌশল মেনে নিয়েই ব্র্যান্ডিং করছে ফ্যাশন বিশ্ব।
ছোট-বড় প্রতিটি ব্র্যান্ডেরই এখন নিজস্ব প্রতিপাদ্য থাকে; যার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি, বিজ্ঞাপন, ইনফ্লুয়েন্সার ও ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর বাছাইকরণ। লোগো শুধু একটি ব্র্যান্ডের পরিচয় নয়; জোরেশোরে জানান দেয় এই তথ্যগুলোও। তাই জটিল নয়; বরং নান্দনিক ও বোধগম্য হওয়া চাই লোগো, এমন পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। কেননা, দুর্বোধ্য কোনো লোগোর অর্থ বুঝতে বুঝতেই যদি বেলা পেরিয়ে যায়; তবে লোকে জানবে কী করে লোগোটির পেছনে থাকা মর্মার্থ? সূক্ষ্মভাবে ব্র্যান্ডের এই বিজ্ঞাপন কোনো সাময়িক কর্মকৌশল নয়; বরং দূরদর্শী চিন্তাভাবনার ফসল।
লোগোনির্ভর বিলাসবহুল ব্র্যান্ডগুলো নিজেদের ভেঙেচুরে পুনর্গঠন করছে। লুই ভিতোঁ তাদের সমসাময়িক পণ্যে আরও বেশি মিনিমালিজম দেখানোর চেষ্টা করছে। লোগোতে অতি চাকচিক্য ভাব এড়িয়ে আরও শৈল্পিক অথচ সাধারণ ভাব ধরে রাখার প্রয়াস ব্র্যান্ডটির। গুচির ক্রিয়েটিভ ডিরেকশনে এসেছে আরও বেশি মিনিমালিজম। বারবেরি চেক যেখানে ছিল বিশ্বজুড়ে ফ্যাশনিস্তাদের নিজেদের তুলে ধরার মোক্ষম হাতিয়ার, সেখানে ব্র্যান্ডটি চেক প্যাটার্নের ঘনত্ব কমিয়ে আরও বেশি সহজ হওয়ার চেষ্টা করছে। লোয়ের নরম ড্রেপড লোগো এবং জ্যাকেমুসের মিনিমাল জে-লুপ এমব্লেম প্রমাণ করেছে, পোশাকের আকারের সঙ্গে মিশে আধুনিক ব্র্যান্ডিং কীভাবে একধরনের শিল্পে পরিণত হতে পারে। বোটেগা ভেনেটার ইনত্রেচাতো উইভেন প্যাটার্ন কোনো কিছু না লিখেই এখন বিশ্বজুড়ে চেনা একটি নাম। ডিজাইনার হাউসগুলোর এই সংযমী আচরণ সত্যিই বাহবা পাওয়ার যোগ্য।
বর্তমানে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিজুড়ে চলছে মৌন বিপ্লব। ফ্যাশনবোদ্ধাদের কাছে চোখে পড়া লোগোর চেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে অদৃশ্য লোগো। অবাস্তব শোনালেও ব্যাপারটা সত্যি। হলিউড থেকে কোরিয়ান এন্টারটেইনমেন্ট, বলিউড থেকে গ্লোবাল মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি—সবখানেই তারকারা এই স্টাইলের চর্চা করছেন। রেড কার্পেটে কেন্ডাল জেনার বা জেন্ডায়ার মতো তারকারা বেছে নিচ্ছেন এক রঙের সিম্পল ছাঁটের পোশাক। লোগো নয়; বরং আভিজাত্যকে প্রাধান্য দেওয়া তাদের উদ্দেশ্য। কোরিয়ান আইডল ও অভিনেতারাও এই ধারার অনুসারী।
বিটিএস কিংবা ব্ল্যাকপিংকের তারকারা লোগোকে হাইলাইট না করেই বনে যাচ্ছেন ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর। বলিউডেও দেখা যাচ্ছে একই ট্রেন্ড। দীপিকা পাড়ুকোন, আলিয়া ভাট, এমনকি পুরুষ তারকাদের মধ্যে রণবীর কাপুরও পরছেন এমন পোশাক, যেখানে কোনো ব্র্যান্ডের লোগো নয়, বরং স্টাইলই কথা বলে। তাদের অফ-ডিউটি লুক, এয়ারপোর্ট ফ্যাশন ও মিডিয়া ইভেন্টগুলোতে বারবার দেখা যায় লাইন ওয়ার্ক, ক্ল্যাসিক রং আর ন্যূনতম ব্র্যান্ডিং। সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাবও এখানে বড় ভূমিকা রাখছে। ইনফ্লুয়েন্সার ও সেলিব্রিটিরা এমন লুক পোস্ট করেন, যা মানুষ অনুকরণ করতে চায়। গেটকিপিং দূরে রেখে ফ্যাশন-সচেতনতাই এখানে মূল লক্ষ্য। বিলাসী, লোকদেখানো মনোভাব নয়; ফ্যাশন থাকুক সর্বসাধারণের নাগালে—হালের সেলিব্রিটিরা হাঁটছেন সে পথে।
ফ্যাশন কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়; বরং সাকল্যে নতুনকে গ্রহণ করার চেষ্টা। নিজের আভিজাত্য ফুটিয়ে তুলতে প্রয়োজন ব্যক্তিসত্তার সঙ্গে ব্র্যান্ডের মূলনীতিগুলোর মেলবন্ধন। প্রতিটি সুতার বুননে, প্রতিটি কাপড়ের পরতে পরতে যাদের ঘাম ও শ্রমে দাঁড়িয়ে আছে ব্র্যান্ডের লোগো, তাদের নিয়েও আজ সময়টা গর্ব করার। লোগোর বিলাসবহুল বিবরণের সময় গত হয়েছে। একাত্মতা প্রকাশ করতে না পারলে গ্রাহকের মনে নিজের জায়গা মেলানো ভার এখন। চাইল্ড লেবার, অ্যানিমেল ক্রুয়েলটি থেকে সরে এসে সময় এখন রিসাইকেলের মাধ্যমে পুরোনোকে নতুন করার। যেসব ব্র্যান্ড তাদের গোঁড়ামি দূর করতে পেরেছে, ভক্তদের মনে সেগুলো ঠাঁই করে নিয়েছে সগৌরবে। আজকের ফ্যাশনে গ্রাহকদের আত্মবিশ্বাস, ব্যক্তিত্ব আর ব্র্যান্ডের পরিচয়ে সেতুবন্ধন সৃষ্টি গুরুত্বপূর্ণ। এখানে বন্ধনটাই সব।
বিদিশা শরাফ
ছবি: ইন্টারনেট
