কভারস্টোরি I ফ্যাশন ফোরকাস্ট
বিশ্ব ফ্যাশনের ট্রেন্ড রিপোর্ট, কালার ফোরকাস্ট, রানওয়ে অ্যানালাইসিস—সবই হাতের মুঠোয়। কিন্তু প্রশ্ন যখন বাংলাদেশের ফ্যাশন বাজার নিয়ে, তার উত্তর পাওয়া খুব সহজ নয়। এই শূন্যস্থান পূরণের লক্ষ্যে নতুন বছরের ফ্যাশন ফোরকাস্ট আয়োজন। অংশ নিয়েছেন দেশের ফ্যাশন বাজারের কয়েকজন স্বপ্নবাজ মানুষ। বিশদ সারাহ্ দীনার বয়ানে
কেমন হবে বাংলাদেশের এ বছরের ফ্যাশন বাজার, তা জানার আগ্রহ অনেকের। অন্তর্জালে সহজে পাওয়া যায় বিশ্ব ফ্যাশনের ভবিষ্যৎ; কিন্তু আমাদের দেশের বাজারে পূর্ণাঙ্গ তথ্য মেলে না। তাই ক্যানভাস প্রথমবারের মতো আয়োজন করেছে ফ্যাশন ফোরকাস্ট। দেশের গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাশন উদ্যোক্তা ও ডিজাইনারদের নিয়ে। সঞ্চালনা করেছেন সিনিয়র ফ্যাশন সাংবাদিক ও টেক্সটাইল হেরিটেজ এক্সপার্ট শেখ সাইফুর রহমান। গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন লিপি খন্দকার, নকশাকার ও স্বত্বাধিকারী, বিবিআনা; সৈয়দ মেহেদী হাসান, সিনিয়র ডিজাইনার, এসকেডি ডিপার্টমেন্ট, ডিজাইন স্টুডিও, আড়ং; বি. এম. সম্রাট খান, ডেপুটি ম্যানেজার (ব্র্যান্ডিং অ্যান্ড ই-কমার্স), টপ টেন গ্রুপ; রাকিব বাবু, ক্রিয়েটিভ অ্যান্ড ফ্যাশন ডিজাইনার, টপ টেন গ্রুপ; মো. নাজমুল ইসলাম, ব্র্যান্ড মার্কেটিং অ্যান্ড পার্টনারশিপ ম্যানেজমেন্ট, ক্লোদেন; তানহা শেখ, উদ্যোক্তা ও ডিজাইনার, তান; ইমাম হাসান, উদ্যোক্তা ও ডিজাইনার, লেবেল ইমাম হাসান এবং হোসনে নুজহাত, এক্সিকিউটিভ এডিটর, ক্যানভাস। এ ছাড়া অন্তর্জালের আশীর্বাদে দূরে থেকেও সঙ্গে ছিলেন চন্দনা দেওয়ান, উদ্যোক্তা ও ডিজাইনার, চন্দন; সাবেরা আনোয়ার, ফাউন্ডার, গোদেশী; আসাদ সাত্তার, ফাউন্ডার, আর্কা ফ্যাশন উইক, ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর, আমি ঢাকা এবং মেহরুজ মুনির, কর্ণধার, জুরহেম।
কেন্দ্রে উৎসব নাকি অন্য কিছু
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ফ্যাশন বাজারের যাত্রা শুরু স্বাধীন হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যে। তখন থেকে এখন, নানা পরিবর্তনের সাক্ষী এই ইন্ডাস্ট্রি। ট্রেন্ডের বদলও এর অন্যতম। ঋতুর পরিবর্তনকে ফ্যাশন বিশ্ব যতটা ধারণ করে, আমাদের দেশে সেই চিত্র ততটা প্রবল নয়; বরং এখানে দাপট উৎসবের। ফ্যাশন ক্যালেন্ডার তৈরিতে উৎসব শুরু থেকেই মসনদে। সেখানে ইতিবাচক পরিবর্তন আসি আসি করছে বলে জানা যায় ফ্যাশন বোদ্ধাদের আলাপে। বাড়ছে ট্রাভেল ওয়্যার ও জিম ওয়্যারের চাহিদা। ভ্রমণের পোশাকের চাহিদা ঢাকায় বেশি; তবে জিম ওয়্যার পুরো দেশের শহরাঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এতে ফেস্টিভ শপিং কমছে; তা কিন্তু নয়। বলা যায়, ক্রেতা চাহিদা কলেবরে বাড়ছে। যাপিত জীবনের চাহিদা সেখানে প্রভাব ফেলছে, বলা বাহুল্য। মিলেনিয়ালের পাশাপাশি জেনারেশন জেড ও আলফার প্রবেশ ঘটেছে কাস্টমার সেগমেন্টে। আবার, জেনারেশন এক্সও হারিয়ে যায়নি; বায়িং ক্যাপাবিলিটির বড় অংশ এখনো তাদের কাছে। একই সঙ্গে তারা ফ্যাশন-সচেতনও বটে। ফিফটি ইজ দ্য নিউ ফোরটি তাদেরই ফিলোসফি। বাজারের হিসাব-নিকাশে তাই বেশ পরিবর্তন এসেছে। বেড়েছে স্বাস্থ্যসচেতনতা। প্রতিদিন খানিকক্ষণ হেঁটে বেড়ানো এখন ডাক্তারের দেওয়া পথ্যের মতোই। মুখ ঘুরিয়ে নেওয়ার সুযোগ নেই। আবার, জিমকেন্দ্রিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায়ও দারুণ মনোযোগী হচ্ছেন অনেকে। সেখানে জেনারেশন এক্স যেমন দেখা যাচ্ছে, জেনারেশন জেডের উপস্থিতিও। এই সেগমেন্ট তাই ব্র্যান্ডের প্রোডাক্ট লাইনকে সমৃদ্ধ করছে বারো মাস।
আরও জানা গেল, মানুষ বিভিন্ন উপলক্ষ নিয়ে ভাবছে। এমনকি বাদ যাচ্ছে না শোকসভার পোশাকও। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জনপ্রিয়তা এখানে শক্তিশালী ভূমিকা রাখছে। পুরো বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়, যেখানে তাদের সামনে ফ্যাশন বিশ্বের দ্বার উন্মুক্ত। তারা শুধু আনন্দের সময় ভেবেচিন্তে পোশাক পরে, তা নয়। আবেগকে প্রাধান্য দিয়ে যতটা দরকারি, ততটাতে ‘হ্যাঁ’ বলতে শিখেছে। কোনো কিছুর একচেটিয়া রাজত্ব নেই; বরং সবই ইন ট্রেন্ড। তাই ফ্যাশন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে এবার উৎসবকেন্দ্রিকতার বাইরেও বাজার থাকবে। শীতের আগমনে ভারী পোশাক নয় শুধু; জীবনযাপনের নানা অধ্যায়ের ইশারায় কেনাকাটা চলবে; বাজার হারাবে না। বৈচিত্র্য আঁকড়ে ধরে কলেবরে বাড়বে।
রং নাকি বেরং
ফ্যাশন ফোরকাস্টের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কালার প্যালেট। হোক সেটি বৈশ্বিক ফ্যাশন অথবা অভ্যন্তরীণ বাজারের গল্প। প্যান্টন এবার কালার অব দ্য ইয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে ক্লাউড ড্যান্সার; যা মূলত প্যালেটের অতি গুরুত্বপূর্ণ রং সাদার একটি শেড। আমাদের এখানে কেমন রং থাকতে পারে, আলোচনায় তা নিয়ে মতামত জানিয়েছেন ফ্যাশন বোদ্ধারা। তবে শুধু একটি রং নির্ধারণ করা হয়নি; বরং খুঁজে নেওয়া হয়েছে কোন শেডগুলো দাপিয়ে বেড়াবে বছরজুড়ে। প্রকৃতিপ্রাণিত রং ভোট পেয়েছে বেশি। এর পেছনে ধরণীকে জেনারেশন জেডের ভালোবাসার গল্পই মুখ্য বলে বিবেচিত হয়েছে বেশির ভাগের বয়ানে। তবে এই ভালোবাসার পেছনের যুক্তিরও প্রকাশ ঘটেছে। এ ধরনের রং পাওয়া যায় প্রকৃতিতে। রাসায়নিক উপাদান কম ব্যবহার করতে হয়, তাই পরিবেশের ক্ষতি কিছুটা কম। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ফ্যাশন বাজার শুধু বছর কয়েক ধরে এ ধরনের রং নিয়ে কাজ করছে, তা নয়। প্রথম প্রজন্মের ফ্যাশন হাউসগুলোর প্রোডাক্ট লাইনে কালার হিসেবে এমন রং অনেক আগে থেকে দেখা যায়। কিন্তু বিশ্বায়নের প্রভাব তেমন প্রবল না হওয়ায় আগে এত আলোচনায় আসেনি। জানা গেল, কাছাকাছি ও আবেগঘন রং প্রাধান্য পাবে এ বছর। আর্দি নিউট্রাল, গ্রে, ডিপ ব্রাউন, চারকোল, রাস্ট আর স্ট্রমি ব্লু, সেইজ গ্রিন, অফ হোয়াইট; সঙ্গে আরও থাকবে মিউটেড গোল্ড বা সবুজের শেড। রংগুলো হবে প্রশান্তির বোধ ছড়ানোর; দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য নয়।
ছয় ঋতুর এ দেশে ইদানীং বছরের বেশির ভাগ সময় জুড়ে থাকে গরমের দাপট। তাই ক্যালেন্ডার গুনে মোটামুটি ছয় মাস সামার ফ্যাশনকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ চলে দেশীয় ফ্যাশন বাজারে। চলতি বছর এ সময়ে নারী ও পুরুষ—উভয় দলের পোশাকের ক্ষেত্রে হালকা রঙের চাহিদা থাকবে বলে মত পাওয়া গেছে। পুরোপুরি চিরায়ত পোশাক নিয়ে কাজ করেন যারা, তাদের পোশাকে রং আসবে ঋতুকে প্রাধান্য দিয়ে। সেখানে ফাল্গুন আর বৈশাখ ছাড়াও প্রাধান্য পাবে দেশের বাকি সব সময়কাল। প্রয়োজনমতো রং নির্বাচন হবে। গ্রীষ্মে উজ্জ্বল, শরতে শান্ত আর শীতে দারুণ গাঢ়—এমন পূর্বাভাস জানালেন ট্র্যাডিশনাল ব্র্যান্ড ডিজাইনাররা।
প্রিন্ট ও সারফেস ট্রেন্ড
মিনিমাল নাকি ম্যাক্সিমাল? মোটেই নতুন প্রশ্ন নয়; কিন্তু চলতি বছরেও প্রাসঙ্গিক। বোদ্ধাদের মতে, এবার সলিড কালারে মন মজবে ক্রেতাদের। টেক্সচার পাবে গুরুত্ব। অর্থাৎ পাল্লা ভারী মিনিমালের দিকে। তাহলে প্রিন্টের কী হবে? ভোজবাজির মতো মিলিয়ে যাবে? না, তা নয়। যতটা থাকবে, তাতে ভিন্টেজ প্রিন্ট গুরুত্ব পেতে পারে। গেল শতকের আশি থেকে নব্বইয়ের দশক, এই সময়কালে প্রিন্টগুলো প্রাসঙ্গিক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। জ্যামিতিক মোটিফের সঙ্গে পরিচয় পুরোনো। কিন্তু চলতি বছর এই জিওমেট্রিই ফিরবে আধুনিকতা সঙ্গে নিয়ে। সে কেমন? হাই-স্টেনসিল থ্রিডি প্রিন্ট থাকবে দারুণ আলোচনায়। যার আভাস এরই মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে কয়েকটি ব্র্যান্ডের কাজে।
ফ্যাব্রিক
ফাস্ট ফ্যাশন নিয়ে অভ্যন্তরীণ ফ্যাশন বাজারের অবস্থান সব সময় বেশ শক্ত। জানা যায়, প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি ফ্যাব্রিক পাবে অধিক গুরুত্ব। ঐতিহ্য রক্ষায় আরও বেশি সচেতন হবে ডিজাইনার সমাজ। ক্রেতারাও স্বাগত জানাবেন বলে ধারণা করা যায়। কারণ, বর্তমান সময়ের ক্রেতাদের মধ্যে অন্তত তিনটি প্রজন্ম স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিষয়ে সংবেদনশীল। মিলেনিয়াল, জেনারেশন জেড ও আলফা—এই তিনের চাহিদা পাশ কাটিয়ে ফ্যাশন বিশ্ব চিন্তা করা যায় না। এদের মধ্যে মিলেনিয়াল আর জেন-জিদের পারচেজিং পাওয়ার ইতিমধ্যে তৈরি হওয়ায় তাদের চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা করবে ফ্যাশন দুনিয়া। আমাদের দেশের আবহাওয়া এখন বেশির ভাগ সময় উষ্ণ থাকে, তাই হালকা ফ্যাব্রিকই রাজত্ব করবে বলা চলে। চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলবে ফ্যাশন লেবেলগুলো। র সিল্ক, লিনেন, ওয়াশড কটন, লাইট উল থাকতে পারে চাহিদার শীর্ষে।
সিলুয়েট ও গার্মেন্টস স্ট্রাকচার
স্ট্রাকচারড, ওভারসাইজড নাকি মাল্টি ওয়ে? ফোরকাস্ট কী বলে? ফ্যাশন বোদ্ধাদের মতে, এবার কোনো কিছুতেই ‘না’ শোনা যাবে না তেমন। সবই থাকবে ট্রেন্ডে। কারণ, ক্রেতাদের কাছে এখন নিজস্বতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কোনো ছকে বাঁধা ফ্যাশন তাদের পছন্দ নয়। সিলুয়েট ওভারসাইজড হওয়ার সম্ভাবনা অনেক। মেল ফ্যাশনে প্যান্টের ক্ষেত্রে বুট কাট থেকে স্ট্রেইট কাট—সবই চলতে পারে। জেন্ডার ফ্লুইডিটি আরও বিস্তৃত হতে পারে। জেনারেশন জেড এ ক্ষেত্রে কৃতিত্ব পাবে অনেকটাই। কারণ, ফ্যাশন যে সবার ক্ষেত্রে একই রকম হতে পারে, সেই ধারণা নিয়ে তাদের দৃপ্ত পদক্ষেপ বেশি। আগের মতো যেকোনো একটি ট্রেন্ডে আটকে না থাকার পেছনে দেশের আর্থিক অবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটি পোশাক মাত্র এক সিজনে ব্যবহারের ইচ্ছা থেকে বেরিয়ে এসেছে মানুষ। তাই মডুলার ফ্যাশন পাচ্ছে গুরুত্ব। ফ্লিপ স্টাইলের পোশাক কিনতে মানুষের আগ্রহের পেছনে একটি পোশাক একাধিকভাবে পরার চেষ্টা মুখ্য। আবার, গেল শতকের আশির দশক থেকে চলতি শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত যেভাবে ফিটিং থেকে লুজ ফিটিং, শর্ট কামিজ থেকে লং কামিজের যাত্রা দেখা গেছে, সেভাবে কোনো ট্রেন্ড এ বছর পুরোটা হয়তো দখল করতে পারবে না। এর পেছনে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা, আবহাওয়া ও জীবনযাপনের ধরন—সবই কাজ করছে। কর্মব্যস্ততা বেড়েছে বহুগুণে, প্রযুক্তি বিশ্বকে পৌঁছে দিয়েছে স্ক্রিনে; আবার, পোশাকের দামের সঙ্গে আয়ের সামঞ্জস্য করতেও বেগ পেতে হচ্ছে অনেককে। তাই টাকার মানের যথাযথ ব্যবহার নিয়ে ভাবতে বসছেন ক্রেতা। আবেগ নয়; গুরুত্ব পাচ্ছে বাস্তবতা। তাই ওভারসাইজড ও মাল্টি ফাংশনাল এবার দারুণভাবে ইন! কেয়ারফুলি কেয়ারলেসই এবারে কুল ফ্যাশন। অ্যাসিমেট্রিক্যাল ও ডায়াগোনাল প্যাটার্নের পোশাক তৈরির পেছনে আরও একটি কার্যকরী কারণ হিসেবে সক্রিয় থাকতে পারে ফ্যাব্রিক ওয়েস্ট কমানোর প্রয়াস। আরও জানা যায়, দিন দিন স্মল সাইজের পোশাকের চাহিদা কমছে। এক্সেল সাইজের বাড়বাড়ন্ত। এই পরিবর্তন কতটা স্বাস্থ্যসম্মত, তা-ও ভাবনার বিষয়। বিশ্বজুড়ে বাড়ছে ওবেসিটি। তার প্রভাব ফ্যাশনে পড়বে, সে তো সহজবোধ্য।
ডেইলি বনাম অকেশন ওয়্যার
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ফ্যাশন বাজারের বয়স পঞ্চাশের বেশি। শুরু থেকে উৎসবকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ চলছে। পয়লা ফাল্গুন, পয়লা বৈশাখ, জাতীয় দিবসসমূহ, দুই ঈদ ও পূজা—সারা বছরে এসব ঘিরে কাজ করেছে বেশির ভাগ ব্র্যান্ড। ক্রেতারাও আগ্রহী হয়েছেন সেই মন্ত্র মেনে। এবারও কি একই রেখায় হাঁটবে দেশ, নাকি আসবে পরিবর্তন? আলোচনায় জানা গেল, এবারের দৃশ্যপটে উৎসব থাকলেও ম্লান হবে না ডেইলি ওয়্যার। যেহেতু মানুষের দৈনন্দিন কাজের চাহিদায় ঘরের বাইরে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে, তাই সেভাবে ওয়্যারড্রোব গোছানোর চাহিদা বাড়তে পারে। যার আভাস পাওয়া যাচ্ছে ইতিমধ্যে। রসদ জুগিয়েছে বিভিন্ন গবেষণা; যা বাস্তবসম্মত হয়েছে রিটার্ন অব ইনভেস্টমেন্টের হিসাব মিলিয়ে। জেনারেশন জেড এবং জেনারেশন আলফাকে গুরুত্ব দিয়ে ডেইলি ওয়্যারে কাজ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আবার, সাসটেইনেবল ডিজাইনারদের মাঝেও দেখা যাচ্ছে লং লাইফ স্প্যানের কাপড় তৈরির প্রয়াস। গুরুত্ব পেতে পারে নাইন টু নাইন পোশাক। অর্থাৎ যা পরে সকাল নয়টায় অফিসে যাওয়া সম্ভব, তেমনি অফিস ফেরত দাওয়াতে রাত নয়টায়ও মানিয়ে যায়। এককথায়, মাল্টি পারপাস ক্লোদিং পাবে গুরুত্ব।
ভোক্তার মানসিক পরিবর্তন
বিশ্ব ফ্যাশনের প্রভাব আমাদের দেশের বাজারে যথেষ্ট বলে মত ফ্যাশন বোদ্ধাদের। বর্তমানে জেনারেশন জেড এই যাত্রায় অগ্রগণ্য। তারা টেকসই তত্ত্ব নিয়ে যেমন ভাবছেন, তেমন দাঁড়াচ্ছেন ফাস্ট ফ্যাশনের বিপরীতে; যা বুঝেশুনে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে বেশির ভাগ ফ্যাশন লিডার। তবে এর বাইরে ট্র্যাডিশনাল বায়িংয়ের মনোভাবও টিকে আছে। কোনো উপলক্ষ ঘিরে যেসব ক্রেতা কেনাকাটা সম্পন্ন করেন, তাদের বেশির ভাগই শুধু কোন আয়োজনে পোশাকটি পরবেন, সে বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়ার চর্চা করে এসেছেন এবং এখনো তা ধরে রেখেছেন; যা হুট করে পরিবর্তন হওয়ার নয়। ক্যাপসুল কালেকশনের প্রয়াসে হয়তো পরিবর্তন আসবে। ইতিমধ্যে এ দেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি যেমনটার সাক্ষী হয়েছে। ক্রেতারা ভালোবাসা দিবস, বন্ধু দিবস, মা দিবস, বাবা দিবস, নারী দিবসের মতো ছোট ছোট কালেকশনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। এসব দিবস ঘিরে এখন বিশেষ কালেকশন নিয়ে আসে বেশির ভাগ ব্র্যান্ড। চলতি বছরেও এমন নতুন কিছু কালেকশনে আগ্রহ তৈরি হবে বলে আশা প্রকাশ করেন ক্যানভাসের গোলটেবিলে অংশগ্রহণকারীরা। আবার জেন্ডার নিউট্রাল পোশাকের চাহিদাও বাড়বে বলে মনে করেন তারা।
ক্র্যাফট বনাম ডিজিটাল ডিজাইন
হাতের কাজ, ঐতিহ্যবাহী মোটিফ, ডিজিটাল প্রিন্ট আর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সে তৈরি ডিজাইন বা ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রসেস ২০২৬ সালে সহাবস্থান করবে বলে মনে করেন ফ্যাশন বোদ্ধারা। পোশাক নকশার ক্ষেত্রে থ্রিডি মডিউল ডিজাইনের মাধ্যমে বাস্তবসম্মত ডিজাইনিং সম্ভব—জানান তরুণ ডিজাইনাররা। একই সঙ্গে সাপ্লাই চেইনকে এটি সহজ করে সময় বাঁচায়। ফলে ডিজাইনাররা খানিকটা বিশ্রামের সুযোগ পান। তবে শুধু আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সে এই কর্মযজ্ঞ নিখুঁতভাবে সম্পন্ন হবে বলে তারা মনে করেন না; বরং সহায়ক হিসেবে কার্যকরী থাকবে বছরজুড়ে।
ফ্যাশন ক্রিয়েটিভ, ব্র্যান্ড অ্যান্ড মার্কেটিংয়ে অভিজ্ঞ অতিথিরা বলছেন, মার্কেটিংয়ের ক্ষেত্রে ক্রেতার কাছে খবর পৌঁছে দেওয়া আরও সহজ হয়েছে এআইয়ের কল্যাণে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যালগরিদম সমসাময়িক নির্দিষ্ট সম্ভাব্য ক্রেতার কাছে পণ্য পৌঁছে দিতে সহায়তা করে। তারা বলেন, বাজারে পোশাক পৌঁছে দেওয়ার আগে ক্রেতার মনোযোগ আকর্ষণের জন্য ফটোশুট করা হয়। সেখানে মডেলরা পোশাকটিকে ক্রেতার পরনে কেমন লাগবে, সে বিষয়ে ধারণা দেন। কিন্তু গত দুই বছর বাংলাদেশের বাজারে এআই মডেলদের ব্যবহার করে এই কর্মযজ্ঞ সহজে সম্পাদনের চেষ্টা দেখা গেছে। যদিও তা শুরুর দিকে ক্রেতা আকর্ষণে তেমন সফল হতে পারেনি; তাই বলে এই পদ্ধতি হারিয়ে যায়নি; বরং এ ক্ষেত্রে ছোট ছোট প্রজেক্ট সম্পন্ন করতে নতুন ব্র্যান্ডগুলো আরও আগ্রহী হচ্ছে। এতে সময় ও মূল্য—দুই-ই সাশ্রয় হবে বলে মনে করছেন বাজার বোদ্ধারা। কিন্তু এবারও ক্রেতার কাছে কতটা গ্রহণযোগ্যতা পাবে, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে পুরো বছর।
মার্কেট গ্যাপ
আলোচনায় বারবার উঠে এসেছে ফ্যাশন বাজারের উৎসবকেন্দ্রিকতা। তাই শেষের আগেও সেখানে মনোযোগ দিতে হচ্ছে আরেকবার। এ বছর পয়লা ফাল্গুন, ভালোবাসা দিবসের পরই শুরু হবে রোজার মাস। সে সময় ঈদের পোশাক নিয়েই ভাববেন ক্রেতা। এর কিছুদিন পরই পয়লা বৈশাখ। পরের মাসে কোরবানির আয়োজন। যা শেষ হচ্ছে মে মাসে। এরপর জুন থেকে নভেম্বর দেশে পূজা ছাড়া বড় কোনো উৎসব নেই। এ সময় ব্র্যান্ডগুলো কীভাবে নিজেদের সাজাবে, সে বিষয়ে জানা গেল গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য। লাইফস্টাইল ফোকাসে রেখে পরিকল্পনা করার বিষয়ে ভাবছে ফ্যাশন বাজার। স্বাস্থ্যসচেতনদের জন্য অ্যাথলাইজার পোশাক, জেনারেশন আলফার জন্য পোশাক, করপোরেট লাক্সারি লাইন, লাউঞ্জ ওয়্যার প্রাসঙ্গিক থাকতে পারে।
ফ্যাশন বাজার কেমন হতে পারে, অল্প কথায় তা জানতে চাওয়া হলে নিজস্ব মতামত জানিয়েছেন উপস্থিত ফ্যাশন ডিজাইনাররা। এখান থেকে উঠে আসে নির্দিষ্ট কিছু ফ্যাশন ফ্যাক্ট, যেগুলো এ বছর বাজারে প্রতিনিধিত্ব করবে—এথনিক, ক্ল্যাসিক, ট্রেন্ডি, মিনিমালিজম, ভিন্টেজ, ন্যাচার ও বেসিক সিলুয়েট।
মডেল: নিকি ফাহ্মিয়া মিজান
মেকওভার: পারসোনা
আইডিয়েশন ও স্টাইলিং: নুজহাত খান
ওয়্যারড্রোব: তান বাই তানহা শেখ
ছবি: জিয়া উদ্দীন
