ইভেন্ট I দেশি বুননের গল্প
পৌষের কাছাকাছি রোদমাখা দিন স্মরণের প্রয়াসে ১৩ ডিসেম্বর গুলশান সোসাইটি ও ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশের (এফডিসিবি) যৌথ আয়োজনে এবং মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সৌজন্যে উদ্যাপিত হলো ‘পৌষ উৎসব’। গুলশান সোসাইটি পার্কে এই লোকজ আমেজে দেশীয় ফ্যাশন শো আয়োজন করা হয়েছিল।
বাংলা সংস্কৃতি ও গ্রামবাংলার ঐতিহ্যকে নগর জীবনে নতুনভাবে উপস্থাপন করা ছিল উৎসবের মূল লক্ষ্য। সকালে শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় উদ্বোধনী নৃত্য পরিবেশনার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক সূচনা। এরপর বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আয়োজনে মুখর হয় প্রাঙ্গণ। অন্যতম আকর্ষণ ছিল এফডিসিবির ফ্যাশন শো। সংগঠনের সভাপতি মাহিন খান বলেন, ‘পৌষ উৎসব নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা অনেক দিনের। এটি বাংলার উৎসবমুখর সময়। গ্রামগঞ্জে নানা আনুষ্ঠানিকতা হয়। গ্রামে গ্রামে মেলা চলে আনন্দমুখর পরিবেশে। সেই অনুপ্রেরণায় আমরা ঢাকায় পৌষ উৎসব আয়োজন করেছি।’
ফ্যাশন শো পর্বে দেখা মেলে দেশের সৃজনশীল ডিজাইনারদের কালেকশন। টাঙ্গাইল শাড়ির আভিজাত্য, মসলিনের মাধুর্য, রেশমের কোমলতা, শিবুড়ির নিবিড় নকশা—সবই ছিল সেখানে। একেকজন বেছে নিয়েছিলেন একেকটি থিম। কেউ ফুল ব্যবহার করেছিলেন মোটিফ হিসেবে; কেউ বেছে নিয়েছিলেন শব্দের বুনন। দেশি ফ্যাশনের এমন উপস্থাপনা দর্শকদের কাছে ছিল উপভোগ্য। ডিজাইনার শৈবাল সাহা বলেন, ‘নতুন ধান কাটার পর গ্রামবাংলায় যে পিঠাপুলির উৎসব হয়, শহরের যান্ত্রিক জীবনে সেই আমেজ আমরা অনেকটাই ভুলতে বসেছি। গ্রামবাংলার সেই উৎসবমুখর পরিবেশ ফিরিয়ে আনতেই আমাদের এই আয়োজন।’
র্যাম্পে আঠারোজন ফ্যাশন ডিজাইনার তাদের কালেকশন উপস্থাপন করেন। এতে তাদের নকশা করা শাড়ি প্রদর্শিত হয়, যেখানে ফুটে ওঠে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী বয়নশিল্পের নান্দনিক রূপ। ফ্যাশন শোর প্রথম পর্বে অংশ নেন আফরিন ইলা, শ্রাবণী, সানজিদা হক, ফারহান এ আহসান, নিঝু, আবেদা খাতুন মিতুল, সিমিলী রহমান, মুনমুন ও ফারজানা রিপা। দ্বিতীয় পর্বে ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশের নয়জন ডিজাইনার অংশ নেন। তারা হলেন লিপি খন্দকার, শৈবাল সাহা, মাহিন খান, ইমাম হাসান, ফাইজা আহমেদ, শাহ্রুখ আমিন, রোকসানা, সাদিয়া রুপা ও রিমা নাজ।
ফ্যাশন শোর কোরিওগ্রাফার ছিলেন ইমরান আলী সিকদার। প্রদর্শিত প্রতিটি নকশায় ফুটে ওঠে দেশের ঐতিহ্যবাহী বয়নশিল্পের বৈচিত্র্য। টাই-ডাই, খাদি, জামদানি, মসলিন, রেশম, নকশিকাঁথা, কারচুপি, টাঙ্গাইল হ্যান্ড পেইন্ট, প্রাকৃতিক ডাই, রাজশাহী সিল্ক ইত্যাদি উপকরণ ও কৌশলের সৃজনশীল প্রয়োগ দেখা যায় ডিজাইনারদের পোশাকে। এবারের আয়োজনে শুধু শাড়ির নকশা উপস্থাপন করেন তারা। ইমাম হাসানের বয়ানে জানা যায়, দেশীয় ট্র্যাডিশনাল ডিজাইনাররা স্বতন্ত্রভাবে দেশীয় বয়নকে শাড়িতে তুলে ধরেন। তিনি খাদি নিয়ে কাজ করেছেন। গোধূলি ও সূর্যাস্তের গোল্ডেন আওয়ারের রংকে অনুপ্রেরণা হিসেবে নিয়ে এই নকশাগুলো তৈরি। আবেদা খাতুন মিতুল দেশীয় বয়নে কৃষ্ণচূড়ার নকশা নিয়ে কাজ করেছেন। ভারতীয় ও পাকিস্তানি কাপড়ের ওপর নির্ভরতা কমাতে দেশীয় বয়নে ফিউশন অপরিহার্য বলে মনে করেন এই ডিজাইনার।
নকশা মিস্ত্রীর ডিজাইনার শ্রাবণী এই শোতে শিবোরি ও নকশিকাঁথা নিয়ে কাজ করেছেন। স্লো ফ্যাশনের ধারণা থেকে নকশিকাঁথাকে নতুনভাবে তুলে ধরাই তার উদ্দেশ্য। হারিয়ে যেতে বসা নকশিকাঁথাকে আধুনিক প্রেক্ষাপটে ফিরিয়ে আনতে তিনি ডেনিমের ওপর কাজ করেছেন। পুরোনো টেক্সটাইল ও ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতির সঙ্গে ফিউশন করলে মানুষ নতুন করে আগ্রহী হবে বলে মনে করেন তিনি। শাহ্রুখ আমিন তার এবারের ডিজাইন তৈরি করেছেন সবুজের আবহে।
পৌষ উৎসবের এই আয়োজনে ফ্যাশন শোর পাশাপাশি ছিল পৌষ মেলা। স্টলগুলোতে দেশের নানা প্রান্তের লোকজ ঐতিহ্য ও কারুশিল্পের সমাহার ঘটে। এ ছাড়া পাট ও কাঁসা-পিতলের সামগ্রী, সোনারগাঁয়ের কাঠের পুতুল, জামদানি ও হাতপাখা, সিরাজগঞ্জের তাঁত, টাঙ্গাইলের শাড়িসহ বিভিন্ন জেলার ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্পের প্রদর্শনী দর্শকদের মুগ্ধ করেছে।
ফ্যাশন ডেস্ক
ছবি: সংগ্রহ
