ফুড বেনিফিট I আখের রস
শরীরের নানামুখী ঘাটতি পূরণ ও রোগবালাই সারিয়ে তুলতে আখের রস অব্যর্থ। ত্বকের সৌন্দর্যেও এর অবদান উপেক্ষণীয় নয়
তৃষ্ণাহরা আখের রস। জোগায় শক্তিও। একে জাদুকরি পানীয় বলা যেতেই পারে। রসের প্রতিটি ফোঁটা খনিজ ও ভিটামিনে ভরপুর। জিংক, পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও ম্যাঙ্গানিজের উৎস। ভিটামিন সিও প্রতুল। পলিফেনলস, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ছাড়াও পেপি কোলিন অ্যাসিডের আধার। আছে মেথিওনিন, ট্রিপটোফ্যান, বি-অ্যালনিন। বেসিক অ্যামিনো অ্যাসিডও বিদ্যমান। যেমন হিস্টিডিন, লাইসিন, আরজিনিন। রস মৃদু ক্ষারীয়। এতে রয়েছে এলডিএল এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের উপস্থিতি।
প্রতি ১০০ গ্রাম রসে ৩৯ ক্যালরি খাদ্যশক্তি, ০.১ গ্রাম আমিষ, ০.২ গ্রাম চর্বি, ৯.১ গ্রাম শর্করা, ১০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ১০ মিলিগ্রাম ফসফরাস, ১.১ মিলিগ্রাম আয়রন, ১০ আইইউ ভিটামিন এ এবং ০.০৪ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি রয়েছে। এতে ফ্লাভোনয়েডস ও ফেনোলিক যৌগ আছে। ফ্লাভোনয়েড অ্যান্টিটিউমার, অ্যান্টিভাইরাস এবং অ্যান্টি-অ্যালার্জিক গুণাগুণও পরিলক্ষিত হয় আখের রসে।
নিত্যদিনের ডায়েটে আখের রস রাখলে একাধিক রোগ ধারে-কাছে ঘেঁষতে পারে না। রসের উপাদানগুলো শরীরের বিবিধ রোগ সারাইয়ের কাজ করে।
ডিহাইড্রেশন থেকে দ্রুত নিরাময় পেতে পান করুন আখের রস। এটি শরীরে তাৎক্ষণিক শক্তি জোগাবে। রসে থাকা সুক্রোজ খুব সহজেই শোষিত হয়, যা শরীর থেকে হারিয়ে যাওয়া চিনির মাত্রা পুনরুদ্ধার করে। এ ছাড়া রস পানের সঙ্গে সঙ্গে শরীরে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, আয়রন, পটাশিয়াম ও আয়রন প্রবেশ করে। এতে এনার্জির ঘাটতি দূর হয়। পাশাপাশি প্লাজমা এবং বডি ফ্লইডের ঘাটতি মেটে। এসব কারণেই আখের রস খাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই মন ও শরীর চনমনে হয়ে ওঠে। যারা অতিরিক্ত ঘামেন, এ ঋতুতে তাদের জন্য আখের রস পথ্যতুল্য। এটি শরীরে পানির মাত্রা ঠিক রেখে ক্লান্তি ও অবসাদ বিনাশ করে। পাশাপাশি পেশির শক্তি বাড়ায়।
নিরাপদ গর্ভধারণ নিশ্চিত করে আখের রস। ডিম্বস্ফুটনের সমস্যা দূর করে গর্ভধারণের সম্ভাবনা বাড়ায় এ পানীয়। এর ফলিক অ্যাসিড ‘স্পাইনা বিফিডা’-এর মতো জন্মগত ত্রুটি থেকে গর্ভের শিশুকে সুরক্ষা দেয়। এটি একটি নিউরাল টিউব ডিফেক্টস। এ রোগে গর্ভের শিশুর নিউরাল টিউবের একটি অংশ ঠিকভাবে বিকশিত হয় না কিংবা গঠনপ্রক্রিয়া ঠিকমতো শেষ হয় না। এ কারণে স্পাইনাল কর্ডে ও মেরুদন্ডের হাড়ে ত্রুটি দেখা দেয়। এ সমস্যা দূর করতে চিকিৎসকেরা গর্ভবতীদের আখের রস পানের পরামর্শ দেন।
নিঃশ্বাসের দুর্গন্ধ একটি অস্বস্তিকর সমস্যা। মূলত পুষ্টির ঘাটতির কারণে এটি হয়। আখের রস পুষ্টির ঘাটতি দূর করার মাধ্যমে শ্বাসের দুর্গন্ধ দূর করে। তবে নিয়মিত পান করতে হবে।
দাঁতের ক্ষয় রোধে এর কার্যকারিতা চমকে দেওয়ার মতো। ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস এনামেল তৈরি করে। শিশুরা আখ চিবিয়ে রস পান করলে ওদের দাঁতের সমস্যা কমে। পাশাপাশি ক্যাভিটি এবং ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনের আশঙ্কা দূর হয়। ক্যালসিয়াম যে শুধু দাঁতের সুরক্ষা দেয়, তা নয়। সুস্থ রাখে হাড়ও। দৈনিক আখের রস পানে হাড় শক্তপোক্ত হয়।
উচ্চমাত্রার জ্বর তথা ফেব্রাইল ডিজঅর্ডারের ওষুধ আখের রস। এ রোগে শরীরে আমিষের ঘাটতি দেখা দেয়। আখের রসে প্রচুর আমিষ থাকে। তাই উচ্চমাত্রার জ্বরে তা পান করতে উপদেশ দেওয়া হয়।
যকৃতের রোগ, যেমন জন্ডিস নিরাময়ে এটি ফলপ্রদ। পিত্তরস জমে গেলে যকৃতের কার্যক্ষমতা কমে যায়। ফলে জন্ডিস হয়। এ ক্ষেত্রে শরীরে গ্লুকোজের মাত্রা ঠিক রেখে দ্রুত নিরাময় পেতে চাইলে আখের রস দুই বেলা পান করতে পারেন। ক্ষারীয় প্রকৃতির হওয়ায় এটি শরীরের ইলেকেট্রোলাইটের ভারসাম্য রক্ষা করে।
টক্সিন যকৃতের জন্য ক্ষতিকর। তা বের করে দিতে আখের রসের তুলনা নেই। গরমকালে লিভার ফাংশন ঠিক রাখতে নিয়মিত এ রস পান করা জরুরি মনে করেন পুষ্টিবিদেরা। নিয়মিত পান করলে শরীরে ফ্লাভোনয়েডের মাত্রা বাড়ে। এ উপাদান ক্যানসার কোষ ধ্বংস করে। ব্রেস্ট ক্যানসার কিংবা প্রোস্টেট ক্যানসার—সব ধরনের ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়ে আখ।
হজমে সমস্যা? গ্যাস-অম্বলে কাতর? আখের রস পান শুরু করতে পারেন। এতে থাকা পটাশিয়াম শরীরে প্রবেশ করে হজমে সহায়ক পাচক রসের ক্ষরণ বাড়ায়। পাকস্থলীর ইনফেকশন রোধেও আখের রস বেশ কাজে আসে। এতে বিদ্যমান একাধিক উপকারী উপাদান ইউরিনারি ট্রাক্ট ইনফেকশন সারাতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। গরমে ডিহাইড্রেশনে ইউরিনারি ট্রাক্ট ইনফেকশনে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। তাই এ ঋতুতে সুযোগ পেলেই আখের রস খাওয়া ভালো। কিডনিতে পাথর হওয়ার সমস্যা দূর করে আখ। কিডনি ফাংশনকে যথাযথ রাখতেও আখের রসের বিকল্প হয় না। চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে ডায়াবেটিক রোগীরা এটি পান করতে পারেন। প্রাকৃতিক চিনির গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম থাকে আখের রসে। ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রায় থাকে না। এমনকি এ পানীয় সুগার লেভেল নিয়ন্ত্রণ করে।
শরীরে মন্দ কোলেস্টেরল বেড়ে গেলে কমানো খুব কষ্টকর হয়ে পড়ে। কোলেস্টেরল কমানোর ভার দিতে পারেন আখের রসের ওপর। ইতিবাচক প্রভাব পড়বে হৃৎপিন্ডেও। হার্ট ভালো রাখার পাশাপাশি হার্ট অ্যাটাক রুখতে পারে এ রস। এর ল্যাক্সেটিভ প্রপার্টিজ মানুষের শরীরের বাওয়েল মুভমেন্টের উন্নতি ঘটায়। এ কারণে কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো সমস্যা খুব কম সময়ের মধ্যেই সেরে যায়। এ ছাড়া আখের ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, আয়রন ও ম্যাঙ্গানিজ শরীরে ইলেকট্রোলাইটসের মাত্রা স্বাভাবিক রাখে। প্রচুর পরিমাণ ফাইবার এতে বিদ্যমান। তাই এটি পানে শরীরের ওজন কমে। এ ছাড়া আখের রস ঠান্ডা জ্বর ও গলার ক্ষত সারায়। শরীর ঠান্ডা রাখে। এ রস পানে সেনসরি অর্গেন, রিপ্রোডাকটিভ অর্গেন এবং মস্তিষ্কের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। আয়ু বাড়ে।
রূপচর্চায়ও কাজে আসে আখের রস। নিয়মিত রস পানে শরীরের ভেতর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও ফ্লাভোনয়েডের পরিমাণ বাড়তে শুরু করে। এ উপাদানদ্বয় ত্বক ও শরীরের অভ্যন্তরে থাকা ক্ষতিকর টক্সিক বের করে। ফলে ত্বকের বয়স বাড়ার আশঙ্কা কমে যায়। গরমকালে অনেকেরই ত্বক খুব শুষ্ক হয়ে পড়ে। এ বালাই থেকে রক্ষা দিতে পারে আখের রসে থাকা আলফা হাইড্রক্সি অ্যাসিড। ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি ত্বকের বিভিন্ন রোগের প্রকোপ কমাতে দারুণ কাজে আসে এই উপাদান। বলিরেখাও দূর করে। মাস্ক হিসেবে মুখে আখের রস মাখলে রুক্ষতা পালায়। ব্রণ দূর করতেও বিশেষ কার্যকর এ রস। এর আলফা হাইড্রক্সি অ্যাসিড ত্বকে কোষের উৎপাদন বাড়িয়ে ব্রণের প্রকোপ কমায়। ব্রণের দাগও দূর করে। আখের রস ত্বককে এক্সফোলিয়েট হতে সাহায্য করে। মরা চামড়া জমার প্রবণতাও কমায় এ তরল।
শিবলী আহমেদ
ছবি: ইন্টারনেট