আলাপন I আমার শ্রোতা ও দর্শকের ৬৫ ভাগই বাংলাদেশি: অঞ্জন দত্ত
অঞ্জন দত্ত। সংগীতশিল্পী, মঞ্চ ও চলচ্চিত্র অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক এবং মঞ্চনাটকের নির্দেশক। কলকাতার শিল্পী হলেও তাঁর শ্রোতা ও দর্শক ছড়িয়ে রয়েছে নিখিল বাংলায়। শিল্পীজীবনের সূচনা থিয়েটারে অভিনয় দিয়ে। তারপর চলচ্চিত্রের অভিনেতা ও নির্দেশক। ক্রমে গানের জগতে আবির্ভাব ও খ্যাতি। অঞ্জনের সঙ্গে আলাপ করে ক্যানভাসের জন্য লিখেছেন অতনু সিংহ
অঞ্জন থাকেন কলকাতার বেনিয়াপুকুর লেনে তাঁর পৈতৃক বাড়িতে। কলকাতার বেশির ভাগ পুরোনো বাড়ি ভেঙে তৈরি হয়েছে ফ্ল্যাট। নতুন আঙ্গিকে। এই বাস্তবতার মধ্যে দাঁড়িয়ে অঞ্জন দত্ত তাঁর পৈতৃক বাড়িটির স্থাপত্যে কোনো পরিবর্তন আনেননি। উঠান, বৈঠকখানা, গ্যারেজ, ঘর-বারান্দা-ছাদ—এসব নিয়েই বেশ অন্য রকম তাঁর বাড়ি। সেখানকার বৈঠকখানায় বসে শুরু হলো আলাপ। প্রথমেই গানের প্রসঙ্গ দিয়ে কথা শুরু হলো। অঞ্জন দত্ত তাঁর লিরিকে লিখেছিলেন, ‘গানের কোনো প্রস্তুতি নেই, নেই যে শিকড়-বাকড়/ মালকোষ বা পিলু-ভৈরবী/ গলায় আমার রেওয়াজ করার স্বভাবটা যে নেই/ এই অভাব আমার থাকবে চিরদিন…’ তাঁর কাছে প্রশ্ন রাখা হলো,
সংগীত জীবনে প্রবেশের আগে প্রাতিষ্ঠানিক সংগীত শিক্ষা বা প্রাতিষ্ঠানিকতার সমান্তরালেও কি কোনো ভাবে কোনোদিন সংগীতচর্চা করেননি?
তিনি বললেন,
না। সংগীতচর্চা বলতে যা বোঝায়, সেই সব কোনো দিন করা হয়নি। আমি দার্জিলিংয়ে একসময় পড়াশোনা করেছি। সেখানে অনেকেই গিটার বাজাত। আমিও বাজাতাম। বাংলা ও ইংরাজিতে গান লিখতাম। এটুকুই। কিন্তু প্রথাগতভাবে সংগীতশিক্ষা, সংগীতচর্চা, সংগীতসাধনা—এসব আমার করা হয়নি। বরং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমি থিয়েটার চর্চা করেছি। অভিনয় শিখেছি বাদল সরকারের কাছে। ওনার দলে অভিনয় করে অভিনয় শিখিনি। উনি আমায় আলাদা করে অভিনয় শিখিয়েছিলেন। লোকে যেমন প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়াশোনা শেখে, তেমনই ওনার কাছে আমি অভিনয় শিখেছিলাম। বাদল সরকার শুধু নাট্যকার, নাট্য পরিচালক নন; উনি একজন অভিনয়শিক্ষকও ছিলেন।
এরপর এই গানের বিষয়েই আরও জানতে চাওয়া হলো, থিয়েটার, অভিনয়, চলচ্চিত্র নির্দেশনা—এসব থেকে গানের জগতে আসার ব্যাপারটা বলেন। সুমনের গানের প্রেরণা ছাড়াও কি অন্য কোনো তাগিদ ছিল?
তিনি বলতে থাকলেন,
সিনেমায় অভিনয় করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নামটাম করলেও এখানে আমার খুব একটা কিছু হচ্ছিল না। অর্থ উপার্জনও হচ্ছিল না। কারণ, আমায় তেমন কেউ কাজ দিচ্ছিলেন না। দু-একজন নামকরা পরিচালক মনে করেছিলেন, আমি ভালো অভিনেতা। কিন্তু সেটা আর কটা ছবি, দু-একটা। বাকি ইন্ডাস্ট্রি আমায় সেভাবে কাজ দেয়নি। তাই বলতে পারেন টাকাপয়সার জন্যই গান গাইতে আসা। সুনীলদা (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়) আমায় একবার মজা করে বলেছিলেন যে রবীন্দ্রনাথ যদি গান না বাঁধতেন, তাহলে ওনার এই পরিমাণে গ্রহণযোগ্যতা হতো না। এমনকি নোবেল পেতেন কি না, সেটাও সন্দেহ। তিনি আরও বলেছিলেন, কবিতা লিখে বেশি জনপ্রিয়তা ও অর্থ উপার্জন করা যায় না। শক্তি চট্টোপাধ্যায় যদি কবিতা না লিখে গান লিখতেন, তাহলে শক্তির অনেক টাকা হতো। অবশ্য সুনীলকে আমি তখন বলেছিলাম, আপনি বা শক্তিদা কি আমার মতো গিটার বাজিয়ে গাইতে পারতেন! এইটা শুনে খুবই মজা পেয়েছিলেন সুনীল। বলেছিলেন, হ্যাঁ, নিজে গান লিখে সুর করে গান গাইতে পারলে সবচেয়ে ভালো। যা হোক, এই কথাগুলো বলছি তার কারণ, অভিনেতা, নির্দেশক, থিয়েটার কর্মী—এসবের চেয়ে গায়ক হিসেবে আমার পরিচিতি অনেক। আর গান গেয়ে দুটো টাকাপয়সাও রোজগার করেছি।
বাংলাদেশকে নিয়ে একটা আস্ত অ্যালবাম রয়েছে অঞ্জনের। লাকী আখান্দ্রে সঙ্গে পারফর্ম করেছেন। বাংলাদেশের ব্যান্ড কালচারের উদ্দীপনা ও ব্যাপ্তির যে যুগ, তার পরবর্তী সময়ে আজকের বাংলাদেশের সমসাময়িক গানের ব্যাপারে তাঁর কী বক্তব্য জানতে চাইলাম।
উত্তরে তিনি বললেন,
ঠিক এই মুহূর্তের কথা আমি বলতে পারব না। তবে এটা আমি বলব, আমার যখন মাকসুদের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়, তখন তাঁকে একজন অসামান্য গায়ক, সংগীতকার ও গীতিকার বলে মনে হয়। আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গে যখন, তখন তাঁকে একজন দুর্দান্ত গিটারিস্ট হিসেবে দেখতে পাই। এলআরবিকে আমার দারুণ লাগত। জেমস বা মাইলস ব্যান্ডকেও আমার দুর্দান্ত লেগেছে। এদের গান আমি নিয়মিত শুনেছি। আমাদের মতো পশ্চিমবঙ্গে বহু মানুষ তাঁদের গান শুনেছেন। এসব শিল্পীকে আমার অত্যন্ত ক্ষমতাবান মনে হয়েছিল। তাদের ঘিরে সেই উদ্দীপনা কমছে কি বাড়ছে, আমার জানার দরকার নেই। তাঁদের আমি অত্যন্ত ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী বলে মনে হয়েছে। আর লাকী আখান্দ্ একেবারে অন্য ঘরানার। সেই ঘরানাও যথেষ্ট মূল্যবান। তাঁর পপ মিউজিকেরও প্রভাব আছে। তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়। দুর্ভাগ্যবশত তখন তাঁর শরীর খারাপ। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ আমাকে প্রথম থেকেই অভিনেতা, সংগীতশিল্পী ও চলচ্চিত্র নির্দেশক হিসেবে চিনেছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ প্রথম দিকে আমার গানটাকেই বেশি করে গ্রহণ করেছেন। এখন বাংলাদেশে আমার শ্রোতা ও দর্শক অনেক। ইউটিউব বা ওয়েবের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মের ভিউয়ার সংখ্যা দেখে আমার যা মনে হয়েছে, তাত আমি এটা হলফ করে বলতে পারি, এখন আমার দর্শক ও শ্রোতার ৬৫ শতাংশই বাংলাদেশি, বাকি ৩৫ শতাংশ দর্শক ও শ্রোতা পশ্চিমবঙ্গসহ গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে রয়েছেন। এমনকি এটাও বলব, বিদেশে যত শো করেছি, সেগুলোর বেশির ভাগই বাংলাদেশিদের সৌজন্যে। বাংলাদেশের মানুষ না থাকলে সংগীতে আমার জনপ্রিয়তা এই পর্যায়ে পৌঁছাত না। এমনকি এখন আমার সিনেমা নিয়েও বাংলাদেশেই বেশি কথা হয়, পশ্চিমবঙ্গের থেকে বাংলাদেশে আমার গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি।
অঞ্জন জানালেন, গানের ক্ষেত্রে তাঁকে বিরাটভাবে প্রভাবিত করেছে থিয়েটার। তাঁর কথায়,
কলকাতায় অভিনয়শিক্ষা ও থিয়েটার নিয়ে কিছু কাজকর্মের জন্য আমি জার্মানি চলে যাই। তখনো জার্মানির দেয়াল অক্ষত। তো ওয়েস্ট বার্লিনে থিয়েটার ম্যানফ্যাকটুর নামে একটা কোম্পানিতে আমি চাকরি পাই। এক জার্মান নাট্যকার আমায় সেই ব্যবস্থাটা করে দিয়েছিলেন। কলকাতার ম্যাক্সমুলার ভবন আর গ্যেটে ইনস্টিটিউট এই ব্যাপারে সাহায্য করেছিল। জার্মানিতে গিয়ে দেখি, থিয়েটারে মিউজিক কীভাবে পাওয়ারফুল হয়ে উঠছে। ধরুন, ব্রেশটের নাটকের গান, মিউজিক—এগুলো তো শুধু মঞ্চেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। পরে বিশ্বের রক এবং পপস্টাররা সেগুলো গেয়েছেন। ওই সুরগুলো প্রথম অরিজিনালি আমরা আমাদের থিয়েটারে ব্যবহার করি। আর থিয়েটারের মিউজিকই আমার সংগীতজীবনে নানাভাবে সাহায্য করেছে।
চলচ্চিত্রে অভিনয়জীবনের সূচনাতেই বাজিমাত করেছিলেন অঞ্জন দত্ত। মৃণাল সেন পরিচালিত ‘চালচিত্র’ ছবিতে অভিনয় করে ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসব থেকে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার সম্মান অর্জন করেছেন। চলচ্চিত্রে কীভাবে তিনি এলেন? মৃণাল সেনের সঙ্গে কীভাবে পরিচয় হলো, জানতে চাইলাম তাঁর কাছে।
অঞ্জন বলতে থাকলেন,
আমার একটি নাটক দেখতে এসেছিলেন মৃণাল সেন ও বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। তাঁরা দুজনেই আমার অভিনয় দেখে তাঁদের সিনেমার জন্য আমায় কাস্ট করলেন। মৃণালবাবুর ছবিটি আগে হয়। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর গৃহযুদ্ধ ছবিটি পরে হয়।
অঞ্জন দত্ত নির্দেশিত চলচ্চিত্র কিংবা সংগীতে কলকাতার তালতলা-রিপন স্ট্রিট-বেনিয়াপুকুর, অ্যাংলোদের পাড়া বো-ব্যারাক, দার্জিলিং, নকশালবাড়ি আন্দোলন, সত্তর দশকের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস—এসব ঘুরেফিরে আসে, এসেছে। এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলো, তিনি কি তাঁর জীবনের টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতাকেই শিল্পের ভাষায় প্রকাশ করতে চেয়েছেন?
অঞ্জনের বক্তব্য,
সবাই তা-ই করে। আমার মনে হয় না কোনো শিল্পীই বানিয়ে বানিয়ে কিছু করেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে কথাসাহিত্যিকেরা গল্প-উপন্যাস লেখেন, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা-অনুভূতিই কবিতায় প্রকাশ পায়, কেউ ছবি আঁকেন, কেউ সিনেমা বানান। কারও কারও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা অনেক বড় মাপের হয়, আবার কারও কারও অভিজ্ঞতার পরিসর ছোট হয়। ধরুন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি আমার পড়তে খুব ভালো লাগছে, কিন্তু এই নিয়ে আমি অন্তত ছবি করতে যাবো না। কারণ, সেই জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা আমার নেই। আমি তাদের নিয়েই কাজ করব, যাদের জগৎটা আমি চিনি, জানি, বুঝি। কিন্তু অভিনেতা হিসেবে যখন কাজ করব, সেটা আবার আলাদা। তখন পরিচালকের নির্দেশমতো আমায় চলতে হবে। আবার যে চরিত্রে অভিনয় করছি, সেই চরিত্রের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে। আমি একটা ছবিতে তাঁতির চরিত্রে অভিনয় করেছি। নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের ‘শিল্পী’ ছবিতে। এ জন্য একটা গ্রামে গিয়ে আমায় এক মাস থাকতে হয়েছিল। বয়নশিল্পীদের ভাষা, বয়নপদ্ধতি—এসব আমায় শিখতে হয়েছিল। অভিনেতা হিসেবে আমাকে চরিত্র অনুযায়ী বদলাতে হয়, শিখতে হয়, কিন্তু যেটা আমি নির্দেশনা দিচ্ছি বা লিখছি, সেটা অবশ্যই আমার ব্যক্তিগত জীবনের পরিসর থেকেই আসবে।
সত্তর দশকে ভারতে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, নকশালবাড়ি আন্দোলন—এসব প্রসঙ্গ বারবার ঘুরেফিরে অঞ্জন দত্তের বিভিন্ন কাজে উঠে এসেছে। তিনি যেহেতু অভিজ্ঞতার কথা বললেন, তাই তাঁর কাছে প্রশ্ন, আপনি কখনো নকশালবাড়ির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন? আপনি কি মতাদর্শের জায়গা থেকে কমিউনিস্ট?
অঞ্জন দত্ত স্পষ্টভাবেই জানালেন,
না, তিনি কোনো পার্টিজান রাজনীতির বা নন-পার্টিজান পরিমন্ডলে মার্ক্সীয় প্র্যাকটিসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। এমনকি তিনি মার্ক্সবাদে বিশ্বাসও করেন না। যদিও তিনি এরপর বললেন,
আমার অনেক বন্ধু নকশাল ছিল। নকশালপন্থীদের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। এ ছাড়া আমায় যাঁরা বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছেন, পড়িয়েছেন, শিখিয়েছেন, তাঁদের প্রায় সবাই কমিউনিস্ট। মৃণালদা কমিউনিস্ট ছিলেন। উনি আমার বাবার মতো। কিন্তু আমি কমিউনিস্ট ছিলাম না। এখনো নই। আমার কাছের বন্ধুদের অনেকেই বামপন্থী, কমিউনিস্ট, কবীর সুমনও তাই। কিন্তু আমি নই। কমিউনিস্টদের থেকে বা কমিউনিস্ট লিটারেচার থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি, জেনেছি বা এই যে বলছি কমিউনিজমে আমার আপত্তি আছে, এইটাও মার্ক্সিস্ট থিওরি পড়েই বলছি। আমার কাছে সমষ্টির চেয়ে ব্যক্তি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমি এক অর্থে অস্তিত্ববাদী। কারণ, আমি ব্যক্তিকে বেশি গুরুত্ব দিই সমষ্টির চেয়ে। তবে মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা আছে। মানবমুক্তির তাগিদের প্রশ্নে। কিন্তু সার্বিকভাবে আমি মার্ক্সিস্ট নই, বরং জাঁ পল সাত্রে আমায় নানাভাবে প্রভাবিত করেছেন। আমি ওঁর থিয়েটার অনুবাদ করেছি। জঁ জেনের থিয়েটারও অনুবাদ করেছি। ঈশ্বরে বিশ্বাস করি। তবে আমি গোঁড়া হিন্দুও নই। আমি মনে করি, মানুষের চেয়ে প্রকৃতি বড়। ঈশ্বরে বিশ্বাস করি বলে এই নয় যে আমি পূজা-অর্চনা করি। না, আমি এসব করি না। কিন্তু প্রকৃতিকে রেসপেক্ট করি।
রাজনীতি, মতাদর্শ, সমাজ—এসব নিয়ে কথা হতে হতে চলচ্চিত্র প্রসঙ্গ ফিরে এলো। তাঁকে বললাম, আপনি যাঁদের ছবিতে অভিনয় করেছেন, তাঁদের ছবি মূলত আর্ট হাউসের ছবি হিসেবেই চিহ্নিত। যদিও আর্ট ও কমার্শিয়াল বাইনারি টানা ঠিক নয়। কিন্তু দেখা গেছে, ছবির ন্যারেটিভ আর পাঁচটা ছবির থেকে আলাদা হয়েও বাণিজ্যিকভাবে সাফল্যের চেষ্টা রয়েছে। আপনি কি বাণিজ্যের ব্যাপারটা মাথায় রেখেই স্ক্রিপ্ট করেন?
অঞ্জন দত্তের উত্তর,
না, এটা করি না। আমি বাণিজ্যিক সফলতার কথা মাথায় রেখে কোনো ছবিই করিনি। ‘বং কানেকশনে’র কথাই বলুন অথবা ‘রঞ্জনা আমি আর আসবো না’ বা ‘ম্যাডলি বাঙালি’ কিংবা ‘দত্ত ভার্সেস দত্ত’—মোটকথা, কোনো ছবির স্ক্রিপ্ট বা নির্মাণের অন্য বিষয়গুলো বাণিজ্যিক সাফল্যের কথা মাথায় রেখে করি না। বরং ছবি নির্মাণের পর তার প্রচার ও বিপণনের জন্য আমার বিশেষ ভাবনা থাকে, পরামর্শ থাকে। কিন্তু বাণিজ্যিক সাফল্যের ছক নির্মাণের সময় আমার মাথায় থাকে না। আমি চিরাচরিত স্টারদের নিয়ে কাজ করার থেকে নতুনদের নিয়ে কাজ করি। দর্শক কী চাইছে, তার চেয়ে আমার কাছে বেশি গুরুত্বের—আমি দর্শককে কী দেখাতে চাইছি। তবে আমি চাই আমার সমাজের, চারপাশের, ভাষার, দেশের দর্শকেরা আমার ছবি দেখুক।
আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে অঞ্জন দত্তর কাছে জানতে চাইলাম, ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম মাস্টারদের মধ্যে কাদের ছবি তাঁকে টানে!
অনেকের কথা বললেন। জোর দিলেন জঁ লুক গোদার, ওয়াংকার ওয়াইদের ওপর। তিনি বললেন,
যাঁরা সিনেমা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেছেন, তাঁদের কাজ আমার ভালো লাগে। সিনেমা মানে গল্প বলা নয়। সিনেমা হচ্ছে বিভিন্ন মুহূর্ত…আমার ছবিতেও সে অর্থে কোনো গল্প নেই। বরং কিছু মুহূর্ত মিলিয়ে সার্বিক কিছু একটা হয়ে ওঠার ব্যাপার আছে। আমি যেভাবে ছবি বানাই, তার সঙ্গে আমার সমসাময়িক যাঁরা ছবি করছেন, তাঁদের খুব একটা মিল নেই। ‘বং কানেকশন’ বা ‘ম্যাডলি বাঙালি’র সঙ্গে ঋতুপর্ণের ছবির কোনো মিল নেই। অথচ আমরা একসঙ্গেই কাজ করেছি, পাশাপাশি কাজ করেছি। গল্প বলার ছবি আমি পছন্দ করি না। মৃণাল সেনের ছবি পছন্দ করি, কারণ উনি গল্প বলেন না, উনি সিনেমার প্রথাগত ধারণাকে ভাঙার চেষ্টা করেন। আমিও তাই করি।
এরপর ইনডিপেনডেন্ট সিনেমার ব্যাপারে কথা উঠলে অঞ্জন বললেন,
আমাদের সব ছবিই ইনডিপেনডেন্ট। কারণ, এখানে স্টুডিও সিস্টেমের কোনো অস্তিত্ব নেই। এখানে একজন টাকা দেয়, আরেকজন ছবি বানায়। সেভাবে দেখতে গেলে এখানে সব ছবিই ইনডিপেনডেন্ট। তিনি আরও নির্দিষ্টভাবে বললেন, এমনকি ভেঙ্কটেশ ফিল্মস আমায় যখন টাকা দিচ্ছে, তারা বলছে না আমায় কোন চরিত্রে কাকে নিতে হবে, আমার লোকেশন কী হবে, কোন সিনেমাটোগ্রাফার আমার সঙ্গে কাজ করবেন ইত্যাদি। তাঁর মতে, স্টুডিও সিস্টেম গড়ে ওঠার জন্য যে শিক্ষাদীক্ষা, পরিকাঠামো ইত্যাদি দরকার ছিল, তা এই অঞ্চলে নেই। আমাদের এখানে এক্সিকিউটিভ প্রডিউসার বলে কিছু নেই। এখানে এক্সিকিউটিভ প্রডিউসার মানে টাকাপয়সার হিসাব রাখা।
ছবির প্রডাকশন, এক্সিকিউশন—এসব নিয়ে দীর্ঘ আলাপ চলল। অঞ্জন দত্ত মূলত বড় পর্দার জন্য ছবি করেছেন। কিন্তু চলচ্চিত্রের ধারণা যে আজকের ওয়েব মাধ্যমে পরিবর্তিত হচ্ছে, এই প্রসঙ্গে তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, ওয়েবের এই সময়ে মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রের জমানা কি শেষ?
উত্তর এলো,
ই-বুক বেরোচ্ছে বলে কি মানুষ বই পড়া ছেড়ে দিয়েছে? ওয়েব পোর্টালে খবর হচ্ছে মানে কি খবরের কাগজ উঠে যাবে? কিছু লোক খবরের কাগজ পড়বে, কিছু লোক ডিজিটালে দেখবে। তো হলেও তো কিছু ছবি চলবে। কিন্তু ওয়েবটাকে ইগনোর করা যাবে না। কারণ, কেউ বাড়ি বসে একটা ল্যাপটপে বা অন্য কিছুতে ছবি দেখতে চায়, সেটাকে অস্বীকার করে লাভ নেই। মোবাইলে সিনেমা দেখার ব্যাপারটাকে স্বীকার করে নিতেই হবে। তার মানে এটা নয় যে হলে সিনেমা দেখার ব্যাপারটা মিথ্যে হয়ে যাবে। কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাত থেকে বইয়ের দোকানগুলো সরিয়ে ফেলে সব কটাকে বুক মলে ঢুকিয়ে দেওয়া যেমন সম্ভব নয়, তেমনই সিনেমা হল পুরোপুরি মুছে ফেলা যাবে না। ক্যাফে এসেছে বলে কি চায়ের দোকান উঠে যাচ্ছে? ক্যাফে থাকবে, চায়ের দোকানও থাকবে। এখন নির্ভর করছে সমাজ কীভাবে নিজেকে চালাতে চায়। সমাজ যদি মনে করে, সবাই প্লাস্টিকের জামা পরে ঘুরবে, তাহলে সেটাই হবে। তবে এটাও দেখছি, আমার ছবি এখন হলে সপ্তাহ দুয়েক চলার পর ওই ওয়েবেই চলছে। আমার ছবির দর্শক যেহেতু শুধু কলকাতার বা পশ্চিমবঙ্গের নয়, আমার দর্শক ঢাকায় থাকেন, সান ফ্রানসিসকোয়, লন্ডনে, শিকাগোয়, নিউইয়র্কে থাকেন। তাদের কথা মাথায় রেখে ওয়েবের জন্য কাজ করছি।
এবার বাংলাদেশের চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে কথা হলো। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে তিনি কীভাবে দেখেন জানতে চাইলাম।
অঞ্জন দত্ত বললেন,
বাংলাদেশের কাজ আমি খুবই দেখি। সিনেমা ছাড়াও ওদের টেলিভিশনের নাটক আমার দারুণ লাগে। সিনেমার কথা যদি বলি, এখন আমার ফারুকীকে দারুণ লাগছে। আহা, কী দারুণ একজন পরিচালক। বাংলাদেশে কত কষ্ট করে কত অধ্যবসায়ে সিনেমা বানানো হচ্ছে আমি জানি। ফাখরুল আরেফিন খানের ‘ভুবন মাঝি’ ছবিটা দেখলাম, দারুণ লেগেছে। ফারুকীর ‘ডুব’ দেখলাম, অসাধারণ। আরেফিন তাঁর একটা ছবিতে কাজের জন্য আমায় অফার করেছিলেন অভিনয় করতে। খুব ইচ্ছা ছিল করার। আমিও রাজি ছিলাম। কিন্তু নানা কারণে করা হয়নি। এই নিয়ে আমার আফসোস হয়। আগে তানভীর মোকাম্মেলের ছবি সিরিয়াসলি দেখতাম। তারেক মাসুদের মতো পরিচালক তো বিস্ময়কর। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তাঁকে আমরা হারালাম। এখন যাঁরা ছবি করছেন বাংলাদেশে, তাঁরা আবার নতুন একটা যুগের সূচনা করেছেন। যেমন আমি, ঋতুপর্ণসহ আরও কয়েকজন নতুন করে ছবি করা শুরু করেছিলাম কলকাতায়। বাংলাদেশে এখন সিনেমার ক্ষেত্রে তেমন একটা নতুন ঢেউ উঠেছে। আমার খুব ইচ্ছা বাংলাদেশ থেকে একটা ছবি করার। একটা প্রডিউসারও পেয়েছিলাম, কিন্তু ওয়ার্ক আউট করল না জানেন, হলো না! প্রডিউসার কেটে গেল।
কলকাতায় কাদের, কোন পরিচালকদের উল্লেখযোগ্য বলে মনে করছেন, জানতে চাইলাম। বললেন,
কৌশিক গাঙ্গুলি, প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য, মানসমুকুল পাল, ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরীর মতো আরও অনেকে। কিন্তু এরাই-বা প্রডিউসার পাচ্ছেন কই! আমিই পাচ্ছি না। বলছে স্টার নিয়ে ছবি করতে হবে। আমি তো আবার ওই স্টারদের পাত্তা দিই না।
এই আলাপে উঠে এসেছিল কলকাতার ঐতিহ্যবাহী পত্রিকা ‘দ্য স্টেটসম্যান’-এ সাংবাদিকতা ও ক্রিটিক হিসেবে অঞ্জন দত্তের অভিজ্ঞতার নানা কথা, বিজ্ঞাপন সংস্থায় চাকরির কথা। কিন্তু সব কথার মধ্যে তাঁর একটাই আক্ষেপ, আজকের এই সময়টা মধ্যমেধায় ভরে গেছে। বিশেষত কলকাতাসহ গোটা ভারতে। নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতির ব্যাপারেও পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সচেতন নয় বলে তাঁর আক্ষেপ। এর জন্য অবশ্য তিনি দায়ী করেছেন ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থাকে।
ছবি: মাসুদুর রহিম রুবাই ও তানিয়া সরকার