ফিচার I বৃষ্টির পানি
বায়ুমন্ডল থেকে ভূমিতে নেমে আসা এই পানি শরীরের জন্য যেমন উপকারী, তেমনি রূপচর্চায়ও কার্যকর
খাদ্যের ছয়টি উপাদানের একটি হলো পানি। এ তরলের মূল কাজ শরীরের কোষে পুষ্টি উপাদান বয়ে নিয়ে যাওয়া। মানবদেহের প্রায় ৭০ শতাংশই পানি। শরীরে প্রায় ৩৭ ট্রিলিয়ন কোষ আছে। প্রতিটি কোষেরই পুষ্টি প্রয়োজন। এ বিপুল পরিমাণ কোষের পুষ্টি নিশ্চিত করতে প্রত্যেক মানুষের দৈনিক দুই থেকে তিন লিটার পানি পান করা দরকার। এর ফলে বিপাক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অতিরিক্ত তরল বের করে দেয় শরীর। বিপাকের ফলে সৃষ্ট বর্জ্য, বিষাক্ত ও অপ্রয়োজনীয় পদার্থ ফুসফুস ও কিডনিতে নিয়ে নিষ্কাশনের কাজটিও সম্পন্ন করে পানি।
পৃথিবীর মোট আয়তনের চার ভাগের তিন ভাগ পানি হলেও সুপেয় পানির পরিমাণ নিতান্তই কম, মাত্র আড়াই শতাংশ। সাধারণত যে পানি স্বাভাবিক গুণাবলিসম্পন্ন, স্বচ্ছ, বর্ণহীন, গন্ধহীন, যাতে ভাসমান জৈব বা অজৈব পদার্থ কিংবা কোনো রোগজীবাণু নেই, তাকে বিশুদ্ধ পানি বলে। এই বিশুদ্ধ পানির মাত্র শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ পাওয়া যায় নদী, হ্রদ ও বায়ুমন্ডলে। বাকিটা ভূগর্ভে। মাটির নিচ থেকে পানি উত্তোলন খরচসাপেক্ষ। সে ক্ষেত্রে বেশির ভাগ মানুষ নির্ভর করে ভূ-উপরিভাগের পানিতে। কিন্তু দূষণের কারণে নদী ও হ্রদের পানিও এখন আর বিশুদ্ধ নেই। এক সমীক্ষা বলছে, ২০২৫ সাল নাগাদ পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার অর্ধেক মানুষ সুপেয় পানির সংকটে পড়বে। সুতরাং, ভরসা এখন বায়ুমন্ডলের পানিতে। পৃথিবীর মোট পানির শূন্য দশমিক ০০১% রয়েছে বায়ুম-লে। দৃশ্যত তা মেঘ এবং অদৃশ্য অবস্থায় জলীয় বাষ্প। সেসব ঘনীভূত হলে তবেই বৃষ্টিপাত হয়। কিন্তু সব বৃষ্টি মাটি ছোঁয় না। অন্যদিকে, পৃথিবীর সব অঞ্চলে বৃষ্টি হয় না। মরুভূমিতে যে বৃষ্টি হয়, তীব্র গরমের কারণে তা মাটি ছোঁয়ার আগেই বাষ্পীভূত হয়ে যায়। অ্যান্টার্কটিকায় বৃষ্টিপাত হয় না বললেই চলে। তাই বৃষ্টির পানি পান করতে পারা প্রাকৃতিক আশীর্বাদ বটে। কিন্তু মানবসৃষ্ট দূষণে সেই আশীর্বাদও অভিশাপ হয়ে উঠেছে। বৃষ্টির পানিও এর বাইরে থাকছে না। তারতম্য ঘটছে ‘পিএইচ’ মানের। পিএইচ হচ্ছে পানির অমøত্ব বা ক্ষারত্বের মাত্রা। স্বাভাবিক পানির পিএইচ মান ৭। এই মান কমলে তা অমøধর্মী হয়ে যায়।
কলকারখানা কিংবা গাড়ির ধোঁয়া থেকে নির্গত ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ বায়ুমন্ডলে থাকা জলকণার সঙ্গে মিশে সালফিউরিক অ্যাসিডে পরিণত হয়। সেই অ্যাসিড বৃষ্টির পানির সঙ্গে নেমে এলে তাকে অ্যাসিড রেইন বলে; যা উদ্ভিদ ও প্রাণীর জন্য ভীষণ ক্ষতিকর। অম্লবৃষ্টির সংস্পর্শে এলে ত্বকে ক্যানসার হতে পারে। চোখের ক্ষতিও হয়। তবে দূষণবিহীন বিশুদ্ধ বৃষ্টির পানি নিরাপদ। এ পানি পানের কিছু সুবিধাও আছে। যেমন এটি হজমশক্তি বাড়ায়। এ কাজটি করে বৃষ্টির পানিতে থাকা অ্যালকালাইন পিএইচ। এতে পিএইচের মাত্রা হয় ৮ থেকে ৯-এর মধ্যে। অর্থাৎ, এ পানি কিছুটা ক্ষারীয়। ক্যানসার রোগীদের জন্যও অ্যালকালাইন পানি অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। এর পিএইচ ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি রুখে দেয়। ভূগর্ভস্থ পানিতে থাকে ফ্লোরাইড। এদিকে পানি বিশুদ্ধ করতে ব্যবহৃত হয় ক্লোরিন। এ দুই উপাদান বেশি মাত্রায় শরীরে প্রবেশ করলে গ্যাস্ট্রাইটিস ও মাথাব্যথার সমস্যা বাড়ে। বৃষ্টির পানিতে এ দুটি উপাদানের একটিও থাকে না। ফলে পান করা যায় নিশ্চিন্তে। পাকস্থলীর সমস্যা নিরাময়ে বৃষ্টির পানি পথ্য হিসেবে কাজ করে। পেটের বালাই দূর করতে সকালে খালি পেটে দুই থেকে তিন চামচ বৃষ্টির পানি পান করার পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। বৃষ্টির পানি পান করলে পাকস্থলীর আলসার ও অ্যাসিডিটি সেরে যায়। পেট ফাঁপা সমস্যায় যারা লাগাতার ওষুধ খাচ্ছেন, তারা বিকল্প হিসেবে এটি পান করতে পারেন। সুফল পাবেন।
জীবকোষের অভ্যন্তরে তৈরি হয় টক্সিন, যা রোগ সৃষ্টি ও শরীরের টিস্যু ধ্বংস করে দিতে পারে। বৃষ্টির পানি পান করলে শরীর থেকে টক্সিন বের হতে থাকে। শুধু তা নয়, বৃষ্টি চলাকালীন এবং এরপর অনেকক্ষণ বায়ুমন্ডল বিশুদ্ধ থাকে। তখনকার বাতাস শরীরে প্রবেশ করলে শ্বাস-প্রশ্বাসের উন্নতি ঘটে। সজীব বাতাসও শরীরের টক্সিন খানিকটা দূর করতে পারে।
মানসিক অবসাদ কমাতে পারে এক পশলা বৃষ্টি। মিনিট পাঁচেক বৃষ্টিতে ভিজলে মনের চাপ কমে। কমে শারীরিক কষ্টও। বৃষ্টির পরপর মাটি থেকে একধরনের গন্ধ বের হয়। একে বলে সোঁদা গন্ধ। বিজ্ঞানের ভাষায় এর নাম ‘পেট্রিকোর’। মাটির ব্যাকটেরিয়া থেকে এ গন্ধ সৃষ্টি হয়। অ্যাকটিনমিসিটিস নামের অণুজীব মাটিতে জেওসমিন নামের রাসায়নিক ছড়ায়। এটি পানির সংস্পর্শে এলে গন্ধের সৃষ্টি হয়। মানসিক অবসাদ দূর করতে এটি বেশ সহায়ক।
শরীরের অভ্যন্তর ছাড়াও বাহ্যিক কাজে লাগে বৃষ্টির পানি। বৃষ্টিতে সরাসরি চুল ভেজান অথবা পানি সংগ্রহ করে চুলে ব্যবহার করুন। এতে একাধিক ব্যাকটেরিয়া ও ময়লা দূর হবে। চুলের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে। খুশকি দূর করতেও বৃষ্টির পানি কার্যকর। মিনারেল না থাকায় শ্যাম্পু বা সাবানের তুলনায় ভালো পরিষ্কারক হিসেবে কাজ করে বৃষ্টির পানি।
আগেই বলা হয়েছে, মানুষের শরীরে অসংখ্যা কোষ থাকে। সেগুলোয় প্রায়শই ব্যাকটেরিয়া বাসা বাঁধে। ফলে ত্বকে জ্বালাপোড়া হতে পারে। বৃষ্টির পানি কোষে জমে থাকা খারাপ ব্যাকটেরিয়া হটায়। এতে ত্বকের প্রদাহ কমে। সুস্থ ত্বকের জন্য বৃষ্টির পানি দারুণ উপযোগী। সুগন্ধি সাবানের অ্যাসিডিক পিএইচ ত্বক রুক্ষ করে দিতে পারে। কিন্তু বৃষ্টির পানিতে সে বালাই নেই। ত্বককে উজ্জ্বল ও নমনীয় করে। হারিয়ে যাওয়া লাবণ্য ফিরিয়ে আনে। এ ছাড়া ভারী বর্ষণের সময় প্রকৃতিতে যে জলীয় বাষ্প থাকে, তা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। জলীয় বাষ্প কিছু কিছু জীবাণুর কাজের ক্ষমতা নাশ করে।
উপকারিতা থাকলেও ১০ থেকে ১২ মিনিটের বেশি বৃষ্টিতে ভেজা উচিত নয়। এতে ঠান্ডা লাগতে পারে। বৃষ্টির পানি পান করতে চাইলে বৃষ্টি শুরু হওয়ার ১০ মিনিট পর থেকে পানি সংগ্রহ করা ভালো।
বৃষ্টির পানি যে শুধু মানুষের জন্য উপকারী, তা নয়। অন্যান্য প্রাণী, চারা গাছ ও বড় গাছের জন্যও তা ভালো। বৃষ্টির পানির কারণে বীজে অঙ্কুরোদ্গম হয়, গাছে ফুল ফোটে। কুকুর, বিড়াল, ঘোড়াসহ অন্যান্য প্রাণী বৃষ্টিতে ভিজলে স্বাস্থ্যবান হয়ে ওঠে। প্রাণীদের জন্য প্রাকৃতিক ওষুধ হিসেবেও কাজ করে বৃষ্টির পানি। এতে কাপড় ধুলে কাপড়ের উজ্জ্বলতা বাড়ে। ফসলি জমির জন্য বৃষ্টির পানি খুবই উপকারী। এ পানিতে কীটপতঙ্গ মরে। ফসল ভালো হয়।
শিবলী আহমেদ
ছবি: ইন্টারনেট
Very nice.