এই শহর এই সময় I জীবনের চিত্রকল্প
বহমান সময়কে নৈর্ব্যক্তিকভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারেন কবি। যদিও তিনি কেবল কবিতালিখিয়ে নয়, বরং একইভাবে কথাশিল্পী, চিত্রকর, নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার, সংগীত— যে কেউ হতে পারেন। যিনি জীবন ও সময়ের উপলব্ধিকে উত্তীর্ণ করতে পারেন, তিনিই ব্যাপক অর্থে কবি। এই মহানগরে জীবন ও সময়ের মগ্ন পর্যবেক্ষণের সাক্ষ্য রেখে গেলেন একজন চিত্রকর ও একজন নাট্যকার। একজন ক্যানভাসে লিখলেন কবিতা, আরেকজন জীবনসংগ্রামের এক আখ্যানকে মঞ্চকবিতায় রূপান্তর করলেন অভিনয়ে, থিয়েট্রিক্যাল কম্পোজিশনে। প্রথমজন চিত্রকর ও অধ্যাপক ড. হীরা সোবহান এবং দ্বিতীয়জন অঞ্জন দত্ত। অঞ্জন দত্তের কথা বলা হলেই আমরা তার সংগীতশিল্পী ও অভিনেতা-চলচ্চিত্রকার পরিচিতিকেই সামনে নিয়ে আসি। কিন্তু এবার নাট্যকার-অভিনেতা অঞ্জন দত্ত ঢাকায় ঘুরে গেলেন তার মঞ্চনাটক উপহার দিয়ে। এ ছাড়া চিত্রকর ফারজানা রহমান ববি মাটির মর্ম তুলে ধরলেন তার চিত্রভাষ্যে।
১২ জুলাই থেকে আঁলিয়স ফ্রঁসেজ দো ঢাকার লা গ্যালারিতে শুরু হয়েছে ‘জীবন এবং সময়ের আখ্যান-১’ শীর্ষক শিল্পী অধ্যাপক ড. হীরা সোবাহানের তৃতীয় একক মিনিয়েচার প্রদর্শনী। এই প্রদর্শনীর জন্য অধ্যাপক ড. হীরা সোবাহান নিউজপ্রিন্টের ওপর অয়েল প্যাস্টেল, কালি-কলম এবং অ্যাক্রিলিকের ব্যবহারে সময়ের আখ্যানকে তুলে ধরেছেন। চিত্রকলার অধুনান্তিক ভাষায় সময়যাপনের নানা উপলব্ধির বিমূর্ত প্রকাশ ঘটিয়েছেন এই শিল্পী। নদীর পানিতে ছিপে আটকে পড়া মাছকে দিয়ে তিনি মহাকালিক সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট স্থানচেতনায় সীমাবদ্ধ অস্তিত্বের ব্যাকুল মুহূর্তকে ফুটিয়েছেন বিমূর্ত কাব্যিক ঢঙে। মিক্সড মিডিয়ামে ফুটে ওঠা তার এই ছবির নাম ‘দ্য ফিশ’। আপন অথবা দূরের কোনো শহরের স্মৃতির আলো-আঁধারির বিমূর্তায়নে আরেকটি মিক্সড মিডিয়াম ছবি ‘মেমোরি অব সিটি-২’। এভাবেই ‘ইমেজ অব টাইম’, ‘আফটার ডেড’, ‘দ্য ফেস’, ‘হিউম্যান রাইটস’ ইত্যাদি ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী।
প্রধান অতিথি হিসেবে এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এমপি। প্রদর্শনী চলে ২৩ জুলাই পর্যন্ত। প্রদর্শনীটি সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল।
অন্যদিকে ৯ জুলাই মহানগরের মহিলা সমিতির ড. নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হলো অঞ্জন দত্ত নির্দেশিত ও অভিনীত মঞ্চনাটক ‘সেলসম্যানের সংসার’। নাটকটি মূলত মার্কিন নাট্যকার আর্থার মিলারের কাহিনি অবলম্বনে। এক সেলসম্যানের জীবনের অর্থনৈতিক উত্থান-পতনের গল্প এটি। মূল চরিত্র উইলি (অঞ্জন দত্ত অভিনীত) মধ্যবিত্ত জীবনের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়া আসতে সেলসম্যানের চাকরি বেছে নেয়। জীবনের স্বপ্ন-আশা সবটুকু সেলসম্যান পেশায় ঢেলে দিয়েছিল উইলি। কিন্তু এই পেশা যে আসলেই পরাধীনতার এবং পরের হাতে নিয়ন্ত্রিত পুতুলের পেশা, তা জানত না উইলি। যে প্রতিষ্ঠানের কাছে সে নিজের অস্তিত্ব সমর্পণ করেছিল, সেখান থেকেই তার চাকরি হারায় অফিসের এক কর্মকর্তার জন্য। চাকরি হারানোর কারণে সে তার বাড়ির মর্টগেজের শেষ কিস্তিটা দিতে পারে না। দুই সন্তান হ্যাপি আর বিফ তখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এই অবস্থায় তার বাড়িতে ঢুকে পড়ে একদল হামলাবাজ, তাদের কেউ ভেঙে ফেলে চেয়ার, কেউ ফুলদানি। বৃদ্ধ উইলি আবার সেই তছনছ হয়ে যাওয়া ঘরটিকে নতুন করে সাজিয়ে তোলার চেষ্টা করে তার ভাঙা শরীর ও মন নিয়েই।
এই নাটকে উইলি চরিত্রে অঞ্জন নিজের অশ্রু-বেদনা-হাসি-ক্রোধসহ নানা আবেগে দর্শকের সামনে হাজির করেছেন। কাঁদিয়েছেন দর্শকদের। শেষ দৃশ্যের পর করতালিতে ভরে গেছে হলঘর। দর্শকের ভালোবাসা পেয়ে অঞ্জন হয়েছেন আবেগাপ্লুত। উইলি নয়, শেষমেশ বাংলাদেশের মানুষের এই ভালোবাসা দেখে কেঁদেছেন স্বয়ং অঞ্জন দত্ত।
এদিকে, শিল্পী ফারজানা রহমান ববির একক চিত্র প্রদর্শনী ‘দ্য সোল অব দ্য সয়েল’ ৫ থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হলো শিল্পাঙ্গন গ্যালারিতে। অ্যাকোয়াটিন্ট, ডাইপয়েন্ট, মনোপ্রিন্ট, কোলোগ্রাফি ইত্যাদি বিভিন্ন মাধ্যমে করা তার এই প্রদর্শনীতে প্রায় অর্ধশতাধিক শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছিল।
স্টাফ রিপোর্টার
ছবি: সংগ্রহ