skip to Main Content

ফিচার I আধুনিক মানুষের সম্পর্কের সালতামামি

‘সবাই তো সুখী হতে চায়,
তবু কেউ সুখী হয়, কেউ হয় না।
জানি না বলে যা লোকে সত্যি কি না,
কপালে সবার নাকি সুখ সয় না…’

আধুনিক মানুষের এই সুখের খোঁজ বহু যুগের। যাযাবর মানুষ, ছিন্নমূল মানুষ দেশে দেশে, অন্যের চেহারায়, গাছে, মাঠে, প্রকৃতিতে, আকাশের দিকে তাকিয়ে সুখের কম খোঁজ করেনি। কিন্তু সুখের খোঁজ মিলল কোথায়? বরং যত দিন যাচ্ছে, সুখ যেন ততই সুদূরপরাহত। অথচ এই যাযাবর, ছিন্নমূল আধুনিক মানুষের সকল খোঁজ কিন্তু জগৎজুড়ে, বাইরে, অন্য কোনোখানে। কিন্তু প্রথম খোঁজ তো হওয়ার কথা নিজের ভেতর, সুখের খোঁজে ডুব দেবার কথা তো ‘আমি’তে। ‘ফের না মন আপন ঘরে, খুঁজিস কোথা জগৎজুড়ে’। আপন ঘরে খোঁজের সময় কোথায়? মোবাইল, ইন্টারনেট, ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রামের যুগে সবার ভেতর নিজের খোঁজ, নিজের ভেতর খোঁজের খবর নাই। তাই, সুখও দূরে দূরে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
আধুনিক মানুষের এমনই এক সুখের খোঁজ বিয়ের ভেতর। যেন বিয়ে করলেই সুখেরা ঝাঁপি খুলে বসবে। আর ওদিকে বিয়ে হয়ে গেছে জন্মদিনের মতো। নানান ভাবনা, নানা আয়োজনের পর মোমবাতি নিভলেই যেমন জন্মদিন শেষ, ঠিক তেমনি বিয়ের দিনটা পেরোলেই বিয়ের শেষের শুরু। বিয়ের পরদিন থেকেই স্বামী স্ত্রীর কাছে, আর স্ত্রীর স্বামীর কাছে সুখের খোঁজ শুরু হয়ে যায়। দিন বাড়তে থাকে, আর জমতে থাকে অভিযোগের পাহাড়। অন্যের দোষ খুঁজতে এত ব্যস্ত যে, নিজের দিকে তাকানোর সময় নেই। খুব অল্পদিনের মধ্যেই রিক্ত, শূন্য মানুষ দুজন বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, যাকে অনেক ভালোবেসে, চোখে অনেক স্বপ্ন নিয়ে বিয়ে করেছিল, তার সঙ্গে আর একত্রে থাকা সম্ভব নয়। সুতরাং পরিণতি- বিচ্ছেদ। বিচ্ছেদের পর প্রথম কদিন মনের আবহাওয়া খুব দুর্যোগময়। আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা, সূর্যের দেখা নেই, যখন-তখন বৃষ্টি, রাস্তাঘাট স্যাঁতসেঁতে। তারপর যা হয় আরকি, একদিন না একদিন সূর্যের দেখা মেলে, ‘এইভাবে আর কয় দিন’ এ কথা বলে আবারও নতুন করে সুখের খোঁজ শুরু, আবারও না-পাওয়ার বেদনায় নীল হওয়ার দুঃখগাথা।

আমাদের সমাজব্যবস্থাও এমন যে, বিয়ে না করলে যেন জীবনের পরিপূর্ণতা আসে না। বিয়ে করতেই হবে। আজকের আধুনিক শহুরে জীবনে পরিবারের বাইরেও মানুষ এত সব সম্পর্কে জড়িয়ে থাকে যে, বিয়ে নামের সম্পর্ক আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। বিয়ের কি আদৌ প্রয়োজন আছে? আধুনিক মানব-মানবীর কাছে এই সম্পর্কের অনেক সুবিধা আজ বিয়ের আগেই হাতের নাগালে। এখন বিয়ের সঙ্গে যেসব বাড়তি ঝামেলা আসে, সেগুলোও তো সামলাতে হয়। যে সমাজ বিয়ের আগে একটা মেয়েকে কন্যার চেহারায় দেখে, বিয়ের পর ঠিক সেই সমাজই মেয়েটাকে দেখতে শুরু করে স্ত্রী, বউ, জায়া এমন নানান চরিত্রে, সঙ্গে সেই সব চরিত্রের ওপর নানান চাপ। কিন্তু আজকের আধুনিক, শিক্ষিত মেয়েটি ওই সব চাপ নিতে যেমন তৈরি নয়, আবার প্রস্তুতও নয়। সবচেয়ে বড় কথা, সেই সব চাপ থেকে তৈরি যন্ত্রণা সহ্য করতেও রাজি নয়। আজকের নিজের পায়ে দাঁড়ানো, শিক্ষিত মেয়ে কারও যুক্তিহীন, পুরোনো দাসপ্রথা ব্যবস্থার কচকচানি শুনতে রাজি না, তাই হরহামেশাই শোনা যায় ভাঙনের শব্দ। আধুনিকতা যেমন মেয়েদের আগের চেয়ে অনেক বেশি স্বাধীন করেছে, পাশাপাশি তাদের ধৈর্যও আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। অনেক সময় দেখা যাচ্ছে, খুব একটা বোঝাপড়া হওয়ার আগেই অনেকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিচ্ছে এবং বিয়ের অল্প দিনের মধ্যেই দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে নতুন সম্পর্কের প্রয়োজন নিয়ে। আবার উল্টো ঘটনাও আছে। ছেলেমেয়ে দুজনই দুজনকে যথেষ্ট ভালোবাসে কিন্তু বিয়ের সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই নিতে পারছে না, মনে দ্বিধার সাগর। তবে আজকের আধুনিক সমাজব্যবস্থা কিন্তু এসব অদ্ভুত সমস্যার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। বিয়ের প্রস্তুতির জন্য ব্যবস্থা হয়েছে প্রি-ম্যারেজ কাউন্সেলিংয়ের, বিয়ের পরের মনের অসুখের জন্য ব্যবস্থা রয়েছে পোস্ট ম্যারেজ কাউন্সেলিংয়ের, কিছুতে বিয়ে ভালো না লাগলে কিংবা সম্পর্কের চাপে দম আটকে আসতে থাকলে ব্যবস্থা রয়েছে প্রি-ডিভোর্স কাউন্সেলিংয়ের। আধুনিক সমাজব্যবস্থায় এর কোনোটাকেই আজ ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। আসলে আমাদের সমাজ এবং সম্পর্কগুলো এত জটিল হয়ে গেছে যে, অনেক সময় অনেক সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়া কঠিন হয়ে যায়, তখন তো এই এক্সপার্টরাই ভরসা। কিন্তু এত সব কথার পরও আজকের এই ক্রমবর্ধমান আত্মনির্ভরশীল আধুনিক মানুষের সমাজে বিয়ে নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। সামাজিক চুক্তি হিসেবে বিয়ে কি আসলেই পুরোনো হয়ে গেছে? কিংবা দুজন শিক্ষিত, আধুনিক, মুক্তচিন্তার মানব-মানবীর একসঙ্গে থাকতে হলে কি সামাজিক চুক্তির আদৌ প্রয়োজন আছে?
আজকের শিক্ষিত, আধুনিক ছেলেমেয়েদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা যেমন বেড়েছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে তার সম্পর্কের বিস্তৃতি। নতুন নতুন নানান সম্পর্ক তাদের জীবনকে রঙিন, জটিল ও ঋদ্ধ করেছে। নতুন নতুন সম্পর্কের মধ্য দিয়ে সে জীবনকে নতুনভাবে চিনেছে, জীবনের নতুন মানে সে খুঁজে পেয়েছে। এত সব সম্পর্কে জড়িত মানুষ আজ অনেক সময় একা থাকাটাকেই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য উপায় বলে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। তার ওপর চারদিকে ভাঙনের শব্দ তাকে আরও বেশি বিশ্বাস করতে সাহায্য করেছে যে, একা থাকাই ভালো থাকা। তাতে আমি যতখানি সবার, ততখানি নিজেরও বটে। এবং এসব কারণেই বোধ হয় আজকাল শহুরে জীবনে এমন বেশ কিছু একাকী সুখী মানুষ দেখতে পাচ্ছি। সমাজ তাদেরকে নানান রকম চাপে ফেলার চেষ্টা করে বটে, তবে সে ঠিকই নানান সম্পর্কের আড়ালে সেই চাপ সামলে নেয়। এত সব কারণেই মনে হয়, আজকের এই আধুনিক, আত্মনির্ভরশীল, শিক্ষিত সমাজব্যবস্থায় সবার জন্য এক সমাধান নেই; বরং মানুষ তার নিজের মতো করেই নিজের অবস্থান ও বিশ্বাস থেকে নিজের মতো সমাধান খুঁজে নিচ্ছে। তাতে এত বছরের পুরোনো সামাজিক মূল্যবোধে আঘাত লাগছে বটে, তবে মনে রাখতে হবে যে, মূল্যবোধের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্যই মূল্যবোধ। তাই আধুনিক মানুষ তার নিজের সামাজিক রীতি, সংস্কার নিজেই ঠিক করে নেবে কিংবা নিচ্ছে।

 সৈয়দ গাউসুল আলম শাওন
ম্যানেজিং ডিরেক্টর, গ্রে ঢাকা
gousulalamshaon@gmail.com
ছবি: ড্রিম ওয়েভার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top