ফিচার I মসলার উষ্ণতায়
শীতের অসুখ-বিসুখ সারাইয়ের ভার ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে মসলার ওপর। রান্না ছাড়াও গরম চা, দুধ, মধু কিংবা পানিতে মিশিয়ে খেলে প্রতিকার মিলবে রোগবালাই থেকে
প্রাচীন গ্রিস ও রোমান সাম্রাজ্যে মৌরি ছিল এখনকার মুদ্রার মতোই। কর পরিশোধ করা হতো এ মসলা দিয়ে। তামা, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, জিঙ্ক, ম্যাঙ্গানিজ, ভিটামিন এ ও সি, আয়রন, সেলেনিয়াম ও ম্যাগনেশিয়ামের আকর মৌরি। শীতকালে এই মসলা ওষুধের মতোই কাজ করে। এর ভিটামিনগুলো গলার গুরুতর সমস্যা সারায়। ঠান্ডাজনিত অসুখ দূর করতে মৌরি বিশেষ কার্যকর। ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া রোধের ক্ষমতা আছে মসলাটিতে। খাবারে মৌরি ব্যবহার করলে শীতকালীন ফ্লু ও ভাইরাসজনিত অসুস্থতা থেকে সুরক্ষিত থাকা যায়। রান্নায় যুক্ত করা ছাড়াও শীতকালে আরও দুভাবে খাওয়া যেতে পারে মসলাটি। গরম পানিতে আধা টেবিল চামচ মৌরি ১০ মিনিট ভিজিয়ে পান করা যেতে পারে। এতে শীতের রোগ সারাইয়ের পাশাপাশি শ্বাসনালির সমস্যা কমে। গরম চায়ে ছেড়ে দিতে পারেন দুটি মৌরি। সঙ্গে কয়েক ফোঁটা মধু। শীতকালে তা টনিকের কাজ করবে। মূল্যবান আরেকটি মসলা হচ্ছে জাফরান। এর দাম সোনার চেয়েও বেশি। সাড়ে তিন হাজার বছর আগে থেকে মসলাটি খাওয়া শুরু করে মানুষ। এতে আছে ক্যালরি, প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ফাইবার, কোলেস্টেরল, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সোডিয়াম, জিংক, থায়ামিন, রিবোফ্লাভিন, নিয়েসিন, ফোলেট, ভিটামিন এ, বি ও সি। শীতকালে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় জাফরান। এ উদ্দেশ্যে চায়ে মিশিয়ে নিয়মিত খাওয়া যেতে পারে মসলাটি। ঠান্ডা-কাশি দূর করতে এক চিমটি জাফরান সামান্য গরম দুধে মিশিয়ে কপালে ম্যাসাজ করা যেতে পারে। এ পদ্ধতি বেশ কার্যকর। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকায় শীতকালে জাফরান খেলে চামড়ার বিভিন্ন সমস্যা থেকে মুক্ত থাকা যায়। পৌষ-মাঘ মাসে প্রয়োজনমতো পানি পান না করার ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। ফাইবারজাতীয় খাবার হওয়ায় জাফরান খেলে এ রোগ সারে।
হাজার বছর ধরে রান্নায় ব্যবহৃত হচ্ছে হলুদ। এর আঁতুড়ঘর দক্ষিণ এশিয়া। মসলাটিতে আছে ক্যালরি, প্রোটিন, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট, ফাইবার ও সুগার। শীতকালীন রোগ দূর কবার বিস্ময়কর ক্ষমতা আছে এতে। এ ঋতুতে হলুদমিশ্রিত দুধ নিয়মিত পান করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে। ফ্লু থেকে রেহাই পেতে পৌষ-মাঘের রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে হলুদমিশ্রিত এক গ্লাস দুধ পান করা যেতে পারে। এ মসলায় থাকা অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি প্রপার্টিজ রেসপিরেটরি ট্রাক্ট ইনফেকশন এবং সর্দি-কাশির প্রকোপ কমায়। ঠান্ডা আবহাওয়ায় অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশির ব্যথা হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে তরকারিতে বা দুধে মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে হলুদ। এতে থাকা প্রদাহবিরোধী উপাদান ব্যথা দূর করবে। শীতকালে ত্বকের সৌন্দর্য ধরে রাখতে পান করা যেতে পারে হলুদমিশ্রিত দুধ। উপকার মিলবে। স্বাস্থ্য রক্ষাকারী আরেকটি মসলা মেথি। পাঁচফোড়নের একটি উপাদান এটি। এই মসলায় আছে ফাইবার, প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ ও ম্যাগনেশিয়াম। তবে শীতকালে মসলাটির ব্যবহার বেড়ে যায় রূপচর্চায়। রাতভর মেথি ভিজিয়ে রেখে সকালে তা বেটে মাথার ত্বকে মাখলে খুশকি দূর হয়। শীতে ত্বক স্বাভাবিক উজ্জ্বলতা হারায়। প্রতিকার চাইলে মেথি বাটার সঙ্গে কাঁচা দুধ মিশিয়ে ফেসপ্যাক হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। টক দইয়ের সঙ্গে এর গুঁড়া মিশিয়েও মাখা যেতে পারে। এটি দারুণ ময়শ্চারাইজার। ব্যবহারে ত্বকের উজ্জ্বলতা ফিরে আসে। শীতকালে মরা চামড়া ওঠে। এ সমস্যার পরিত্রাণ আছে মেথিতে। এর পেস্ট তৈরি করে মধুযোগে ত্বকে মাখলে মৃতকোষ দূর হবে। মেথি খেলে শীতকালীন গলাব্যথা কমতে পারে। এর অ্যান্টিভাইরাল উপাদান এ ক্ষেত্রে কার্যকর।
ইন্দোনেশিয়া থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া মসলা জায়ফল। প্রোটিন, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট, ফাইবার, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সোডিয়াম, জিংক, ফ্যাটি অ্যাসিড, ফলেট, রিবোফ্লাভিন, নিয়েসিন, ভিটামিন এ, বি, সি ও কে-এর দারুণ উৎস এটি। জায়ফলের অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান ইমিউন সিস্টেম উন্নত করে। শীতকালে ঠান্ডাজনিত রোগব্যাধি থেকে সুরক্ষিত থাকতে চাইলে গরম দুধে এ ফলের গুঁড়া, কয়েক ফোঁটা মধু ও থেঁতলানো এলাচি একসঙ্গে মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে। জায়ফলে ঘি মিশিয়ে শিশুদের খাওয়ালে সর্দি সেরে যেতে পারে। হলুদের মতোই এর তেল শীতকালে অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশির ব্যথা কমায়। জায়ফল খেতে হবে খুবই অল্প। এক চিমটি। অন্যথায় হিতে বিপরীত হতে পারে। রূপচর্চায়ও কাজে আসে মসলাটি। শুষ্ক ত্বকে শীতকালে কালো ছোপ ছোপ দাগ পড়ার আশঙ্কা থাকে। দূর করতে চাইলে জায়ফলের বীজ বেটে তার সঙ্গে কাঁচা দুধ ও বেসন মিশিয়ে মাখা যেতে পারে। জায়ফলের মতোই পুষ্টিগুণে ভরপুর আরেকটি মসলা গোলমরিচ। উৎপত্তি দক্ষিণ ভারতে। এতে আছে প্রোটিন, ফ্যাট, শর্করা, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, জিংক, ক্রোমিয়াম, ফসফরাস, আয়রন, ভিটামিন এ, বি ও সি। এসব উপাদান শীতের রোগব্যাধি সারায়। ঠান্ডা লাগলে এক বাটি গরম স্যুপে গোলমরিচের গুঁড়া মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে। উপশম হবে। এর অ্যান্টিইনফ্ল্যামেটরি উপাদান অ্যাজমা প্রতিরোধ করে। হলুদ ও জায়ফলের মতো গোলমরিচও অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশিতে ঠান্ডাজনিত ব্যথা কমায়। কাজটি করে এ মসলায় থাকা পাইপিরিন নামের উপাদান। গোলমরিচ গরম করে কাপড়ে মুড়ে ব্যথার স্থানে কিছুক্ষণ চেপে রাখলে যন্ত্রণা কমে। চায়ের সঙ্গে এই মসলা মিশিয়ে খেলে কাশি দূর হয়। গলা ব্যথাও সারে। গোলমরিচে থাকা অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কফ বের করে দেয়। ঠান্ডার কারণে নাক বন্ধ হলে গরম চায়ে গোলমরিচ দিয়ে ধোঁয়া সেবন করা যেতে পারে। এ ছাড়া এর গুঁড়া পানিতে মিশিয়ে স্ক্রাবার হিসেবে ব্যবহার করলে মরা চামড়া দূর হয়।
ষোলো ও সতেরো শতকে যে মসলাকে কেন্দ্র করে পর্তুগিজ, ওলন্দাজ ও ফরাসিদের মধ্যে তুমুল গোল বাধে, তা হচ্ছে লবঙ্গ। উৎপত্তি ইন্দোনেশিয়ায়। লবঙ্গগাছের ফুলের কুঁড়ি শুকিয়ে তৈরি হয় মসলাটি। এতে আছে ক্যালরি, কার্বোহাইড্রেট, ফাইবার, ম্যাঙ্গানিজ, ভিটামিস সি ও কে। শীতকালে খুশখুশে কাশি দূর করতে এর জুড়ি নেই। ঠান্ডায় জ্বর হলে ফুটন্ত গরম পানিতে লবঙ্গ দিয়ে পান করলে সেরে যায়। এতে ইউজেনল থাকে, যা শ্লেষ্মাজনিত অসুখ সারায়। লবঙ্গের তেল গরম পানিতে মিশিয়ে পান করলে সর্দি-কাশি উপশম হয়। মসলাটির সঙ্গে পানি যোগ করে নিয়মিত পান করলে সাইনাসের সংক্রমণ দূর হয়। ঠান্ডাজনিত বালাই সারাতে পারে এলাচিও। সুগন্ধি যুক্ত এ মসলায় আছে ফাইবার, কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, নিয়েসিন, রিবোফ্লাভিন, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, পাইরিডক্সিন, থিয়ামিন, কপার, সোডিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, আয়রন, ফসফরাস, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ভিটামিন এ ও সি। খাবারে এলাচি রাখলে শীতকালীন ঠান্ডা ও কফজনিত সমস্যা দূর হয়। অ্যান্টিসেপটিক হওয়ায় এর বীজে থাকা তেল গলাব্যথার পথ্য হিসেবে কাজ করে। এ উদ্দেশ্যে চায়ে এলাচি যোগ করে পান করা যেতে পারে। প্রদাহবিরোধী উপাদান থাকায় মসলাটি অ্যাজমা প্রতিরোধী। এ ছাড়া প্রতিদিন আধঘণ্টা এলাচি চিবালে ঠান্ডাজনিত রোগ থেকে সুরক্ষিত থাকা যায়।
ঔষধি গুণে ভরপুর আরেকটি মসলা দারুচিনি। এতে আছে ক্যালরি, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস, পটাশিয়াম এবং ভিটামিন এ ও সি। এসব উপাদান শীতকালীন বালাই সারাতে পারে। দারুচিনির সঙ্গে মধু ও লেবুযোগে সিরাপ বানিয়ে পান করলে সর্দি-কাশি উপশম হয়। শীতকালে তাপমাত্রা ওঠানামার জন্য গলায় ব্যথা হতে পারে। রেহাই পেতে চাইলে দুধের সঙ্গে দারুচিনি মিশিয়ে পান করা যেতে পারে। এটি জ্বরের প্রকোপও কমায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। গরম পানিতে এক চিমটি দারুচিনি গুঁড়া এবং এক চামচ মধু মিশিয়ে পান করলে শীতকালের প্রায় সব ধরনের রোগ প্রতিরোধ হয়।
শিবলী আহমেদ
ছবি: লেখক