ফিচার I মিডোরি বাই লেকশোর
বিশেষ সব স্বাদ উপভোগ করতে করতে সেখানে পাখির ওড়াউড়ি দেখা যায়। ফলে, ভোজনরসিকদের লোভনীয় ঠিকানা এটি। বহুদিন ধরে
দেশের সেবাশিল্পে লেকশোর-এর কদর বহুদিন ধরে। তবে এই হোটেল একটু ভিন্ন; কারণ, এর নকশা থেকে শুরু করে সবকিছুই নতুন প্রজন্মের হাত ধরে। পশে গ্রুপের ম্যানেজিং ডিরেক্টর স্থপতি কাজী মাহজুকা ম্যাসুনের পরিকল্পনাতেই নতুন প্রজন্মের এই হোটেল; যা ঢাকার কলোনিয়াল লেগাসির ভাইব দেয়, আবার সার্ভিসের ব্যাপারে স্টেট অব দ্য আর্ট।
গুলশান ২ নম্বর গোলচত্বর থেকে হাঁটা দূরত্বে তিলোত্তমা নগরীর নবীন আবাসিক হোটেল মিডোরি বাই লেকশোর অবস্থান। জাপানি ভাষায় মিডোরি অর্থ গাঢ় সবুজ। ঢাকা শহরে সবুজ কোথায়? সে তো হারাতে বসেছে কংক্রিটের আগ্রাসনে!
মিডোরির ঠিক পাশেই গুলশান হেলথ ক্লাব। তাই জেনট্রিফিকেশনের এই সময়েও প্রতিবেশী হিসেবে সবুজের ছড়াছড়ি, হারিয়ে যেতে বসা জলাশয়। পাশের স্কুলের মৃদু-মন্দ কোলাহল হয়তো খানিকটা স্মৃতিজাগানিয়াও হতে পারে।
৮৬ নম্বর সড়কের ১৬ নম্বর লাল ইটের বাড়িতে ঢুকতে হলে প্রথমেই কড়া প্রহরা পেরোতে হয়। বেশ খানিকটা খোলা জায়গার পর লবি। সবুজের সমারোহ সর্বত্র। লবিতে ঢোকার মুখেই দরজার কাঠের জালির কারুকাজ চোখে লাগে। আর ছোট্ট লবিতে প্রাকৃতিক আলো আর টাংস্টেন লাইটের নরম হলুদ আলো। দেয়ালে দেয়ালে ঝুলছে কোম্পানি পেইন্টারদের আঁকা—মোগল ঢাকার ধ্বংসস্তূপ।
দোতলায় মিডোরির অফিস। সেখান থেকে বিভিন্ন তলায় বিভিন্ন আকার-প্রকারের রুম দেখা হলো। ডিলাক্স আর স্যুইট মিলে মোট সাতটি ক্যাটাগরির রুম রয়েছে এখানে। রুমগুলোর মূল বৈশিষ্ট্য হলো এর ইন্টেরিয়র। কাঠের ফ্লোর, সাবেকি ঘরানার ফার্নিচার সব ঘরে। প্রতিটি রুমেই রয়েছে টেবিল ল্যাম্পসহ ওয়ার্ক ডেস্ক। আর গুগল হোম ও নেটফ্লিক্সের সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি রুম। সাবেকি আমলের সূক্ষ্ম সুরুচির সঙ্গে যোগ হয়েছে সমকালীনতা। বেশ কিছু রুম থেকে দেখা যায় সবুজ প্রকৃতি। সেখানে বারান্দায় বসে বা রুমের ভেতরেই কোজি চেয়ারে বসে প্রকৃতি দেখতে দেখতে চা বা কফি খাওয়াটাও হতে পারে দারুণ এক অভিজ্ঞতা। রুমের ভেতরেই রয়েছে ক্যাবিনেট, মিনি ফ্রিজ। আর বাথরুম একেবারে ঝকঝকে। অনেক অনেক সুবিধার ভেতরে আরেকটি যেটা না উল্লেখ করলেই নয়—জিম। ছোট্ট একটা জিম রয়েছে গেস্টদের সুবিধার্থে।
রুম দেখার পর শরণ নেওয়া হলো সবচেয়ে উপরের তলার—সাভানা’র। তখন ঘড়ির কাঁটা প্রায় ২টা ছুঁইছুঁই। এক কোনার টেবিলে বসে সদ্য ব্রিউ করা কফি বিনের ঘ্রাণে আমেরিকানোর স্বাদ নিতে নিতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখা গেল এক জোড়া শঙ্খচিল মাছ ধরায় ব্যস্ত। জানা গেল প্রায়ই হেলথ ক্লাবের গাছগুলোতে আশ্রয় নেয় ঢাকার বাস্তুচ্যুত বানরগুলোও। সারা বছরই ছোট ছোট পাখির কলতানে মুখর থাকে পার্ক এলাকা। সেটা উপভোগ করার শ্রেষ্ঠ জায়গা এই হোটেল। এই রেস্টুরেন্টের সুনাম রয়েছে দুটো কারণে। প্রথমত প্রাতরাশ, দ্বিতীয়ত জাপানিজ খাবার। সকালের বুফে নাশতায় পরিবেশন করা হয় ৬০ থেকে ৭০ পদের খাবার। বেলা দুইটায় তো আর সেটা করার জো নেই। তাই জাপানিজ খাবার চেখে দেখা হলো। কিচেনে ঢুকে দেখলাম কীভাবে তৈরি হয় টুনা স্যালাড আর জাপানি ঘরানার শ্রিম্প ট্যাকো। এটা দেখার সময় অবশ্য তাদের নিজস্ব বেকারের তৈরি চিজ স্টিক সঙ্গী হয়েছিল আরও এক কাপ আমেরিকানোর সঙ্গে। কিচেনটা বেশ বড়, আর বেশ সাজানো। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো এর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা।
লেটুস পাতার বিছানায় শুয়ে থাকা গোলাপি-রঙা টুনা আর সফেদ অ্যাভোক্যাডোর সঙ্গী লালরঙা চেরি টমেটোর টুকরো। তাতে আবার ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে জাপানি ঘরানার ড্রেসিং। আর দাঁতের নিচে আসছে তিলের স্বাদ। অসাধারণ স্বাদের এই স্যালাডের সিক্রেট অবশ্য এর উপাদানেই। কাঁচামাল ছাড়া সব উপাদানই সংগ্রহ করা হয় জাপান থেকে। তবে শ্রিম্প ট্যাকো ছিল একটু অন্য রকমের। আমরা যারা মেক্সিকান ধরনের ট্যাকো খেয়ে অভ্যস্ত, তাদের জন্য বড় এক ধাক্কাই বলা যায়। ক্র্যাব স্টিক, জাপানিজ ড্রেসিং, হ্যালাপিনো একসঙ্গে মিশিয়ে শ্রিম্প টেম্পুরা আর অ্যাভোক্যাডো দিয়ে নোরি শিটে রেখে পরিবেশন করা হয়। এখানে নোরি শিটই সফট শেল বা ক্রিস্প শেল টর্টিলার বিকল্প। এই নোরি শিট সামুদ্রিক শেওলা দিয়ে তৈরি করা হয়। এ ছাড়া রেস্টুরেন্টে মেলে কন্টিনেন্টাল, ওরিয়েন্টাল—নানা পদের খাবার।
রেস্টুরেন্টের ইন্টেরিয়রেও রয়েছে সেই কলোনিয়াল ভাইব। চেয়ার-টেবিল, ল্যাম্পশেড—সবকিছুতেই সেই ছাপ। আধুনিক অংশ বলতে এখানকার কফি কাউন্টার। প্রায় ৬০ জনের বসার ব্যবস্থা এখানে। আর পেছনের কনফারেন্স রুমে আরও ২৫ জনের আয়োজন রয়েছে। কনফারেন্স রুমের পরেই যে বারান্দার মতো অংশ, সেখানে কৃত্রিম ঘাস দিয়ে সাজানো। বসার ব্যবস্থা রয়েছে কেবল একটি ছোট্ট রাউন্ড টেবিল দিয়ে। এটাই নাকি রেস্টুরেন্টের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও জনপ্রিয় জায়গা।
হোটেলের সুনাম ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে অন্তর্জালেও। গত আগস্ট মাস থেকে আসতে থাকা রিভিউয়ে ট্রিপ অ্যাডভাইজার আর অ্যাগোডায় পুরো নম্বরই পেয়ে বসে আছে এই হোটেল। রিভিউগুলোতে হোটেলের সেবার মান, স্টাফদের ব্যবহার, নিরাপত্তা, রুমের অবস্থা, হাইজিন আর খাবারের প্রশংসা করেছেন সবাই।
করবে নাই-বা কেন! মোট ৫২টি সিসি ক্যামেরা দিয়ে হোটেলে সবার গতিবিধি লক্ষ করা হয়। আর গাড়ি ও ব্যক্তির তল্লাশিও নেওয়া হয় ইউরোপীয় তরিকায়। ঢাকার বিজনেস জোনে এমন আবাস, যেখানে পছন্দসই খাবার খেতে বসে শঙ্খচিলের মাছ ধরা দেখা যায়, রুমের ভেতরে পাওয়া যায় কলোনিয়াল ঢাকার ভাইব, এমন হোটেল—আর ক’টা আছে?
আল মারুফ রাসেল
ছবি: মিডোরি